নীলাঞ্জন হাজরার কবিতা
১।
গ্রামছাড়া খয়েরি মোরাম-পথ-চোখ
পরিত্যক্ত এ শহরে কী খোঁজো?
কী খোঁজো হৃদয়ের এই ধ্বংস্তূপে
দেওয়াল-লিখন সব ভাঙা
কাবাড়িওয়ালার দল বেছেবুছে
তুলে নিয়ে চলেগেছে ভাঙাচোরা কাহিনীগুলোও
কেন নাম ডাকো বিস্মৃত লুপ্ত ভাষায়?
ফিরে যাও, এখানে রাত্রি বড়ো একা
বিপদ আর ভীতিরাও ছেড়ে চলে গেছে কবে
ভেঙে যাওয়া লেটারবক্সে আর
কান্নার
রেশটুকু নেই
খয়েরি মোরাম-পথ-চোখ
কেন জল আনো এই
না-থাকা-থাকার কিনারে?
—
২।
এই কলকলে হৃদয়ের
চকিত আড়ালে
গোপন ডেরায় ডেরায়
অশ্লীল তল্লাসি চালিয়েও
ওরা কোত্থাও খুঁজেই পেল না তোমায়
রাষ্ট্রীয় গণপিটুনির বমি আর রক্তের দিনকালে
রাত্রির কুকুর আর স্বপ্নের সাথে রাত জেগে
আমাদের বেআইনি ভালোবাসার নিবিড় বস্তির
ধমনীর গলি তস্য গলি ধরে
ছড়িয়ে দিয়েছি তোমায়
তোমার খয়েরি-মোরাম-পথ চোখের ইশারায়
রাঢ়ী অরণ্য-গন্ধের ভীষণ বিস্ফোরক
বারুদ লাব-ডাব চালু হয়ে গেছে
সন্ত্রস্ত অপেক্ষা এবার
রাষ্ট্রীয় দিনরাতের
বিপদসংকুল প্রহরে প্রহরে
তোমার বর্ণে বর্ণে ক্ষরিত
বেআইনি আগুনরঙা স্বপ্নগুলো
চেতনার শিবির থেকে শিবিরে শিবিরে
সংক্রমিত হয়ে চলেছে
কল্পনার অলীক গতিতে
অলীক গতিতে
ছড়িয়ে পড়ছো
সমস্ত বেঁচেথাকাময়
তুমি
আমার
নিষিদ্ধ ইস্তেহার
—
৩।
তুমি কখনও
রেসের মাঠে বাতিল হয়ে যাওয়া ঘোড়াদের
মিছিল দেখেছ?
তুমি কখনও আমার
হৃদয়ের
ময়দানে পিকনিক করতে আসনি
এই ময়দান পার করেই
সার বেঁধে
রেসের মাঠের বাতিল হয়ে যাওয়া ঘোড়াদের
বধ্যভূমিতে
নিয়ে যাওয়া হয় দিনের যে কোনও সময়ে
আমি প্রায়শই দেখি
এবং অবাক হয়ে যাই
তাদের নিরুত্তাপ পায়ের নালের শব্দ শুনে
কালো অ্যাসফল্টের ওপর — টগবগ টগবগ টগবগ
পিকনিকের শেষে
সক্কলে, শেষ ট্রাম, এমনকি শেষ নেড়িটাও,
চলে যাওয়ার পরে
তারাদের
ফিকে নীল অজস্র কাহিনীর নীচে
রেসের মাঠে বাতিল হয়ে যাওয়া ঘোড়ারা
একে একে এসে যায়
ময়দানে
নিশ্চিত নিরুত্তাপ নিঃশব্দ নালহীন পায়ে
দাঁতে দাঁতে ছিঁড়ে নেয় সবুজ
সবুজ ঘাস
যাদের তুমি কখনও দেখনি
তুমি কখনও আমার
হৃদয়ের
ময়দানে আসনি কোনও রাত্রিকালীন
অভিসারে
—
৪।
অরণ্য পরিবৃত
মফস্সল প্রাচীন শহরের
সেই মেয়েটির
কোনও সুযোগই হয়নি
বিদায়ের চুমু
দেওয়ার আমাকে
আমরা
যে-সকলের কাছ থেকে বিদায় নিই
বা যাদের বিদায় জানাই
(কখনও কখনও চিরবিদায়ও)
তাদের সকলকেই আমরা
বিদায়ের চুমু
দিই না
কিছু মানুষকে আমরা বিদায় করে দিতে চাই
তাদের আমরা কক্খনও
বিদায়ের চুমু
দিই না
