অবিন সেন
১ম পর্বের পর
দুই
অর্কর জন্য অপেক্ষা করে করে তিন কাপ চা শেষ হয়ে গিয়েছে তন্ময় সামন্তর। বসার ঘরের উল্টো দিকের সোফায় বসে প্রবাল একটা কম্পিউটার ইলেকট্রনিক ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। পাশের ঘরে তনুকা মোবাইলে কার সঙ্গে বকবক করছে। বেশ চেঁচিয়েই কথা বলছিল সে। বসার ঘর থেকে তার টুকরো টুকরো গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
প্রবাল ম্যাগাজিনটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল—
–আপনার সাহেব বোধ হয় আর আসবে না।
সামন্ত কিছু বলল না। সম্মতিসূচক ভাবে হাসল।
প্রবাল মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলল—
–দাঁড়ান একবার ফোন করে দেখি।
অর্কর ফোন বেজে বেজে কেটে গেল। ফোন রিসিভ হল না। প্রবাল দু-দু-বার ট্রাই করল। দ্বিতীয়বারও যখন অর্ক ফোন রিসিভ করল না তখন যেন কিছুটা বিরক্ত হল প্রবাল। বলল—
–মনে হয় আর আসবে না। রাত নটা বেজে গেল! আর কখন আসবে! বরং, আপত্তি না থাকলে আপনি শুরু করুন।
–না স্যার, আপত্তি কীসের?
তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রবাল বলল—
–আমাকে কিন্তু স্যার বা সাহেব বলবেন না। নিন শুরু করুন…
সামন্ত তখনই শুরু করল না। সে ধীরস্থিরভাবে হাতের বাঁধা ফাইলটা খুলে একটা ছবি বার করল। পোস্টকার্ড মাপের। আবক্ষ এক পুরুষের ছবি। ছবিটা প্রবালের হাতে দিয়ে সে শুরু করে—
–ইনি হলেন রাহুল বৈদ্য। বয়স মধ্য ত্রিশ। ছবি দেখেই বুঝতে পারছেন বেশ চোখে লাগার মতো চেহারা। মতিঝিল কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেছিল। সেখানে সে ছাত্রনেতাও ছিল। তবে তখন সে ছিল বামপন্থী। লম্বায় প্রায় ছ-ফুট। টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো ছাড়িয়ে নাকতলার দিকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে একটা গলির মধ্যে এঁদের তিনতলা বাড়ি। বনেদি পরিবার নয়। তবে তিন পুরুষ ধরে এখানেই বসবাস করছেন। আগে একতলা বাড়ি ছিল। প্রোমোটারি করে বছর পাঁচেকের মধ্যেই অঢেল টাকার মালিক হয়ে গিয়েছিলেন। একতলা বাড়িটা ভেঙে একেবারে আধুনিক স্টাইলে তিনতলা বাড়িটা বানিয়েছেন বছর দুই হল। এক মন্ত্রীর সঙ্গে এঁর ওঠাবসা ইদানীং খুব বেড়েছিল।
সামন্ত একটু থামল। সামনে রাখা গ্লাস থেকে কয়েক ঢোক জল খেল। তনুকার ফোনে কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। রহস্যের গন্ধ পেয়ে সেও এসে বসেছে প্রবালের পাশে।
সামন্ত আবার শুধু করল—
–এবার রাহুলের পারিবারিক দিকের কথায় আসি। এখন বাড়িতে শুধু এঁর মা আর এক দূর সম্পর্কের কাকা থাকেন। কাকার প্রসঙ্গ পরে আসবে। রাহুলের এক ভাই ছিল রোহণ। সেও দাদার সঙ্গে ব্যবসার দেখভাল করত। বছর খানেক আগে রোহণ সুইসাইড করে।
তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রবাল রিপিট করল—
–সুইসাইড?
–কেসটাকে সেই ভাবেই সাজানো হয়। র্যাদার চাপা দেওয়া হয়। না হলে পুলিশের মনে যথেষ্ট ডাউট ছিল।
–কীরকম ডাউট?
–রাহুলই হয়ত তার ভাইকে খুন করেছে বা করিয়েছে।
–কারণ হিসাবে কী অনুমান আপনাদের?
