রায়া দেবনাথ
সালটা ১৯৯৭। তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্কুল সার্ভিস কমিশন অ্যাক্ট ১৯৯৭ অনুযায়ী রাজ্য সরকারের পোষিত এবং সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগের পরীক্ষা শুরু হয় ঠিক তার পরের বছর, ১৯৯৮ থেকে। এরপর, প্রত্যেক বছর নিয়ম করে এই পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, এবং বছরের পর বছর বেড়েছে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। সেই সময় একটা নির্দিষ্ট নিয়মে নিয়মিতভাবে পরীক্ষা, মোটামুটি সম্মানজনক ও নিয়মিত বেতন, সুরক্ষিত নিশ্চিত পেশা, আশা জাগিয়েছিল রাজ্যের বহু শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর মধ্যে। এটাও সত্যি যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে রীতিমত ভালো ফল করা বহু ছাত্রছাত্রীরা এই পরীক্ষার মাধ্যমে গোটা রাজ্যেই রাজ্য সরকার অনুমোদিত স্কুলগুলিতে চাকরিতে ঢুকেছিলেন। এই পরীক্ষা যে রাজ্যের বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে নিশ্চিত জীবিকার সন্ধান দিতে পেরেছিল, ভরসার স্থান হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ, ১৯৯৮ থেকে ২০১০, এই ১২ বছরের, প্রতি বছর এসএসসিতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। এই পরীক্ষার জনপ্রিয়তা কতটা ছিল? এক সময় এসএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এ রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল!
সালটা ২০১১। রাজ্যের ক্ষমতার হাতবদল, দীর্ঘ ৩৪ বছর পর। এরপর থেকে এখনও পর্যন্ত অর্থাৎ ২০১৯ সাল অবধি কতগুলি এসএসসি পরীক্ষা হয়েছে? উত্তর– দু’টি! হ্যাঁ, মাত্র দু’টি! ২০১২ এবং ২০১৬ সালে। এক সময় নিয়মিত যে পরীক্ষা এ বাংলার বহু বহু শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের কাছে জীবনধারণের অবলম্বন হয়ে উঠেছিল, আট বছরে মাত্র দু’বার তার দেখা মেলার পর, বলাই বাহুল্য সে অবলম্বন, সে ভরসার স্থান ক্রমশ দূরগামী হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পড়াশোনা শেষ করার পরেও চাকরির অনিশ্চয়তায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করে তারা আরও বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়েছেন।
শুধুই কি অনিয়মিত? না, একের পর এক দুর্নীতি, বিতর্কের জালে এই মুহূর্তে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে এসএসসি পরীক্ষা। ফলে স্কুলগুলিতে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগের নিয়মিত প্রক্রিয়া আদতে এই মুহূর্তে বিশ বাঁও জলে। নতুন রাজ্য সরকার আসার পর প্রথম এসএসসি ঘিরে বিতর্ক কম হয়নি। আদালত অব্দি গড়ায় অনেকগুলি অভিযোগ। বিএড সংক্রান্ত সমস্যাই শুধু নয়, তখনও উঠেছিল ব্যপক দুর্নীতির অভিযোগ। পরীক্ষার্থীর সই বা ইনভিজিলেটরের সই ছাড়া খাতাকেই বৈধতা দেওয়া হয়, পরে মুচলেকা লিখিয়ে! অভিযোগ ওঠে, ওই খাতাগুলি যে পরে বাইরে থেকে সরবরাহ করা হয়নি তার কী প্রমাণ? এই মুচলেকার গ্রহণযোগ্যতাই বা কতটুকু? যথাযথ নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগ দায়ের করে অনশন আন্দোলনেও বসে ছিলেন বেশ কিছু সফল পরীক্ষার্থী। কোনও রকম আলোচনা তো দূরস্থান, সেই আন্দোলন চলাকালীন অনশনকারীদের বাথরুম