কিছু মানুষ যে কখন বিদায় নিয়ে যায় আমরা টেরও পাই না
তাদেরও আমরা
বিদায়ের চুমু
দিতে পারি না
আমরা কেবল সেই সব
মানুষকেই দিয়ে থাকি
বিদায়ের চুমু
আসলে যাদের আমরা কিছুতেই
বিদায় দিতে পারি না
আমার হৃদয়ের
অরণ্য পরিবৃত
মফস্সল প্রাচীন শহরের
খর দাবদাহের আগুন দিগন্তে
থরথর করে কাঁপছে একটা
বিদায়ের চুমু
যা সেই মেয়েটির
আমাকে দেওয়ার সুযোগই হয়নি কোনও দিন
—
৫।
অনেক পুরনো কথা
ছবির মতো
মিথ্যে স্মৃতি বয়ে আনে
বয়ে আনে পশ্চিম রাঢ়ের
সাঁওতাল গ্রাম-ছাড়া
কাঁচা রাঙামাটি রাস্তার মতো
দুটো চোখ
মিথ্যেই মনে পড়ে
মনে পড়ে
এ পথে আমি যে
গেছি বার বার
দাবদাহ শৈশবে
যৌবনের আগুন রেখায়
হৃদয়ে এঁকেছি যেন
মানচিত্র তার
অনৃত স্মরণে
সেই রাঙা পথ-চোখে আমি ফিরে
যেতে পারি
থাক
অবলুপ্ত ভাষার আখরে
বিপদসঙ্কুল অরণ্য-সবুজ
সেই সব ভুল মনে পড়া
করলা মাচায়
ঝুলে থাকা মিঠে-রোদ-রঙা
মেয়েটির পোশাক
আগুন আর অপমানের দিনে
চিনেছি
মসৃণ অ্যাসফল্ট পথ
রাষ্ট্র ও সফলেরা
গলা-পিচে দামি টায়ারের দাগ রেখে
দেওয়ালের বিপজ্জনক সব
আঁকিবুঁকি
মুছে দিয়ে গেছে
টুরিস্ট ব্রশারে
মেকি মনখারাপের
সুযোগ সাজানো আছে
উইক-এন্ড ট্রিপ
সব বুক হয়ে গেছে
আগামী
সতেরো জীবন
—
৬।
যে মেয়েটি অকারণ সন্ধ্যায়
আমার কবিতা পড়ে কেঁদেছিল
সে আমার সাথে মিছিলে হাঁটেনি
৩৩ নম্বর আপ কল্যাণী লোকালের প্যাচপেচে ভিড়ে
সুগন্ধী জাদুবাস্তবে কাছাকাছি, মগ্ন ঘন্টা দেড়েক পথ
এক সাথে বাড়িও ফিরিনি কোনওদিন
তার ভালোবাসার উদ্ভ্রান্ত পথে পথে
কোনও সন্ধ্যা নামেনি আমার
কোনও তারা ডোবেনি ওঠেনি তার ইশারায়
যে মেয়েটি আমার কবিতা পড়ে কেঁদেছিল
তবু তার নাম ধরে ডাক দিলে, পাঁজরের আনাচ কানাচ থেকে
বার বার তুমি সাড়া দাও
—
৭।
আমার
নিষিদ্ধ ভালোবাসা
আমি তোমায় একটা তারা দিলাম
তুমি সে তারা নিয়ে যা খুশি করতে পারো
যেমন, তুমি সে তারা দিতে পারো
একটা পতাকাকে
তোমার চুমুর রঙের পতাকাকে
যার নিচে জড়ো হতে পারে
দুনিয়ার সব নিষিদ্ধ ভালোবাসা
নিষিদ্ধ জমায়েতে
তুমি সে তারা
দিতে পারো একটি ফুটপাথের শিশুকে
তোমার হাসির রঙের শিশুকে
যে পা ছড়িয়ে নিজের আনন্দেই খেলে চলেছে
ভাঙা বাটি নিয়ে পথের ধুলোয়
যাকে শিশুসাথী এনজিওর দেওয়া খেলনাটা
তার এখনকার বাপ বেচে দিয়েছে
কাবাড়িওয়ালার কাছে
কিংবা
তুমি সে তারা ক্ষরণ করেও দিতে পারো
আমার সমস্ত পারজিত রাতের আকাশে
তোমার চলে যাওয়ার রঙের আকাশে
যাতে আমি সুনিশ্চিত পথ চিনে পৌঁছে যেতে পারি
নিষিদ্ধ এ জীবন পাড়ি দিয়ে
শেষ বন্দরে
—
৮।
কী আশ্চর্য!