–নিখোঁজ অভিনেত্রী বিশাখা দত্ত আসলে ছিল রোহণের গার্ল-ফ্রেন্ড। রোহণের এক বন্ধু পুলিশের কাছে এসে উপযাচক হয়ে এমনটাই জবানবন্দি দিয়েছিল। এটা অবশ্য রোহণের মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পরে। যেহেতু ততদিনে কেসটা ক্লোজ করে দেওয়া হয়েছে। তাই বিষয়টার আর কোনও তদন্ত হয়নি। যাক, আবার রাহুলের কথায় আসি। রাহুল বছর দশেক আগে নাকতলার এক অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়েকে ফুসলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। সে নিয়েও বেশ হইচই হয়েছিল। তাদের বিয়েটা টিকেছিল বছর খানেক। তখন রাহুলের অবস্থা এখনকার মতো এত ভালো ছিল না।
প্রবাল বলল—
–সেই মহিলা এখন কোথায়?
–তিনি আবার বিয়ে করে সুখে সংসার করছেন বলে খবর। সেই কারণেই আমরা আর তাঁকে এই কেসে এখনও জড়াইনি।
–আচ্ছা। এবার রাহুলের খুনের ব্যাপারটা বলুন।
তন্ময় সামন্ত যেন শশব্যস্ত হয়ে একবার ঘড়ি দেখল। রাত হয়ে যাচ্ছে। সে আবার শুরু করল–
–রাহুল বৈদ্যকে তার বসার ঘরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে সোফায় বসে তিনি নিজেরই নিজের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়েছেন।
প্রবাল ইন্টারাপ্ট করল–
–মনে হবে কেন? এমনটা নয় বলে আপনাদের মনে হচ্ছে কেন?
–বেশ কয়েকটা খটকা আছে। তবে আমি স্যার আপনাকে ক্রাইম স্পটে না নিয়ে গেলে ঠিক বোঝাতে পারব না।
প্রবাল ঘাড় নাড়ল।
–আচ্ছা। তা নায়িকাকেই তো আপনারা খুনি ভাবছেন। তাকে খোঁজার চেষ্টা করেননি?
–তা করছি, স্যার।
প্রবাল ধমক দিল।
–আবার স্যার?
সামন্ত জিভ কেটে বলল—
–ওটা স্লিপ করে বেরিয়ে গেল স্যার।
সে হেসে ফেলল।
প্রবালও হাসতে হাসতে ঘাড় নাড়ল। ঠিক আছে আপনি শুরু করুন।
–নায়িকাকে খোঁজার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সেখানেও ডাউট আছে।
–কীরকম ?
–আমাদের মনে হচ্ছে নায়িকা আগে থেকেই বেপাত্তা। মানে রাহুল খুন হবার আগে থাকেই। কারণ বিশাখার শুটিং ছিল সেদিন দুপুরে। সে শুটিঙে গিয়েছিল। যখন মেকআপ চলছিল তখন তার মোবাইলে একটা ফোন আসে। ফোনটা আসার পরেই সে মেকআপ আর্টিস্ট রেখা দাশকে “আমি একটু আসছি”, বলেই খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। আর ফেরেনি। আমরা তার ফোন নাম্বার ট্র্যাক করে দেখেছি। তার ফোন এই ঘটনার আধ ঘণ্টা পরে খিদিরপুর এলাকায় ছিল। তারপরেই সুইচ অফ হয়ে যায়। তারপর থেকে এখনও ট্রেস করা যায়নি। হয়ত সিম খুলে ফেলে দিয়েছে।
–আপনারা রেখা দাশকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন?
–করেছি। কিন্তু সে বেশ শক্ত ঠাঁই। সহজে মচকাবে না। আমাদের একটু খেলাতে হবে।
–তা কী মনে হয়েছে আপনাদের? সে কিছু জানে?
–মনে হয়েছে তার পেটে কিছু আছে। কিন্তু খুব বেশি কিছু আছে বলে মনে হয় না।
–কেন?
–সে সামান্য কিছুদিন হয়েছে বিশাখার মেকআপ আর্টিস্টের কাজ পেয়েছে।
–এই কাজটা নিশ্চয়ই এমনি এমনি পায়নি। কেউ তাকে কাজে লিগিয়েছে। কে সে?
সামন্ত এবার একটু মৃদু হাসল।
–আমাদের কাছে খবর এই কাজটা রাহুল বৈদ্যই তাকে পাইয়ে দিয়েছিল।
প্রবাল নিজের মনে একটু মাথা নাড়ল।
–আই সি। তার মানে কী এটা হচ্ছে না যে রাহুলই তার গার্লফ্রেন্ড বিশাখার পিছনে চর লাগিয়েছিল!