ব্যবহার এমনকি স্যানিটারি ন্যাপকিন বদলেও পুলিশ বাধা দিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে ২০১৪ সালে বিতর্ক অন্যমাত্রা পায়। একদিকে যখন কমিশনের কম্বাইন্ড মেধাতালিকাভুক্ত প্রার্থীরা তখনও চাকরির দাবিতে বিক্ষোভ আন্দোলন করছিলেন, তখনই, কমিশনেরই সহকারী সচিব অমিতেশ বিশ্বাস এক টেলিভিশন চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে দাবি করেন যোগ্যদের বাদ দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে অযোগ্যদের চাকরিতে নিয়োগ করেছে কমিশন। অভিযোগ আনেন ব্যাপক কারচুপির। প্রশ্ন তোলেন অন্তিম মেধাতালিকা নিয়েও। সরাসরি কাঠগড়ায় দাঁড় করান কমিশনের তদানীন্তন চেয়ারম্যানকে! যদিও, কমিশনের পক্ষ থেকে সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করা হয়! কোনও এক অদৃশ্য ইশারায় কীভাবে যেন ধামাচাপা পড়ে যায় সেই বিতর্ক! শুধু কমিশন থেকে নিঃশব্দে সরিয়ে দেওয়া হয় অমিতেশবাবুকে।
২০১৬ সালে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নয়া বিল নিয়ে আসে রাজ্য সরকার। অঞ্চলভিত্তিক নিয়োগের নিয়ম (উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ পূর্ব– এই পাঁচ ভাগে পশ্চিমবঙ্গকে ভাগ করে নিয়ে তারপর রিজিওনাল অফিসের মাধ্যমে পরীক্ষা সঞ্চালনা ও নিয়োগ হত) বাতিল করা হয়, আসে কেন্দ্রীয় নিয়োগ। বিধানসভায়, বামফ্রন্টের তীব্র বিরোধিতার পরেও বিনা আয়াসেই পাশ হয় বিল।
২০১৬ সালে ফের এসএসসি পরীক্ষার দিন ঘোষণার পর, আশায় বুক বেঁধে ছিলেন অনেকে। ভাবতে বসলেন, এবার বুঝি জট খুলল, এবার বুঝি কাঙ্খিত চাকরির আশা পূর্ণ হবে! বাস্তবে হল ঠিক উল্টো। এ সরকারের আমলে প্রথমবার এসএসসির যাবতীয় দুর্নীতির অভিযোগকে বেশ কয়েক গোল খাইয়ে এই বছরের এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতি খাতায় কলমে নয়া ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করে ফেলল!
ঠিক কোথা থেকে শুরু করা যায় সেই দুর্নীতির ইয়া বড় উপাখ্যান? প্রথমেই জানিয়ে রাখি, এই মুহূর্ত এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে হাইকোর্টে কম বেশি ১৫টি মামলা চলছে। প্রথমেই ধরুন, শূন্যপদের আপডেটেড ভেকেন্সির খবর বেপাত্তা! জানা নেই কাট অফ মার্ক্স! রেজাল্ট প্রকাশেও বিস্তর গড়িমসি! ইন্টারভিউতে উধাও ১ : ১.৪-এর (১০০টি শূন্যপদের জন্য ১৪০ জনকে ডাকা) অনুপাত। তারপর মেধাতালিকা প্রকাশের পর যেন খুলে গেল প্যান্ডোরার বাক্স, আর তার থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো হরেক কিসিমের দুর্নীতির খবর! রাজ্যজুড়ে মোট কত শূন্যপদ? পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি থেকে স্পষ্ট করে জানা যায় না সে তথ্যও! মেধাতালিকা প্রকাশের জন্যেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে কোর্টের হস্তক্ষেপ! মেধাতালিকা প্রকাশের আগেই ডাক দেওয়া হয় কাউন্সেলিংয়ের! মেধাতালিকা ছাড়া কীসের ভিত্তিতে হবে কাউন্সেলিং? স্বাভাবিকভাবেই আদালতের এই প্রশ্নের উত্তর ছিল না কমিশন সচিবের কাছে। মেধাতালিকা প্রকাশ না হলে জেলের ঘানি, আদালতের এই চরম হুঁশিয়ারির পর মেধাতালিকা প্রকাশ হলেও দেখা যায় সেখান থেকে হাওয়া র্যাঙ্ক এবং নম্বর! এই মেধাতালিকা নিয়েই আদালতে মামলা দায়ের হয়!
