দিগ্বলয়ের ওপারে চলে গেলেন অশ্রুকুমার

অশ্রুকুমার সিকদার
অশ্রুকুমার সিকদার | প্রাবন্ধিক, চিন্তক

বিপুল দাস

 

বাংলা সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রভূমি শহর কলকাতা থেকে অনেক দূরে, প্রায় পরিধি অঞ্চলে বসে নিভৃত গোপনচারীর মত সমস্ত জীবন সারস্বত-সাধনায় মগ্ন থেকে লিখেছেন ‘আধুনিক কবিতার দিগ্বলয়’ বা ‘আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস’-এর মত লেখা। বাংলা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী বা বাংলা ভাষায় যারা সাহিত্যচর্চা করেন, তদের ভেতরে এমন কেউ নেই যে, এ বইদুটির নাম শোনেনি। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এল এ সময়ের কবি ও গদ্যকারদের কথা, তার জীবনচর্যা, প্রিয়জন সান্নিধ্যের কথা। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ সমালোচকের আবরণ থেকে বেরিয়ে এলেন অশ্রুকুমার সিকদার। কখনও আমার প্রশ্নের উত্তরে, কখনও বা আপন মনেই বলে গেলেন তার এ পথে পরিব্রাজনের কথা। তার পাণ্ডিত্য বা বিষয়বৈদগ্ধ প্রশ্নাতীত। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় এই সাক্ষাৎকারের, কথাবার্তার, আলোচনার ভেতর কুয়াশার মত ছড়িয়ে ছিল অন্য এক বাষ্প। বাংলার সাহিত্যসংস্কৃতির কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে, প্রায় পরিধির এক প্রান্তে বসে সারস্বত-সাধনার জন্য তার একক লড়াই-এর কথা বলতে গিয়ে অনেক বাস্তব সমস্যার কথা এসেছে, আশ্চর্য! কোনও অভিযোগ নেই, খেদ নেই, সাধকের উদাসীন দর্শনে ‘যা পেয়েছি, না নাই’— এই তৃপ্তির কথা গভীর বিশ্বাস থেকে তিনি বলেছেন।

অশ্রুকুমার সিকদার

ব্যক্তিমানুষের বিশ্বাস, ব্যক্তিজীবনের শৃঙ্খলে থেকেও মহাজীবনকে ছুঁয়ে দেখার আকুতি, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী, তবু রবীন্দ্রনাথের গানে কোথায় এবং কেন ‘প্রাণের মাঝে সুধা’ জেগে ওঠে— সব বলেছেন। এই শহরকে তিনি এক গ্রাম থেকে প্রায় মহানগর হয়ে ঊঠতে দেখেছেন। তাঁর আক্ষেপ রইল এই পরিবর্তন নিয়ে একটা ভালো লেখা কেউ লিখল না।

শুধু একজন প্রাবন্ধিক-সমালোচকই নন, এই শহরের মানুষের কাছে তাঁর অন্য পরিচয়ও রয়েছে। একজন আদ্যন্ত সৎ মানুষ, স্পষ্টবাদী ও যে কোনও রকম সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিরকাল তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শুনেছি আমরা। তাঁর কথাতেই শুনি–

লোলেগাঁও-এ এক রাতে শঙ্খ তার নিজের কবিতা অনেকগুলো পড়েছিল। প্রতিমা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমরা পরদিনই চলে এসেছিলাম। শুনছিলাম কারা যেন বন্ধ্‌ ডেকেছে। কিন্তু আমাদের ফিরে আসতে কোনও অসুবিধা হয়নি। বাড়ি ফিরে কাগজ খুলেই জানতে পারলাম নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর খবর। দু’জনই আমরা উত্তেজিত, ব্যথিত। কলকাতা থেকে শঙ্খের কাছে ঘন ঘন ফোন আসছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে পদত্যাগ করব। শঙ্খ হঠাৎ রাস্তায় বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ রাস্তায় হেঁটে ঘরে ফিরে লিখল বিনয় কোঙারকে নিয়ে কবিতা – ‘সবিনয় নিবেদন’

