সেই দিনটা আসবে… আসবেই…

শ্রমিক মিছিল

রায়া দেবনাথ

 

শুরুতেই বলে রাখি, এ’ লেখা রাজনৈতিক, এ’ লেখায় স্পষ্ট পক্ষপাত রয়েছে।

অদ্ভুত এক সময়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি আমরা। হাঁটছে গোটা দেশ। ক’দিন পরেই লোকসভা নির্বাচন। শাসক আর বিরোধী, সব দলই এখন কোমর বেঁধে ভোটে জিতে ক্ষমতা দখলের অঙ্ক কষছে, জোরদার। চলছে দোষারোপ, পালটা দোষারোপের পালা। যুদ্ধোন্মদনার টনিক গিলিয়ে সাধারণ মানুষকে তাদের দৈনন্দিন চাওয়া পাওয়া, অধিকারের প্রশ্ন থেকে ক্রমে দূরে, বহু দূরে ঠেলে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। মানুষ যত সরছে, তাদের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন থেকে, তত মরছে, তত একা, বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। এমনকি যাঁরা মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন তুলছেন, মরছেন তাঁরাও, এক্ষেত্রে মেরে ফেলা হচ্ছে তাঁদের, বা যেনতেন প্রকারে চলছে তাঁদের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা।

ঠিক এই সময়ে, গত ৩ মার্চ বৃষ্টিভেজা এক রবিবাসরীয় সকালে, রাজধানীর বুকে জড়ো হয়েছিলেন, ওঁরা, যাঁরা আদতে এ’ দেশ, এ’ সমাজের বহমানতার যথার্থ রূপকার। জড়ো হয়েছিলেন, নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে। জড়ো হয়েছিলেন ন্যায্য দাবি আদায় করে নেওয়ার আওয়াজ তুলে। ওঁরা শ্রমিক। মজুর। যাঁদের শ্রমের বিনিময়ে গড়ে ওঠে অট্টালিকা, জঙ্গম হয় যান, নিকোনো হয় গৃহকোণ, পরিচ্ছন্ন থাকে পথঘাট, পরিখা, গায়ে ওঠে বস্ত্র, মাথায় থাকে ছাদ। খনি ছেঁচে যাঁরা আকর তুলে আনেন, সেই আকরকে ব্যবহারযোগ্যও করে তোলেন যাঁরা, যে যন্ত্র আমাদের শ্রম লাঘব করে, সেই যন্ত্রে প্রয়োজনীয় যান্ত্রিকতা প্রদান করেন যারা, আবার সেই যন্ত্র ব্যবহারও করেন, তাঁরা সে’ দিন জড়ো হয়েছিলেন, এ’ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সৃষ্টির সঙ্গে যাঁরা ধারণ এবং বহন উভয়ই করেন, তাঁদের হাতেই তো সমাজের চালিকাশক্তি থাকার কথা ছিল! কিন্তু তা হয় না, হয়নি, চালিকাশক্তি তো দূরের কথা পেটে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোটে না অধিকাংশের।

হ্যাঁ, সে’ দিন তাঁরা জড়ো হয়েছিলেন ওই পেটের ভাতের নিয়মিত জোগানের দাবিতেও। রাজস্থান, তামিলনাড়ু, গুজরাট, হরিয়ানা, দিল্লি, অসম, বাংলা, ওড়িশা, বিহার, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, হিমাচলপ্রদেশ— দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিলেন ওঁরা। সাত দফা দাবি নিয়ে।

কী কী ছিল সেই তালিকায়?

  1. ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি।
  2. শ্রম আইনে শ্রমিক-মারা সংশোধন বাতিল করে শ্রমিকের হিতে শ্রম আইনে পরিবর্তন।
  3. সরকারি, বেসরকারি সমস্ত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠন, সংগঠিত হওয়া, এবং ধর্না প্রদর্শনের অধিকার।
  4. পাবলিক সেক্টরে বেসরকারিকরণ, ঠিকা প্রথা, যত্রতত্র ছাঁটাই, লে-অফ, শ্রমিক বস্তিগুলির উচ্ছেদ, শ্রমিক আন্দোলনের উপর রাষ্ট্র ও মালিকের অন্যায় দমনের অবিলম্বে রদ।
  5. শ্রমিক পরিবারের জন্য সোশ্যাল সিক্যুরিটি, পেনশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা, বিনামূল্যে চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা। বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের ভাতা বৃদ্ধি। পেনশন ন্যূনতম ১৫ হাজার টাকা।
  6. স্থায়ী কাজ, সব ক্ষেত্রে সম কাজে সম বেতন।
  7. অসংগঠিত শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক, মহিলা শ্রমিকদের সমস্ত অধিকার সংরক্ষণ। মিড ডে মিলের ব্যবস্থা। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা কর্মী এবং গৃহপরিচারিকাদের শ্রমিকের মর্যাদা দান।

