অতনু কুমার
তখনও ফোন বলতে তার লাগানো ল্যান্ডলাইন ফোনই বোঝাত, ডায়াল ঘুরিয়ে ফোন করতে হত বলে সববার নাম্বার মুখস্থ থাকত। কম্পিউটার, ইন্টারনেট এসব শব্দ সবে শোনা যাচ্ছে। তখন টিভি বলতে বোঝাত ডিডি-১ আর ডিডি-২; যাদের কেবল টিভি এসে গেছিল, রুদ্ধশ্বাস খেলার দিনে তাদের বাড়িতে লোকের ভিড় জমে যেত। তখনও বাংলা মাধ্যম ইস্কুলে পড়াটা হীনম্মন্যতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি, তখনও বাবা-মা’রা টিউশন পড়ানোর জন্য দু’বেলা এসকর্ট করে নিয়ে যেতেন না। তখনও মহম্মদ আজহারউদ্দিন ভারতের হয়ে টস করতে নামতেন, সৌরভ গাঙ্গুলী লর্ডসে সেঞ্চুরি করেছে কি করেনি। তখনও আনন্দমেলার পুজোসংখ্যায় নিয়মিত হাজিরা দিতেন কাকাবাবু, কিকিরা, অর্জুন, অরণ্যদেব; কখনও সঙ্গ দিত কলাবতী, ফ্রান্সিস, পাণ্ডব গোয়েন্দা। সেবারই শেষবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিলেন জ্যোতিবাবু; আর কিছু মাস পরেই কংগ্রেস ত্যাগ করে নিজের দল খুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই বছরই আমি মর্নিং সেকশান পার করে ডে সেকশানে ভর্তি হলাম আর প্রথম দিনই পরপর তিনটে ক্লাসে মনিটারের খাতায় নাম উঠতে দেখে এসকেবি স্যার আমাকে আর সৈকতকে দরজার বাইরে নিল ডাউন করে শাসিয়ে দিলেন, “এই দুটো নাম আর একবার দেখলে কিন্তু পিঠের চামড়া তুলে নেব!” সেবারই আমি আর দাদা মিলে হাতে লেখা “ছোট্ট পত্রিকা” বের করলাম আর সৈকত ওর বোনের সঙ্গে বের করল “দুর্লভ পত্রিকা”। সেই সব পত্রিকাতেই আমি গল্প লিখব “গুপিদা” আর তার সাঙ্গপাঙ্গ ন্যাপলা, টুটুন, বুবাই-কে নিয়ে আর সৈকত লিখবে “শিবুদা”কে নিয়ে। এদিকে গুপিদা হানাবাড়িতে রাত কাটাতে গিয়ে ভূতের ভয়ে দৌড় মারবে আর ওদিকে শিবুদা মাছ ধরার কম্পিটিশনে নাম দিয়ে ছিপ দিয়ে লরি থেকে মাছ তুলে ফার্স্ট প্রাইজ জিতে নেবে। আর সেই বছরেই পুজোর উপহার হিসেবে ছোটকাকুর কাছ থেকে আদায় করলাম “টেনিদা সমগ্র”।
“দাদা” শব্দটা অন্য ভাষায় কতটা প্রচলিত জানি না কিন্তু “দাদাগিরি”র পেটেন্ট বাঙালিরই। বেহালার মহারাজ কিংবা আলিমুদ্দিন স্ট্রীট ছাড়া দাদাগিরি কাকে মানায়? (পলিটিকালি কারেক্ট এবং জেন্ডার নিউট্রাল থাকার জন্য কালিঘাটের “দিদিগিরি” যোগ করা যাতে পারে।) তাই বিশ্ববিখ্যাত দাদা-রা যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছেড়ে বাংলা সাহিত্যের পুণ্যভূমিতেই তাঁদের কীর্তি প্রতিষ্ঠা করবেন তাতে আর আশ্চর্য কি??!! ঘনাদা-টেনিদা-ফেলুদা ত্রয়ীর মধ্যে প্রথম ও তৃতীয় জনের যাবতীয় বিশিষ্টতা স্বীকার করেও বলতে হয় বাংলা সাহিত্যে গল্পবলিয়ে বা গোয়েন্দার অভাব নেই। সেই দিক দিয়ে টেনিদার মতো চরিত্র বাংলা সাহিত্যে প্রায় বিরল। “প্রায়” বললাম কারণ বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গণশার দল আর দীপঙ্কর বিশ্বাসের মেজদা অ্যান্ড কোং-এর কথা মনে রাখতে হবে।
না টেনিদা কোনও সুপারম্যান নয়। জিনিয়াসও নয়। টেনিদা টেনিদা-ই। সে বছরের পর বছর একই ক্লাসে থেকে যায়। পরীক্ষা-ফরীক্ষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলতে পারে, “কতকগুলো গাধা ছেলে গাদা গাদা বই মুখস্থ করে আর টকাটক পাশ করে যায়। পাশ না করতে পারাই সবচেয়ে শক্ত।” আবার সে-ই সম্রাট তেমুজিন আর হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার কাণ্ড, পকেটমার সম্রাট দশাননের জীবনচরিত কিংবা বার্মা ফ্রন্টে