সোমেন বসু
শুরু করা যায় সেই ১৯২৭ সাল থেকে। সেই বছর থেকেই ব্রিটিশরা লাগু করেছিল ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৯২৭। যে আইনে জঙ্গলে “অনুমতি ছাড়া যে কোনও রকম কার্যকলাপই নিষিদ্ধ” বলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে ফ্রি হ্যান্ড দেওয়া হয়। কার্যকলাপ বলতে জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসী জনগণের কার্যকলাপ বলাই বাহুল্য। তাদের কাজকর্ম নিষিদ্ধ করতে হবে কারণ তারা জংলি, বর্বর। তারা জঙ্গলে শুকনো পাতাপুতা জ্বালিয়ে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে তাতে টুকটাক চাষাবাদ করে। এই দহনকার্যের ফলে মাটির সার হয়, মাটি পুষ্ট হয়, যা ঘুরিয়ে আবার জঙ্গলকেই পুষ্ট করে। তাই এই চাষ-পদ্ধতি, যার পোশাকি নাম সুইডেন (Swidden) এগ্রিকালচার, সম্পর্কে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বলেছিল, এই চাষীরা সদর্থকভাবে জঙ্গলে আগুন লাগান[1]।
কিন্তু ওরা তো জংলি, বর্বর, জঙ্গলে থাকে। সভ্যতা, বিজ্ঞান এসব ওরা কী বোঝে! অতএব, অনুমতি ছাড়া ওদের কিছুই করা চলবে না।
করবে সুসভ্য ব্রিটিশরা। জঙ্গলে খামারবাড়ি হবে, ফুর্তিফার্তা এবং বীরত্ব দেখিয়ে কিছু শিকার টিকার হবে, আর সর্বোপরি দখল নেওয়া হবে জঙ্গলের অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদের।
ব্রিটিশদের লুঠেরা বলে প্রকাশ্যে গালি দিয়ে এবং প্রভু বলে গোপনে প্রণিপাত করে সরিয়ে রাখা যায়। বরং শুরু করে যায় ব্রিটিশ-পরবর্তী ভারত থেকে।
এবারের শব্দ উন্নয়ন। আমাদের নবজাত রাষ্ট্র বড় নদীবাঁধ প্রকল্পকে সেই সময় উন্নয়নের প্রধান সোপান ঠাউরেছিল।
স্বাধীন ভারতে শুধুমাত্র বড় বড় নদীবাঁধ প্রকল্পের জন্য উচ্ছিন্ন মানুষের ৪০ শতাংশ আদিবাসী জনতা। জনসংখ্যার বিচারে মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হলেও। নেহরু বলেছিলেন আদিবাসী জনগণ দেশের স্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করছেন।
এই গেল আদিকথাবস্তু বা প্রস্তাবনা (শব্দঋণ : অভীক ভট্টাচার্য[2])। মূলকথাবস্তু হল গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট এক দশকেরও বেশি চলা একটি মামলার রায় দিয়ে প্রায় ১৮ লক্ষেরও বেশি আদিবাসী এবং অরণ্যবাসী মানুষকে তাঁদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকারগুলিকে। কারণ তাঁরা প্রমাণ করতে পারেননি যে তাঁরা অন্তত তিন পুরুষ ধরে নিজেদের ভিটেয় বসবাস করছেন। রাজ্য সরকারদের নির্দেশ, এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া ২৭শে জুলাইয়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
রায়টি, স্বাভাবিকভাবেই, ‘বিস্ময়কর’ ‘দানবিক’ ইত্যাদি আখ্যা পাচ্ছে[3]। আবার একই সঙ্গে কারও কারও অভিবাদনও। সেটাও অস্বাভাবিক নয়, কারণ এই রায়টি দেওয়াই হয়েছে একটি পিটিশনের প্রেক্ষিতে, ফলে পিটিশনকারীদের উল্লসিত হওয়ার কারণ তো থাকেই।
সে কথা থাক। যে তিনটি বিষয় এই রায় প্রসঙ্গে আলোচিত হওয়ার দরকার বলে মনে হচ্ছে, সেগুলি বরং করা যাক।