গোটা দেশের মোট ১৪টি শ্রমিক সংগঠন, মাসা (মজদুর অধিকার সংঘর্ষ অভিযান) নামক ছাতার তলায় এসে ৩ মার্চ দিল্লির রামলীলা ময়দান থেকে সংসদ মার্গ অবধি একটি মিছিল এবং সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। এই দাবিগুলিই ছিল তার ভিত্তি।

হঠাৎ এই দাবি কেন? যারা এই লেখা পড়ছেন, তাদের চট করে জানিয়ে রাখি কতগুলো তথ্য। এই মুহূর্তে আমাদের দেশের মোট শ্রমশক্তির ৯৪% আসে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে। ৬% সংগঠিত ক্ষেত্রের অধিকাংশই বাধ্য হন চুক্তিভিত্তিক কাজে, (শুধু কলকারখানা নয়, সার্বিকভাবেই) আমাদের দেশে ৮২% পুরুষ এবং ৯২% মহিলা শ্রমিকদের মাসিক আয় ১০ হাজারেরও কম। কারণ চুক্তিভিত্তিক কাজে চুক্তির যাঁতাকলে মরতে থাকে শ্রমিকরাই, যেখানে আইনকে বুড়ো আঙুলই মালিকের দস্তুর। আমাদের দেশের দেড় কোটি খাদান শ্রমিক ন্যূনতম পরিকাঠামো এবং সচেতনতার অভাবে ভোগেন সিলিকোসিস নামের মারণ রোগে। দেশের পূতিগন্ধময় বর্জ্যপূর্ণ নালানর্দমা খালি হাতে, কোনও রকম ইক্যুইপমেন্ট বা সুরক্ষা ছাড়া সাফ করতে গিয়ে প্রতি পাঁচদিনে গড়ে প্রাণ হারান অন্তত একজন সাফাই কর্মী। মেঘালয়ে ইঁদুরের গর্তের মতো কয়লার খনিতে আটকে পড়ে মরতে বাধ্য হন ১৯ জন শ্রমিক। মৌলিক দাবির ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করার জন্য ডাইকিনের শ্রমিকদের সহ্য করতে হয় একসঙ্গে পুলিশ ও মালিকের গুণ্ডাদের মার। অন্যায়ভাবে মিথ্যে কেসে ফাঁসিয়ে আটকে রাখা হয় তাঁদের। সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা  শ্রমিকমারা মুক্তাঞ্চল সেজ-এ, মানেসরের মারুতি শ্রমিকরা ১০ বছর টানা লড়াই চালিয়ে যান, ইউনিয়ন করার অধিকারটুকু আদায় করতে, ঘটমান শ্রেণি বিপ্লবের অবহেলিত উদাহরণ হয়ে। পেটের টানে গর্ভাবস্থাতেও চায়ের পাতা তুলে যান অসমের শ্রমিকরা, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মালিক দিব্য আড়মোড়া ভাঙে। ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আমাদের সকালের গরম চায়ের জোগানদার শ্রমিকরা মাথাকুটে মরেন, আর খুব দরাদরি করে ১০ টাকা মাইনে বাড়ায় সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’ জানাচ্ছে দার্জিলিং তরাই ডুয়ার্স অঞ্চলেরর চা বাগানগুলোতে বিরাজ করছে অনাহারের পরিস্থিতি। প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্টের পরিশোধন দূরের কথা, যে’টুকু আছে মালিকরা মানছে না সে’টাও। এমনিতেই মেলে না মাস মাইনে তার উপর নোটবন্দি পরবর্তী ভারতে ডকে উঠেছিল ২.৩৪ লক্ষ ছোট কারখানা, অবলুপ্ত হয়েছিল ৭০ লক্ষ চাকরি, ইনফরমাল ইকোনমির ৬ কোটি মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। মুখে রক্ততুলে পরিশ্রমের পরও শ্রমিকের মর্যাদাটুকু পান না গৃহপরিচারিকা বা আশাকর্মীরা। যুদ্ধ যুদ্ধ রবের মাঝেই দাম বাড়ে গ্যাসের, বিমানবন্দর চলে যায় পুঁজিপতিদের দখলে, আর সরকার ছক কষে প্রো এমপ্লয়ার অ্যামেডমেন্টে শিলমোহর বসানোর। বঞ্চনার লিস্টটা আদতে এতটাই লম্বা লিখতে বসলে দিন কাবার হয়ে যাবে।

