দুর্জয় আশরাফুল ইসলামের কবিতা

চকবাজার

চকবাজার : পোড়া মানুষের গন্ধ

 

১.

কিছুই থেমে থাকে না দ্যাখো, রাষ্ট্র এসে আগেভাগে ফুল রেখে যায়
ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পেট্রোল-ডিজেলের সাথে;
একই সংক্রামক, যেহেতু একই পথ। দাহ্যের নীচে সমস্ত সুন্দর।
অফুরান মৃত্যুর মিছিল দ্যাখো, চকবাজার এসে গলাগলি খায় কারা,
পূর্বতন নিমতলির আত্মারা, যাদের কারো হাড়গোড় নেই,
কারো শরীর থেকে শূন্য হয়েছে মাংসের নিশান। তারা আসে…
একই দাহ্যবেদনায়, ধেয়ে আসা মৃত্যুর নীচে যারা পড়েছে ধরা,
তাদের জন্য রাখে বুকের বেদনা। আর যারা রাষ্ট্র, সমাজ, আনুষ্ঠানিকতা
আর যারা বুঝে উন্নয়ন, খাবারের ফর্দ, পানের পিকের সৌন্দর্য্য,
যারা বেঁচে থাকে এই মৃত্যুর মিছিল থেকে দূরে, অন্য চাকচিক্যে
তাদের আরেকটি দিন, মুহূর্তের শোক, আর না-হবার প্রতিশ্রুতি, আর
আধুনিকায়ন, উর্ধ্বরেখার অর্থনীতি, দিনবদলের অঙ্ক কষে দিনশেষ।
আরেকটি দিবস এলে, অন্য মৃত্যুর দিকে ছুটবে মানুষ, কী আসে যায়…
কিছুই থেমে থাকে না দ্যাখো, অহরহ মেনে আর মানুষের ঘুম পায়,
যা কিছু ঘটুক রানা প্লাজায়, নিমতলি চকবাজার আর পাড়ায় পাড়ায়

 

২.

এসেছি কুয়াশা দেশ। নির্জন নদীপাড়, একটু দূরের জল মনে হয় বিস্তৃত উদ্যান। কী নাম বৃক্ষ সবের, ভেবে নেয়া যাক, যদিও বনসাই কিছুতে নয়। আর শিশিরের জল টুপ করে পড়লে মনে হয় একটু কাঠবেড়ালির আকস্মিক দৌড়ে যাওয়া থেকে শুরু হচ্ছে ছন্দের পাঠ। এই দেখি গভীরতম একলার দৃশ্যে, জল সুর ছন্দ একা দৃশ্য পরিক্রমা। আর যা কিছু জরা, পুড়ে যাওয়া শরীর, যা কিছু ফেলে আসা ছাইভস্মের পৃথিবীতে, সব একে একে উঁকি দিচ্ছে অনন্ত ভাবনায়। এইসব, মৃত্যুর কথা, ধেয়ে আসা আগুনের কথা, আর বিস্ফোরণের নিচে চাপা পড়া কান্না আহুতির কথা কিছুতেই মুছে ফেলা যাচ্ছে না।

এই কুয়াশা দেশ আকস্মিক ভরে ওঠে ছাইচাপা আগুন গন্ধে, নাভিমূলের কী ভীষণ সংকেত বারংবার বেজে ওঠছে আর শিশির জলের ছন্দে এত দ্রুতলয় সুর তৈরি হচ্ছে যদি, আত্ম-জিজ্ঞাসায় ম্লান এক মুখ এসে যেন বলে যাচ্ছে, কাঠবেড়ালির এত দৌড় ছিল কোথায়? আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করে না এই কুয়াশায়।

 

৩.

হলদে ঘাসের বনে আমি ঝরাপাতার মিছিল দেখেছি, মর্মর ধ্বনি কিছু নেই, নিচে তুলোর মতো মানুষের মাংস। আমার তখন মনে পড়েছে সূর্যোদয়ে দেখা কসাইখানার বিভৎসতা। কী দক্ষ কী নিপুণ হাতে ছুরি চালিয়ে একটা চারপেয়ে জন্তুকে টুকরো টুকরো ভরে দিচ্ছে পাটকল উদ্ভাবিত নতুন ব্যাগের ভেতর। তখন আরও কটা জন্তু মুখ, কোনও শব্দ নেই, চোখের কোণে জল শুকিয়ে আসা লবন, আর নিরীহ দৃষ্টি নিয়ে খণ্ড বিচ্ছিন্ন হবার সারিতে। হায় অপেক্ষা! লোকে বলে পাশবিক, যদিও মানুষের হাত, মানুষের সদিচ্ছা আর ভোগ আকাঙ্ক্ষার ভেতর এই সব নৈমিত্তিক। বীভৎস নরম সে তুলোর মাংসের ভেতর আমি অনেক ঘুম শুয়ে থাকতে দেখেছি আর, এটুকুও বলি। মাংসেরা জানে না তাদের ছুরি হাতে টুকরো করেছে কারা, কোন বিস্ফোরণে হাড় খসে গেলে পর চতুর এক গণিতবিদ কমিয়ে এনেছে নিখোঁজ প্রাণের যোগফল!

 

৪.

মানুষের মৃত্যুর চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে জুতো আবিষ্কার
রাজা যায় আসে, রাজাকে বানায় রাজা
তুমি গণমানুষের সারিতে দাঁড়িয়ে ভাবতে পারো
তত্ত্বের কথা; ভাবতে পারো লেখকের বিনীত ধর্ম
অন্তরাল ভেঙে যে আসতে চায় না রঙিন আসরে
তার দিন গেছে। তাই আজ অন্য শোরগোল –
জুতো আবিষ্কারের গল্প। মৃত মানুষের ধূসর মুখ নিয়ে
যে লুকায়িত অনুসন্ধান, তার কথা কেউ ভাবে না
সকলের চোখ রাজার দিকে, সকলের চোখ জুতোয়
ধ্বংসাবশেষের নিচে আর যত মৃত্যু, টুকরো হাত
সব আড়াল করার মোক্ষম অস্ত্র এসে গেছে শহরে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

আপনার মতামত...