সামন্ত এই কথায় সায় দিল। বলল–
–আমারও স্যার এমনটাই মনে হয়েছে।
প্রবাল আবার বলল।
–ইদানিং রাহুল আর বিশাখার সম্পর্ক কী খারাপ হয়েছিল?
–সেরকমই মনে হয়েছে। দু জনের আলাদা শোবার ঘর।
প্রবাল যেন এই উত্তরে কিছু বিরক্ত হয়। কিছুটা শ্লেষের ভঙ্গিতেই যেন বলে–
–দুর! আলাদা ঘরে শুলেই কি সম্পর্ক খারাপ হয়? আপনিও যেমন!
সামন্ত যেন প্রবালের কথায় মুষড়ে পড়েছে এমনি হতাশার ভঙ্গিতে বলল–
–না মানে, ঝগড়া হলে আমাকে পাশের ঘরে গিয়ে শুতে হয় কিনা! তাই!
প্রবাল হেসে ওঠে। সেই সঙ্গে তনুকাও। তার পরে হাসিটা পাতলা হয়ে এলে তনুকা যেন এক হাত দিয়ে মুখের হাসিটা মুছে নিয়ে বলে–
–উনি তো ঠিকই বলেছেন।
প্রবাল হাসিটা গিলে নিয়েছে এমন ভঙ্গিমায় বলে–
–তা, আশে-পাশের লোকের কাছ থেকে বা ইন্ডাস্ট্রির ভিতরে এমন কোনও কথা শুনেছেন কি যাতে করে মনে হয়েছে ওদের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল।
সামন্তর মুখে তখনও তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা লেগেছিল। সে হাসিটাকে মিলিয়ে যেতে দেয় না, সেটাকে মুখের কানাচে ঝুলিয়ে রেখে বলে–
–হ্যাঁ, স্যার। ইদানিং তাদের ভিতরে ঝগড়া-ঝাটি বেড়েছিল। এমনকি এই ঘটনার মাত্র কয়েক দিন আগে স্টুডিওর ভিতরে তাদের দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল।
কথাটা শুনে প্রবাল কিছু প্রতিক্রিয়া দিল না তখনই। সে যেন কিছু একটা ভাবছিল। তার পরে বলল–
–আচ্ছা সামন্তবাবু, বিশাখা কি রোহণকে ছেড়ে নিজেই রাহুলের দিকে ঝুঁকেছিল না ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছিল?
–সেটা তো স্যার ঠিক ভেবে দেখিনি!
প্রবাল বলল—
–এটা নিয়ে এবার একটু ভাবুন।
সামন্ত কবজি উল্টে ঘড়ি দেখল। রাত প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে। সে একটু ইতস্তত করছিল।
প্রবাল বলল—
–সামন্তবাবু আজ থাক এই পর্যন্তই। আগামীকাল একটু সময় করে দুপুরের পরে আমার অফিসে চলে আসুন। আপনার সঙ্গে একবার ক্রাইম স্পটে যাব।
তিন
গঙ্গার হাওয়া এখানে অঢেল। অবারিত তার আনাগোনা সারা দিন রাত। কোনও বিরাম নেই বিরতি নেই। অদূরে একটা পোড়ো শ্মশান চেনা অচেনা গাছের জঙ্গলে একেবারে জটলা পাকিয়ে রেখেছে। এই শ্মশানে কালে ভদ্রে মড়া আসে। তখন যেন চারপাশটা মুখর হয়ে ওঠে। “বলো হরি হরি বোল” রবে খোল করতালের তালে বেতালে গঙ্গার হাওয়া যেন কিছু সময়ের জন্য বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। গাছে গাছে হৈ হৈ করে পাখিরা উড়ে আসে আবার শবযাত্রীদের গগনভেদী চিৎকারে তারা বিক্ষুব্ধ কিচির মিচিরে উড়ে চলে যায়। অদূরে বটের মগডালে কয়েকটি শকুন ঠায় বসে থাকে। কী যে তাদের আশা কে জানে!
