ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জি
১৯০০ সালে লাগু হওয়া পঞ্জাব ল্যান্ড প্রিজার্ভেশন অ্যাক্টের অ্যামেন্ডমেন্ট বিল বিধানসভায় পাস হওয়ার পর হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর মন্তব্য করেছেন এটা খুব জরুরি ছিল, একশ বছরের পুরানো আইনে বদল আনতেই হত, এটা সময়ের দাবি। আরও বলেছেন, এবার Kant Enclave সহ আরও অনেক দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা আইনি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
এখানে ‘সময়ের দাবি’-র প্রকৃত স্বরূপটি বোঝা দরকার। এক্ষেত্রে সময়ের দাবি হল আরাবল্লির কোলে হাজার হাজার একর জমি নানা প্রকল্পের জন্য মুক্ত করে দিতে হবে। সেখানে যাতে গজিয়ে উঠতে পারে নতুন নতুন হাউজিং এস্টেট বা মাইনিং প্রোজেক্ট। পি.এল.পি.এ. সেই পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল, তাই সময়ের দাবি অনুযায়ী তা বদলে ফেলতে হবে। এর ফলে সহজেই সমাধান হয়ে যাবে কন্ত এনক্লেভ সমস্যারও। সুপ্রিম কোর্টের সেপ্টেম্বর মাসের রায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুরোপুরি বৈধতা দান করা যাবে কন্ত এনক্লেভকে। সেখানকার বাসিন্দাদের আর দুশ্চিন্তায় রাত কাটাতে হবে না যে এই বুঝি বাড়ি ভেঙে ফেলার জন্য বুলডোজার এসে দাঁড়াল।
সমস্ত বিরোধী দল এই অ্যামেন্ডমেন্ট বিলের বিরোধিতা করে এবং অভিযোগ আনে যে সরকার পরিবেশের কথা মাথায় না রেখে জমি আর খনি মাফিয়াদের হাতে আরাবল্লির অরণ্যের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে চাইছে। অভিযোগ এতই স্পষ্ট যে উত্থাপন করারও দরকার পড়ে না। অতএব, বিরোধিতাই প্রত্যাশিত ছিল। পরে সুপ্রিম কোর্টও হরিয়ানা সরকারকে ধমক দিয়ে বলেছেন যে আরাবল্লির কিছু হলে সরকার বিপদে পড়বে। অ্যামেন্ডমেন্ট বিল আপাতত লাগু হওয়ার সম্ভাবনা তাই দেখা যাচ্ছে না।
হরিয়ানা সরকারের এই গা-জোয়ারি এবং তার পর পিছু হটতে বাধ্য হওয়া দেখে প্রফুল্ল বোধ করা স্বাভাবিক। মনে হতেই পারে, এভাবেই বদলাবে সব কিছু। একদিন পরিবেশ সবার কাছেই প্রায়োরিটি হয়ে উঠবে, আবার সবুজ হবে পৃথিবী, থমকে যাবে দল বেঁধে প্রজাতি অবলুপ্তি। মনে হতেই পারে, মানুষ এতদিনে দায়িত্ব নিতে শিখছে বুঝি। এমনকি ভারতেও!
