আ মরি, মাতৃ/পড়শি ভাষা…

ভাষিক আন্দোলন

রাজদীপ্ত রায়

 

বেশ বড়সড় কোনও কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রকে নাড়িয়ে দিতে পারলে সমাজ সাধারণত প্রতিবাদী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। এই প্রাপ্তি ব্যক্তি বা সমষ্টি যেকোনও কারুর কাছেই অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়। বিশেষ করে মানুষের ইতিহাস জুড়ে যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক অন্যায় আর ক্ষমতার আস্ফালনের প্রভূত বাড়বাড়ন্ত, সেখানে যেকোনও প্রতিবাদ, স্বার্থ আর নির্বুদ্ধিতার অচলায়তনকে সমূলে আঘাত করার জন্য ভীষণ, ভীষণরকমভাবে সদর্থক ভূমিকা পালন করে। সুতরাং, প্রতিবাদী বরেণ্য, প্রতিবাদও স্বাগত। এইপর্যন্ত মেনে নিতে কোনও অসুবিধে নেই। বিদ্রোহ, প্রতিবাদ বা সর্বস্ব পণ করে, প্রাণ বাজি রেখে অধিকার ছিনিয়ে আনার যেকোনও অ্যানেকডোট অচিরেই বীরগাথার রূপ নেয়। নেবেই। এই বীরত্ব কৌম, জাতি বা দেশ, বৃহত্তর অর্থে বিশ্বজনীন মানব ইতিহাসের সঙ্গে ভাগ করে উপভোগ করবার মতই বিষয়, সন্দেহ নেই। এমনটাই হয়, হয়ে থাকে। এমনটাই হয়েছিল বাংলা ভাষার আত্মমর্যাদা রক্ষার শহীদ রক্তে ভেজা দিনগুলিতে। পঞ্চাশের দশকের পূর্ব পাকিস্তান তথা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশে, জোর করে বাংলাকে মান্যতা না দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর ক্ষমতাদর্পী সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে। এরপর দশক পেরিয়ে আসামের শিলচরেও সেই ভাষিক স্বাভিমানের লড়াই হল। আবার রক্ত, প্রাণপাত করে রুখে দাঁড়ানো। আবারও প্রতিবাদ। প্রতিস্পর্ধা। নিজেকে শেষ করে দিয়েও ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করবার অসম্ভব মানবীয় জেদ আর অভিমানের দুরন্ত আখ্যান রচনা।

ছোটখাটো, নাম না জানা আরও নানান লড়াই লাঞ্ছনা ইত্যাদির পর শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হল বা হয়েছে বাংলা ভাষার সার্বভৌম সম্মানের অধিকার। সমস্ত বলিদান আর অর্জিত অধিকারের অস্মিতা কপালে নিয়ে আজ বাংলা ভাষা সুপ্রতিষ্ঠিত সারা বিশ্বে। ইতিহাস গড়ে মর্যাদা কেড়ে এনেছে বিশ্বের দরবারে। বিশ্ব সংস্কৃতি নিয়ামক সংস্থা, ইউনেসকো, বাঙালির মাতৃ ভাষার অধিকার রক্ষার দাবিকে সেলাম জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। অধিকারের লড়াই, আত্মমর্যাদার প্রতিবাদ ঐতিহাসিক স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে দর্প ভরে। নিতে পেরেছে। বাংলাভাষী হিসেবে, বাঙালি হিসেবে সে গর্ব আমাদের অপরিসীম। ঠিক। এই গর্ব জাতি হিসেবে আমাদের অর্জন। আর তাছাড়া পুরো ঘটনাটাতেই একটা টান টান আবেগের স্বাভিমানী প্রলেপ স্বাভাবিক ভাবেই লেগে আছে, থাকবেও। অনৈতিক কিছু নয়। কিন্তু, শুধুমাত্র বাংলা ভাষা দিবস হিসেবে একটি দিনের স্বীকৃতি উদযাপন, আর আপামর গ্রহবাসীর মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একই সাংখ্যমান নির্ধারিত দিবসের উদযাপন লিপি, প্রণালী বা প্রস্তুতি চেতন ও প্রেক্ষিত তো এক হতে পারে না। সেক্ষেত্রে কিছু জিজ্ঞাসা, কিছু নৈতিক দায়ের খসড়া, ইতিহাস নির্ধারিত ইন্ট্রোস্পেক্টিভ যুক্তি শৃঙ্খলার নির্মোহ আয়নায় স্বরূপের প্রতিফলন যে আবশ্যক হয়ে ওঠে, এবং উঠবেই, ইতিহাসের দায় মেনে সে কথা অস্বীকার করি কী করে? আজ, এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের কোনও একটি একুশে ফেব্রুয়ারির সপ্রশ্ন সকালে?