শ্রমিক মিছিল

ব্যাক টু তিন মার্চ। সে’দিন রামলীলা ময়দানে জড়ো হয়েছিলেন হাজার হাজার শ্রমিক, সঙ্গে ছিলেন সমাজবদলের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা কিছু মানুষও। হাতে লাল পতাকা নিয়ে তাঁরা এসেছিলেন, আদতে একটা যুদ্ধের ডাক দিয়ে। অনাহার, বেসরকারিকরণ, অন্যায়ভাবে শ্রম আইনের বদলের চেষ্টার বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধ। মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে তখন কেউ বক্তব্য রাখছেন বাংলায় কেউ বা তামিলে। কেউ লড়াইয়ের গান গাইছেন ভোজপুরীতে, কেউ বা নেপালিতে। ভাষা অন্য, অন্য সংস্কৃতি, তা প্রকাশের ভঙ্গিও। কিন্তু এতটা ভিন্ন সঙ্গে করেও সবাই যেন সবার সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। সমস্যা হচ্ছে না ভাব বিনিময়ে, সমস্যা হচ্ছে না ভাবনার আদানপ্রদানেও। এক হাতের মুঠির মধ্যে অন্য কোনও মুঠি যখন নিশ্বাস নিচ্ছে, তখন যেন স্পন্দিত হচ্ছে দেশ, যে দেশ মানুষের। যে দেশটাই আদতে আমাদের।

লাল পতাকার মোড়া মিছিল সর্পিল গতিতে দিল্লির রাজপধের বুক চিড়ে হাঁটছিলেন যখন, ন্যূনতম মজুরি, স্থায়ীকরণের দাবি, বেসরকারিকরণের বিরোধিতা, ঠিকা প্রথার অবসানের সঙ্গেই উঠে এল অন্য স্লোগানও “না জাতপাত কা অত্যাচার, হর মজদুর কী এহি পুকার”, “না লিঙ্গভেদ কা অত্যাচার, হর মজদুর কী এহি পুকার”, না, শিখিয়ে দেওয়া তোতার বুলি নয়, নাগরিক সভ্যতার অহংকে পদানত করে, চমকে দিয়ে এই স্লোগানের জন্ম দিলেন ‘দেহাতি’ শ্রমিকরাই।

এমনিতেই মিছিলের ধর্ম একের সঙ্গে অনেকের মিশে যাওয়া। রামলীলা ময়দানে বহু ভাষার মিশে যাওয়ার যে শুরুটা হয়েছিল এই মিছিল বোধহয় তাকে পূর্ণতা দিল। ওই তো বাংলা স্লোগানেও গলা মেলাচ্ছেন হরিয়ানার শ্রমিকরা, ওই তো এক ফোটা কন্নর না বুঝেও, উজ্জ্বল মুখে স্লোগানের তালে হাততালি দিচ্ছেন ওড়িশার তরুণী, নেপালি ছেলের গিটারের সুরের মূর্চ্ছনায় তখন লাল পতাকা নেড়ে গোটা মিছিলকে উৎসাহ দিচ্ছেন পাঞ্জাব থেকে আসা বৃদ্ধ। মিছিলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হাসি মুখে ছুটে চলেছেন প্রায় আশি বছরের বাউড়িয়ার বৃদ্ধা, যিনি এক সময় গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন।

চারদিকে উৎসবের আমেজ। হ্যাঁ, উৎসব। দুঃখ, গ্লানি, অত্যাচারের ইতিহাসকে পিছনে ফেলে এক সঙ্গে সমবেত দাবি আদায়ের শুরুর লড়াইকে কান্না নয়, বোধহয় উৎসবেই মানায় ভালো!