তোমার চোখে চোখ রেখে
আমি কোনও দিন তার আয়ত আয়নায়
নিজেকে প্রতিফলিত হতে দেখি না
আমি প্রতিফলিত হতে দেখি
একটা ভীষণ সহমর্মী মানুষকে
যে আমাকে আশৈশব
সমস্ত বিপদের বিষয়ে সাবধান করেও
রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছে
যে আমাকে শিখিয়েছে
ভাগাভাগি করে খাওয়া
যে আমাকে কান্নায় ভেঙে পড়ার
মর্ম বুঝিয়েছে
আমি প্রতিফলিত দেখি সেই ভীষণ
সহমর্মী মানুষটাকে
যে আমার সামনে
তোমার চোখে চোখ রাখা ছাড়া
আর কোনও উপায়ই রাখেনি
তুমি আমার চোখ থেকে
চোখ সরিও না
সেই ভীষণ সহমর্মী মানুষটার মুখ
পাগলের মতো যে মুখ আমি
আশৈশব
সর্বত্র খুঁজে বেড়িয়েছি
মরুভূমি থেকে হৃদয়ে হৃদয়ে
সেই মুখ
আমি আর হারাতে চাইনা
—
৯।
যদি আমি তোমাকে দেখে ফেলে থাকি
আনখশির রাত্রির পোশাকে মির্জ়ার কবিতায় নতজানু
গোলাপ বা অশ্রুহীন
একা
সৌধবিহীন স্মৃতির কবরে
তর্জনী ডুবিয়ে ধুলোর আস্তরণে
ছুঁয়ে যেতে, ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে
বিলুপ্ত ভাষার অক্ষরে
ক্ষরিত ভালোবাসার ক্ষতের এপিটাফ
মার্জনা করো
২৯ জীবন আগে যে হাসি ছড়িয়ে গিয়েছিলে
আমার তন্দ্রায়
তার কোনওখানে ছিল না গাঁথা
অতন্দ্র ফলক তোমার কবিতার —
‘এ হৃদয়ে প্রবেশ নিষেধ’
—
১০।
তোমরা কখনও
নিষিদ্ধ
ভালোবাসার উপত্যকায় গিয়েছো?
পড়েছো কি কোনও দিন
সীমান্ত অস্বীকার করে গড়িয়ে আসা
রক্তের
আর্তনাদে ডুবে যাওয়া
ভালোবাসার লুপ্ত স্বরলিপি?
বুঝেছো কি সীমান্তবন্দী প্রিয়তমার
অন্ধকার হৃদয়-ভরা তারার সংকেত?
করতলরেখায়
রেখায় মাথা কুটে
কখনও কি
বদলে দিতে চেয়েছ ইতিহাস?
যদি করে থাকো এ সব কিছুই
এবং আরও সব কিছু, নিষেধের কাঁটাতার
গভীর হৃদয়ক্ষতর তাপে ছিঁড়ে
এসো, এখানে আমাদের গোপন জমায়েত
দ্রোহকালের প্রস্তুতি এইখানে, এখানে
কবিতা
—
অনাথ দূরত্বের শিলালেখমালা
বিষাণ বসু
“তোমার দুই চোখের মাঝখানে রাজকন্যার প্রাণভোমরা পোঁতা আছে
হ্যারি পটার রাজকন্যাকে ভালোবাসে কিন্তু তোমায় চেনে না
রাজকন্যা আমার কবিতা প’ড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে
হ্যারি পটার টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলছে প্রত্যেকটা কবিতার মুখোশ
তুমি কবিতা থেকে কবিতায় পালাতে পালাতে হাঁফিয়ে উঠছো
আমি কিছুতেই তোমায় ধরতে পারছি না জোড়া জোড়া চোখের জঙ্গলে
আমি মরে গেলেই তুমি ভ্যানিশ করে যাবে বলে হ্যারি পটার আমায় খুন করতে পারছে না
রাজকন্যা ভীষণ বিপদ মাথায় নিয়ে ঘুমোচ্ছে
আমার দিন ফুরিয়ে আসছে
তুমি পালাচ্ছো
হ্যারি পটার দিশেহারা ছোটাছুটি করছে”
নীলাঞ্জন হাজরার সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচিতি সেই কৈশোর থেকেই। বস্তুত, পঠন বিষয়ে তিনি আমার গুরুসম। এই ব্যক্তিগত সম্পর্ক এতখানিই গভীর, যে, তাঁর কবিতা নিয়ে তৃতীয় পক্ষের কাছে কোনও মত, এযাবৎ, ব্যক্ত করিনি। কেননা, নীলাঞ্জন হাজরার সঙ্গে আমার পুরনো চেনাশোনা-অন্তরঙ্গতা তাঁর কবিতা বিষয়ে আমার মতামতে ছায়া ফেলুক, এমনটা কাঙ্ক্ষিত নয়।
কিন্তু, ইদানীং মনে হচ্ছে, অগ্রজসমের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসার ব্যক্তিগত বোধ যদি কবি নীলাঞ্জন হাজরার বই পড়ে আমার অনুভবের প্রকাশের পথ আটকায়, সেও এক অন্যায়।
কাজেই, নীলাঞ্জন হাজরার কবিতা নিয়ে কিছু কথা।
১.