যে দায়ের কথা উচ্চারণ করা গেল, সে উবাচ খোলসা করার চেষ্টা করা যাক খানিক। পৃথিবীর ইতিহাসে এ বাস্তব বহুবার পুনরাবর্তিত যে বিদ্রোহী বা প্রতিবাদী চরিত্র আর সে চরিত্র যথাযথ সম্মানে বজায় রাখার অভ্যেস বা চর্চা এক জিনিস নয়। কখনওই ছিল না। অর্থাৎ, কোনও একটি অন্যায় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা লড়াই করে যুযুধান পক্ষ বিদ্রোহী বা প্রতিবাদীর মর্যাদা পেতেই পারেন। কিন্তু ক্ষমতাকেন্দ্রে ওই একই প্রতিবাদী পরবর্তীতে বিরাজমান হলে, কালের নিয়মে একশোর মধ্যে প্রায় নিশ্চিতভাবে নিরানব্বইটি ক্ষেত্রেই তার আচরণ হয়ে ওঠে আগের ওই ক্ষমতাসীন দর্পিত চরিত্রটির মতো। তাঁর কণ্ঠে তখন ক্ষমতার স্বর। কেন্দ্র স্থল উপভোগ্য হওয়ায় নিশ্চিত প্রতীতিতে একটি বাইনারি প্রান্তিকের অবস্থান নির্ণয় করে ফেলা তখন তাঁর আশুকর্তব্য। অর্থাৎ, ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত মুহূর্ত থেকে তিনি, মানে সেই পূর্বপরিচিত প্রতিস্পর্ধী সত্ত্বা, প্রতিবাদের স্ব-ধর্মচ্যুত হয়ে ক্ষমতাসীনের কেন্দ্রীয় ভাষ্যকে নৈর্ব্যক্তিক শৃঙ্খলায় পারপিচ্যুয়েট করতে উঠে পড়ে লাগেন। এই অদ্ভুত কিন্তু অমোঘ কাজকম্ম শুধু যে একটি ব্যক্তিবিশেষ, একটি দল, বা গোষ্ঠী করে তাই নয়। এই একই ব্যারামে আমাদের আপামর যাপিত বা ভাষিক সংস্কৃতিও আক্রান্ত। প্রায় নিরুপায়, কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবেই।

একুশে ফেব্রুয়ারি বা মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে এইসব ক্ষমতা রাজনীতির হযবরল মাথায় আসার অনেকগুলো সঙ্গত কারণ আছে। বিশেষ করে ক্ষমতা রাজনীতির বিচিত্র বিন্যাস যেখানে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভাষিক মানচিত্রকে দুমড়ে মুচড়ে সকলে মিলে একসাথে থাকার সাংস্কৃতিক অভ্যেসটাকেই আজকে বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে দিয়েছে, তখন বৃহৎ এবং প্রধান ভাষার মর্যাদাবাহী বাংলা ভাষার ক্ষমতা পরিবহনের চরিত্রটিকে যে কিঞ্চিত আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, অন্তত আলোচনা পরিসরে, সে দাবি নিশ্চয়ই সহৃদয় পাঠকের খুব একটা অনুচিত মনে হবে না।

