১০ই আষাঢ় ১৪২৪ বঙ্গাব্দ

 

 

অথ বর্ষাগমন ও চিৎপুরের রথকথা 

 

বর্ষা এইবার বেশি বিলম্ব না হইতেই আসিয়াছেন, শহর কলিকাতায় বাদল বেশি হইতেছে না অপিচ সেই ছিটাফোঁটা লইয়া সম্বাদপত্রে বিলক্ষণ রইরই শুরু হইতে বাকি নাই, বংশীবাদনরত বাবু ও কৃষ্ণভামিনীগণ কে বা আগে বৃষ্টি দেখিলেন তাহা লইয়া ফেসবুকে সচিত্র পোস্টো দাখিল করিতেছেন, কেহ আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে নবদুর্বাদলশ্যাম মেঘসঞ্চারে পেখম মেলিয়া লাইভ হইতেছেন, কোনও বুদ্ধিমান কোচবিহারের বৃষ্টির ফটোক তুলিয়া তাহাকে কলিকাতার বলিয়া চালাইয়া দিয়া সুখে গৌর-নিতাই হইয়া বগল বাজাইতেছেন… শহর এই প্রকারে বর্ষা উদ্‌যাপন শুরু করিয়াছে…

এদিকে স্নানযাত্রা শেষ হইয়া শহরে রথযাত্রার ধুম উঠিয়াছে, জ্বর সারিয়া উঠিয়া পথ্যগ্রহণান্তে জগন্নাথ বলভদ্র ও সুভদ্রা মুখে চুষি-লবেঞ্জুস ও খড়কেকাঠি লইয়া মাসির বাড়ি যাইবার উদ্যোগ করিতেছেন, মাহেশ নবদ্বীপ ও যত্র-তত্র হইতে টিকিধারী নেড়েগণ আসিয়া খ্রষ্ণ-খ্রষ্ণ বলিয়া শহর মাতাইয়া তুলিবার আয়োজন করিতেছে… রাজরাজেশ্বরী মাতাঠাকুরাণী অধুনা উদ্যোগপতি ও সাম্বাদিকগণ-সমভিব্যাহারে কর্তব্যোপলক্ষ্যে ওলন্দাজদেশ পরিক্রমণরত বিধায় কলিকাতায় উৎসবের নির্ঘণ্ট প্রস্তুত করিতে নগরকূলচূড়ামণি ও তদীয় হুঁকাবরদারদিগের গলদ্‌ঘর্ম হইতেছে… আমাদিগের বটতলার কাগজের বর্ষাবরণ সংখ্যায় সম্পাদকীয় কলমে কী লেখা হইবে স্থির করিতে না-পাইয়া মন উচাটন হইয়াছে… এমন সময়ে দফতরের দরোজায় কড়া নাড়িবার শব্দ হইল, এবং আমরা ঘাড় ফিরাইতে না-ফিরাইতে তালিপত্রের চপ্পলযুগলে ফটাফট ধ্বনি সমুৎপন্ন করিয়া মদীয় অভিভাবক তথা প্রধান সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয়ের শুভাগমন ঘটিল। মহাশয়কে দেখিয়া আমাদিগের ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়িল, কেননা তিনি দফতরে থাকিলে অন্য কাহারও সম্পাদকীয় লিখিবার প্রশ্ন নাই… পরন্তু পরচর্চ্চাবিষয়ক পরুষ বাক্য তাঁহার কলমে প্রকাশিত হইলে আমরা সকলেই নিশ্চিন্ত থাকি… লাট-সরকারের সঙ্গে তাঁহার সম্পর্ক অতি সুমিষ্ট হওয়ায় চিন্তাপুলিশ সহসা কাগজ বাজেয়াপ্ত করিতে সাহস দেখায় না…

কাগজ রথযাত্রা উপলক্ষ্যে প্রকাশ পাইবে শুনিয়া সিঙ্গিমহাশয় কিয়ৎমিনিটকাল ঊর্ধ্বনেত্র হইয়া স্থানু রহিলেন, ও তৎপরে উড়ে প্রুফরিডারের দিকে চক্ষু ফিরাইয়া তাহাকে দোয়াত-কলম লইয়া প্রস্তুত হইতে ইঙ্গিত করিলেন। সঙ্গের ছড়িটি কোলের উপর রাখিয়া, বামহস্তে একটিপ নস্য লইয়া বাবু অতঃপর বলিতে লাগিলেন…