“স্বপ্নটা দেখেই তুমি
বেঁধে ফেললে সেটা অ্যালার্ম দেওয়া ঘড়ির কাঁটায়
সুযোগ সুবিধা মতো
তুমি
ধোঁয়া, মাটি, চোখের জল কিংবা ‘’আহা বেচারা’
হয়ে যাওয়ার বহু বহু বছর পর
আজও কেউ ঠাহরই করে উঠতে পারলো না
ঠিক কখন সহসা বেজে উঠবে
স্বপ্নের অ্যালার্ম”
জানি, বড়রা বলে গিয়েছেন, কবিকে তাঁর জীবনের মধ্যে খোঁজা উচিত নয়। কিন্তু, ও-কথা বড়দের জন্যে। আমরা, তুচ্ছ মনুষ্যেরা, কবির জীবন নিয়ে জানতে উদগ্রীব থাকি। আর, জীবন থেকে, জীবনের অভিজ্ঞতা অনুভব থেকেই তো কবিতা আসে। কাজেই, কবির জীবন বিষয়ে দু’চারকথা জানা থাকলে কবিতার প্রেক্ষিৎটি বুঝতে সুবিধে হয়। কোনটি আদত জীবনসঞ্জাত, আর কোনটি “নকল সে সৌখিন মজদুরি” এইটুকু জানাও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নীলাঞ্জন হাজরার কবিতা নিয়ে লিখতে বসার মুখ্য উদ্দেশ্য এইটাই, যে, অন্তত আমার ধারণা, তাঁর কবিতার প্রেক্ষিৎটি আমি ধরিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারব। কবিতার বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা বা ওইধরনের কিছু যে আমার পক্ষে সম্ভব নয়, সেটুকু কাণ্ডজ্ঞান আমার আছে।
খুব বিশদে না গিয়ে বলি, তাঁর ছেলেবেলা-কৈশোর-ইস্কুলজীবন কাটে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে, দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশনে, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। কলেজজীবন প্রেসিডেন্সি কলেজে।
কোনও ‘গুরুজন’-কেই প্রশ্নহীন আনুগত্যে স্বীকার করা তাঁর ধাতে নেই। একেবারে বাল্যকালে, স্কুলজীবনেই, জেরোম কে জেরোমের সুবিখ্যাত কাহিনীর ততোধিক বিখ্যাত আঙ্কল পজার-এর সঠিক উচ্চারণ শিক্ষককথিত পোডগার না হয়ে পজার হবে, এই নিয়ে তিনি ক্লাসের মধ্যেই যে তর্কে জড়ান, তার জল গড়ায় বহুদূর। আবার, আর একদিকে, বাবা-মা দুজনেই পেশাগতভাবে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও নীলাঞ্জনদা এমএ পড়তে পড়তে ছেড়ে দেন, স্রেফ এমএ পড়ে ডিগ্রি (যে ডিগ্রির প্রয়োজন তাঁর কাছে কখনওই ছিল না, এখনও নেই) বাদ দিয়ে আর কী পাওয়ার আছে, এই প্রশ্ন তুলে।
তারপর, উর্দু কবিতার প্রেমে পড়ে বিষ্ণুপুরের এক পিরের দরগার মৌলভির কাছে উর্দু শেখা। উপার্জনের আশাহীন উর্দু শিক্ষার ফসল হিসেবে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতাকে বাংলায় আনা। পরবর্তীতে, পাকিস্তানের সমকালীন কিছু মহিলা কবির কবিতার সঙ্গে বাঙালির প্রথম পরিচয় ঘটান নীলাঞ্জনই। বস্তুত, এই সময়ের পাকিস্তানের কবিতাকে বাংলা ভাষায় পড়তে হলে নীলাঞ্জন হাজরার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই।
এমন করেই, মূল ভাষায় কবিতার রসাস্বাদনের জন্যে ফরাসি, স্প্যানিশ শেখা। কিছুটা ফার্সিও। ভাষাগুলো বেশ কিছুটা জানা থাকলেও, না, নীলাঞ্জন এইসব ভাষায় নিজেকে দক্ষ বলে দাবি করেন না কখনও।
এরপর সাংবাদিক জীবন। মাঝে সাংবাদিকতা ছেড়ে প্রায় দেড় দশক দূতাবাসে উচ্চপদে চাকরি। আবার সেই জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সাংবাদিকতায় ফেরা। পুরো সময়টাতেই চলেছে উর্দু কবিতা থেকে বাংলা অনুবাদের কাজ। মুখ্যত, পাকিস্তানের সমকালীন কবিতা। এর মধ্যে একটি ‘কেড়ে নেওয়া ইতিহাস’ বাংলা অনুবাদ কবিতায় ল্যান্ডমার্ক বললেও অত্যুক্তি হয় না। সেটি লীলা রায় পুরস্কারে ভূষিতও। এছাড়া মিশরের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নাগিব মেহফুজ-এর ছোটোগল্পকে বাংলায় আনার কাজটিও আশ্চর্য দক্ষতায় করেছেন নীলাঞ্জন। পাশাপাশি লিখেছেন চমৎকার কিছু ভ্রমণের গল্পও, ইতিহাস আর সমাজের বাস্তবতা মিলিয়ে যেগুলো প্রচলিত ভ্রমণকাহিনী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের।
২.