এমনিতে একুশ শতকের ভারতবর্ষে প্রায় সমস্ত প্রধান ও অপ্রধান আঞ্চলিক ভাষাই এক অসম লড়াইয়ের মাঠে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। কতকটা অনিচ্ছেতেই, বলা চলে। এক্ষেত্রে সর্বগ্রাসী আধিপত্যের বোলবালা নিয়ে সমস্ত অন্য/ভিন্ন ভাষিক পরিচিতি গিলে খাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে ঝড় তুলে চলেছে হিন্দিভাষা। পেছনে অসাংবিধানিক প্ররোচনা, মিথ্যে কথন (যেমন, হিন্দি নাকি ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা, ইত্যাদি কৌশলী প্রচার) আর ভারত জুড়ে বাজার অর্থনীতির একরৈখিক ও সমস্যাহীন বিপণিক্ষেত্র তৈরি করবার প্রকট কর্পোরেট মদত তো আছেই। তার সঙ্গে আছে নিজেরই শরীরের ভেতরে আরও একটা গভীর কিন্তু দুরূহ অসুখ। যা কিনা ভেতর থেকে দুর্বল করেছে এবং করছে আমাদের স্ব স্ব অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষিক সমূহতাকে। এবং সেই অসুখ অনেকদিনের। তার অতীত ইতিহাস ওই কিছুক্ষণ আগে উল্লেখ করা অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন অথবা পারপিচ্যুয়েশনের রাজনীতির দোষে সম্যকভাবে দুষ্ট।

বলতে চাইছি, বাংলা ভাষা এবং তার সঙ্গে একই জায়গায় থাকা অন্যান্য ছোট ভাষাগুলির আন্তর্সম্পর্ক আর সে সম্পর্কের সূক্ষ্ম রাজনীতির কথা। গত বেশ কয়েক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশে, নির্দিষ্ট করে বললে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং বা সাম্প্রতিকের আলিপুরদুয়ার জেলার ভাষামানচিত্রে বিভিন্ন জাতির মুখের ভাষা, তার মর্যাদা প্রাপ্তি বা পরিচিতির স্বীকৃতি, সেসব নিয়ে অস্থিরতার চালচিত্র বেশ ভালোভাবেই সরগরম। আড়ালে অন্য ক্ষমতা দখলের রাজনীতি বা পরিচিতির রাজনীতি প্রভৃতির ছায়াপাতও আছে প্রচুর। রাজবংশী ভাষার স্বাতন্ত্র্যের দাবিকে নিয়ে, বা সেই দাবি আদায়ের মাধ্যমে ভিন্ন প্রাদেশিক পরিচিতি সুনিশ্চিত করার দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রস্তাব, সে স্বরেও আনুপাতিক বিভিন্নতা, আদিবাসী পরিষদের সৃষ্টি, গোর্খালি বা নেপালি ভাষাভাষীদের পৃথক রাজ্যের দাবি, লেপচা ভাষীদের আলাদা পরিষদ এবং আরও নানান ছোট, উপ, অণু, চোরা বিবিধতার বিচিত্র আলোড়ন সত্ত্বেও একটা সত্য কিন্তু দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। এই সমস্ত পরিচিতি নির্ধারক ভাষিক আন্দোলন, ভাষাকেন্দ্রিক জাতি অস্তিত্ব বুঝে নেওয়ার কোলোনিয়্যাল পরম্পরা, ভাষা দিয়ে নেশন বা জাতি চিহ্নিত করার সর্বৈব পরিত্যাজ্য কিন্তু ভীষণ রকম উগ্র আবেগী, পুরনোপন্থী দাবিদাওয়ার লালন হয়েছে এই জাতীয় ছোট ছোট ভাষাকে মান্যতা বা ন্যূনতম স্বীকৃতি দেওয়ার দীর্ঘকালীন রাষ্ট্রীয় কুণ্ঠা আর অনভ্যাসের কোলেকাঁখে। আর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশের পাহাড় বা তার পাদদেশ সংলগ্ন অঞ্চলগুলির বিশাল ভাষিক বৈচিত্র্যকে প্রান্তিক ডিসকোর্স হিসেবে রেখে দেওয়ার দায়, স্থান কাল পাত্রের পরিপ্রেক্ষিতে, বেশ খানিকটা যে মান্য, মূল ধারার বাংলাভাষী সংস্কৃতির ওপরেই বর্তায়, সে কথা অবলীলায় অস্বীকার করা যায় না।