যে মেধাতালিকা প্রকাশ্যে আসে তাতে দেখা যায় শূন্যপদের তুলনায় তালিকায় প্রকাশিত নাম অনেক কম! এমপ্যানেলড লিস্টের থেকে ওয়েটিং লিস্টের দৈর্ঘ্য অনেকটাই বেশি! অথচ নিয়ম বলছে এমপ্যানেলড এবং ওয়েটিং লিস্ট উভয় মিলিয়েই তৈরি হয় অন্তিম মেধাতালিকা। এরা প্রত্যেকেই আদতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। সেক্ষেত্রে গোদা হিসাব বলে, এমপ্যানেলড চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগের পর যে শূন্যস্থান থাকবে তাতে আসবেন ওয়েটিং লিস্টের প্রার্থীরা। এক্ষেত্রে দেখা যায় প্রথমেই শূন্যপদের তুলনায় এমপ্যানেলড চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা অনেক কম, ওদিকে লম্বা ওয়েটিং লিস্ট! যদি এতগুলো শূন্যপদ এমনিতেই থাকে, তাহলে মূল তালিকাটি এত ছোট করার অর্থ কী? কেন অকারণে বাড়িয়ে তোলা ওয়েটিং লিস্ট? আর যদিও বা বিশাল ওয়েটিং লিস্ট তৈরিই হল, এতগুলো শূন্যপদ তো রয়ে যাচ্ছে, তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার! তাহলে এই ঘটনার পরেও, কেন শূন্যপদে যথাযথ নিয়োগ হল না? বলাবাহুল্য এই প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি! প্রসঙ্গত, শূন্যপদ ঠিক কতগুলো? এ বিষয়ে কমিশন কোনও পরিচ্ছন্ন বক্তব্য না জানালেও পরীক্ষার্থীদেরই করা আরটিআই রিপোর্ট জানাচ্ছে শুধুমাত্র বাঁকুড়াতেই এই মুহূর্তে শূন্যপদের সংখ্যা ১৪০০! দার্জিলিং বাদ রেখে অন্য জেলাগুলোতে শূন্যপদ অন্তত ৫০০ হলেও হিসেব করে দেখুন, এখনও মোট শূন্যপদের সংখ্যাটা আসলে কত!
এখানেই শেষ নয় কিন্তু! অনেকেই কাউন্সেলিংয়ের পর পছন্দমতো স্কুল বাছাই করে চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে দেখেন সেখানে বিজ্ঞাপিত পদের কোনও ভেকেন্সিই নেই! কমিশনের কাছে সে তথ্য জানালে তাঁদের কাছে এসএমএস আসে! তাঁদের দেওয়া হয় ভিন্ন স্কুলের নাম এবং সেখানে যোগদানের নির্দেশ! সেখানে যোগ না দিলে থাকবে না চাকরিটাই! জানিয়ে দেওয়া হয় তাও। তাহলে প্রচুর খাটাখাটনি করে মেধাতালিকার উপরের দিকে জায়গা করে নিয়ে লাভ কী হল? উত্তর একটাই। কোনও লাভই হল না। প্রসঙ্গত, দাড়িভিটায় ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা আমরা নিশ্চয়ই এখনও ভুলিনি! আরও আছে। রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী পরেশ অধিকারী তৃণমূলে যোগদানের পরেই ওয়েটিং লিস্টে নেই থেকে একেবারে এক নম্বরে উঠে আসে তাঁর মেয়ের নাম! আরটিআই করলেও সময়মত উত্তর মেলে না কমিশনের তরফ থেকে। আবার সেই আরটিআই করেই জানা যায়, মোট ৫৫ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় কেউ পেয়ে যান ৫৯! এই রকম অজস্র উদাহরণ! অজস্র! এমনটা মোটেও নয় যে বাম জমানাতে এসএসসি নিয়ে কোনও অভিযোগই আসেনি। তখনও দুর্নীতির টুকরো খবর শোনা গেছে। কিন্তু তা কখনই এত ব্যপক, এত বৃহৎ নয়। সত্যি কথা বলতে, তুলনাও চলে না বোধহয়!
