সুব্রত সরকারের কবিতা

সুব্রত সরকারের কবিতা

বাংলা মদের সঙ্গে

 

চঞ্চল, তুমি আজ ঈর্ষা করো কাকে?
সে তোমার মেঘগর্জন, অখণ্ড ঋ, অনন্তে রয়েছে করুণা, তাকে
ক্ষুধা দাও, ঋণ করো, মৃত্যুর কাছে এসে সুধা
খুব কাঁদছে, কারণ ভালোবাসা এইভাবে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে
যায়, অমীমাংসার প্লেটে চেরীফল, আঙুর ও কোমল
বেদানাগুচ্ছ, তুমি তাকে নিজের কবিতা ভেবেছ।

এরপর স্মৃতি, স্বপ্ন-পরিখা, মেঘবর্ণের পাখি ডেকে ওঠে অন্তরে–
বাহিরে সারাদিন, অপরিচিত মনের নিচু বাংলো, তার
কেয়ার-টেকারও ছন্দ জানে, একলা কুয়ো, সেও জানে যতি-চিহ্ন
রেখা, বাংলা বানান, আমাকে কি এসবেরও উর্ধে
উঠে যেতে হবে, জন্মেরও আগে কি কাউকে কথা দিয়ে এসেছি?

মনে তো পড়ছে না। সারাজীবন ধরে যত অন্ন, অপমান ও তৃষ্ণা
আমি লুকিয়ে রেখেছি কৌতুকে, মৃত্তিকায়, মৃগশিরা
নক্ষত্রের নিচুব আঁধারে, তারা আজ আমাকে উপহাস করে –
তুই একটা কড়ে-আঙুল, তোকে নুন-লঙ্কা দিয়ে খেতে
বেশ ভালো লাগবে বাংলা মদের সঙ্গে তোর
এইটুকু অন্ত্যমিল রয়েছে দেখলাম।

 

কিছু ভয় নেই-রে, বেটা

 

হংস ধ্বনি করি, আমার নিঃশ্বাস তুমি কি আজ কেয়াপাতার নৌকো
করে আসবে? দুঃসহ করুণা সাঁকোর মতো
খালের অন্যপাড়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করছে নিসর্গ-কে, এই
সন্ধ্যাবেলা, অশ্রু-বিন্দুর মতো একফোঁটা তারা
দেখা গেলো চাঁদের পায়ের কাছে বসে চুল খুলে দিয়েছে, কি?
কাল-সর্পযোগ? ক্ষুধা, অপরামানবিক আগুন, নিহত
বৃক্ষের মা, আমি ধর্মের নামে, আমি গুরুর ইচ্ছায়, আমি নেতাদের
খুশি করবো বলে তরোয়ালে তার একটি স্তন
কেটে নিয়েছিলাম, গতজন্মে, তারও আগের জন্মে, এইবারে এসে
মন্দির, মসজিদ, চার্চ ও গুরুদোয়ার, বুদ্ধের মঠের মাথায়
দেখছি সর্বত্রে সেই স্তন-টি বসে আছে, বলে –
আয়, কাছে আয়, কিছু ভয় নেই-রে, বেটা!

 

দুঃখের করাতের শব্দ

 

মাটির ঈশ্বরী, গাছতলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা
করছে, মৃত্যুর, সন্তানের মতো সে আসবে, চুলে ধুলো লেগে
পাক ধরে গেছে, ছিন্ন-বসনে লজ্জা ঢেকে রাখাও ক্রমে
কঠিন, কপালের ফাটল দিয়ে রোদ এসে প্রবেশ করে আত্মায়, কবে
পুজো হয়েছিলো তারপর থেকে না-খেয়ে,  ও প্রদীপের
প্রশ্নই আসে না, বিসর্জনের বদলে পুকুরপাড়ের এই
গাছতলায়, প্রতি রাতে জ্যোৎস্না এসে চোরের মতো গায়ে হাত
বোলায়, পুকুরের জলে হাওয়া লাগলে যেমন শিরশির
করে ওঠে ওইরকম অনুভূতি হয় মনে, বিষণ্ণ
মুখে একলা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় সে বোঝে – সময়ই
হলো আসল, দৈবশক্তি, যখন তাকে তৈরি করা
হলো – সে ছিলো মাটির প্রতিমা, আবার পুজোর সময়
সে দেবী, আর এখন সে দেবীর পরিত্যক্ত
খোলস, আবর্জনা, মৃত্যুর
চিন্তা তাকে ঘিরে রাখে, আর অনর্গল দুঃখের করাতের শব্দ হয়।