স্বাধীনতার পর থেকে যে রাজ্যের ভাষিক সংযোগের মূল স্রোত নিয়ামক বাংলাভাষা, যে ভাষা তার আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, প্রতিবাদকে ঐতিহাসিক গরিমায় তুলে নিয়ে গেছে বারবার, সেই চির-প্রতিবাদী যখন কেন্দ্রীয় বিন্দুতে অধিষ্ঠিত, শাসন ভার তুলে নিয়েছে হাতে, তখন তার কাছে একটু লালন, হারিয়ে যাওয়ার গড্ডলিকা থেকে বেঁচে ফিরবার উপযোগী দু-একটা সক্রিয় এবং সদর্থক সিদ্ধান্ত বা উপচার আশা করাটা তো অন্যায় নয়। কিন্তু প্রতিবাদীর স্ব-ধর্মে স্থিত হয়ে রাজপাট চালানো বোধহয় সর্বত্রই কঠিন বা অ-জরুরি কাজ। ফলে, যা হওয়ার তাই হল। তাই হয়। বাংলা কালে কালে ক্ষমতার কেন্দ্রকে নিজের আত্মপরিচয় ভেবে বসেছে। রাষ্ট্রীয় এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বৃত্ত অক্ষুণ্ণ রাখাটাকেই মনে করেছে রাজধর্মের পালন করা। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দেশীয় ও অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাগুলির সঙ্গে তার দূরত্ব। অন্যভাষা বা অন্যস্বর যখুনি মাথা তুলেছে উপস্থিতি জানান দেবে বলে, তখন আবার ওই একই ঔপনিবেশিক ভাবনার বাঁধা গতে গা এলিয়ে প্রথমে করেছে উপহাস। তারপর স্বীকৃতিদানে থেকেছে অপারগ। নামিয়ে এনেছে কঠোর শাসন, রাজনৈতিক ক্যোয়্যার‍্যান্টাইন। আর শেষমেশ, সব হারিয়ে পপ্যুলিস্ট ভাবাদর্শের ভাবনা-রহিত পাইয়ে দেওয়ার খেলায় যাবতীয় ভাষিক বা সাংস্কৃতিক পরিচিতজ্ঞাপক আন্দোলন বা প্রশ্নকে করতে চেয়েছে আত্মসাৎ। এও একরকমের কো-অপ্টেশনের রাজনীতি। বিদ্রোহ বা প্রতিবাদ বা আত্মসংরক্ষণের দাবিকেও ভুবনের গ্রন্থিখোলা হাটে বিকিকিনির সস্তা নিয়মের নিগড়ে বেঁধে ফেলা। তোমার জন্য অ্যাকাডেমি আছে, অতএব তোমার সব দাবি মিটে গেছে৷ ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে গেছে, আর কিছু করবার নেই, এখন তুমি আমার বশংবদ। সুতরাং, ধর্মমতে আমার ক্ষমতায় থাকাটাকে তুমি ও তোমার ভাষিক গোষ্ঠী নিশ্চিত করো। ক্ষমতার জনমোহিনী গলাগলিতে ছোট ভাষাগুলির অন্য ধরনের নাভিশ্বাস ওঠানো সুনিশ্চিত করার এ আবার এক নতুন কিন্তু প্রায় সুনিশ্চিত পদক্ষেপ।