“কবিতাকে
কেমন দ্যাখো তুমি?
গাল ভরা নাম থেকে ঝুলে পড়া
কিশোরের লাশের মতো
শেষ নিমেষে যার দুটো পা
মাটি ছুঁতেই চেয়েছিল মাত্র?
তুমি কি কবিতাকে দ্যাখো
সেই সব গাছের মতো
যাদের গুঁড়িতে গাঁথা আছে ফলক
‘’একটি গাছ একটি প্রাণ’
আর পোড়ানোর জন্যেই যাদের লাগানো হয়?
কিংবা বিরক্তিভরে
ফুটপাথ বোঝাই নোংরা বাচ্চাগুলোর মতো?
যাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়
তুমি শক্ত হাতে চেপে ধরো সন্তানের হাত
সেই হাত, প্রিয় বন্ধু, যা থেকে হয়তো একদিন
বড়ো হবে তেমনই কবিতা
ভীষণ রক্তপাতের দিনে যার
এতটুকু হাত কাঁপবে না”
কথায় বলে, যে বাঙালি কৈশোর পার করে কবিতা লেখেনি, সে বাঙালিই নয়। কিন্তু, নীলাঞ্জন কৈশোর কেন, অন্তত পঁয়ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত একটিও কবিতা লেখেননি। তিনি মুখ্যত পাঠক, গোগ্রাসী এবং অসম্ভব মেধাবী পাঠক। বিশ্বসাহিত্যের আনাচকানাচ পর্যন্ত এমন পাঠের বিস্তার, অন্তত আমি, খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। গভীর পাঠ, তীক্ষ্ণ মেধা, তদ্সঞ্জাত জীবনভাবনা – আর সেইখান থেকে উঠে আসা মিতবাক্ কবিতা – বাংলা কবিতাজগতে মননশীলতার যে ধারাটি বিষ্ণু দে-সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরে শুকিয়ে এসেছে – নীলাঞ্জন হাজরার অবস্থান সেইখানেই।
বাংলা কবিতার তুলনায়, বিশ্বের অন্যান্য নানা ভাষায় কবিতাপাঠের ঈর্ষণীয় অভিজ্ঞতা নীলাঞ্জনের। তাঁর কবিতাকে বুঝতে হলেও এই নিবিড় পাঠাভ্যাসের বিষয়টি মাথায় রাখলে ভালো হয়। আর, তার সঙ্গেই জীবনের বিভিন্ন সময়ে বাম রাজনীতি ও অ্যাক্টিভিজম, গভীর ইতিহাসবোধ – সব মিলিয়েই নীলাঞ্জন হাজরার কাব্যজগৎ।
আবারও বলি, এই লেখা নীলাঞ্জনের কবিতার কোনও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নয়। এর উদ্দেশ্য, ওঁর কবিতার প্রেক্ষিৎটি সবাইকে জানানো। যে প্রেক্ষিৎ না জেনেও কবিতা হয়তো পড়াই যায়, কিন্তু জানলে, কবিতার পাঠটি আরও আকর্ষণীয় হতে পারে।
৩.
কবিতায় রচনাকালের উল্লেখ না-থাকলে একটু অসুবিধা। মোটামুটিভাবে বইয়ের রচনাকালকেই কবিতার সৃষ্টির মুহূর্ত বলে ধরে নেওয়া ভিন্ন পথ থাকে না। যেমন ধরুন, এই কবিতাটি, নীলাঞ্জন হাজরার দ্বিতীয় কবিতার বই, “হৃদয়ে পানীয় জল নেই” থেকে নেওয়া (জানুয়ারি ২০১০-এ প্রকাশিত, প্রকাশক: উর্বী প্রকাশন)…
“সেই সব শিল্পীর আঁকা ছবি টাঙানো
এই সব ঘর বেশ ঠাণ্ডা
এই সব ঘরে বসা মানুষদের চোখের মতোই
এই সব ঠাণ্ডা চোখের মানুষদের বেশ লাগে
এঁরা গভীর প্রত্যয় নিয়ে একে অপরের দিকে
ক্রমাগত ঢিল ছুড়তে থাকেন
কিন্তু ঝনঝন করে ভেঙে পড়েন না কেউ
এঁদের চোখের মতো এঁরাও সকলে তৈরি
ঝকঝকে স্বছ বুলেটপ্রুফ কাচে
তাই তাক করার মতো চোখে পড়ে না
এঁদের কারুরই হৃদয়
যদিও এঁরা প্রায়শই মারা যান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে
এই রোগ এড়াতে এঁদের চাই অশ্রু-টলটলে ভোজ্য তেল
যার জন্যে চাই আদিগন্ত রোদ্দুরে সূর্যমুখীর ক্ষেত”
নীলাঞ্জন হাজরার কবিতা ভনিতাহীন, ভাষার প্যাঁচপয়জারের ভারমুক্ত। সরাসরি। রাজনৈতিক। কাব্যসুষমার তোয়াক্কা তিনি, তেমনভাবে, করেন না। কবিতাটি লক্ষ করুন। আরও লক্ষ করুন এর পরের অংশটুকুতে কবিতার উড়ানটি।
“যে ক্ষেত রক্তে আগুন ধরাবে সেই শিল্পীর
যার জ্বলন্ত ছবির পোস্টার
অনতিক্রম্য আলোকবর্ষ ঘেরা প্রত্যেক শিল্পীর মতো
নিজস্ব দহনে একা একা জ্বলতে থাকবে
কাচ-কাচ গন্ধ ঠাসা ঘরের পিচ্ছিল দেওয়ালগুলো জুড়ে
যেই সব ঘর বেশ ঠাণ্ডা
সেই সব ঘরে বসা মানুষদের চোখের মতোই।”
প্রথাভাঙা প্রতিবাদের শিল্পকেও প্রতিষ্ঠান যে কেমন করে আত্মস্মাৎ করে ফেলে!!!”
