সার্থক সেনগুপ্ত
কাট ১:
ফুটবল। স্কুলে পৌঁছে একপ্রস্থ, দ্বিতীয়টা টিফিনে, তৃতীয় একটা অফ পিরিয়ডে, আর স্কুলশেষে চতুর্থ এবং অন্তিম প্রস্থ। চ্যালেঞ্জ ছিল এইসবগুলোকে অভিভাবকের নজর থেকে ঢেকে রেখে বাড়ি ফিরে সরকারিভাবে আবার মাঠে পৌঁছোনো। ক্রিকেটের সরঞ্জাম বড্ড দুর্মূল্য। দু’টাকার রবারের বলটা বড়জোর কেনা যেত দশজন মিলে, কুড়ি পয়সা করে চাঁদা দিয়ে। গোলপোস্টের জন্য দুটো দুটো চারটে ইঁট যথেষ্ট, তাও গোটা নয়, আধলা। আর কল্পনাটা তৈরি করত আকাশবাণী কলকাতা ‘ক’, শতবর্ষ প্রাচীন কলকাতা ফুটবল লিগের এ ডিভিশন, বা পরবর্তীকালের প্রিমিয়ার ডিভিশন সম্প্রচার।
মায়ের থেকে পাওয়া সবুজ মেরুন রঙ মনের প্যালেটে। কিন্তু ছুটির দুপুরে এমনকি তৃতীয় প্রধান ময়দানের ডার্ক হর্স মহামেডান স্পোর্টিং বনাম বিএনআর-এর কমেন্ট্রি শুনছি প্রতিপক্ষকে মেপে নিতে। ম্যাচের পরেরদিন অশোক দাশগুপ্তের সম্পাদনায় মাদকীয় আজকালের খেলার পাতা না জানা গল্পের ফাঁক ভরাট করত। ওদের চিমা, তো আমাদের বাবলুদা। না, তখনও ট্রোল হননি, ট্রোল শব্দটার মানে জানত না কেউ, মাথা গরম সত্যিকারের দুর্ভেদ্য ঘরের ছেলে বাবলুদা, মাঝেমধ্যে রেফারির নাক ভেঙে যিনি সাসপেনশনে। ওদের ভোকাল টনিকের পিকে তো আমাদের অমল দত্তর বিদেশি সিস্টেমের এক্সপেরিমেন্ট। ওদের কৃশানু বিকাশের স্কিল, তো আমাদের চিরভরসার সত্যজিৎ। শিশির ঘোষের হেড, মনোরঞ্জনের শক্ত চোয়াল, সুযোগসন্ধানী প্রশান্ত, মিডফিল্ডার জেনারেল সুদীপ। গোলে অতন্দ্র ভাস্কর, দেবাশীষ, তনুময়, হেমন্ত। বিদেশি বলতে চিমা ছাড়া বড়জোর চিবুজার আর বার্নার্ড ওপারা। একবার এমেকা, যাকে পরে বিশ্বকাপে দেখে চমকে ওঠা। দলবদলের খেলোয়াড় গায়েব করা থ্রিলার। ট্রফি বলতে এ ছাড়া শিল্ড, ডুরান্ড, ফেডারেশন কাপ, বড়জোর সন্তোষ ট্রফি। কিন্তু বছর শেষে ট্রফিগুলো হয় নিজের বা লাল হলুদ রঙের, খুব বদলালে সাদা-কালো। জেসিটি, সালগাওকার, ডেম্পো, মাহিন্দ্রা ইউনাইটেড, বিএসএফ বা এয়ার ইন্ডিয়া কালেভদ্রেই।
কাট ২:
খেলার মাঠগুলো কোচিং ক্লাস আর নেশাঝাড়ি দখল নিল। পকেটমানি বাড়ল, ক্রিকেটের রোমান্টিসিজম গেল, চাকচিক্য এল হাতের মুঠোয়। মহামেডান বলতে বাবরি পরবর্তী প্রজন্ম বুঝল একটা জাতি, যাকে ঘৃণা করা যায়। একটা একটা করে কমতে লাগল রাজ্যের জেলা আর মফস্বলের মুখগুলো। কালো টাকা, মদের টাকা পেরিয়ে এল চিটফান্ডের টাকা। বিদেশি এল আর গেল। ভিনরাজ্যের থেকেও এলেন, কিন্তু বিজয়ন আনচেরি বা বাইচুং হয়ে মিশে গেলেন সামান্য কজনই। ১৯৯৬-এর জাতীয় লিগ ২০০৭-এ রং বদলে হল আই লিগ। ঠিক যে সময়ে বাঙালি আর বাংলা ধীরে ধীরে আত্মঘাতী হতে শিখছে। সুখবিন্দর সিং, খালিদ জামিল, ডেরেক পেরেরারা আস্তে