রিমি মুৎসুদ্দি
তেমন ধুলো তো নেই? তবুও ইনহেলারটা জরুরি। তেমন ভিড় তো নেই? তবুও দূরত্ব মাঝেমাঝে হাঁপ ধরে যায়। বরং ছোটো ছোটো সব প্রকাশনী স্টলগুলো বেশ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অথবা নিছক ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। আচ্ছা, দূরত্ব কি মাপা যায়? তাহলে মাপলাম কী করে? মুখবই থেকে সবকিছু মাপা যায়? অথবা চোখে দেখে? কিন্তু কবিতার ভাষা? সব দূরত্ব শেষপর্যন্ত কবিতাই। যা আসলে কোত্থাও না পৌঁছেও যাস্ট থেকে যাওয়া। শুধুমাত্র থেকে যাওয়া।
বৈভাষিক, তবুও প্রয়াস, ধানসিঁড়ি, সৃষ্টিসুখ নতুন কবিতা –এইসব স্টলগুলোর গদ্যের ও কবিতার বইগুলোতে বেশ বৈচিত্র্য। আদম ও কারিগর কবিতা ও প্রবন্ধের বেশ কিছু ভাল বইয়ের কাজ করেছে। যারমধ্যে আদমের দেবদাস আচার্যর কবিতার বইটি খুবই উল্লেখযোগ্য কাজ। অমিতাভ মৈত্র ও জহর সেন মজুমদার তবুও প্রয়াসের অন্যতম ভাল কাজ। ছোঁয়া স্টলটিতে বিভাস রায়চৌধুরি ও কবি সুমন গুণের কবিতার বইগুলো অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় বোঝা যাচ্ছে।
বইমেলা থেকে ফিরেই হাতের সামনে যে বইগুলো রয়েছে তা হল জহর সেন মজুমদারের দাঁড়কাক শুধু দাঁড়কাক, পবন পঞ্ছি পানি, স্বপ্নগাছ বোকা স্বপ্নগাছ। রমিত দে-র ভাষান্তর নির্বাচিতট্রান্সটোমার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাছাড়াও একঝাঁক শূন্যদশকের কবিতায় ঝোলা মানে ব্যাগপ্যাক ভর্তি। শূন্যদশক আসলে বাংলা কবিতাকে একটা স্বাধীন পরিসরে দিয়েছে। অচেনা স্বর, অচেনা আঙ্গিকে বাংলা কবিতার এই যাত্রা নিয়ে বিশেষ কাজ হয়নি। তাই বইমেলাটুকুই শূন্যের যোগাযোগের একটা মাধ্যম।
একঝাঁক নতুন লেখকদের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানগুলো প্রবীণ পুরনো পরিচিতদের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আলাদা। কারো কারো অবশ্য মঞ্চের আলোয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন আবার বেশিরভাগেরই শুধুমাত্র প্রকাশকের স্টলেই পরিচিত প্রিয় মানুষদের সাথে সেলফি, সিংড়া ও আড্ডায় প্রকাশ। মেলা তার নিয়মে প্রতিটা দিন আগের দিনের থেকে আলাদা। কোথাও আনন্দ আবার কোথাও উদ্বেগ। সময় বই স্টলে না আসার উদ্বেগ। প্রকাশক ও নতুন লেখকের হাঁ করে প্রিন্টিং প্রেসের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন অপেক্ষা। হয়ত স্টলে বই এসে পৌঁছায় নি। যাদের বই এসে পৌঁছেছে তাদের পাঠকের অপেক্ষা। পাঠকের প্রিয় বইয়ের অপেক্ষা। তারই মাঝে মেলার গান, কবিতা পাঠ, গল্পপাঠ ও কিছু অনুষ্ঠান সইসাবুদ, সেলফি, গ্রুপফি, চা আর বেনফিসের ঠাণ্ডা ফিস পকোড়া।
বিশেষ ধন্যবাদ কৌরব পত্রিকাকে। উদয়ন ঘোষের গদ্যসংগ্রহ অত্যন্ত জরুরি কাজ। আদম থেকে প্রকাশিত অশোক দত্তচৌধুরীর কবিতা সংগ্রহ, অবভাসে দেবারত মিত্রর গদ্যসমগ্র, পরিমল ভট্টাচার্যের ‘ডোডোপাখির গান’ এই ধুলো অথচ ধুলোহীন মেলায় প্রাপ্তি।
ধুলোর কথায় বইয়ের তাকগুলোয় কিছুটা ধুলোর মাঝে পড়ে থাকে মনীন্দ্র গুপ্ত, সৌরীন ভট্টাচার্য, বিজয় দে। শ্রেষ্ঠ কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধগুলো এখনও বেশ কিছুটা নিঃসঙ্গ। একলা মানুষের মতোই ধুলোয় মুড়ে পড়ে রয়েছে। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে লেখকের ভিড় ক্রমবর্ধমান। ভিড় আর জনসংখ্যার মধ্যে কোনও রাশিতত্ত্বীয় সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা গবেষকরাই নির্ধারণ করুন। কিন্তু মেলার মাঠে ঘুরতে ঘুরতে একটু গভীর পর্যবেক্ষণ করলে সেই একলা নিঃসঙ্গ মানুষের মতোই পড়ে থাকা অত্যন্ত মূল্যবান বইগুলোর দিকে চোখ যায়। যতটা মর্যাদা পাওয়া উচিত ততটা জরুরি মানুষ আর মূল্যবান বই হয়ত পায় না। খুব কাজের মানুষ চলে গেলে হয়ত অনুপস্থিতি টের পাওয়া যায়। ভাল বই না পড়ার আক্ষেপটুকুও হয়ত তেমনই। এক শূন্যতা থেকে ক্রমে আরেক শূন্যতায় চলে যাওয়া। মাঝে কোনও স্পেস নেই। কোনও রূপান্তর নেই। শুধুই নাল এণ্ড ভয়েড।