পশ্চিমবঙ্গের তরাই বা ডুয়ার্স এলাকায় নয় নয় করেও ১৫/২০টি ভাষার ঐতিহাসিক সহাবস্থান। সেদিক থেকে দেখলে, এতটা বিরাট ভাষিক বৈচিত্র্য এ প্রদেশের আর কোথাও নেই। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হল, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় এবং নানান সামাজিক কারণে এই সমস্ত ভাষাগুলিই কমবেশি বিপন্নতার মুখোমুখি। ধুঁকতে ধুঁকতে, অসম লড়াইয়ে ভরা বদলে যাওয়া বাজার-বিশ্বে টিঁকে থাকবার যন্ত্রণা আর বিস্ময় বোধে জারিত সে বিপন্নতা। এবং এর মধ্যে কয়েকটির অস্তিত্ব সত্যিই ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। বাংলা বা হিন্দির মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতাধর ভাষা বাদ দিলে তরাই-ডুয়ার্সের প্রচলিত আদিবাসী ভাষাগুলি হল— ভোটিয়া, ভূমিজ, বোড়ো (মেচ), গারো, গোন্ডি, হো, খারিয়া, কিষাণ, কয়া, কুড়ুখ (ওঁরাও), লেপচা, মুন্ডা, রাভা, সাঁওতালি, শবর, টোটো, ধিমল, সাদরি এবং রাজবংশী (সূত্র : District Census Handbook: Darjeeling, Jalpaiguri. Census of India 1971, Series 22, Part XC. Directorate of Census Operations. Govt. of WB. Kolkata)। দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা, হিন্দি বা নেপালি এইসব ছোট ভাষার আঙিনা অনেকটাই সঙ্কুচিত করেছে। প্রায় চল্লিশ বছরের ওপরে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বিচিত্র ভাষাপট নিয়ে স্বাধীন এবং প্রণিধানযোগ্য গবেষণা অক্লান্ত নিষ্ঠায় চালিয়ে নিয়ে গিয়ে প্রথিতযশ গবেষক শ্রী কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্য তাঁর অনন্য বহুভাষিক শব্দকোষের ভূমিকায় খেদের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন, “একটা কথা কিঞ্চিৎ শ্রুতিকটু হলেও সম্ভবত সত্যি যে, তরাই-ডুয়ার্সের লিপিহীন কথ্যভাষাগুলোর অস্তিত্ব সঙ্কট এবং অকালমৃত্যুর প্রধান কারণ এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান বাংলা ভাষার আধিপত্য (hegemony)। শুধুমাত্র একটি বড় ভাষা বলেই এই উপজাতীয় ভূখণ্ডে বাংলার এই আধিপত্য তা নয়, বাংলা ভাষাভাষীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাধিক্যও এর মূলে বলে মনে হয়।” (১৯ : ২০০৬)

গবেষকের নিশানায় ভাষিক আধিপত্যের দিকে ইশারা ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যটির মধ্যে যে নিহিত ইঙ্গিত আছে, সেই উপসর্গ মনে হয় আরও বেশি উদ্বেগজনক। কোন ভাষার মানুষজন কোন অঞ্চলে সংখ্যায় বাড়বেন, কেন বাড়বেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশে স্বাধীনতা, দেশভাগ এবং তারপর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের প্রেক্ষিতে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা কীভাবে বেড়েছে সে তথ্যপাঠের ভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক দিক আছে। সেসবের আলোচনা এই পরিসরে অসম্ভব। কিন্তু একটা ছোট কথা এই প্রবণতাকে মাথায় রেখে সহজেই আন্দাজ করা যায়। যে বিপুল বাংলাভাষী মানুষজন এই অঞ্চলে রুটি, রুজি, আশ্রয়ের কারণে গত একশতক ধরে বসত গড়েছেন, তাঁদের নাগরিক সংস্কৃতি নির্ভর ঔপনিবেশিক শিক্ষার পুঁজি সম্ভার এতদঞ্চলের অন্যান্য আদিবাসী ভাষিক জনগোষ্ঠীগুলোর চাইতে অনেকটাই বেশি ছিল। ফলে স্বাধীনতা পরবর্তী নাগরিক বিকাশ বা আরও পরে, গত শতকের নয়ের দশক থেকে বিশ্ববাজারের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার উন্নয়নের হাটে এই বাংলা ভাষার স্বাভাবিক প্রায়োরিটি, অন্তর্ভুক্তি ও আধিপত্য অনেকটাই সেই ঔপনিবেশিক শিক্ষা বিস্তারের পরিচিত যুক্তি শৃঙখলা মেনেই হয়েছে। মানতে বাধা নেই যে, এই গ্লোব্যাল দুনিয়ার প্রেক্ষিতে বাংলাও আজ আর খুব সুখে নেই। হিন্দির বানিয়ে তোলা রাষ্ট্রীয় এবং কর্পোরেট প্রযোজিত আগ্রাসনে তারও যথেষ্ট শঙ্কিত অবস্থা। কোণঠাসা বলাটা বাড়াবাড়ি হবে, কারণ একুশে ফেব্রুয়ারির বাৎসরিক পুণ্যতিথিতে আলো ঝলমলে নগর-মঞ্চে সমূহ কান্নার আয়োজন করলেই বাংলা বিপন্ন বলে প্রমাণ হয় না। যদি ভাষা টিঁকে থাকে, তবে সে টিঁকবে গ্রাম বা পল্লীর মাঠ-পাথারের মুখের বুলি দিয়ে, মেট্রোপোলিট্যান বাস্তবতার নিরিখে নয়।

