বইমেলা মানেই আমাদের মুক্তাঞ্চল, আমাদের স্বাধীন পৃথিবী

বইরচিত

বেবী সাউ

 

কোনও একটা উৎসব তখনই জাতি বা জনগণের উৎসব হয়ে ওঠে, যখন তা মানুষের স্নায়ু, স্বপ্ন, নাড়ি, রক্তের মধ্যে মিশে যায়। তখন সেই উৎসবের প্রাক্কালে, কে কোথায় বসবাস করছে, তা খুব একটা প্রাধান্য লাভ করে না। কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলাটি অনেকটা সেরকম। আমার আসল বাড়ি ঝাড়গ্রামে হলেও, কাজের জন্য আমাকে থাকতে হয় জামশেদপুরে। তাই কলকাতার অনেক ফেস্টিভ্যাল, অনেক অনুষ্ঠানেই আমি যেতে পারি না। কিন্তু সেইসব অনুষ্ঠানগুলিকে কি আমি বুকের মধ্যে করে নিয়ে বেড়াই? সত্যি কথা বলতে, না। কিন্তু বইমেলার কথাই আলাদা। কলকাতা বইমেলা অনেকটা একটা ব্ল্যাক হোলের মতো। একজন বইপ্রেমী বাঙালি, তা সে ডালাসের সৌম্য দাশগুপ্ত হোন, বা সিয়াটেলের অঙ্কুর সাহা, অস্ট্রেলিয়ার মণিশংকর বিশ্বাস হোন বা ঢাকার দেদার মালেক, তাঁরা হয়ত কলকাতা বইমেলায় আসতে পারেননি, কিন্তু তাঁরা এই বইমেলায় আছেন, যেমন আমিও আছি। কিন্তু কেমনভাবে আছি? যেমনভাবে আপনিও আছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছি হয়ত জামশেদপুর আকাশবাণীর অফিসে, কিন্তু মন পড়ে আছে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে। ওই তো ৩৯ নং টেবিলে সব নতুন পুরনো বই নিয়ে বসে আছেন আমাদের নবনীতাদি। কত যত্ন করে বইগুলি প্রকাশ করেছেন তিনি। পাশে বসে আছেন হয়ত আমাদের সঞ্জীবদা। ভাষালিপির প্রতিটি বইয়ের গায়ে যাঁর তুলির স্পর্শ। ওই তো আদমের গৌতমদা। গৌতম মণ্ডল। কী নিষ্ঠা, ভালোবাসায় বড় করে তুলেছেন আদম। কত কবিতার বই প্রকাশ করেছেন তিনি। বইমেলার শেষ দিনের আগের দিন পর্যন্তও তাঁর প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে একটির পর একটি কবিতার বই। শুধু কী সে সব অগ্রজদের? নবীনদেরও। সকলের প্রতি তাঁর সমান ভালোবাসা, সমান সম্মান। সিগনেটে নতুন কবিতার বই নিতে ভিড় করে আছে কত পাঠক। ধানসিড়ির সামনে গম্ভীর সুদীপ বসু একটার পর একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন। তাঁরও তো এবার গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে তাই না? আর রাতুলদা, গলায় গান নেই, এখন কেবল ধুলো। তবু কি তিনি গুনগুন করছেন না? প্রকাশিত হয়েছে বাতিঘর। অত্যন্ত সমৃদ্ধ সংখ্যা তিনি তুলে দিচ্ছেন গুণীজনেদের হাতে। কী সুন্দর বন্ধুতা সকলের মধ্যে। কী উষ্ণ আলিঙ্গন! সারা বইমেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে ভাষানগরের কবিতার গাড়ি। চলমান এই কবিতার গাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে পত্রপত্রিকা, কবিতার বই। প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে কবিতাপাঠ। ওই তো সোপান, ওই তো আনন্দ, ওই তো ঐহিক। ওই তো বিভাসদা হেঁটে যাচ্ছেন। মুখে তাঁর চিরাচরিত হাসি। দেখতে পাচ্ছি শ্রীজাতদা, অংশুমান দা, বিনায়কদাকে। হিন্দোল ভট্টাচার্য যথারীতি অনুপস্থিত। ওই তো গান গাইছেন রজতেন্দ্রদা। ধুলোয় গা গড়াগড়ি দিয়ে কী পরম মমতায় সকলের বয়স কমে গেছে। সমস্ত দূরত্বকে কলা দেখিয়ে চলে এসেছেন গুরুচণ্ডা৯-র টিম। সরোজদা আর রোহণদার সৃষ্টিসুখের কথাও বলতে হবে। কে বলে এখন শুধুই ফেসবুক কবি? দেখতে পাচ্ছি কত নতুন নতুন কবিদের কবিতার বই প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলা ভাষা বেঁচে থাকছে। অমিত সরকার আর অরণ্যা সরকার তাঁদের চর্যাপদ নিয়ে বাংলা সাহিত্যের নিভৃতির কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। আমাদের আবহমান-ও আছে। সকলের অগ্রজ, স্নেহময়, প্রচারবিমুখ সন্দীপন চক্রবর্তী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন সকলের প্রতি। এই উষ্ণতা তো বাংলার অন্য কোথাও মেলে না। এই উষ্ণতা তো কলকাতা বইমেলাতেই মেলে। ঐ তো হেঁটে যাচ্ছেন শাশ্বতী, কস্তুরী, শমীক, অনির্বাণ, সাদিক হোসেন। জয়দা উদাস চোখে বিজল্পের স্টলের সামনে থেকে তাকিয়ে আছেন পশ্চিমের আকাশের দিকে। চোখে তাঁর কত অজানার গন্ধ। গৌতম বসু চিরাচরিত লাজুক মুখে পরম মমতায় একটি একটি বইয়ের পাতা উলটে দেখছেন। তাঁর গদ্যসংগ্রহ প্রকাশিত হল। সম্ভবত এই বইমেলার সবচেয়ে বড় ঘটনাগুলির একটি। আরেকটি বড় ঘটনা হল প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতাসংগ্রহ ও অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্রের কথাসংগ্রহ। ধন্যবাদ আদম, রাবণ ও ভাষালিপিকে। গত চার পাঁচ বছর ধরে এই প্রকাশনীগুলি বাংলা কবিতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পৃথ্বী বসুর দশমিক আর অভিষেক ঈশানীর একশো আশি ডিগ্রির কথাও বলতে হবে।