শ্মশানের অদূরে এখানে একটা বাড়ি, বহুদিন মেরামতের অভাবে পোড়ো বাড়ির মতো হয়ে গিয়েছে। কাঠের জানালা দরজা থেকে রং উঠে গিয়ে মলিন, তারপরে আবার উইপোকা নিচের তলার জানালাগুলোকে ফোপরা করে দিয়েছে। বহুদিন থেকে সাধুচরণ এই বাড়িটার কেয়ারটেকার। সে তার বাপের সঙ্গে প্রথম যখন এসেছিল তখন তার বয়স কত আর সাত কি আট। তার মা মারা যাবার পরে তার বাপ কিছু দিন পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে। তার পরে এই বাড়িটাতে কেয়ারটেকারের কাজ কে যেন জুটিয়ে দিয়েছিল তার বাপকে। তখন থেকে সে আর তার বাপ এই বাড়ির বাসিন্দা। নিচতলার দুটো ঘর, এক টুকরো বারান্দা আর এক চিলতে রান্নার জায়গা তারা নিজেদের মতো ব্যবহার করে এসেছে। দুটো তলা মিলিয়ে বাড়িটাতে ছটা সাতটা ঘর। লম্বা টানা বারান্দা। ঘরগুলো এক একটা পেল্লায় বড়। চারটে শোবার ঘরে দামি কাঠের ভারি ভারি পালঙ্ক। সাধুচরণ আর তার বাপ মাসে একবার কি দুবার সব ঘরগুলোর চাবি খুলে খুলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করত। একটু বড় হতে সেই কাজটা সাধুচরণকে একাই করতে হত। কাজটা তার ভালোই লাগত। এই সারা বাড়িটাকে তার যেন নিজেরই বাড়ি মনে হয়। সে ঘরদোর পরিষ্কার করার অছিলায় বড় বড় গরাদ দেওয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকত। দেখতে পেত দূরে গঙ্গার বুকের উপর দিয়ে নৌকা চলে যাচ্ছে। আরও দূর দিয়ে কখনও সখনও দু একটা জাহাজ। সাধুচরণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই ছায়াছবির মতো দৃশ্য দেখে নিয়ে বস্তুত বেহুঁশ হয়ে যেত। সে টের পেত তার কানের কাছে কার যেন মৃদু নিশ্বাস পড়ছে। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে সেটা দেখবার অভিলাষ তার কখনও হয়নি। সাধুচরণ যেন বুঝতে পরত পারে এই বাড়িতে সে একা নয়, আরও কয়েকজন থাকে। তারা সবাই সাধুচরণের বন্ধু। সে জানে।
এই বাড়িটা নিয়ে এলাকায় খুব একটা বদনাম আছে। এটা ভূতের বাড়ি। এর ফলে সাধুচরণের একটা খুব সুবিধা হয়েছে। পারতপক্ষে চোর ডাকাতের উপদ্রব এখানে হয় না।
সাধুচরণের বাপ তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল। কিন্তু সাধুচরণের স্কুলে যেতে একেবারেই ভালো লাগেনি। ক্লাস সেভেনের পরে সে একেবারেই স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। সারাদিন সারা বাড়িটায় সে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ির পিছনে যে প্রাচীর ঘেরা অনেকটা জায়গা জংলা হয়ে পড়েছিল, সেটা সে পরিষ্কার করেছে। সেখানে সে নানারকম সবজি লাগিয়েছে। তাদের পিছনে সে দিনের অনেকটা সময় পড়ে থাকে। বাকি সময় সে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। তার পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ায় তার সাধের নেড়ি কুকুর লড়বড়ি। বিকেলের দিকে শ্মশানের কাছে বটগাছের নিচে বসে বসে গঙ্গার হাওয়ায় কিছুটা বিলাসিতা করে নেয় সে। বিশ বছর হল তার বাপ মারা গিয়েছে। বিশ বছর ধরে সে এভাবেই দিন কাটায়। তার কোনও পরিবর্তন নেই।
এই বাড়ির মালিকের নামটুকু জানে শুধু সাধুচরণ। কিন্তু তাদের কোনও দিন দেখেনি সে। তারা কোথায় থাকেন, কী করেন ইত্যাদি আর কিছু বিষয় সে জানে না। তার নামে ব্যাঙ্কে একটা বই করা আছে, সেটায় ঠিক মাসের শেষে তার কেয়ারটেকারের চাকরির টাকা জমা হয়। সেই টাকাটা নেহাত কম নয়। সেটা দিয়ে সাধুচরণের দিন বেশ ফেলে ছড়িয়ে কেটে যায়।