কিন্তু, কথা হচ্ছিল ছোট ভাষার প্রতি বাংলা ভাষার নিজস্ব উদাসীনতা এবং কৃষ্ণপ্রিয়বাবুর হাতে নেড়ে ঘেঁটে দেখা বাস্তবতার অনুধাবনকে নিয়ে। যেকোনও ভাষায় তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সম্পর্কিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে অসম্পর্কিত ভাষাদের একটা গতিশীল দেওয়া নেওয়া চলে। এভাবেই ভাষা বাঁচে, শ্বাস নেয়, শ্বাস দেয়, বেড়ে ওঠে, বাড়িয়ে তোলে। আরবি, ফারসি, তুর্কি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজি শব্দের বা বাগধারার মিশ্রণ এবং সংখ্যাধিক্য নিয়ে প্রাতঃস্মরণীয় অধ্যাপকদের প্রভূত বক্তব্য এবং তথ্য সংরক্ষণ আছে। অর্থাৎ, ভাষার গতিশীলতার স্বাভাবিক নিয়মেই বাংলা অন্যান্য ভাষা থেকে প্রচুর নিয়েছে। নিজের মতো করে নিয়েছে। আরও বেশি বেশি করে প্রাসঙ্গিক এবং সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে কালে কালে। কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা হল, তরাই-ডুয়ার্সের আদিবাসী ভাষা বৈচিত্র্যকে মান্যতা দিয়ে সেখান থেকে শব্দ বা স্থানিক অভিজ্ঞতার সুচারু অভিব্যক্তি হিসেবে নেওয়া বাগধারার অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে স্থানীয়, মান্য অথবা প্রমিত বাংলা ভাষা এবং ভাষিকদের অনীহা চোখে পড়বার মতো। এক জাতীয় চোরা শ্রেণিচেতনাও হয়তো এক্ষেত্রে বরাবর কাজ করে এসেছে আধিপত্য বিস্তারী বাংলাভাষীদের কৌম অচেতনে। যে জনজাতিরা ঔপনিবেশিক শিক্ষা-পুঁজিতে বলীয়ান নয়, খেটে খাওয়া কৃষক বা শ্রমিক হিসেবেই যাঁদের দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক পরিসরে দেখতে অভ্যস্ত আপামর বাঙালি, তাঁদের শব্দে হয়তো এক্সোটিক ভূতের বা রোমাঞ্চকর গল্পে আদিবাসী দেবতার মন্ত্র সাজানো যায়, কিন্তু প্রাত্যহিকীর অভিজ্ঞতার যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে কৌলীন্যে মুখে তুলে নেওয়া যায় না। কিন্তু একথা তো জানাই যে, এই এক্সোটিকের রাজনীতি আপাদমস্তক ঔপনিবেশিক জরায় আক্রান্ত। তার অর্থ তাহলে এরকম যে, উত্তরের বাংলাভাষীরা, এবং কালক্রমে প্রমিত বাংলার বৃহত্তর সমাজও আসলে এই অসম প্রতিযোগিতার বাজারে সভ্যতার মোনোলিথ নির্মাণ করেই ক্ষান্ত থেকেছে। যে প্রতিবাদী চরিত্রের উৎসাহী পূজা আর স্মরণে ফি-বছর একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় সাড়ম্বরে, সে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী চরিত্রের কোনও নৈতিক দায় রক্ষায়, অন্তত প্র্যাক্সিসে, বাংলা সংস্কৃতি আর যত্নবান নয়। ছিলও না হয়তো কোনও দিন।