প্রথমত, সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ের মধ্যে যে মনোভাবের পরিচায়ক, তার সঙ্গে ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৯২৭-এর প্রণেতা ব্রিটিশদের মনোভাবের কতটা অমিল? যদি তর্কের খাতিরে ধরেই নিই যে যাঁদের উচ্ছেদ করার কথা বলা হয়েছে তাঁরা সত্যিই বেআইনি বসবাসকারী, অর্থাৎ ২০০৬-এর ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্টের আইনি বসবাসকারীর সংজ্ঞা অনুযায়ী তিন পুরুষ ধরে একটি নির্দিষ্ট জমিতে থাকেন না, তবেই তাকে উচ্ছেদ করে দেওয়া যায় পরিবারশুদ্ধু, তাঁর জীবন জীবিকাকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়ে? ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক শাসক, লুণ্ঠনের স্বার্থে আমাদের দেশে রাজত্ব করে গেছে, দেশের জনগণের প্রতি তাদের দরদ থাকবে এমন প্রত্যাশা কেউ করে না। কিন্তু আমাদের এই স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের সরকার বা সর্বোচ্চ আদালত? আদৌ তফাত করতে পারছে তো নিজেদের সেই ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে? নাকি আমাদের স্বাধীনতা স্রেফ ‘তথাকথিত’, আসলে আমাদের শাসকেরা সেই ব্রিটিশ লেগ্যাসিই বহন করে চলেছেন স্পর্ধা এবং গৌরবের সঙ্গে?
স্পর্ধা এবং গৌরবের প্রকৃষ্ট নমুনা হল, এই রায় দেওয়ার সময় সুপ্রিম কোর্ট একবারও মনে রাখল না, এবং সরকার পক্ষের আইনজীবীও তাদের মনে করিয়ে দিল না যে, যে আইন নিয়ে তাদের এই মামলা শুনতে হচ্ছে, সেই আইনেই পরিষ্কারভাবে অরণ্যবাসী জনগণকে এরকম সরাসরি উচ্ছেদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যদি বেআইনি-ই হয়, তবে নোটিস পাঠাতে হবে, তাঁদের আবেদন করার সুযোগ দিতে হবে, তারপর নির্ধারিত হবে পরবর্তী প্রক্রিয়া— এমনটাই বিধান ২০০৬-এর ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্টের।
দ্বিতীয়ত, এটি একটি চলমান বিতর্ক। পরিবেশ নিয়ে এখন আকবর বাদশা থেকে থেকে হরিপদ কেরানি সবাই কমবেশি চিন্তিত, বা অন্তত চিন্তার ভান করে থাকেন। উপায়ও নেই। পরিবেশ তথা প্রকৃতিকে যথেচ্ছ ছিবড়ে করে দেওয়া হয়েছে, এবং প্রকৃতি বদলাও নিচ্ছে মাঝেমধ্যেই বিভিন্নভাবে। চেষ্টা করেও এর থেকে চোখ বুজে থাকা যাচ্ছে না। বিতর্কের বিষয়টি হল, এই পরিবেশ রক্ষার মূল দৃষ্টিভঙ্গিটি কী হবে বা হওয়া উচিত? পরিবেশ রক্ষা বলতে কি আমরা শুধুই গাছপালা নদীনালা পাহাড়জঙ্গল এবং এসবে বিচরণকারী মনুষ্যেতর প্রাণীকুলকে বুঝব, নাকি তার সঙ্গে যুক্ত করব মানুষকেও, যে মানুষ নিবিড়ভাবে এই প্রকৃতির সঙ্গে লেপটে থাকেন? যদি দ্বিতীয়টির পক্ষে মত দেন তবে আসবে আরও একটি প্রশ্ন। মানুষকে যুক্ত করব কেমনভাবে? যেমনভাবে যুক্ত করি অন্য প্রাণীদের, আমাদের কৃপাপ্রার্থী হিসেবে? নাকি তাঁদেরই প্রথম স্থান দিয়ে নির্ভর করব তাঁদের ওপর, মেনে নেব যুগ যুগ ধরে পরিবেশ এবং প্রকৃতি রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকার কথা, যা আসলে তাঁদের জীবনচর্যারই অঙ্গ, তাই অত্যন্ত সহজ, অত্যন্ত স্বাভাবিক? নতজানু হব তাঁদের প্রতি?