এবারে বর্ষা যেন বেশ আগে চলে এসেছে। সাধুচরণ ভাবে। জ্যৈষ্ঠের শেষেই এক মেদুর নিম্নচাপ মুখে নিয়ে যেন বর্ষা হাজির হয়ে গিয়েছে। তার পরে দু-তিনদিন টানা বর্ষণ গেল। বৃষ্টি একেবারে ভালোবাসে না সে। বৃষ্টিতে তার বিকেলের গঙ্গাভ্রমণ মাটি হয়ে যায়। সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার তার কাছে।
অদূরে মড়া পুড়ছিল আর বটগাছের নিচে বাঁধানো চাতালে বসে বসে সাধুচরণ তা এক মনে দেখছিল। যারা হরিনাম গাইছিল তারাও বটগাছের অদূরে বসে বেতালে হরিনাম গাইছিল। তাদের সামনে দিশি মাদের বোতল, চপ তেলেভাজার চাট। প্লাস্টিকের গ্লাসে মদ ঢেলে তারা মাঝে মাঝে গালায় ঢালছিল আর তারপরেই একবার হরির নামে গগনভেদী চিৎকারে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছিল।
সাধুচরণ তাদের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছিল। মদের ছিটেফোঁটা সে ভাগ পেয়েছিল তাদের কাছ থেকে। চোখ বুজে এক ঢোকে সবটা গলায় ঢেলে দিয়ে সে হরিনামের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছিল। এই শ্মশানে কালেভদ্রে মড়া আসে কিন্তু যখন আসে তখন যেন তা সাধুচরণের কাছে উৎসব বলে মানে হয়। সাধুচরণের জীবনে আর কোনও উৎসব নেই। তার দোল-দুর্গোৎসব নেই, পূর্ণিমা অমাবস্যা নেই, একাদশী দ্বাদশী নেই, তার উৎসব শুধু এই শবযাত্রীদের সঙ্গে বসে থাকা। বসে বসে দেখা একটা মানুষের দেহ কেমন পুড়ে ঝলসে ক্রমশ ছোট হতে থাকে, ছোট হতে হতে শেষে দু-তিন টুকরো হয়ে শেষে একেবারে ফুরিয়ে যায়। কী যেন এক আশ্চর্য রহস্য মনে হয় তার কাছে, তার নাভিকুণ্ডলী থেকে একটা শিরশিরে ভাব ক্রমশ উঠে এসে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। তার কেমন অসহায় লাগে নিজেকে, মনে ভাবে তার দেহটাও একদিন এমন হাওয়ায় ফুস করে মিলিয়ে যাবে। সাধুচরণ দু-একদিন যেন খাওয়া হাগা ভুলে যায় এই সব ভেবে ভেবে। তার কি ভয় করে? সে ঠিক নিজেকে বোঝাতে পারে না। মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে যায়, তার মনে হয় দোতলার বারান্দা দিয়ে কারা যেন হেঁটে যায়। সে চুপ করে মড়ার মতো পড়ে থাকে। তার খুব পেচ্ছাপ পায়, সে ওঠে না। তার মনে হয়, উপরে যারা হাঁটছে তারা যেন একদিন তাকে ডেকে নিয়ে যাবে। কোথায় ডেকে নিয়ে যাবে তা সাধুচরণ ঠিক জানে না। কোনও দিন সে শুনতে পায় বাড়িটার পিছন দিকে কারা যেন কোদাল দিয়ে মাটি কোপায়। মাঝ রাতে। শুয়ে শুয়ে সে ভাবে কারা যেন কবর খুঁড়ছে। পুড়ে যাবার থেকে কি কবরে শুয়ে থাকা ভালো? সে বুঝতে পারে না। শুয়ে শুয়ে সে যেন মরা মানুষের পুড়ে যাবার বেদনা টের পায়।
হঠাৎ সে তলপেটে বেগ অনুভব করে। অদূরে ঝোপঝাড়ের দিকে সে দৌড়ে যায়। নদীর দিকে নামতে গিয়ে সে ভিরমি খেয়ে যায়। সে হৈ হৈ করে শবযাত্রীদের ডাক দেয়। দু একজন তার পাগলামির মতো ডাক শুনে দৌড়ে যায়। তারা সাধুচরণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সাধুচরণের পেটের ভিতর কী সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।
এক মেয়েমানুষের শরীর চিত হয়ে পাড়ে আছে। মুখটা হাঁ করা, জিভটা খানিক বেরিয়ে আছে। চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। নাক দিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে নেমেছে। পোশাক পরিচ্ছদ অবিন্যস্ত। বাকি শরীরটা ডাঙায় শুধু জলের ঢেউয়ে তার নগ্ন পা দুটো মাঝে মাঝে দুলে উঠছে।
আবার আগামী সংখ্যায়
পড়ছি, অবিন। সাধুচরণের ইন্ট্রোডাকশনটা খুব ভালো লাগল।