 

সংগীত কণিকা মাত্র

 

বরং নিজেই তুমি পুষ্পিত হও – দারুব্রহ্ম বললেন, তার
দক্ষিণে প্রকাণ্ড এক দুধপুকুর এখন জলে টৈ-টুম্বুর, আর বামে নিহত
শকুনগাছ, সেখানে রাতে চাঁদের গাড়ি এসে দাঁড়ায়, রোজ
কলমে কর্পূর ভোরে অঙ্ক করি, পিপাসায় গলা শুকিয়ে
কাঠ, সেখানে আজ আর সুর নেই, সুগন্ধ পালিয়ে গেছে অন্য লোকের
বাড়ি, অশ্রু, লজ্জা, অশ্বভয়, এবার গগনতলে উদিত হলো
স্বপ্নের প্রতিহিংসা, ক্রমে দুঃখের কিনারাগুলিকে
দেখা যাবে, তাদের তৃণাচ্ছাদিত ষড়যন্ত্ররাও প্রকাশিত হবে উটের
মতো, কাঁটা খাচ্ছে আর মুখের কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে
পড়ে আত্মায়, দিব্যলোকে, কবিতা এসে প্রণাম জানায় সূর্যকে, ধীরে
ক্ষমা, মাটি, তীর্থজল পেরিয়ে চলেছি পান-সুপুরির
দেশে, পরমব্রত বালি খুঁড়ে জল খুঁজছে, পবিত্র
প্রণয়-পাশা তুমি ঈষৎ মলিন এখন, শস্য-ময়ূরটাকে তবে
কুলুঙ্গিতে রেখে দিই, অন্ধ-মন স্পর্শে, গন্ধে, শব্দে টের
পায় কে এলো, কে চলে গেলো, রাজনৈতিক ক্ষুধায় অসম্মান এখন
মরকত মণির মতো জ্বলছে, বাজারে মাছ-মাংস অপ্রস্তুত হয়ে
ওঠে, সম্ভ্রম নিচু হয়ে যায়, সে সময় হে সংযম, তুমি
শতভিষা, তুমিই পারো হৃদয়-শীর্ষ, তোমাকে
স্মরণ করি প্রেতলোকে, নিজেকে মুঠি ভরে কাম ভিক্ষা
দিই, সংগীত কণিকা মাত্র, উৎসব করো
প্রতিভা, স্নানের ঘরে, সাবানের ফেনার ভিতর তার নগ্ন
শরীরে ইলেকট্রিকের আলো ধীরে নেমে আসছে।

 

বিষণ্ণ করোটি ও হরিদ্রার সৌরভ

 

আমি তার বিষণ্ণ করোটিতে চন্দন দিই, পাশে মন-খারাপের অদ্ভুত এক
নর্দমা বইছে, সেখানে পাঁকের মধ্যে কলাপাতার উপর
আতপ-চাল, দূর্বা ও রসুন সাজিয়ে রেখে আমি আগামী দিনগুলির
মঙ্গলের উদ্দেশ্যে, লঙ্কা-জবার পুষ্পের মালা ব্যথার গলায়
পরিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করি, ও অশ্রু, ও আমার সকল প্রকার অসম্মান
আশীর্বাদ করো – আমার হিংসার মুরতি যেন এবার আবির্ভূত
হয় ধরাতলে, প্রণয়, কাম, লাঞ্ছিত-ক্ষুধা পাশে থাকুক ভাইয়ের মতো, বন্ধুর
মতো, যতরকমের ভণ্ডামিগুলি নষ্ট-শশা, পচা চালকুমড়োর মতো
এই কুটির প্রাঙ্গনে আলো, ক্রমে আলো হয়ে ফুটে উঠছে
তোমাদের স্নেহে ও ভালোবাসায়, ক্ষুদ্র, কুটিল সাপ, মন, ফোঁস ফোঁস
করে আর তুমি হে অনন্ত নক্ষত্র-বীথি অস্ত যাও নিশাবসানে
দেহ শরীর চাইছে, আমি এতটুকু একটা নেংটা, পরের খাই, পরের
ক্ষতি করবার সুযোগ খুঁজি, মিথ্যার পাহাড়ের উপর বসে নিজস্ব
কীটনাশক হরিদ্রার সৌরভের মতো মৃদু মৃদু হাসি, কখন এসে তুমি আমার
শরীরে চুম্বনের আতর মাখিয়ে দেবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...