এমনকি ভারতেও। যেখানে জনসংখ্যার চাপ ভয়াবহ। পাশের দেশ চিনেও তাই। এই সূত্রে আর একটা ভালো খবরের কথা মনে পড়া স্বাভাবিক। নাসা-র আর্থ অবজার্ভেটরি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি জানিয়েছে যে কুড়ি বছর আগের পৃথিবীর তুলনায় আজকের পৃথিবী নাকি বেশ কিছুটা সবুজতর হয়েছে। এই সহস্রাব্দের শুরুর দিকের তুলনায় সবুজের (অ্যাভারেজ লিফ এরিয়া পার ইয়ার) পরিমাণ বেড়েছে প্রায় পাঁচ শতাংশ, মাপ করে বললে যা গোটা আমাজন বৃষ্টি অরণ্যের সমান! আর এই বৃদ্ধি যে দুটি দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মাঝে সবচেয়ে বেশি তারা হল– আশ্চর্যের ওপর আশ্চর্য– চিন আর ভারত! এই দুই দেশ মিলে মোট বৃদ্ধির এক তৃতীয়াংশের দাবিদার! নাসা-র এমিস রিসার্চ সেন্টারের গবেষক রমা নেমানি বলেছেন, “সত্তর আর আশির দশক জুড়ে চিন আর ভারতে ব্যাপক সবুজ ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে মানুষ পরিস্থিতিটা বুঝতে শুরু করে। তারই ফল আজকের এই বৃদ্ধি। প্রজাতি হিসেবে মানুষ যে (নিজের ভুল শুধরে) ঘুরে দাঁড়াতে পারে, স্যাটেলাইট ইমেজে আসলে সেই ছবিই দেখা যাচ্ছে।”
তবে কি সত্যিই মানুষ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে? নাকি এই দুটি খবরে বেশি খুশি হওয়ার দরকার নেই? সিদ্ধান্ত টানার আগে খবরদুটো আর একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। আগে দ্বিতীয়টা। নাসা-র বিশ্লেষণ অনুযায়ী চিনে সবুজ বাড়ার একটা বড় কারণ তাদের বনভূমি সংরক্ষণের ওপর দেওয়া জোর। বিয়াল্লিশ শতাংশ বৃদ্ধিই চিনে জঙ্গলে ঢাকা এলাকার। বাকি আরও বত্রিশ শতাংশ বৃদ্ধির কারণ, চিনের ক্ষেত্রে, ফসলের জমির বারবার ব্যবহার। ভারতের ক্ষেত্রে কিন্তু ইনটেন্সিভ এগ্রিকালচারের কারণে সবুজ বৃদ্ধি ঘটেছে বিরাশি শতাংশ। অর্থাৎ, আমাদের দেশে সবুজের বাড়বাড়ন্তের আসল কারণ সারা বছর ধরে উৎপাদন করতে থাকা কৃষিজমি। এই বছরভর ফসল ফলাতে গিয়ে কিভাবে শুষে নেওয়া হচ্ছে ভূগর্ভের জল, তা আমরা সবাই জানি। অতএব বলা যায় সবুজের বৃদ্ধি অন্তত আমাদের জন্য খুব একটা খুশির খবর নয়। এই চকচকে বেলুনের ভেতরে আসলে অনেকটা হাওয়া ছাড়া কিছু নেই। কিছু বছরের মধ্যেই ভূ-জলে টান পড়তে পারে, আর উলটে যেতে পারে ছবিটা।
এবার প্রথম খবরটি। মোহনলাল খট্টরের বলা ‘সময়ের দাবি’র কথা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব না। বিরোধী দলগুলি আপাতত আক্রমণ করেছে বটে সরকারকে, কিন্তু ক্ষমতায় থাকলে তারাও এই ‘সময়ের দাবি’ অস্বীকার করতে পারত কি? উন্নয়নের জন্য, অর্থনীতিকে বাড়তে হলে জমি চাই, খনিজ চাই। পরিবেশের দাবি আর সময়ের দাবি অনস্বীকার্যভাবে পরস্পরবিরোধী। আরাবল্লির অরণ্য আপাতত বেঁচে গেলেও খট্টরের প্রকাশ করা দাবি ভবিষ্যতে বারবার উঠবেই। আর ষাট হাজার একর এক লপ্তে হারিয়ে না গেলেও পুরো দেশ জুড়ে চুপি চুপি, খবর না হয়েই উন্নয়নের গ্রাসে চলে যেতে থাকবে আরও অনেক বেশি পরিমাণ জমি। দিনের শেষে রাষ্ট্র নয়, নিজেদের সৃষ্ট সভ্যতার সাথেই আসল লড়াই মানুষের। সভ্যতার শ্যাম আর পরিবেশের কুল, এই দ্বন্দ্বের সামনে দাঁড়িয়ে কাকে বেশি গুরুত্ব দেবে মানুষ তা একমাত্র সময়ই বলতে পারবে।