“… স্নানযাত্রার আমোদ ফুরুলো, গুরুদাস গুঁই গুলদার উড়ুনী পরিহার করে পুনরায় চিরপরিচিত র‍্যাঁদা ও ঘিস্‌কাপ ধল্লেন। ক্রমে রথ এসে পড়লো। ফ্যেতো র‍্যতো পরব প্রলয় বুড়ুটে; এতে ইয়ারকির লেশমাত্র নাই, সুতরাং সহরে (এইস্থলে ‘শহর’ বানানে কেন দন্ত্য স-ই লিখিতে হইবে এবং তালব্য শ কেন চলিবে না সে-বিষয়ে বাবু কিছু বলিলেন, কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বিধায় আমরা তাহা বর্জন করিলাম) রথ-পার্ব্বণে বড় একটা ঘটা নাই; কিন্তু কলিকাতায় কিছুই ফাঁক যাবার নয়। রথের দিন চিৎপুর রোড লোকারণ্য হয়ে উঠলো, ছোট ছোট ছেলেরা বার্নীস করা জুতো ও সেপাইপেড়ে ঢাকাই ধুতি পোরে, কোমরে রুমাল বেঁধে চুল ফিরিয়ে চাকর-চাকরাণীদের হাত ধোরে, পয়নালার ওপর, পোদ্দারের দোকানে ও বাজারের বারাণ্ডায় রথ দেকতে দাঁড়িয়েচে। আদবইসি মাগীরা খাতায় খাতায় কোরা ও কলপ দেওয়া কাপড় পোরে, রাস্তা জুড়ে চলেচে; মাটির জগন্নাথ, কাঁটাল, তালপাতের ভেঁপু, পাখা ও শোলার পাখী বেধড়ক বিক্রী হচ্চে; ছেলেদের দ্যাখাদেখি বুড়ো বুড়ো মিন্‌ষেরাও তালপাতের ভেঁপু নিয়ে বাজাচ্চেন, রাস্তায় ভোঁ পোঁ ভোঁ পোঁ শব্দের তুফান উঠেচে। ক্রমে ঘণ্টা, হরিবোল, খোল-কত্তাল ও লোকের গোলের সঙ্গে একখানা রথ এলো। রথের প্রথমে পেটা ঘড়ি, নিশান খুন্তী, ভোড়ং ও নেড়ির কবি, তারপর বৈরাগীদের দু-তিন দল নিমখাসা কেত্তন, তার পেচোনে সখের সংকীর্ত্তন পাওনা। দোহার-দলের সঙ্গে বড় বড় আটচালার মত গোলপাতার ছাতা ও পাখা চলেচে, আশে-পাশে কর্ম্মকর্ত্তারা পরিশ্রম ও গলদঘর্ম্ম – কেউ নিশান ও রেশালার মিলে ব্যতিব্যস্ত, কেউ পাখার বন্দোবস্তে বিব্রত। সখের সংকীর্ত্তনওয়ালারা গোচসই বারাণ্ডার নীচে, চৌমাথায় ও চকের সামনে থেমে-থেমে গান কোরে যাচ্চেন; পেচোনে চোতাদারেরা চেঁচিয়ে হাত নেড়ে গান বোলে দিচ্চেন; দোহারেরা কী গাচ্চেন, তা তাঁরা ভিন্ন আর কেউ বুঝতে পাচ্চেন না। দর্শকদের ভীড়ের ভিতর একটা মাতাল ছিল, সে রথ দর্শন কোরে ভক্তিভরে মাতলামী সুরে –

“কে মা রথ এলি?

সর্ব্বাঙ্গে পেরেক-মারা চাকা ঘুর্‌-ঘুর্‌ ঘুরালি।

মা তোর সামনে দুটো ক্যেটো ঘোড়া,

চূড়োর উপর মুকপোড়া,

চাঁদ চামুরে ঘণ্টা নাড়া, মধ্যে বনমালী।

মা তোর চৌদিকে দেবতা আঁকা

লোকের টানে চলচে চাকা,

আগে-পাছে ছাতা পাকা, বেহদ্দ ছেনালী।”

 

গানটি গেয়ে “মা রথ! পেন্নাম হই মা!” বোলে প্রণাম কল্লে। এদিকে রথ হেল্‌তে দুল্‌তে বেরিয়ে গেলো; ক্রমে এই রকমে দু চারখানা রথ দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে পড়লো – গ্যাস-জ্বালা মুটেরা মৈ কাঁধে করে দ্যাখা দিলে। পুলিসের পাশের সময় ফুরিয়ে এলো, দর্শকেরাও যে যার ঘরমুখো হলেন।”

এ-পর্যন্ত বলিয়া হুতোম নস্য লইবার জন্য থামিতেই উড়ে প্রুফরিডার চিড়বিড় করিয়া বলিয়া উঠিল, “সে যাই বলুন, আমাদিগের ওড্র শ্রীক্ষেত্রধামের রথযাত্রার সঙ্গে আপনার এই রথের কোনও তুলনাই চলিতে পারে না… সেখানে স্বর্গদ্বার হইতে গুণ্ডিচা অবধি লোকে লোকারণ্য হইয়া থাকে… পুরীধামের রাজামহাশয় স্বয়ং তালধ্বজ রথাগ্রে সম্মার্জনী হস্তে রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে চলেন… তাহার পার্শ্বে আপনার এইটুকুন কড়ে আঙুলপানা রথ আর তার আগে-পিছে চলা জেলেপাড়ার সং কিছুই নহে।” বলিয়া কপালে হাত ছোঁয়াইয়া বিড়বিড় করিয়া “জয় জগন্নাথঅ” বলিয়া উঠিল।

হুতোম হাসিয়া বলিলেন, “তা বই কী। তবে তোমাদের ওখেনে তো রথযাত্রা এখন কর্পোরেটদের হাতে, সেখেনে জগন্নাথ সরকার-বাহাদুরের ‘অতুল্য ভারত’-এর তোলা পান; আর আমাদের এখেনে দ্যাখো রথ চলে কেবল মা-মাটি-মানুষের…”

সিঙ্গিমহাশয় আরও কী-কী বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু বিষয় ক্রমে বিপদসীমা অতিক্রম করিতেছে বুঝিয়া আমরা দ্রুত প্রসঙ্গ পালটাইয়া মাটির টিয়েপাখি, পাপড়ভাজা ও লিকর চা অর্ডার করিলাম…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...