চলচ্চিত্র এবং নাটকের একজন নিয়মিত দর্শক ছিলেন অশ্রুকুমার সিকদার। এই শহরে বসেই তিনি হাঙ্গেরিয়ান নাট্যকার জুলিয়াস হে-র দ্য হর্স নাটকের বঙ্গীকরণ করেছিলেন। নাটকের নাম দিয়েছিলেন— এক যে ছিল ঘোড়া। সে সময়ে নান্দীকারের বিখ্যাত অভিনেতা অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় এ শহরে ছিলেন। মূলত তাঁরই প্রভাবে ও আগ্রহে কাজটি হয়েছিল। নাটকটি কলকাতার মঞ্চেও অভিনীত হয়েছিল। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, এ সময়ের নাটক এবং চলচ্চিত্র সম্পর্কেও তাঁর সমান আগ্রহ ছিল। শিলিগুড়ির নাট্যকর্মীদের সঙ্গে সহজ যোগ ছিল তাঁর।

অশ্রুকুমার সিকদার

চোখের সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন অশ্রুকুমার সিকদার। এক সময় রাত জেগে লণ্ঠনের আলোতেই পড়াশোনা করেছেন দীর্ঘদিন। তাঁর পেশা পড়ানো, নেশা পড়া। সুতরাং চিরকাল অক্ষরের সঙ্গেই তাঁর সহবাস। ক্রমে চোখে বাসা বেঁধেছে গ্লকোমা। দৃষ্টিশক্তির অনেকটা ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পরই সেটা ধরা পড়ে। শিলিগুড়ি, কলকাতা, হায়দরাবাদ— চিকিৎসা চলছিল। কিছুদিন শক্তিশালী আতশ কাচ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছেন। বই ছাড়া কেমন করে থাকবেন। এখন সেটাও কষ্টকর। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম পেছন ফিরে তাকালে কোন দৃশ্যগুলো তার মনে পড়ে। তিনি জানিয়েছিলেন—

এক: বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ বিল্ডিং-এর চারতলায় লাইব্রেরিতে বসে গুটিকতক ছেলেমেয়ে পড়ছি। তার মধ্যে আমি একজন। সেই নিস্তব্ধতায় আমি পড়ছি আদ্রে জিঁদের ফ্রুটস্‌ অফ দা আর্থ।

দুই: আমি তরুণ অধ্যাপক হিসেবে শিলিগুড়ি কলেজে পড়াতে যাচ্ছি। সামনের মাঠ ভেঙে হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছি। তখন কলেজের পেছনে কোনও বড় বাড়ি হয়নি। আমি শরৎকালের ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতে হেঁটে যাচ্ছি। কোনও দিকে তাকাচ্ছি না। আমার দৃষ্টি ওই রৌদ্রস্নাত কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে।

তিন: একবার বিদেশভ্রমণের সময় আমরা ভেনিস থেকে জাহাজে করে মুরানো বলে একটা দ্বীপের দিকে যাচ্ছি। নীল সমুদ্রের ওপর দিয়ে আমাদের জাহাজ চলেছে। সেই নীল জল নীল জল নীল জল আমি দেখতে দেখতে যাচ্ছি। পেছন ফিরে তাকালে আমি এই দৃশ্যগুলো দেখতে পাই

তাঁর ঘরের চারপাশে বই, শুধু বই। সেন্টার টেবিলে বই, ডিভানের ওপর বই, দেওয়ালজোড়া আলমারি, আলমারিভর্তি বই। ছাত্রছাত্রীর দল এসে বই দিয়ে যায়। সদ্য-প্রকাশিত বই দিয়ে যায় নবীন লেখক। বইগুলো ধরে দ্যাখেন, পৃষ্ঠা খুলে অক্ষরের গন্ধ টেনে নেন ফুসফুসে। তারপর আবার রেখে দেন টেবিলের ওপর।

দিগ্বলয়ের ওপারে চলে গেলেন অশ্রুকুমার সিকদার। আমার প্রণাম রইল স্যারের পায়ে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...