কিন্তু ওই যে অতগুলো মানুষ ওয়েটিং লিস্টের চক্করে পড়ে থাকলেন, তাঁদের কী হল? তাঁরা এই দফতর থেকে সেই দফতরে ঘুরলেন। হকের চাকরির দাবিতে। থালাবাসন নিয়ে নবান্ন অভিযান করলেন। ডেপুটেশনের পর ডেপুটেশন জমা দিলেন। আবেদনের পর আবেদন জমা পড়ল এবং অবশ্যই তাঁরা চাকরি পেলেন না!
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
এই মুহূর্তে তাঁরা কী করছেন? এই মুহূর্তে তাঁদের জনা ৪০০-এর ঠিকানা কলকাতার রাজপথ!
বেলা তিনটের দুপুর রোদে মেয়ো রোডের পিচের রাস্তা যেখানে তীব্র দহনে ধুঁকছে, ঠিক সেখানেই কলকাতা প্রেস ক্লাব থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ফুটপাথ আর রাস্তার একফালির উপর ত্রিপল, বস্তা, সতরঞ্চি বিছিয়ে বসে আছেন ওঁরা। গত ১৬ দিন ধরে। টানা। ভয়াবহ রোদের ভ্রুকুটি বা হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে আনা ছাতাগুলোই সম্বল। মেলেনি মাথাটুকু ত্রিপলে ঢাকার অনুমতিও! মলিন মুখের প্রায় শ’চারেক যুবকযুবতী ওইভাবেই পড়ে আছেন ওখানে। না খেয়ে। দিন দশেক রিলে অনশনের পর গত চারদিন হল অনির্দিষ্টকালীন অনশন শুরু করেছেন ওই ২৫ থেকে ৩৫-এর দল। বলা ভালো বাধ্য হয়েছেন, এই পথ বেছে নিতে।
ওঁরা প্রত্যেকে রাজ্য সরকারের স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার সফল পরীক্ষার্থী। আজ্ঞে, হ্যাঁ, সফলই। স্কুল সার্ভিস কমিশনেরই গেজেটের সংজ্ঞা অনুযায়ী ওয়েটিং লিস্টের প্রত্যেকেই সফল। নিয়ম অনুযায়ীই এঁরা কেউই অকৃতকার্য নন। কিন্তু, মেলেনি চাকরি! এঁরা প্রত্যেক ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার কোয়ালিফায়ার। ২০১৭ সালের ইন্টারভিউ পরবর্তী অন্তিম তালিকা অনুযায়ী এঁরা প্রত্যেকেই ওয়েটিং লিস্টভুক্ত। খুব সাধারণ লজিকেই যাঁরা ওয়েটিং লিস্টভুক্ত, মূল তালিকায় থাকা প্রার্থীদের নিয়োগের পর যদি শূন্যস্হান থাকে, তাঁরাই সেই চাকরির যোগ্য প্রার্থী।
রেজাল্ট বেরোনোর আগে পর্যন্ত যে ভেকেন্সি ছিল, রেজাল্ট বেরোবার পর হঠাৎ করেই শোনা গেল সেই ভেকেন্সি হাওয়া! যদিও, আবারও, আরটিআইয়ের রিপোর্ট একেবারে অন্য কথা বলছে, বারবার।
ওই যে আগেই বললাম, ওয়েটিং লিস্টের যে তালিকাটি বের হয়েছে, সেটিও বড়ই অদ্ভুত, হাস্যকরও! অন্তিম তালিকায় (এমপ্যানেলড+ওয়েটিং লিস্ট) যাঁদের নাম আছে, তালিকায় তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, রিটেন টেস্ট, ভাইভা ইত্যাদির নম্বর আলাদা করে উল্লেখ করা নেই বা মোট যোগফলও দেখানো নেই। পুরোটাই শুধু নামের তালিকা! কীসের ভিত্তিতে ক্রমানুসারে এই তালিকা তৈরি হয়েছে, তালিকাটি দেখে সে সব বোঝার কণামাত্র জো নেই!