বিদেশে ছবিকে মিউজিয়াম-মুক্ত করার আন্দোলনের শিল্পীদের আঁকা ছবি শেষমেষ মিউজিয়ামের দেওয়ালেই শোভা পায়। আর, ঘরের পাশে প্রতিবাদী কবি দিনের শেষে ক্ষমতার চেয়ার মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজেই, এই কবিতা সমকালীন রাজনীতির, আবার একইসঙ্গে চিরকালীনও।
তবে কি প্রতিবাদ অর্থহীন? এক নিছক মূল্যহীন ঝাঁকুনি দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা? প্রতিষ্ঠানের গিলে নেওয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে, নিরন্তর কথোপকথন কি অযৌক্তিক?
“আমি সেই মুখোশ ফেরিওয়ালা” (প্রকাশকাল, সেপ্টেম্বর ২০০৯, প্রকাশক: কবিতীর্থ) বই থেকে একটা কবিতা।
“কিছু বলো
কিছু বলো
কিছু বলো
নইলে যে অব্যবহারে
বাতাসের ডানা খসে যেতে পারে
ব্যূহ ও বাগান
অপেক্ষমান
ভোর চলে গেলে
চায় যদি প্রমাণ সকলে
হৃদ্পিঞ্জর থেকে সেই ডাক
কিছু খোদা থাক
ধমনীর টানে
ফেলে যাওয়া কথার নিশানে
এমনই ধারালো
কিছু বলো
কিছু বলো”
হ্যাঁ, এই হিসেবনিকেশের নিত্য-অপসৃয়মান জগতে একান্ত কথোপকথনটুকু নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে জরুরি। এও এক প্রতিরোধ, নয় কি? তাই, এই কবিতা প্রেমের, প্রতিরোধী অস্তিত্বেরও।
একই বই থেকে আর একখানি কবিতা। না, পুরোটা নয়, কিছুটা অংশ।
“দূরত্ব কোথায় থাকে? কখন আসে?
কীভাবে নিঃশব্দে গড়ে নেয় দুর্লঙ্ঘ্য ব্যূহ তার অলীক দুর্গ ঘিরে?
সময়ের সাথে দূরত্বের সম্পর্ক তো
আসলে অন্য দূরত্বের ছুতো মাত্র
ভীষণ তাণ্ডবেও
গর্জন নৈঃশব্দের কাছে যেতে পারে না”
কিন্তু, কিছু দূরত্বের সংজ্ঞা প্রকৃতিগতভাবেই ভিন্ন হয়ে যায়, ভিন্ন হয়েই থাকে। তার উত্তরও নীলাঞ্জন হাজরা খুঁজে নেন নিজস্ব ইতিহাসবোধের মধ্যে দিয়ে।
সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ “অনাথ দূরত্বেরা” (প্রকাশকাল, জুন ২০১৮, প্রকাশক: ধানসিঁড়ি) থেকে নেওয়া একটি কবিতা।
“দূরত্ব
ভূগোলের হয় না
ইতিহাসের হয়
এ কথাই তুমি পড়াচ্ছিলে
কোনো ছাত্রী তোমার কাছে দেখতে চায়
দূরত্বের ছবি
মুঠো খুলে দ্যাখো
আমাদের
দূরত্বের ছবি
রেখায় রেখায়”
এই দূরত্ব কি ভবিতব্যই তবে? রেখায় রেখায় আঁকা থাকা এই দূরত্বকে কি নিয়তি বলে মেনে নেব? মেনে নিতেই থাকব? অবিশ্বাস আর ঘৃণামিশ্রিত এক দূরত্বের কাহিনী তো চারপাশে নিপুণভাবে বোনা হয়ে চলেছে। পাশের ঘর, পাশের পাড়া, পাশের দেশ – দূরত্ব ভূগোলের তো নয় নিশ্চিত। তা হলে এই ইতিহাস কি অপরিবর্তনীয়?
