ট্যানারি বন্ধের নির্দেশ : দূষণ নিয়ন্ত্রণ, নাকি বিদ্বেষের পরম্পরা?

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

অর্ধকুম্ভ। এলাহাবাদ। শাহি স্নান। শুদ্ধিকরণ। মতবাদ যাই হোক না কেন, প্রাচীন ভারত, সনাতন ভারত, পরম্পরাগত ভারতের ছবি এমনই। ঐতিহ্য দেশকে বাঁচিয়ে রাখে। সেখানে কোনও আপস নেই। আপস? হঠাৎ আপসের কথাই বা উঠছে কেন? উঠছে, প্রিয় পাঠক, একটু গভীরে ঢুকলেই।

ট্যানারি। আপাতভাবে শুনলেই দূষণের কথা মনে আসবে। সারি সারি ঝোলানো র’ অ্যানিম্যাল স্কিনের কথা মনে আসবে। দূষিত ক্রোমিয়াম এবং অন্যান্য রাসায়নিকের কথা মনে আসবে। অবশ্য এসবই চলে আসে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে। এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট ক্রমশ আধুনিক হচ্ছে। যা কাজে লাগানো হচ্ছে ট্যানারিগুলোতে। কিন্তু যে কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল। কুম্ভ মেলা। এবং ট্যানারি। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললে শোনায়, কানেকশন কোথায়? আপাতভাবে যে যোগসূত্র আছে, তা খুব পরিষ্কার, প্রাসঙ্গিক এবং যুক্তিযুক্ত। উত্তরপ্রদেশের ট্যানারিগুলোর অধিকাংশই আছে কানপুর, উন্নাও এবং বান্থারে। কুম্ভমেলার ঠিক তিন দিন আগে এর মালিকেরা নিজে থেকেই কারখানার কাজ আপাতভাবে বন্ধ করতেন। কেন তিনদিন? কারণ কানপুর, উন্নাওয়ের ট্যানারির দূষিত জল এলাহাবাদে পৌঁছতে মোটামুটি তিনদিন লাগত। তাই, সমস্যা হত না। সরকার থেকেও, একধরনের বাধ্যতা করলেও, তার বিরোধিতা করতে দেখা যেত না মালিক বা শ্রমিকদের।

সময় বদলাল। ২০১৯। অর্ধকুম্ভের ঠিক তিন মাস আগে, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে ১৫ মার্চ ২০১৯– ৩০০-র বেশি ট্যানারির স্থায়ী বন্ধের নির্দেশ এল। না, অস্থায়ী কাজ গোটানো নয়। পার্মানেন্ট সেটব্যাক। কানপুর, বান্থারে অধিকাংশই পুরোপুরি বন্ধ, উন্নাওয়ের বেশ কিছু আংশিক। হিসেবটা কেমন? দেখা গেছে কানপুর, বান্থার এবং উন্নাওয়ের ট্যানারির সংখ্যা যথাক্রমে ৪০০, ২৭ এবং ১৭। যার মধ্যে অধিকাংশই এই বন্ধের আওতায়। মালিক। শ্রমিক। অনুসারী শিল্প। এক লাখ পরিবার। তিন লাখ মানুষ। আয় বন্ধ। কোথায় যাবেন তাঁরা? হিসেব নেই। কানপুরের জুজমাউ রোডের রাম রানি চা বেচেন। আগে দিনে হাজার টাকা বিক্রি হত। শ্রমিক আনাগোনা। এখন? রাম রানি হিসেব করে দেখেন গত তিন মাসে দিনে দু’শ টাকা বড়জোর। ছোট ট্যানারি মালিকদের ক্ষতি স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা। জুজমাউ ট্যানারি অঞ্চলের নাইয়ার জামাল বুঝতে পারেন না কোথায় সমস্যা হল? র’ অ্যানিমেল স্কিন জড়ো করে রাখা। কবরিস্তান…। বিরাটাকার ড্রাম ব্যারেল নিষ্কর্মা হয়ে পড়ে আছে। আদৌ কোনওদিন অবস্থা পালটালেও মেশিন নতুন করে চালু করতেও বিশাল খরচা। এর বাইরে, সামগ্রিক ক্ষতির দিক আরও আছে। ট্যানারি বন্ধের সঙ্গে দেশের চর্ম ব্যবসা এবং মাংস রপ্তানি ব্যবসার অবনমন শুরু হয়েছে। এদেশের বদলে পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ছে বিদেশি স্টেকহোল্ডাররা। বিশ্বের বাজারের সামগ্রিক হিসেব হল, ভারত থেকে মোট নয় শতাংশ জুতো বা ফুটওয়্যার তৈরি হয় এবং বারো শতাংশ প্রসেসড পশু চামড়া বা হাইড স্কিন তৈরি হয়। এই সংখ্যার ব্যাপক বদল আসছে। এমনিতেই, এই কুম্ভের ঘটনার আগে, ২০১৬-র পর থেকে এটা ওটা হিসেব দেখিয়ে প্রায় দেড়শ-র ওপর ট্যানারি বন্ধের একটা গ্রাফ তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। মাংস রপ্তানি ব্যবসার হিসেবটাও বদলেছে তেমনভাবেই। ২০১৬-১৭-র মোট ৯৬২৪.১৯৩ কোটি টাকার ব্যবসা পরের বছর কমে হয়ে দাঁড়িয়েছে ৯১৫৩.৩২১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ নেগেটিভ গ্রোথ শতকরা ৪.৮৯। এই তিনমাসে ট্যানারি বন্ধের কোপে পড়ে মোট ক্ষতির মাত্রা প্রতি মাসে ৪০০০ কোটি টাকার হিসেবে মোট ১২০০০ কোটি টাকা, যা এই তিন মাসে তারা ব্যবসা করতে পারত। মনে পড়ছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্কিম। মনে পড়ছে দেশের সম্পদ দেশেই বানাও। ব্যবসা দেশেই করো। এমন গালভরা কথাবার্তা। সব কোথায় গেল? কী দোষ করল জামালরা?

