পাশাখেলা
আর কী বাজি রাখার আছে বলুন?
ভাবছি।
ভাবার মতো এখনও কিছু বাকি আছে?
সেটাই তো ভাবছি।
এই সমূহ বৃক্ষ, নদী, আকাশ, বাতাস, খনিজ— একে একে সবই বাজি রেখে হেরেছেন আপনি। আরও কিছু আছে নাকি যে বাজি ধরবেন?
একটা জিনিস আছে মনে হচ্ছে।
কী বলুন তো?
আমার ভোট, ভোটাধিকার।
বলেন কী!
কেন, তোমাদের গণতন্ত্রে তো সকলের জন্যই ভোটের অধিকার আছে। আমারও থাকা উচিত।
বেশ তর্কের খাতিরে ধরলাম তা আছে। কিন্তু সে আর এমন কী মূল্যবান!
বলো কী! একমাত্র সেটাই তো মূল্যবান। ধনী, গরিব, ব্রাহ্মণ, শুদ্র— এই একটা জায়গাতেই সমান। রাজার ঘরে যে ধন, টুনির ঘরেও সে ধন। মজার ব্যাপার! অন্তত তোমরা তো তাই-ই সাব্যস্ত করেছ বাপু।
করেছি। কিন্তু একটা ফাঁকও যে আছে হুজুর। আপনার মনে হয় নজরে পড়েনি, এ অধিকারের জোর তখনই খাটে, যখন আমরা নির্বাচন ঘোষণা করব এবং সেই নির্বাচনে আপনাকে ভোট দিতে অনুমতি দেব। অর্থাৎ আপনার অধিকার তখনই গ্রাহ্য, যখন আমরা বলব গ্রাহ্য। নতুবা নয়। ও অধিকার একরকম আমাদের কাছেই বন্ধক আছে ধরে নিতে পারেন। তা ছাড়া একবার ভোট মিটে গেলে, এ অধিকার ব্যবহার করে আর কিছু করাও যায় না।
তাও বটে!
তাহলেই বুঝছেন… ওটি বাজি রাখার জো নেই।
তাই-ই তো দেখছি। সামনে একটাও ভোট নেই, না?
আজ্ঞে না। আবার সেই পাঁচ বছর পরে।
তাহলে?
তাহলে আবার কী, ওটা বাজি রাখার ভাবনা ছেড়ে এবার মানে মানে পরাজয় স্বীকার করে নিন।
পরাজয়ের পরিণাম?
আপনাকে ঈশ্বর হয়ে উঠতে হবে।
কিন্তু, আমি তো তাই-ই।
তা বটে! কিন্তু এবার আপনি হবেন মানুষের ঈশ্বর। মানুষ বলবে বটে আপনি সর্বশক্তিমান, কিন্তু জানবে, আপনার শক্তি তার হাতেই বাঁধা। আপনি আসলে শক্তিরহিত।
তাহলে এখন নতুন ঈশ্বর কে হবেন?
কেন? ধরুন, ভোটাধিকারই হল নতুন ঈশ্বর…
কিন্তু সেও তো আসলে মানুষের হাতেই…
অট্টহাস্যে বিদীর্ণ হয় রাত্রি। কেউ কেউ শুধু শোনে ডাকছে, কুকুর ডাকছে…
অন্তর্ধান
কুকুর ডাকছিল। কিন্তু, কুকুর কাকে ডাকছিল? অপর একটা কুকুরকে নাকি মানুষকে? নাকি সে সবাইকেই জাগিয়ে দিতে চাইছিল?
তখন চাঁদ উঠেছে খুব। নেশার ঘোর খানিক ফিকে হয়েছে। অথবা নেশা এখন এমন স্তরে পৌঁছেছে, যখন নেশাকে আর আলাদা করে নেশা বলে মনে হয় না। এমন সময় জানলা থেকে বড় পুকুরের দিকে তাকিয়ে দেখল সুধন্য। সুধন্য হালদার। বয়স ৩৫। অবিবাহিত। কী করে কেউ জানে না। সে নিজেও ঠিক জানে না। তবে রাতে নেশা করে।
এই সুধন্য দেখল, পুকুরের জলে ভেসে যাচ্ছে নারকেল পাতার ছায়া আর প্রশ্নেরা— যে কুকুর কাকে ডাকছিল?
সুধন্য চোখ কচলায়। কারণ তার বিস্ময় জাগে। কারণ সে বুঝতে পারে, ওসব প্রশ্ন নয়। আসলে এক নারীর দীর্ঘ কেশরাশি ভেসে ভেসে চলেছে বড় পুকুরের জলে। এপার থেকে ওপার। আবার ওপার থেকে এপার।
ডুবসাঁতার! এতক্ষণ! এই মাঝরাতে!