মনে রাখতে হবে, তাঁর এই কবিতার বইয়ের নাম, “অনাথ দূরত্বেরা”। আর, সেই নামের ঠিক নীচেই সাবহেডিং, করাচির কবিতা। পশ্চিমি মিডিয়ার চোখে (আমাদেরও) বিশ্বের সবচাইতে বিপজ্জনক শহরে কিছু সময় কাটানো, মানুষে মানুষের পরিচিতির সবকটি শর্ত ছাপিয়ে পরস্পরের পানে ভারতীয়-পাকিস্তানির একমাত্রিক আত্মপরিচয় ও তজ্জনিত তীব্র অবিশ্বাস, এই জটিল দূরত্বের অনুভব-যন্ত্রণা – এসব মিলিয়েই উঠে এসেছে তাঁর এইসব কবিতা, এই বই।
এই বইয়ের আর একটি কবিতার কিছু অংশ…
“আমাদের হৃদয়ের
দূরত্বগুলো
এত অন্ধকারও ছিলো না
যে তাতে কোনো কবিকে খুন করা যায়
এত উজ্জ্বলও ছিল না
যে তাতে উদ্ভাসিত হতে পারে
কোনো বৈপ্লবিক প্রার্থনা
সেইসব দূরত্ব-ছোঁয়া রাস্তার
নকশা আঁকলে
তাতে দেখা যাবে না
কোনো রহস্যময় ত্রিভুজ
সোনালি চতুর্ভুজ
বিপ্লবী পঞ্চভুজী তারা
কিংবা তেমন প্রতীকী কোনোকিছুই”
হ্যাঁ, এইসব দূরত্বেরা অনাথ। কেননা, আমরা জানিনা বা জানতে চাই না, বা আমাদের জানতে দেওয়া হয় না এইসব দূরত্বদের বংশপরিচয়, অতীত ইতিহাস। তাই, এরা বেড়ে ওঠে, বাড়তেই থাকে।
এই কবিতারই শেষে, কবি বার্তা দেন…
“তবু বন্ধু
আমাদের উচিত নয়
এই দূরত্বদের ভুলে যাওয়া
এইসব দূরত্বের পথে ছড়ানো
রঙচটা, ভাঙাচোরা
মাইলপোস্টগুলো ছাড়া
আমাদের সম্পর্কের
নাম-পরিচয়ের
আর তো কোনো চিহ্নমাত্র নেই”
মনে রাখতে হবে, আট বছর আগের কবিতার বইয়ে, এই কবিই বলেছিলেন…
“এই সব দূরত্ব, এখন
ভরে উঠেছে জলে
শিরায় শিরায় অ্যাতো নদী
দূর ডিঙি, জেলেদের গান
মাঝরাতে ভয়ানক ঘূর্ণির বান
পলি
বয়ে যাওয়া
শিরায় শিরায় অ্যাতো নদী হয়ে আছে
এই সব দূরত্ব এখন।”
মানুষ আর মানুষের দূরত্ব, হৃদয় আর হৃদয়ের দূরত্ব – যে দূরত্ব অবশ্য-অতিক্রম্য – সেই দূরত্ব নীলাঞ্জন হাজরাকে তাড়া করে অবিরত। বাড়িয়ে তোলা দূরত্বের আড়ালে অন্ধকারের ছবিগুলো প্রকাশ্যে আনেন এইভাবে…
“মোমবাতি
জ্বালাও
শান্তি
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
কাশ্মীরে
শিশুরা এবার শুধু
খিদেয়
বিনা চিকিৎসায়
আর বন্যায়
মারা যাবে
মোমবাতি
জ্বালাও
শান্তি
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে”
হ্যাঁ, নীলাঞ্জনের কবিতা আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক। দলীয় রাজনীতির স্লোগাননির্ভর কবিতা নয়, এই রাজনীতি রাজ্য-দেশের বেড়া পার হয়ে প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক। তাই, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে বাংলা রাজনৈতিক কবিতার যে উজ্জ্বল ঐতিহ্য রয়েছে, নীলাঞ্জন হাজরা সেই ধারার উত্তরসুরি হয়েও কিছুটা ভিন্ন।
কবি হিসেবে তিনি সফল কিনা, তাঁর কবিতা আদৌ কবিতা কিনা, সেই বিচার পাঠক করবেন। কিন্তু, তাঁর কবিতা, তাঁর কাব্যভাষা যে একান্তই তাঁর নিজস্ব, এই কথায়, বোধ হয়, দ্বিমত পোষণের জায়গা নেই।
“সাফল্যের মানচিত্র আমার নেই
রয়েছে
মিছিল
আর
তোমার করতল
আহত মানুষদের মিছিলে হেঁটে
আমি বাতাসের সাথে পতাকার সম্পর্কে
উড়েছি তোমার আকাশী হৃদয়ে