এই বিতর্কের কথা আসছে, কারণ সুপ্রিম কোর্টের রায়টি যে মামলা তথা পিটিশনের প্রেক্ষিতে সেটি করেছিল ওয়াইল্ডলাইফ ফার্স্ট[4] সহ আরও কিছু সংস্থা। যাদের মূল দাবি হল ২০০৬-এর আইনটি অসাংবিধানিক। কারণ ২০০৬-এর আইনে বনভূমির ওপর আদিবাসী এবং অন্যান্য অরণ্যবাসী জনগণকে আইনি অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। পিটিশনকারী সংগঠনগুলির বক্তব্য, এতে দীর্ঘমেয়াদি অরণ্য সংরক্ষণ এবং অরণ্যের জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে উল্লেখ্য, ভারতে কিন্তু সেই ১৯২৭-এর ব্রিটিশ আইনটিই বলবৎ রয়েছে, এবং তার ৮০ বছর এবং ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার ৬০ বছর পরে স্বাধীন ভারত সরকারের অরণ্যবাসী জনগণের প্রতি কিছু মলমসুলভ দায়িত্ববোধের প্রেরণায় এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এবং তার দুবছরের মধ্যেই, ২০০৮ সালে আইনটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়।
এই রায়ে পরিষ্কার, পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টও মানুষকে বাদ দেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী।
বিতর্কটি, বিতর্কদের স্বাভাবিক চরিত্র অনুযায়ী, দীর্ঘ। তার মধ্যে এখন ঢুকব না। কিন্তু তা বলে নিজের মতটা গোপনও রাখব না। যে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে ওঠে বসে, সেই মানুষকে বাদ দিয়ে প্রকৃতি বা পরিবেশ রক্ষার কথা যারা বলে তারা হয় মূর্খ নয় যান্ত্রিক নয় পরিবেশ রক্ষা ব্যতীত তাদের ভিন্ন কোনও অভিসন্ধি আছে। কারণটা পরিষ্কার এবং সরল। ঐ মানুষগুলির সঙ্গে পরিবেশের মিথোজীবিতার সম্পর্ক। পরিবেশ রক্ষা করাটা তাদের জীবন রক্ষারই একটি অঙ্গ। বাইরে থেকে তত্ত্বকথা আওড়ানো যায় অজস্র, জীবন দিয়ে পরিবেশের বা প্রকৃতির মর্ম উপলব্ধি করা যায় না।
দুটো তথ্য থাক এর সঙ্গে। গত তিরিশ বছরে আমাদের দেশের সুসভ্য এবং পরিবেশ রক্ষার জন্য দায়বদ্ধ বিভিন্ন সরকার মোট ৫৪০০ বর্গ মাইল বনভূমির চরিত্র পালটে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিয়েছে[5]। এবং এই ২০১৮-র শেষদিকেই ওড়িশার ঝিঙ্কারগড়ি জঙ্গলকে তথাকথিত উন্নয়নের নামে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন সেখানকার মানুষ[6]। মনে করিয়ে দিয়েছেন ঐতিহাসিক চিপকো আন্দোলনের স্মৃতি।
এই প্রসঙ্গে একটি বইয়ের কথা বলে এই পয়েন্টটি শেষ করি। কানেক্টিকাট ইউনিভার্সিটির পলিটিকাল সায়েন্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর প্রকাশ কাশওয়ান তার Democracy in the Woods : Environmental Conservation and Social Justice in India, Tanzania and Mexico। পারলে পড়ে নেবেন।