গত দু-আড়াই বছর ধরে ন্যায্য চাকরির দাবিতে প্রশাসনের এক দরজা থেকে আরেক দরজায় ঘুরেছেন এই প্রার্থীরা। ভেকেন্সি প্রচুর। ডিআই অফিস থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়ার পরেও বদলায়নি দুরবস্থার রোজনামচা। একে তো গত আট বছরে রাজ্যে একদা নিয়মিত এসএসসি পরীক্ষা অনিয়মিত হওয়ার দৌড়ে সবাইকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ওই ‘ওয়ান্স ইন আ ব্লু মুন”-এ হওয়া পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েও মিলছে না হকের চাকরি! বিকাশ ভবন জানাচ্ছে শূন্যস্থান অন্তত ১০০০। তালিকা নাকি পাঠানো হয়ে গেছে আচার্য সদনে! আচার্য সদন জানাচ্ছে তাদের হাতে কোনও তালিকা নেই! পিংপং বলের মত একবার এ দফতর থেকে সে দফতর ঘুরে শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়েই মহানগরের রাস্তায় অনশনে বসেছেন অন্তত ৪০০ জন মানুষ!
গত মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করে ছিলেন তাঁরা। “সমস্যা মিটবে” এই রকম ছেঁড়া প্রতিশ্রুতি ছাড়া মেলেনি কিছুই! নাহ, আর এই সব মুখের কথায় ভরসা করতে পারছেন না আন্দোলনকারীরা। কেনই বা করবেন? কেন নিয়মিত নয় এসএসসি পরীক্ষা? কয়েকদিন আগে এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জবাব ছিল ‘এসএসসি দুর্গাপুজো নাকি যে প্রত্যেক বছর হতে হবে?’
এই ওয়েটিং লিস্টের প্রার্থীদেরও তো তিনি প্রথমে অকৃতকার্য বলে দাগিয়ে দিয়েছিলেন, নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে! পরে অবশ্য ঢোক গিলতে বাধ্য হন! এই তো কয়েকদিন আগেই তিনি দাবিও করেছিলেন ওয়েটিং লিস্টের প্রার্থীদের চাকরি দিলে নাকি পরের বছর ভেকেন্সি থাকবেই না অন্যদের জন্য! অথচ বাস্তব নাকচ করছে তাঁর এই দাবিকেও! লিখিত কোনও ডকুমেন্ট ছাড়া কেন বিশ্বাস করবেন তাঁকে আর মানুষ? কীসের ভিত্তিতে? আড়াই বছরেও যেখানে সমস্যার সমাধানে প্রশাসন বিন্দুমাত্র কোনও সদর্থক পদক্ষেপই গ্রহণ করে না, সেখানে এই ধরনের ভাসা ভাসা উড়ো প্রতিশ্রুতির মূল্য আদতে কী, কতটুকু?