নীৎশের মতে ভাষা যদি হয় একটি সিম্বলিক সামাজিক ক্রিয়া, যেখানে দায় থাকে, তাহলে তার দায় গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী।  বিশেষ করে আমাদের মতো বহুভাষিক এবং বহু সংস্কৃতির দেশে। কেননা, কেন্দ্র-প্রান্ত বিপ্রতীপের অশিষ্ট চলন আমাদের সমাজের আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে আছে। যে ভাষা, তা সে বাংলা, হিন্দি, মালয়ালি বা মারাঠি যাই হোক না কেন, আপেক্ষিক ক্ষমতার স্পর্শে আছে, তারই দায়িত্ব প্রান্তে ঠেলে দেওয়ার রাজনীতিকে প্রতিহত করা। ভাষা একধরনের জীবন। হ্বিটগেনস্টাইন বলেছেন। জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা শুধু সামাজিকই নয়। একজাতীয় রাজনৈতিক দায়িত্বও বটে। এ দায় প্রতিবাদী জয়তিলক কপালে নেওয়া বীরের নির্ভীক স্বধর্ম। এথিক্যাল পূর্বশর্ত। আমার ভাষার স্বাভিমানের জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁরা প্রণম্য। সেই প্রণাম আরও প্রাসঙ্গিক হয় যদি, আজ, এই একুশের মহিমান্বিত সকালে আমরা কুর্ণিশ জানাতে পারি সেই অন্য শহীদদেরও, যাঁরা তাঁর ভাষার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষকে উপেক্ষা করে প্রাণপাত করেছেন। করতে পেরেছেন। না হয়, এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, হলই বা সেই সংগ্রাম আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো বাংলা ভাষার আধিপত্য-স্বরের বিরুদ্ধে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আকাশ বাতাস মুখরিত হোক নিজের ভাষার জন্য। রুখে দাঁড়াই, চলুন, সমস্ত ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। একই সাথে নিজের মুখেই নাহয় এবার তুলে নিলাম পড়শি ভাষার আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিও। চলুন না, সবাই মিলে এখন থেকে নাহয় খানিক পড়শির কথাও বলি। তার ভাষা, ভাষিক অস্তিত্বকে রক্ষা করি প্রাণ মন ভাষা দিয়ে। শ্রেণি, আধিপত্য, ক্ষমতা বিন্যাস অল্প সরিয়ে রেখে নির্ভার সহযোদ্ধার হৃদয়টুকু নিয়ে। সাবঅল্টার্ন কথা কইতে পারেন, কি পারেন না, সে জিজ্ঞাসার চুলচেরা বিশ্লেষণ  এই একুশে সম্ভবত নিরর্থক। কিন্তু সাবঅল্টার্ন বলে চিহ্নিত না করে, আরও বেশি প্রান্তের দূরত্বে সরিয়ে না রেখে, পাশে দাঁড়ানোটা বোধহয় আজ অনেক বেশি জরুরি। কঠিন কাজ, কিন্তু অসম্ভব হয়তো নয়।

 

তথ্যসূত্র:

  • ভট্টাচার্য, কৃষ্ণপ্রিয়। তরাই-ডুয়ার্সের লোকায়ত শব্দকোষ। কোলকাতা : প্যাপিরাস। ২০০৬।
  • মিরি, মৃণাল। লিঙ্গুইস্টিক সিচ্যুয়েশন ইন নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া। নিউ ডেলহি : কনসেপ্ট পাব্লিশিং কোম্প্যানি। ২০০২।
  • বেনেডিক্টার, থমাস। ল্যাঙ্গুয়েজ পলিসি অ্যান্ড লিঙ্গুইস্টিক মাইনরিটিজ ইন ইন্ডিয়া। বার্লিন : এল আই টি ভারল্যাগ। ২০০৯।
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4651 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...