সংসদ মার্গে সমাবেশের শুরুটাও তো তেমন ছিল। লড়াইয়ের গানে বাজনায় নেচে উঠলেন তামিলনাড়ুর শ্রমিকরা। মঞ্চে যখন বক্তব্য রাখছেন ভিন্নভিন্ন রাজ্যের শ্রমিক প্রতিনিধিরা, দর্শক আসনে বসে মনোযোগ সহকারে শুনছেন তাঁরাই। শেষ কবে এত মনোযোগ সহকারে কোনও রাজনৈতিক সমাবেশ শ্রোতাদের শুনতে দেখেছি, সত্যিই মনে নেই।

সমাবেশের ফাঁকেই কথা হচ্ছিল, হরিয়ানা থেকে আসা বছর ষাটের লক্ষ্মীর সঙ্গে। প্রশ্ন করেছিলাম কেন এসেছেন? কাঠের কাজ করেন লক্ষ্মী। রাস্তায় পড়ে থাকা কাঠ কুড়িয়েই ছেনি হাতুড়ি দিয়ে তাতে শিল্পের নিদর্শন স্থাপন করেন। কিন্তু রাস্তায় ধারে ঝুপরি জীবনও টানতে গেলে দরকার টাকার। পেটের টানে সেই শিল্প খুব স্বল্পমূল্যে বেচে দিতে বাধ্য হন লক্ষ্মী আর তাঁর পরিবার। সেই সৃষ্টি চড়া দামে বিকোয় শপিংমলে। শ্রমের সৃষ্টির যথাযথ মূল্য চান লক্ষ্মী, তাই এসেছেন সমাবেশে। সাফ জানালেন।

রাজস্থানের ১৮ বছরের ছেলেটা নির্মাণ শ্রমিক, বড় বড় ইমারত তৈরির জোগানের কাজ করে সে। মাস গেলে পেলে মেরেকেটে হাজার পাঁচেক। “ঘর মে মা হে, ভাই হে, ইস সে ভুখ নেহি মিটতা দিদি, জিয়ে ক্যায়সে?” এসেছিলেন, সাফাই কর্মীরা। বেশিরভাগই চু্ক্তিভিত্তিক কাজ করেন। মাস গেলে ঘরে আসে মেরেকেটে হাজার ছ’য়েক।

তবে, অবাক করলেন ডাইকিন আর মারুতি শ্রমিকরা। অস্থায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে মিছিলে এসেছিলেন বহু স্থায়ী শ্রমিকও। যাঁদের পাকা চাকরি, আর তুলনামূলক মোটা মাস মাইনে এখনও অবধি টিকে আছে। কেন এসেছেন তবে? প্রশ্ন শুনে এত অবাক অবজ্ঞার চোখে তাকালেন, নিজেরই লজ্জা হল। খানিক বিরক্তির স্বরেই ডাইকিনের একজন উত্তর দিলেন,

ও লোগ ক্যায়া হামারে আপনে নেহি হে? বাস আপনে বারে মেঁ সোচতা রহু? ইউনিয়ন কেয়া মেরা নেহি হোগা? যিনকো মারা, জেল ভেজা হামরা কুছ লাগতা হে, মেডাম!

ফিরে আর প্রশ্নের সাহস পাইনি।

আগে অন্তত মেনে নিন আমরাও শ্রমিক, ঘাম ঝড়াই, তাই আপনাদের বাড়িগুলো বেঁচে থাকে।

জানালেন বাংলার এক গৃহপরিচারিকা।

একবার চা বাগানের বস্তিগুলো দেখে আসুন, থেকে আসুন, কীভাবে বেঁচে থাকতে বাধ্য হই বুঝবেন, বুঝবেন আজ কেন এতদূর এলাম!

গোলগাল চেহারার চা বাগান শ্রমিক এতটা দৃঢ় উত্তর দেবেন ভাবিনি।

এসেছিলেন বাংলার বেশ কিছু বন্ধ কারখানার শ্রমিকরাও। ঘরে চাল চড়ানোর উপায়ও রাখেনি মালিকপক্ষ। কিন্তু অধিকারের কথা ভুলে যাননি তাঁরা, ছাড়েননি লড়াইয়ের পথও।

এইরকমই আরও কত কত মুখ, কত কত দাবি। তাদের মধ্যেই চমকে দিলেন পাগড়ি মাথার এক অশীতিপর বৃদ্ধ!