এবং শেষত। যে ফ্যাসিস্ট জমানার অধীনে আমাদের দেশ গত পাঁচ বছর অতিবাহিত করছে তাদের ভূমিকা। খুব কি আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে যে সরকারের তরফে সুপ্রিম কোর্টে প্রায় কোনও সওয়ালই করা হল না। এবং এতেও আশ্চর্যের কিছু নেই যে, এত বড় একটি রায়ের পরও সরকারি দল এখনও অবধি মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। স্বাভাবিক। এই সরকারের জমানাতেই আমরা ৪০ লক্ষ মানুষকে ভিটেমাটি তো দূর স্থান, দেশহীন হয়ে যেতে দেখেছি। দেখে চলেছি ধর্ম, জাত ইত্যাদি নিয়ে জনজীবনে নানান বর্বরতার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুশীলন। আর এই অরণ্যবাসী আদিবাসীদের প্রসঙ্গে? আবার দুটি তথ্য।
২০০৬-এর আইনে যে আইনি বৈধতার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বলে আগে বললাম, সেই বৈধতার পরীক্ষা চলছে সমস্ত রাজ্যেই বেশ কিছুদিন ধরে। তা এর মধ্যে, একটা নমুনা দিই, গুজরাট সরকার অন্যন্য কাগজপত্রের সঙ্গে জমির উপগ্রহ চিত্র চেয়েছে[7]! জঙ্গলে থাকা দিন-আনা-দিন-খাওয়া আদিবাসী জনগণের কাছে জমির উপগ্রহ চিত্র!
বস্তার অঞ্চলে খনি গড়ার জন্য আম্বানি আদানি বা অন্যদের নজর যেসব বনাঞ্চলে পড়ে, সেখানে আগে মিলিটারি ক্যাম্প বসে সেখানকার আদিবাসীদের উৎখাত করার জন্য। আরও যা সব বর্বরতা হয়, তা আমরা এই চার নম্বর প্ল্যাটফর্মেই অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তীর লেখায়[8] পড়েছি।
ফলে, সব মিলিয়ে, সুপ্রিম কোর্ট একদমই নতুন কিছু করেনি। বরং রাজ্য সরকারগুলি তাদের ভূতপূর্ব ব্রিটিশদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই অরণ্যবাসী আদিবাসী জনগণের ওপর যে বর্বরতা চালিয়েই যাচ্ছে[9], তাকেই আইনি সিলমোহর দিয়েছে মাত্র। এবং ইস্যুটি শুধুমাত্র পরিবেশেই আবদ্ধ নেই, বরং আপাদমস্তক রাজনৈতিক। রাস্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর মীমাংসা সম্ভব।
[1] https://news.nationalgeographic.com/2016/03/160303-thailand-farmers-slash-and-burn-forests-climate-environment/
[2] https://www.4numberplatform.com/?p=3808
[3] https://www.washingtonpost.com/world/2019/02/22/india-orders-staggering-eviction-million-indigenous-people-some-environmentalists-are-cheering/?noredirect=on&utm_term=.94487a8dafe9
[4] http://www.wildlifefirst.info/
[5] https://scroll.in/article/809286/in-just-30-years-india-has-lost-large-forests-to-23716-industrial-projects
[6] https://www.4numberplatform.com/?p=9731
[7] https://scroll.in/article/914095/ten-lakh-forest-dwellers-face-eviction-because-of-centres-weak-legal-defence-claim-activists
[8] https://www.4numberplatform.com/?cat=800
[9] https://www.prsindia.org/uploads/media/1167469383/bill53_2007010353_Nac_note_on_tribal_eviction.pdf
অরণ্যবাসী এই এতগুলো মানুষ এখন কোথায় যাবেন! উচ্ছেদ উৎসব যে আন্তরিকতায় হলো, উচ্ছেদ হওয়া জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে ততটা আন্তরিকতা দেখানো হবে? কী জানি… ‘আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক’ অরণ্যবাসী জনগোষ্ঠী বা তাদের মত’রা তো আসলে কোন দেশ বিলং করেন না। তাদের কোন দেশ থাকতে নেই। কাজেই খামোখাই প্রতিরোধ, প্রতিবাদে, শক্তিক্ষয়ের বোকামিতে আমি নাই। সরি!