কী বলছেন পাঠক? কেউ কি কিনলেন? পড়লেন আমার রক্ত? আমার স্নায়ু? এই তো আমি অটোয় সাকচি ক্রস করে ঢুকে পড়লাম করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ডের পাশের গেট দিয়ে বইমেলায়। ভোঁ পড়ল টাটায় কারখানার। কিন্তু আমার চোখের সামনে তো লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন। যেতে হবে কৃত্তিবাসেও। আর তারপর না হয় আবার ফিরে যাব মানগোয়। সক্কাল সক্কাল আবার আকাশবাণী যেতে হবে। তা হোক, এখন তো এই পুণ্যভূমির ধুলো মেখে নেওয়া যাক। কে বলছে আমি যাইনি একদিনও? যখন প্রথম কোনও পাঠক আমার নতুন কবিতার বইটি হাতে তুলে নিলেন, বুকের ভিতর তখন ধুকপুক ধুকপুক করছে। যেন আমাকেই স্পর্শ করছেন তিনি। নতুন পাঠক, আপনি ঠিক কেমনভাবে নিচ্ছেন আমার কবিতা? তা কি এই দখিনা বাতাস বয়ে যাওয়ার মতোই সুন্দর? আচমকা হাওয়া দিচ্ছে। ঘোষণা হচ্ছে বইমেলার মাঠে। আমাদের বারান্দায় রোদ এসে পড়েছে। মানুষের হাতে বই তুলে দিতে দিতে বইয়ের মধ্যেই হারিয়ে গেলেন উর্বী প্রকাশনীর প্রদীপ ভট্টাচার্য।

আমরা যেখানেই থাকি না কেন, বইমেলায়, বইমেলাতেই থাকি। ৩১ জানুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি, প্রতিটি দিন আমাদের শুরু হয় বইমেলার কথা ভেবে। রাত নটা বাজলেই মনে হয় এই তো সকলে বাড়ি ফিরছে। আজ যেমন মন খারাপ। কারণ জানি, আজ বইমেলা শেষ। কোথাও এক আত্মীয় যেন বইমেলা। যার সঙ্গে আবার দেখা হবে আগামী বছর। আবার মনের মধ্যে মনকেমন। অথচ আমার সঙ্গে তো তার দেখা হয়নি খুব। দেখা হয় না। দূরের সম্পর্ক। কিন্তু দূরে থাকি, কাছে থাকি বলে। তখন দুরত্ব প্রকৃত সত্য নয়।

বইমেলা হল একটি দেশের নাম, যার কোনও সময় স্থান কাল পাত্র দেশের কাঁটাতার নেই। বইমেলা, একটি টাইমমেশিন, একসঙ্গে জয়েস থেকে জয়ে হাঁটার জন্য।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...