দেবপ্রসাদ দেবু
পেশাগত কারণে পুরানো ঢাকায় আমার যাতায়াত দীর্ঘদিনের। প্রায় এক যুগ। এ এক অসহ্য পরিবেশ। হাজারো মানুষ গাদাগাদি করে বাস করে এখানে। অলিতে গলিতে, চিপায় চাপায় গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ছোট ছোট কারখানা, গুদাম। আক্ষরিক অর্থেই নিশ্বাস ফেলার জায়গাটুকুও নেই এখানে। যা-ও বা নিশ্বাস নিবেন, সেটাতে থাকবে বিভিন্ন রাসায়নিকের কটু গন্ধ বা বিভিন্নধরনের গুদামজাত দ্রব্যের গন্ধ। প্রতি ইঞ্চি জায়গা এই এলাকার মানুষ এত নৃশংসভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করেছে যে, কোনও কোনও চিপা এক-দু তলার ভবনে (গোডাউনের উদ্দেশ্যে নির্মিত) একতলা থেকে আরেক তলায় যাওয়ার জন্য সিড়ির ব্যবস্থাও ঠিকমতো রাখা হয়নি। যারা এই এলাকায় যাতায়াত করেন, তারা দেখে থাকবেন তারা মসজিদের পাশে সরু সরু মই বিক্রি হয় সন্ধ্যাবেলা। সেগুলো ব্যবহার হয় এই সিড়িবিহীন গোডাউনগুলোর উপরে উঠার কাজে।
অলিতে গলিতে চেপে বসা বিভিন্ন রাসায়নিক কিংবা গুদামজাত পণ্যের মজুদের কারণে চারপাশটা এতো কটু গন্ধময় হয়ে থাকে যে, নতুন কেউ এইসব এলাকায় গেলে শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। আমার কয়েকজন কলিগ নাজিমুদ্দিন রোড়ের পাশেই এক গলিতে ‘বাসা’ ভাড়া নিয়ে থাকে। বর্ষার পরপর চারিদিকে তখন মশার খুব উপদ্রব। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে দিনে মশার ওষুধ ছড়ায় নালা নর্দমার যেটুকু এখনও পুরানো ঢাকায় অবশিষ্ট আছে সেখানে। সেই সময় অফিসে একদিন সেই কলিগরা আলাপ করছিল যে, ওদের বাসায় নাকি রাতে মশারি টানানো লাগে না। কারণ চারপাশের কেমিক্যালের গন্ধে মশা মারা পড়েছে। অর্থাৎ এমন একটা পরিবেশে পুরানো ঢাকায় মানুষ বাস করে যেখানে কেমিক্যালের গন্ধে পোকামাকড় থাকতে পারে না, কিন্তু মানুষ থাকে। আমরা থাকি!
একটা আদর্শ শহরে শতকরা ২৫ ভাগ রাস্তাঘাট জরুরি। ঢাকা শহরে আছে ৭/৮ ভাগ (তাও আমাদের ঢাকা নাকি লস এঞ্জেলস!)। আর পুরানো ঢাকায় আছে বড়জোর ২/৩ ভাগ। ফলে, সারাটা দিন ধরে প্রচণ্ড জ্যামে মানুষ অথর্বের মতো অসহায়ভাবে হাঁসফাঁস করে উদ্দিষ্ট কাজ সারতে, কিন্তু জায়গা থেকে নড়তে পারে না এতটুকুও। দেশের সবচেয়ে বড় বিজনেস হাব বা বাণিজ্য কেন্দ্র হল পুরানো ঢাকার মৌলভীবাজার -চকবাজার- মিডফোর্ড এলাকা৷ আর খুব সম্ভবত দেশের সবচেয়ে সরু রাস্তাঘাটও এই এলাকাতেই। তেল-চিনি-আটা-ময়দার সবচেয়ে বড় ফাড়িয়া ব্যবসা এই মৌলভীবাজারে। প্লাস্টিক দানা polypropylene/High density polyethylene থেকে যত ধরনের পণ্য উৎপাদন সম্ভব প্রায় সকল পণ্যের ছোটখাটো কারখানা এই এলাকায় আছে। যেমন পাস্টিকের পাদুকা, পলিথিন, খেলনা, বিভিন্ন গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ইত্যাদি। এছাড়াও এসবের কাঁচামাল মজুদেরও বড় আড়ত এখানেও। যেগুলো প্রচণ্ড উচ্চমাত্রার দাহ্য পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া হাজারো রকমের রাসায়নিক গুদাম তো আছেই। এ ছাড়াও আছে হাজারো রকমের মনিহারি ইম্পোর্টেড পণ্যের বড় পাইকারি বাজার। জড়িয়ে আছে কয়েক হাজার মানুষের জীবিকার প্রশ্ন। প্রতিদিন অন্তত হাজার চল্লিশেক মানুষ এই এলাকায় আসা যাওয়া করে বলে আমার ধারণা। ফলে অপরিকল্পিত ভাবে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট। ব্যবহার হচ্ছে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার। নিরাপদ কিংবা অনিরাপদ ভাবে। একটুখানি জায়গা পেলেই রেস্টুরেন্ট না হয় টং দোকান নিয়ে বসে যাচ্ছে মানুষ। মোটামুটি পুঁজির হোটেল ব্যবসায়ী উপরে জায়গা না পেলে অসুবিধা নেই। বেসমেন্টে খুলে বসছেন রেস্টুরেন্ট। বেসমেন্ট রেস্টুরেন্টের সংখ্যাও বেশ কিছু হবে এই এলাকায়। সব মিলিয়ে ওয়ার্কিং আওয়ারে এখানে হাঁটাচলা রীতিমতো অসম্ভব বিষয়।
এত লোকের গাদাগাদি বসবাসের পুরানো ঢাকায় যে সুয়ারেজ ব্যবস্থা থাকার কথা বা উচিত, বাস্তবে আছে তার ৩/৪ ভাগ হয়তো। ফলে বর্ষা মৌসুমে নাজিমুদ্দিন রোড সহ অনেক রাস্তাতেই পানি জমে মোটামুটি কোমর পর্যন্ত। আমি এই পানি পেরিয়ে অফিস করেছি সেই মৌসুমে। আর ‘পানিপার’ নামক ভ্যান গাড়িতে চড়তে চড়তে ভাবতাম, একটা ইমার্জেন্সি রোগীকে যদি এখন হাসপাতালে নিতে হয় তাহলে তার পরিবার কী করবে? নিশ্চয়ই প্রয়োজন হয়ও। ম্যানেজও নিশ্চয়ই করে ফেলে কোনওভাবে। বড় দুটো সরকারি মেডিকেল কলেজ এই এলাকার দুইপাশে। ঢাকা মেডিকেল এবং সলিমুল্লাহ মেডিকেল। জরুরি পরিস্থিতিতে যে দুটো মেডিকেলে এলাকার মানুষ পৌঁছানোর কথা বড়জোর চার বা পাঁচ মিনিটে। কিন্তু আমার মনে হয় না এই নরক থেকে শুষ্ক মৌসুমেও ৪০/৫০ মিনিটের আগে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু তীব্র কোনও প্রতিবাদ নেই এই বিষয়ে কারও। ‘খানিক’ ক্ষোভ হয়তো আছে৷ কিন্তু দাবি নেই কারও কাছে। কারও কাছেই না! এখানে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর আছেন, মেয়র আছেন, স্থানীয় সাংসদও আছেন। কিন্তু কারও কাছেই জনগণের কিচ্ছু চাওয়ার নেই।
কয়েক বছর আগে নিমতলি ট্র্যাজেডি ঘটল। শতাধিক মানুষ মারা গেল। তদন্ত হল। হাম্বিতাম্বি হল। অমুক গোডাউন তুলে দেয়া হবে, তমুক করা হবে। হল না কিছুই। এবার ঘটল নির্মম চকবাজার ট্রাজেডি। আবারও ক’দিন শোরগোল হবে হয়তো। ক’টাকা ‘ক্ষতিপুরণ’ দেওয়া হবে। ভাগ্য ভালো হলে দু-একজন পরিবারের কেউ কেউ চাকরি পাবে, কিংবা কারও কারও ভেঙে যাওয়া বিয়েও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হবে হয়তো। কিন্তু পুরানো ঢাকার চিত্র পাল্টাবে না এতোটুকুও। সেই কটু গন্ধময় গিজগিজে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সেই জ্যামে আটকে থাকা অথর্বের জীবন চলতেই থাকবে।