না, ওঁরা স্বাভাবিকভাবেই আর এসবে ভুলছেন না। ‘আগে তো তাও বছরে একবার পরীক্ষা হত, এক বছর না হলে পরের বছরের জন্য কোমর বাঁধা যেত, এখন তো সেসবের কোনও বালাই নেই৷’ তাই জীবন বাজি রেখেই বেছে নিয়েছেন অনশন আন্দোলনের পথ। হকের দাবি আদায় না হওয়া অবধি সরবেন না, সাফ জানাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।
‘আমরা ক্লান্ত। যদি চাকরিই না হয়, তাহলে যেন মরেই যাই। এখানেই নাহয় মরি। না জিতে ফিরব না, মরলে মরব।’ ধ্বস্ত, ক্লান্ত, মলিন সাধারণ মুখগুলো টানা বলে যাচ্ছেন এক কথা। হ্যাঁ, মরে যেতে চাইছেন! ২০১৯ সালে! কষ্ট করে পড়াশোনা করে, চাকরির পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েও চাকরি না পাওয়ার হতাশা এতটাই গ্রাস করে ফেলছে যে, মরে যেতে চাইছেন একদল মানুষ! নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, দিনাজপুর, মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি… দূর দূর থেকে এসে, প্রাপ্য চাকরি সুনিশ্চিত করতে মহানগরের রাস্তায় অনশনের পথ বেছে নিয়েছেন ওঁরা! দুধের ছানাকে বুকে চেপে বসে রয়েছেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তরুণী মা-ও! জনাপঞ্চাশ অনির্দিষ্টকালীন হাঙ্গার স্ট্রাইক শুরু করে দিলেও, বাকিরাও প্রায় খাচ্ছেন না কিছুই! ইতিমধ্যে হসপিটালাইজড বেশ কয়েকজন।
এই দুর্নীতির বলি কিন্তু শুধু চাকরিপ্রার্থীরা হচ্ছেন না। পড়ুয়াদের পঠনপাঠন, ভবিষ্যৎ, সর্বোপরি রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই আস্তে আস্তে ভেন্টিলেশনে চলে যাচ্ছে। এমনিতে নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ৩০ জন ছাত্রপিছু একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা থাকার কথা। আমাদের রাজ্যে এই অনুপাত যা তার বাস্তব চিত্রটা এককথায় ভয়াবহ। খানিক উদাহরণ দিই। ইউনাইটেড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন (ইউডাইস) এর রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যের মাধ্যমিক স্কুলে অঙ্কে ৮৫৭ জন পড়ুয়া পিছু মাত্র ১ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা। বিজ্ঞান বিভাগে ৩৮৩ জন পড়ুয়া পিছু ১ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা, সমাজ বিজ্ঞানে ৩৮৯ জন পড়ুয়া পিছু ১ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা। ইংরেজিতে ২৬০ জন পড়ুয়া পিছু রয়েছেন ১ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা। (তথ্যসূত্র : যুবপ্রত্যাশা) এক্ষেত্রে তাহলে কীভাবে চলছে স্কুলগুলি? নিয়ম অনুযায়ী পার্শ্বশিক্ষকের নিয়োগও শতাংশের হিসাবে বাঁধা। নির্দিষ্ট বিষয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্কুলগুলিতে নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য যে শিক্ষক বা শিক্ষিকার নিয়োগ হচ্ছে তাঁরা নিজের বিষয় ছাড়াও ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত অন্যান্য বিবিধ বিষয়ে ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছেন। মাধ্যমিক স্কুলগুলিতেও চিত্র একই! বহুক্ষেত্রে তাঁদের উপর যেমন অমানবিক চাপ তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে, পড়ুয়া-শিক্ষক/শিক্ষিকা অনুপাতের করুণতম অবস্থার জন্য দিন দিন সরকার পোষিত এবং সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে পঠনপাঠন গোল্লায় যাচ্ছে। সার্বিক মান কমছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা বহু চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারছেন না এই অবনমন। এই ফাঁকে ব্যাঙের ছাতার মত যত্রতত্র তৈরি হচ্ছে একের পর এক ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুল।