আহত মানুষদের মিছিলে হেঁটেই
পৌঁছে গিয়েছি তোমার
দীর্ঘনিশ্বাসের অরণ্য-কিনারা পার করে
রাষ্ট্রবিহীন ভালোবাসার গোপন ডেরায়
অস্বীকার করেছি মানচিত্রের কঠোর সীমানা
সাফল্যেরা কাল কিংবা পরশুর আগের দিন এসে যাবে
ক্যামোফ্ল্যাজ পোশাকের তঞ্চকতা আর
নির্ভুল নিশানার স্নাইপার-ছোবল-দৃষ্টি নিয়ে
তোমার করতলরেখায় রেখায়, প্রিয়তমা
রুখে দাঁড়ানোর রক্তাক্ত ছোটোছোটো মুহূর্তগুলো
ছড়ানো রয়েছে
মুঠোয় আঁকড়ে ধরে
তোমার আকাশী হৃদয়ে তুলো
আমাদের ছোটো ছোটো নিবিড় দেওয়া-নেওয়ার স্মৃতি”
প্রেম-ভালোবাসা-সমাজ-ইতিহাস-রাজনীতির দর্শন নিয়ে ব্যক্তিগত বেঁচে থাকার এক আশ্চর্য ছবি আঁকতে পারেন নীলাঞ্জন। এই জগৎ তাঁর একান্ত নিজস্ব, আবার অদ্ভুতভাবে আমাদের সকলেরও।
“কিচ্ছু-না থেকে
যদি
কিচ্ছু না-ই হতো
তাহলে রেখা থেকে ফুটে বেরোত না এত রক্ত
আসমান কিংবা জল কিংবা বালির ওপর টানা
সীমান্তরেখা থেকে
হৃদয়ের ওপর টানা
অপসৃয়মান দু-পায়ের
ছাপের রেখা থেকে
বাড়িঘর জ্বালিয়ে-দেওয়া শিশুদের
গালের ওপর টানা
অশ্রুরেখা থেকে
মগজের ওপর টানা
গোষ্ঠী-পরিচয়ের রেখা থেকে
আমার নিঃসঙ্গতার ওপর টানা
তোমার নামের অক্ষরের রেখা থেকে
ফুটে ফুটে বেরোত না এত রক্ত”
জীবন যাপনে ভাবনায় আদ্যন্ত প্রথাভাঙা এই মানুষটির মননশীল অনুভবের কবিতাজগৎ আমাদেরকেও চমকে দেয় প্রতিনিয়ত, পারিপার্শ্বিককে নতুন চোখে দেখতে শেখায়।
৪.
“এখন আমি
উপযুক্ত প্রশিক্ষণে ব্যস্ত
এখন আমি হাতেকলমে শিখছি
কী করে আমার এই ভীষণ গরমের দেশকে
ঘৃণা করা যায়
এখন আমি শিখছি
গাছ, নদী, তোমার চুমু, ভ্যাটে পচতে-থাকা জঞ্জাল
কিংবা মৃত জরায়ুর থেকেও কীভাবে
মুনাফা ছেঁকে নেওয়া যেতে পারে
যার উপযুক্ত ব্যবহারে ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির চোখে পড়ার মতো
মাইনের কর্মসংস্থান হতে পারে বহু মানুষের
এখন আমি শিখছি, সেই আশ্চর্য ভাষা
যাতে তোমার অরণ্যে মুখ গুঁজে
কান্নায় ভেঙে পড়ার শব্দেও
আমায় একটিও বাড়তি বর্ণ
খরচ করতে না হয়
এখন আমি শিখছি
প্রতি মুহূর্তে মরে যাওয়ার পরেই
কী করে মোবাইলে জেনে নিতে হয়
জীবনের বাকি ব্যালেন্স”
আবারও বলার, এই লেখা নীলাঞ্জন হাজরার কবিতার বিশ্লেষণ বা পর্যালোচনা নয়। তাঁর কবিতার উপক্রমণিকা হিসেবে দেখা যেতে পারে এই লেখা। বা, তাঁর কবিতার প্রেক্ষিৎটি বোঝার সহায়ক হিসেবেও পড়া যেতে পারে।
অনুরোধ, নীলাঞ্জন হাজরার কবিতা পড়ুন। ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন ভাবনার, এক নতুন কাব্যভাষায় লেখা হওয়া মেধাদীপ্ত এই কবিতা পড়ে দেখুন। আশ্চর্য এক ঝকঝকে স্মার্টনেস তাঁর কবিতার শরীর জুড়ে। হ্যাঁ, এক বুদ্ধিদীপ্ত আর্বান স্মার্টনেস, যার অবস্থান সাম্প্রতিক জনপ্রিয় উপরচালাকির সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে।
“যে ভুল-আমি রয়ে গেছি
তোমাদের আবছা মনে
জনে জনে
হাত ধরে শুধরাতে চাই
সে তুমুল-আমি কবে ক্ষয়ে গেছি, দ্যাখো
রঙিলা-দালান-পোড়া-ছাই
যে ভুল-আমি রয়ে গেছি, শুধরাতে চাই”