আস্তে স্বপ্নটা ওপারে ধার করে নিয়ে নিলেন বাংলার ফুটবল থেকে। ইস্ট-মোহন লড়াই রোয়াক আর মাঠের বুদ্ধিদীপ্ত কটাক্ষ আর বন্ধুত্বের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছোল ট্রাক থেকে ছুঁড়ে দেয়া বিপক্ষের উদ্দেশ্যে থুতুতে। ফুটবল আবেগের। বাংলা আবেগ ছাড়ল। আর অন্যদিকে স্বপ্নটাকে ধরল ব্যাঙ্গালোর এফ সি, আইজল, পাঞ্জাব বা এবারের চেন্নাই। সামাজিক দ্বেষের প্রতিফলনে টিটকারির মহোৎসব চলল দুই প্রধানের মধ্যে, উন্নতির প্রতিযোগিতা চলতে পারত, কিন্তু চলল না। মাত্র একবার জিতে কোনওবার না জেতা দলকে ট্রোল করবার সময় মনে আসেই না তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ডেম্পো এখন প্রায় ইতিহাসের পাতায়। টুম্পাই বা নিতুর টাকায় গরিবকে নিঃস্ব করা চলে, মেঠো রাজনীতি চলে, দু পক্ষকে লড়িয়ে দেওয়া চলে, ফুটবল বোধহয় বেশিদিন চলে না।
এরও শেষে এল আইএসএল। প্রথমে বোঝানো হল এই ক্লাব-ফুটবলের প্রাচীন সংসার হল ধোঁকার টাটি, পয়সাটাই সব। পয়সা এলেই বিনয়, থুড়ি, ফিফা ক্রমতালিকায় উন্নতি আসবে। শহর লড়বে শহরের সাথে, আমাদের ক্রমবর্ধমান প্রাদেশিকতার পালে থাকবে হাওয়া। আসবেন সবাই। ফিল্মস্টার, শিল্পপতি, ক্রিকেটগুরু। এককথায় ফুটবলার ছাড়া সবাই। উন্নত বিশ্বের বুড়ো দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির ফুটবলাররা পেনশনের বদলে পাবেন রোজগার। আর স্বপ্ন দেখাবেন কে? কেরি প্যাকারের মডেলে মাননীয় আম্বানি। একসময় যাদের পোর্ট ট্রাস্টের বা খিদিরপুরেরও এগারো জনের নাম মুখস্থ থাকত, তারা তাদের শহরের নামের টিমের দু’ চারজনের বেশি নাম মনে রাখতে পারেন না। আর মনে না রাখলে, বুকে রাখবেন কীকরে? সেই আগের মতো?
শেষটুকু। মাননীয় কর্তারা, হুজুর আইএফএ, এত বড় মাঠ আপনাদের, এত পৃষ্ঠপোষক, অমন রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি, দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, খুঁজুন না একটু রাজ্যজুড়ে, দেখুন না। আছে তো, এই সময়েও তো পেয়েছেন দীপেন্দু থেকে মেহতাব বা সুব্রত পালকে। এখনও তো সোদপুর বা বসিরহাট থেকে বিকেলে ময়দানে আসে স্বপ্ন নিয়ে অনেকগুলো মুখ, তাদের কাজে লাগিয়ে পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যায় না? শুনতে পাচ্ছেন না চেন্নাই এফ সি প্রথম হয়ে গর্ব করে বলছে দলের দশ ভূমিপুত্রের কথা। এখনও তো দ্বিতীয় হয়ে ক্লাব তাঁবুতে জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে কাঁদে কাঁচা পাকা চুলের অনেকগুলো মাথা। এই ভালোবাসার সম্পত্তি অর্জন হয়েছে একশো বছর ধরে, সামান্য গদির লোভে উড়িয়ে দেবেন না। এদেরকে একটা সুযোগ দেবেন না, আবার গর্ব করার?