কে এই মেয়ে? তাকে তো দেখা যায় না। সে জানায় না, আদপে সে কীরকম! শুধু ওই দীর্ঘকেশ যেন বলছে, সে অপরূপা, অদ্বিতীয়া। যেন ওই ডুবসাঁতার জানাচ্ছে, একবার তাকে জল থেকে টেনে তুলে ভেজা শরীরখানা দুই বাহুর মধ্যে পেলেই পরিচ্ছন্ন একটা ভোর হবে।
সুধন্যর শরীরটা হালকা লাগে। মনটাও। পুলিশ, পার্টি আর পিস্তলের ভয়টা আচমকা কর্পূরের মতো উবে যায়। সুধন্য শান্তি পায়। বুঝতে পারে, ওই ডুবসাঁতারের নারীতেই তার মুক্তি।
রাত তখন নিবিড় হয়ে আসে। সুধন্য সন্তর্পণে পুরনো বাড়ির দরজা খুলে নেমে আসে। একবার তাকিয়ে দেখে। বাড়িখানা এক অজগরের মতো ঘুমোচ্ছে। কেউ জেগে নেই। সত্যি বলতে, কেউ নেই-ই।
বড় পুকুর বেশ গভীর। গভীর মানে অতলান্ত। সুধন্য আসতে আসতে জলে নামে। নামতে থাকে। দীর্ঘ কেশ ভেসে যায়, হাতছানিতে। সুধন্য জল ঠেলে ঠেলে এগোতে থাকে।
কুকুর তখনও ডাকছিল।
কাকে!
রৌদ্র-ছায়া
সূর্যালোক অকৃপণ! সাম্যবাদী! বিশ্বাস করে না মধুপর্ণা। এ নিয়ে একবার তর্ক হয়েছিল খুব। অদ্বয়ের সঙ্গে। প্রেমিক তার। পজেসিভ। কিন্তু সে আলাদা ব্যাপার। অদ্বয়ের যুক্তি ছিল, সূর্যালোক কাউকে বঞ্চিত করে না।
কিন্তু মধুপর্ণা দেখেছে, খেয়াল করেছে, পাতার দু-পিঠে সবুজের দুরকম রং। একপিঠে গাঢ়, অন্যদিকে একটু ফিকে। কেন? একদিক সূর্যের প্রতি উন্মুক্ত। অন্যদিকের ছায়ার কাছে সমর্পণ। তার মানে সূর্যালোক সর্বত্র সমান উদার নয়। হওয়া সম্ভবও নয়। অর্থাৎ সিস্টেমের ভিতরই খানিক দ্বিচারিতা আছে। সূর্যের আলোর এহেন সমুদ্রে ডুব দিয়েও কেউ একটু কম ভিজে উঠতে পারে। অথচ রোদ্দুরের সমুদ্রকে তো তাই নিয়ে দোষ দেওয়া যাবে না।
দিলেও অদ্বয় মানবে না। যেমন সে মানছে না। এই এখন। ফোনের ওপারে। আবার কথায় কথায় সেই তর্ক ফিরে এসেছে। স্নান শেষে এখনও ভেজা চুল মোছেনি মধুপর্ণা। মাথায় গামছা জড়ানো চুড়ো করে। আজ ছুটি। তার এই একতলার ভাড়াঘরের জানলায় এখন রোদ্দুর আসবে। মধুপর্ণা চুল মেলে দাঁড়াবে জানলায়।
ঘরোয়া পোশাক গায়ে চাপিয়ে জানলাটা তাই খুলে দেয় সে। অদ্বয় এখনও ফোনে। তর্ক করছে সমানে। ব্যাপারটা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে এই জায়গায়— মানুষের প্রকৃতির মধ্যেও এই দ্বিচারিতা আছে। তাই বলে সমগ্র মানুষকে কি দোষ দেওয়া যায়! দিলেই বা আপত্তি কী, বলছে মধুপর্ণা। মানুষ কেন মেনে নিতে পারবে না, অকৃপণ রোদ্দুরের ভিতরও খানিক ফিকে সবুজ থাকতে পারে! ইন ফ্যাক্ট আছেই।
কথা বলতে বলতে মধুপর্ণার খেয়াল হয়, আরে! জানলাটা তো খোলাই। আর ছেলেটা! দোতালার মেস থেকে যে তার জানলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে! মধুপর্ণাকে দেখেও যে সরে না। সেও কি এখন দাঁড়িয়ে আছে! খুব আলতো করে ঘাড়টা একটু কাত করে মধুপর্ণা। দেখে, আছে ছেলেটি। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আর সিগারেট খাচ্ছে।
মধুপর্ণা সরে না। জানলার সামনে এসে প্রথমে খুলে দেয় ভেজা চুল। ঘাড় ঘুরে বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। জাপটে ধরে রোদ্দুরকে। রোদ্দুর পেয়ে ঝিকিয়ে ওঠে মধুপর্ণার নাকছাবি। মুখখানা আয়নার হয়ে ওঠে তার। সেসব সে দেখে না। তবে জানে না কি!
ছেলেটি দাঁড়িয়েই আছে। অদ্বয়ের বকবকও থামেনি।
রোদ্দুরের সমুদ্রে এখন মধুপর্ণা আলগোছে টাঙিয়ে দিতে থাকে তার ভিজে অন্তর্বাসগুলো।