মজদুরকা কোই হিন্দু মুসলমান নেহি হে, মজদুর স্রিফ মজদুর হোতা হে। ইয়ে সব দাঙ্গা ফাসাদ নেতালোগোকা করতুতে হে, হমে বাঁটনেকে লিয়ে।

সচেতনতা, বোধ স্রেফ পুঁথিগত নয়, জীবন থেকেই উঠে আসে, শেখালেন তিনি।

এভাবে শেষ হল সমাবেশও। কিন্তু থেকে গেল আমদানি আম্বানি বা বিদেশি পুঁজির বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে মানুষের হুঙ্কার। শ্রমের হুঙ্কার। রাষ্ট্রের অন্যায় দমন পীড়নকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে হকের দাবিগুলো আদায় করে নেওয়ার যৌথ অঙ্গীকার।

তিন লাখের বিয়ের কার্ড আর তিন হাজার কোটির আখাম্বা মূর্তির দেশ আপাতত গত ৪৫ বছরের নিরিখে বেকারত্বে রেকর্ড স্থাপন করে ফেলেছে, প্রো এমপ্লয়ার লেবার ল অ্যামেডমেন্ট আমার জন্য খুব ব্যস্ত সরকার, বিদেশি শাসিত কয়েক রাজ্যে বদল চলেই এসেছে, সেজ এরিয়াতে তো রাষ্ট্র-মালিক আঁতাতের মুক্তাঞ্চল। শেয়ার বাজারের ফাটকাবাজিতে ডুবেছ কেন্দ্র সরকার কর্মচারীদের পেনশন, ফি বছর সরকারি খাতে ৩% করে কর্মসংস্থান কমছে। রেল, প্রতিরক্ষা সবেতেই থাবা বসিয়েছে এফডিআই। রাফায়েলের নথি নাকি হারিয়ে যাচ্ছে, সেনারা ঝুঁকছেন আত্মহত্যার দিকে। মানুষ যখন একা থেকে একাতর হওয়ার ফাঁদে পা দিয়ে হিংসার আবর্তে জড়িয়ে পড়ছে তখনই আবার মানুষেরই বেঁধে বেঁধে অধিকার রক্ষার লড়াই বিশেষ তাৎপর্য্য তৈরি করে বৈকি!

হাজার চার পাঁচ শ্রমিক একদিন জড়ো হলেই কী বদলে যাবে দেশ, এই মানুষমারা ব্যবস্থা? উত্তর না, যাবে না। কিন্তু তাঁদের জোট বাঁধার, লড়াইয়ের ইচ্ছা সমাজটা বদলের সত্যি ইঙ্গিত দেয়। ভোট বাক্সের রাজনীতির সঙ্গে মিথ্যে প্রতিশ্রুতির আড়ালে নয়, এই বদলের কাণ্ডারী একমাত্র মানুষই হতে পারে, সমস্ত ভেদাভেদ, ভুলে মানুষই পারে মানুষের দাবিতে গোটা দেশ হয়ে উঠতে, তুলনামূলক ছোট্ট পরিসরে হলেও শ্রমিকদের অনমনীয় লড়াইয়ের অঙ্গীকার সেই বার্তাই দিয়ে যায়।

মিছিল ভাঙার পর একগুচ্ছ তরুণ তরুণীকে লাল নিশানগুলো বড় যত্নে জড়ো করতে দেখে মনে হচ্ছিল দিনবদলের ছোড়া, বিক্ষিপ্ত স্বপ্নগুলোকে আবার একটার সঙ্গে আর একটাকে জোড়া লাগিয়ে, বুনতে শুরু করেছেন তাঁরা, নতুন, প্রজন্ম, তাজা মানুষের দল।

দিল্লির সংসদ মার্গ থেকে আগ্রার তাজমহলের দূরত্ব মাত্র ঘণ্টা চারেকের। সেই তাজমহল যাকে ইতিহাস চেনে কোনও শাসকের তার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার নির্দশন হিসাবে। এমন অনেক অনেক মিছিল যে’দিন একের সঙ্গে অন্যে মিলে যাবে, সেইদিনই স্থাপত্যের কারিগরদের রক্ত ঘামের বুনিয়াদে গড়ে ওঠা ইতিহাস মানুষের কাছে উন্মুক্ত হবে।

সে’দিন আসবে। আসবেই।

 

ছবি সৌজন্য : নিশান চট্টোপাধ্যায়, অবন্তিকা তেওয়ারি

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...