স্মৃতিতে মৃণাল সেন

ছবি

রাইসুল ইসলাম আসাদ

 

 

লেখক বাংলাদেশের স্বনামধন্য অভিনেতা। রেডিও, টিভি, মঞ্চ, পর্দা সবেতেই কাজ করেছেন এবং করছেন। পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য চারটি জাতীয় পুরস্কার— পদ্মা নদীর মাঝি, অন্য জীবন, দুখাই এবং লালশালু ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে।

 

 

মৃণাল সেনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ অনেকদিনই। তাঁর সঙ্গে কথাও হয়েছে বহুবার। তাঁর কথাগুলোও পরিষ্কার মনে পড়ে – ‘দেখো আসাদ ভাই, আমি তোমার বেশ কিছু কাজ দেখেছি। আমার ভাল লেগেছে। একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, শরীর সুস্থ রাখবে এবং তার সঙ্গে মনও। সবচেয়ে বড় কথা হল কাজ করে যেতে হবে। কাজ অনেকেই করছে। কিন্তু সত্যিকারের কাজ করার লোক সংখ্যায় কম। তাই, তোমাদের মতো যারা সত্যিকারের ভালোবেসে কাজ করো, তাদের কাজ করে যাওয়াটা খুব দরকার। তবে কাজ করতে গেলে তিনটে জিনিস মনে রাখবে – ধৈর্য, বিশ্বাস এবং বাইরের পৃথিবীর চলমানতার সঙ্গে, প্রবাহমানতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চোখ-কান খোলা রেখে এগিয়ে যাওয়া। কাজ করলেই ভুল হবে। ভুল থেকে শিখবে। নতুন কাজ করতে গেলে নতুন নতুন ভুল হবে। তা থেকেও শিখবে। আমাদের জীবনটাও এইভাবে ভুল এবং ভুল থেকে শেখার মধ্যে দিয়েই এগোবে। ভুলের ভয়ে অন্ধকারে চুপ করে বসে থাকলে হবে না। ভুলকে ভয় পেলে চলবে না। কারণ, ভুলই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

মনে আছে ২০০২ সালে কলকাতার ম্যাক্সমুলার ভবনে ঋত্বিক ঘটকের উপরে অনুপ সিং-এর ডকু-ফিকশন ‘দ্য নেম অফ আ রিভার’ (একটি নদীর নাম) দেখানো হল। হলের বাইরে আমার সামনে হাঁটছিলেন একজন দীর্ঘদেহী মানুষ। আমি গতি বাড়িয়েও ধরতে পারছিলাম না তাঁকে। আমার চেয়েও অনেকটাই সিনিয়র অথচ বলিষ্ঠ স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন মৃণালদা। আমি চিনতে পারলাম। কথা হল অনেক। এছাড়াও কলকাতায় দেখা হয়েছে আগে, কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার। ছবি নিয়ে কথা বলেছেন। কাজ করার প্রেরণা দিয়েছেন।

মৃণালদার কাজ নিয়ে একজন অভিনেতা হিসেবে শুধু না, একজন শিল্পরসিক দর্শক হিসেবেও আমার মুগ্ধতার সীমা থাকে না। ‘আকালের সন্ধানে’, আকাশকুসুম’, ভুবন সোম’, এমনকি শেষদিকের অসামান্য এক ছবি ‘অন্তরীন’ কিংবা শেষ ছবি ‘আমার ভুবন’ – এই মুগ্ধতার শেষ নেই কোনও। আসলে মৃণাল সেন তো শুধুমাত্র একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর ছবিতে দেশ এবং বিশ্বের ছবি ফুটে উঠেছে। তিনি চলচ্চিত্রের পাশাপাশি একটা বিশেষ সময়ের নির্মাতা ছিলেন। চলচ্চিত্রশিল্পের মধ্যে দিয়ে তিনি যেভাবে সমাজবোধ, জীবনদর্শন, মানবিক সম্পর্কের দিকগুলি ভেবেছিলেন তার উদাহরণ বিরল।

বাংলাদেশের একজন শিল্পী হিসেবে, অভিনেতা হিসেবে আমার কাছে মৃণাল সেন আরও একটি কারণে খুব কাছের। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরের মানুষ। ফরিদপুরের ভাঙ্গা অঞ্চল মৃণাল সেনের সঙ্গে আরও দুজন গুণী চলচ্চিত্রব্যক্তিত্বেরও জন্মস্থান। গৌতম ঘোষ। তার সঙ্গে গৌতম ঘোষেরই ‘পদ্মানদীর মাঝি’-খ্যাত অভিনেতা মজিবুর রহমান খাঁয়ের, যিনি আমাদের কাছে খাঁয়ের ভাই নামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে মৃণালদার সুন্দর সম্পর্ক ছিল।

মৃণালদাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে এমনই আরও কত কথা মনে আসবে। তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। বহুসংখ্যক ছবি করেছেন। তাঁর প্রয়াণের পর এই কাজগুলোই আলো হয়ে থাকবে। চলচ্চিত্রপ্রেমীরা শিল্পরসের পাশাপাশি এক দীর্ঘ সময়কে খুঁজে পাবেন, ইতিহাসকে ধরতে পারবেন তাঁর ছবি দেখে। এর চেয়ে বড় কথা আর কী …

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...