শহরাঞ্চলে শোচনীয়ভাবে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ও পোষিত স্কুলগুলিতে পড়ুয়া কমার অন্যতম কারণ যেমন ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি আকর্ষণ (যার বাস্তবতাও অস্বীকারযোগ্য নয়), অন্যদিকে স্কুলগুলির শোচনীয় অবস্থাও কিন্তু কম দায়ী নয়। কোনও কোনও স্কুলে তো পড়ুয়ার অভাবে তালা পর্যন্ত ঝুলতে শুরু করেছে! ভরসা হারিয়ে অভিভাবকরা মানের বিচার না করেই ঝুঁকছেন বেসরকারি স্কুলের দিকে। ‘ভালো’ বেসরকারি ইস্কুলের ফিজ যোগানোর ক্ষমতা বেশিরভাগ অভিভাবকেরই নেই, ফলে সেখানে মানের বিচার করার প্রশ্নই আদতে বাতুলতা সামিল। অনেকে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সামর্থ্যের বাইরে গিয়েই বেসরকারি স্কুলের দ্বারস্থ হচ্ছেন। পুরো শিক্ষাব্যবস্থা প্রশাসনের চরম গাফিলতির জন্য নিঃশব্দে ঢালাও বেসরকারিকরণ পথে হাঁটছে। পকেট ভারী হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। রোজ তারা বাড়িয়ে চলেছে শিক্ষার “মূল্য”। ফলে, যার পকেটে টাকা থাকছে, সে কিনতে পারছে শিক্ষা! স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম মৌলিক অধিকার শিক্ষা, আস্তে আস্তে কুক্ষিগত হচ্ছে মুষ্টিমেয়র হাতে!
শুধু বড় বড় সদর শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও কিন্তু রোজ বাড়ছে বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা। যদিও, এখনও সেখানে পড়ুয়াদের মূল ভরসা এই সাহায্যপ্রাপ্ত বা পোষিত স্কুলগুলোই। কিন্তু ওই যে, পড়ুয়া-শিক্ষক/শিক্ষিকা অনুপাতের বেহাল দশার জন্য শিক্ষিক/শিক্ষিকাদের পক্ষে সব পড়ুয়াদের প্রতি সমান নজর দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলে পড়ুয়াদের শিক্ষাও খাপছাড়া, অসম্পূর্ণ হয়ে থাকছে।
আছে শূন্যপদ, আছেন উত্তীর্ণ প্রার্থী। কিন্তু তাও মিলছে না চাকরি!
ওই যে যাঁরা, হতাশ হয়ে, হয় চাকরি না হয় মৃত্যুর পথ বেছে নিতে চাইছেন আজ, সত্যিই কি লড়াইটা শুধু তাঁদের? আজ যেখানে শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও ন্যায্য চাকরির থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ ঝাঁক যুবকযুবতী, কে বলতে পারে এই রকমই কোনও দুর্নীতির নাগপাশে আবদ্ধ হবে না আমার আপনার আপাত সুখী গৃহকোণ? শিশুদের থেকে যেভাবে শিক্ষার মৌলিক অধিকার আস্তে আস্তে সরে আসছে, জবাব দিতে পারব তো তাদের, ভবিষ্যতে? ক্ষমা করবে কখনও তারা? ধুঁকছে পরিকাঠামো, ধুঁকছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধুঁকছে প্রজন্ম, পড়ুয়ারা। চাকরি পাচ্ছেন না কৃতকার্যরা অন্যদিকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অদ্ভুত আঁধারে ঢাকতে মাসিক দু’ আড়াই হাজারের বিনিময়ে সিভিক টিচার নিয়োগের ঘোষণা চলছে!
প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট। জানি না, কীভাবে এরপর সমাধান হবে এই জটের। জানি না আর কদিন অভুক্ত থাকতে হবে ওদের। শুধু জানি, পাশে দাঁড়াতে হবে। এইভাবে সব ভাসিয়ে দিলে একদিন বন্যা এসে যে আমাদেরও গৃহহীন করবে! তখন ঠাঁই পাব কোথায়, পাশে পাব কাকে?