ক্যামোফ্লেজ করে জাপানিদের জব্দ করার গল্প শোনাতে পারে। সেসব গল্প না গুল্প সে তর্ক থাক, কিন্তু এমন “গুল্প”ই বা কোন পড়ার বইয়ে মেলে? টেনিদা অন্ধকারে ছাদের পাঁচিলে বেড়ালের জ্বলন্ত চোখ দেখে ভির্মি খায়, নীলপাহাড়িতে কাটামুণ্ডুর নাচ দেখে খাটের তলায় লুকিয়ে পড়ে। সেই টেনিদা-ই গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে সহবৎ শেখায়, মা নেংটিশ্বরীর তিনমণি মস্তান খগেন মাশ্চটককে কুপোকাৎ করে ফেলে। হাড়কেপ্পন ভজগৌরাঙ্গবাবু, বিটকেল স্বভাবের ব্রহ্মবিকাশবাবু কিম্বা জাঁদরেল টিকিট চেকার রাইনোসোরাস জব্দ হয় টেনিদার হাতে। আবার প্যালাজ্বরে ভোগা, শিঙিমাছের ঝোল খাওয়া প্যালারাম সেই টেনিদাকেই টুপি পড়িয়ে মুড়ো বলে কাঁকড়ার দাঁড়া গছিয়ে দেয়! টেনিদা কাউকে কোনওদিন খাইয়েছে এমন বদনাম কেউ দিতে পারবে না বলে গর্ব ছিল টেনিদার। নিত্য প্যালা, ক্যাবলা আর হাবুলের ঘাড় ভেঙে ঘুগনি, আলুকাবলি, সিঙাড়া, মিষ্টি খাওয়াই টেনিদার ট্রেড মার্ক। সেই টেনিদাকেই বুদ্ধু বানিয়ে চারটে কাটলেট, দু প্লেট মাংস, এক প্লেট পোলাও আর এক প্লেট পুডিং খেয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে ট্যাক্সিতে উধাও হয়ে যায় বেচারাম গড়গড়ি ওরফে হনোলুলুর মাকুদা।
এই টেনিদাকে কেন প্রাণ দিয়ে ভালবাসে প্যালারাম, ঢাকাই হাবুল আর স্কলারশিপ পাওয়া ক্যাবলা তা যদি কেউ না বোঝেন তাহলে তিনি দাদাগিরির মানেই জানেন না। প্যালা-ক্যাবলা-হাবুল যেমন টেনিদা ছাড়া অনাথ, টেনিদাও তেমনি ভাইদের বাদ দিয়ে অসম্পূর্ণ। টেনিদা মানে আসলে পটলডাঙার চারমূর্তি। ক্যাবলা না থাকলে কে জানত যে কুরুবক একধরণের ফুল আর মেফিস্টোফিলিস মানে শয়তান? আর হাবুল বলেছিল বলেই তো জানলুম, বিড়ালের “মিঞাআও” ডাকের অর্থ হল “আইসো ইন্দুর মিঞা, তোমারে ধইর্যা চাবাইয়া খামু!” আর প্যালা? সে না থাকলে টেনিদার গল্প শোনাবে কে? ঝন্টিপাহাড়ির দুর্ধর্ষ জাপানি দস্যু কাগামাছির মুখোশই বা খুলবে কে?
আজকের ছোটরা, ইস্কুল থেকে যাদের বাড়িতে বলে দেওয়া হয়, “বাচ্চার সঙ্গে একদম বাংলায় কথা বলবেন না”, খেলা বলতে যারা ভিডিও গেম বোঝে, ইস্কুলের পর চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে আড্ডা না মেরে যারা ব্যাগ কাঁধে টিউশন পড়তে ছোটে, তাদের কাছে টেনিদার কোনও আকর্ষণ থাকতে পারে কি? পরীক্ষার খাতায় সুন্দর করে নারকেল গাছের ছবি এঁকে আসার বিলাসিতা কি তাদের আছে? ওদের কথা শুনলে হাবুল সেন বলত, “ছাড়ান দাও, পোলাপান”। ক্যাবলা ভুরু কুঁচকিয়ে বলত “খামোশ”। অনেকদিন পশ্চিমে কাটিয়েছে বলে ওর মুখ থেকে মাঝে মাঝেই রাষ্ট্রভাষা বেরিয়ে আসে। আর টেনিদা হয়ত এক চড় মেরে ওদের মুণ্ডু কাঠমাণ্ডুতে পাঠিয়ে দিত। আর তারপর প্যালার মাথায় গাঁট্টা মেরে বলত, কুরুবকের মত বকবক করিস না। যা ঐ বুড়োটার কাছ থেকে একটা ভালো দেখে আইসক্রিম নিয়ে আয়!
(নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষকে মনে রেখে।)
হ্যারি পটার, রোয়াল্ড ডাল পড়েটড়ে বুঝলাম, লীলা মজুমদার, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় যেসব ছেলেবেলায় নেই, তা রীতিমতো দুঃখের। লেখককে ধন্যবাদ, ভালো লাগলো এই স্মৃতিভ্রমণ। তবে লেখক দীপঙকর বিশ্বাসের নাম প্রথম শুনলাম এই লেখাটায়।
ধন্যবাদ৷ সন্দেশ, শুকতারায় দীপঙ্কর বিশ্বাস মেজদা-সেজদা-গণেশ-ঢাকনাদা কে নিয়ে অনেকগুলো গল্প-উপন্যাস লিখেছিলেন৷