তাহলে মূল কারণ কি দূষণ? একটু দূষণ-জনিত ঘটনাগুলো তলিয়ে দেখি না হয়। ১৯৮৫ সালে এম সি মেহতা দূষিত কারখানাগুলির ওয়েস্ট মেটিরিয়াল থেকে ট্রিটমেন্ট জনিত সমস্যা থেকে একটি পাব্লিক লিটিগেশন মামলা এনেছিলেন। তারপর থেকে দূষিত জল প্রাইমারি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে বেরিয়ে দ্বিতীয় একটি সিইটিপি বা কমন এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট দিয়ে নালায় মেশে, যা পরে নদীতে চালনা করা হয়। সরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ট্যানারিগুলি তাদের খরচের প্রায় ১৭.৫ শতাংশ এই সিইটিপি-তেই ব্যয় করে। কানপুর, উন্নাও বা বান্থারের ট্যানারিগুলি দূষণের সীমা লঙ্খন সেইভাবে করছে না একেবারেই। বরং প্রায় তিনবার শোধিত জলের আশি শতাংশই সরাসরি পড়ছে না নদীতে। যেটুকু পড়ছে, যেভাবে পড়ছে তাতে ক্ষতির সম্ভাবনা খুব কম। উপরন্তু, আধুনিকতর চিন্তাভাবনাও থাকে যথেষ্টই। নাইয়ার জামালের মতো ছোট ট্যানারি মালিক বা আশরাফ রিজওয়ানদের মতো বড় ট্যানারি মালিকদের কথায় উঠে আসে অন্য এক বৈজ্ঞানিক এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা। ট্যানারির শোধিত জল তাঁরা নদীতে না ফেলে চাষে জলসেচের জন্য পাঠানোর কথা ভাবছেন। কথা হচ্ছে সরকারি এবং বেসরকারি বেশ কিছু সংস্থা এবং কৃষিবিজ্ঞানীর সঙ্গেও। তো, এসব সত্ত্বেও অন্ধকার। ২০১৩-র সিএসই-র সমীক্ষা বলছে, সারা দেশের বিষাক্ত দূষিত ওয়েস্ট ওয়াটারের মাত্র ৮ শতাংশ আসে ট্যানারি থেকে। বাকি ৭০ শতাংশ পেপার, পাল্প এবং সুগার ফ্যাক্টরি থেকে। তাহলে? ট্যানারি একা দোষ করল কোথায়?

পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯

এখানেই চলে আসে অন্য কথা। ট্যানারি ব্যবসা। মালিক। শ্রমিক। অনুসারী শিল্পের রোজগার পাওয়া মানুষ। কারা তাঁরা? ট্যানারি মালিকদের ৯০ শতাংশই মুসলিম। শ্রমিকদের অধিকাংশই দলিত। তপশিলি জাতি, উপজাতি। আর সেখানেই রোষ। এদেশ যে সবার থাকার জন্য নয়। প্রাণে মারো, আর তা না পারলে ভাতে মারো। প্রায় তিন লাখ পরিবারের আকস্মিক বজ্রাঘাত, দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদে আঘাত– সবকিছুই মেনে নেওয়া চলে বিদ্বেষের নামে। তথাকথিত হিন্দুইজম-এর নামে। বলতে পারেন, তিলকে তাল করছি। বলতে পারেন, হয়ত এমন কোনও কারণ আদৌ ভেতরে নেই। তাহলে কী আছে? দূষণ বা অন্যান্য যা যা হিসেব মিলছে আর কী কিছু কারণ মাথায় আসছে, প্রিয় পাঠক? কিছু বলবেন প্লিজ…

নাইয়ার জামাল ১৯৮১ সাল থেকে কাজ করছেন জুজমাউ ট্যানারির। তাঁর আব্বার দেখানো পথে। কানপুরের লেদার ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাস নিয়ে অসংখ্য বই জড়ো করে একটি লাইব্রেরি করেছেন। নিজে উল্টেপাল্টে দেখেন। বন্ধুরাও। চা কফি। আলাপ। জামাল তাঁর বইগুলো ফেলে দেবেন? গন্ধগুলো? বন্ধুত্বগুলো, আলাপগুলো? লেগ্যাসি, ইতিহাস এসব?

প্রশ্নগুলো সহজ। আর উত্তরও তো জানা…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...