পুরানো ঢাকার চারপাশে গড়ে উঠা অপরিকল্পিত কলকারখানার বর্জ্য থেকে ইতিমধ্যে বুড়িগঙ্গা সাবাড়। এই প্রজন্ম বিশ্বাসই করবে না এই বুড়িগঙ্গার কারণেই আজকের ঢাকার গোড়াপত্তন হয়েছিল। একদিন এই বুড়িগঙ্গারও টলটলে পানি ছিল। তখনকার নবাবজাদারা বৈকালিক বিনোদনে এই বুড়িগঙ্গার তীরেই যেতেন। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বুড়িগঙ্গাকে আর ফেরানো যাবে কিনা সন্দেহ আছে। সেই সাথে বড় ধরণের ভুমিকম্পে কে বলতে পারে গোটা পুরানো ঢাকারই হয়তো সলিলসমাধি রচিত হবে!
এই এলাকার বাইরের অনেকেই জানেন না যে, এই অঞ্চলে বিল্ডিং উঠে ওয়াল শেয়ারিং করে। অর্থাৎ পাশাপাশি দুইটা ভবনের একটা দেওয়াল শেয়ার করা থাকে। মানে, ধরুন চার দেয়ালে কলিমুদ্দিন একটা ভবন উঠালেন। এর এক বছর পর তার পাশে ছলিমুদ্দিন ভবন উঠাবেন তিন দেওয়ালে। বাকী দেয়ালটা কলিমুদ্দিন থেকে শেয়ার করবে সে। রাজউক আছে। সিটি কর্পোরেশন আছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় আছে। রাষ্ট্রও নাকি আছে!
কিন্তু দেখার কেউ নেই। বিল্ডিং উঠছে। বিল্ডিং প্ল্যান পাশ হচ্ছে। ভবন উঠানোর অনুমতি মিলুক না মিলুক ভবন উঠছেই। ফলে মানুষ মরছে। মানুষ মরবে আরও। খেয়াল করবেন চুড়িহাট্টার এই ট্রাজেডিতে প্রচুর মানুষ রাস্তায় মারা পড়েছে। কারণ ছুটে পালানোর রাস্তাটুকু অবশিষ্ট নেই পুরানো ঢাকায়।
ড. মাকসুদ কামালের একটা কথা দিয়ে শেষ করি—
ঢাকা শহর বড় ধরনের ভূমিকম্পের কবলে পড়লে ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে যত মানুষ মারা যাবে, তার কয়েক গুণ মারা যাবে আগুনে পুড়ে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। কারণ ভূমিকম্পের পর গ্যাসের লাইনের পাইপে বিস্ফোরণ ঘটবে আর সেই আগুনে পুরো নগর দাউ দাউ করে জ্বলবে।
ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে তাতে আধঘণ্টার মধ্যে উদ্ধারকাজ শুরু করা গেলে ৯০ শতাংশ মানুষকে বাঁচানো যাবে। উদ্ধারকাজ শুরু করতে এক দিন লাগলে ৮১ শতাংশ, দুদিন লাগলে ৩৬ শতাংশ এবং তিনদিন লাগলে ৩৩ শতাংশ মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। উদ্ধারকাজ শুরু করতে যত বেশি বিলম্ব হবে মৃতের সংখ্যা তত বেশি বাড়বে।
ড. কামালের এই বক্তব্য গোটা ঢাকা শহর নিয়ে। এবার ভাবুন জরুরি পরিস্থিতিতে পুরানো ঢাকার কী হবে? কত দেরি হবে পুরানো ঢাকায় উদ্ধারকাজ শুরু করতে? কেউ বলতে পারেন? ধারণা করতে পারেন? ভেবেছেন কখনও?