প্রতিভা সরকার
একটা গান। করুণ সুরের অথচ দ্রুত তালের গান। কিছুক্ষণ শোনার পর নেশা লেগে যায়। এইটেই যেন সেই আদিসুর যা প্রবাহিত প্রাণের প্রথম প্রকাশমুহূর্ত থেকে। কখনও মনে হয় কেউ বিলাপ করছে, হেঁচকি তুলে কাঁদছে, অভিযোগের তুফান তুলে দিচ্ছে। যেন এখুনি এই সুর বদলে যাবে তর্জনী-তোলা অভিশাপে! এই গান যেন বলে, যারা ধ্বংস করেছে প্রাণবায়ু যোগান দেওয়া এই বিরাট মহীরুহদের, তারা সব তফাত যাও, তফাত যাও। তফাত যাও যত বহিরাগতের দল, এ ভূমি আমাদের। গানের ধুয়ার মতো যে প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে তা হল, একটি নদীও কি ছাড় পাবে ওই বজ্রমুষ্টির থেকে, পাবে কি একটি ঝরনাও? আর প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর নিহিত থাকে— না, পাবে না। নিয়মরাজা যদি না থাকেন তাহলে টিঁকবে না এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, কারণ তিনিই স্রষ্টা এই বনজঙ্গল, নদী পাহাড় আর মানুষ, পশু, পাখির।
গানটি সকলের শোনার জন্য রইল। এ এক দুর্লভ গান, যেন প্রকৃতির নিজের সুরতালে বাঁধা। বেদনার এবং রূপকের মোড়কে থাকলেও এ গান প্রতিবাদের এবং সচেতনতার গান। এটি নিয়মগিরির ডোঙ্গরিয়া কন্ধ উপজাতির গান।
The Song of Niyamagiri from CircaFilms on Vimeo.
দক্ষিণ-পশ্চিম ওড়িশার এই আদিম উপজাতিটি বহুদিন হল খবরের শিরোনামে। শুধু তাদের অরণ্যনির্ভর অসাধারণ জীবনযাত্রা বা তাদের যাপন-অনুপ্রাণিত অস্কারজয়ী অবতার সিনেমার সুবাদে নয়। জমিহাঙর, পরিবেশ ও খনিজখোর কর্পোরেট ও কর্পোরেটবান্ধব রাষ্ট্রের সঙ্গে অসম লড়াইতে প্রথম রাউন্ড জিতে যাবার জন্যও বটে। জানিমানি বিদেশি কম্পানি বেদান্ত রিসোর্স-এর বক্সাইট উত্তোলন রুখে দিয়ে তারা গোটা বিশ্বে এই ধরনের প্রতিবাদ ও লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক মুখ। কিন্তু সেই ডেভিড-গলিয়াথের লড়াইয়ের পরও কি শান্তিতে আছে নিয়মগিরির কন্ধরা? ইউপিএ সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বক্সাইট খনন বন্ধ করে দিলেও পালাবদলের পর কেমন আছে প্রকৃতি-উপাসক এই সরল উপজাতীয় মানুষগুলি? বিজেপি সরকারের ফরেস্ট অ্যাক্ট পাল্টাবার দিকে দ্রুত পদক্ষেপ, সুপ্রিম কোর্টের বনবাসী মানুষ সংক্রান্ত নতুন নির্দেশনামা কি তাদের ফের ঠেলে দিল নতুন আতান্তরে?
নিয়মগিরি ও ডোঙ্গরিয়া কন্ধেরা
ওড়িশার দুর্ভিক্ষপীড়িত কালাহান্ডি থেকে রায়গড় অব্দি টানা নীল পাহাড়শ্রেণির নাম নিয়মগিরি। এইখানেই বাস কন্ধ উপজাতির। এদেরই এক শাখার নাম ডোঙ্গরিয়া কন্ধ। নিয়মগিরিই তাদের নিয়মরাজা, যাঁর বসত ঠিক ওই পাহাড়ের মাথায়। তাদের প্রতিপালক এবং দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তিনি অবলীলায় ঠিক করে দেন পরিবেশ, ব্যক্তি এবং সমাজজীবনের সমস্ত নিয়ম। পাহাড় এবং পাহাড়জোড়া অরণ্য পূজ্য, কারণ বনাঞ্চল তাদের জীবনধারণের সমস্ত উপকরণ সরাবরাহ করে, পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে আসা ঝরনা নদী তৃষ্ণার জল এবং সেচের জল যোগায়। আর দেয় আত্মিক শান্তি, দুর্লভ জাতিগত সত্তা। ফলে পূর্বজদের আশীর্বাদধন্য এই ভূমি তাদের স্বর্গসমান। পাহাড় তাদের রক্তে এমন ভাবে মিশে আছে যে ডোঙ্গরিয়ারা যেন পাহাড়ময়। তাদের মন্দিরের চুড়ো, অভ্যন্তরের নানা মোটিফ, এমনকি হাতে বোনা শাল অব্দি পাহাড়ের তেকোণা ডিজাইনে ভর্তি। তাদের জাতিনামটি এসেছে ডোঙ্গার কথাটি থেকে যার অর্থ হল পাহাড়। নিজেদের তারা ডাকে ঝার্নিয়া, এই শব্দটির অর্থ ঝরনার প্রহরী। শান্তিপ্রিয় এই মানুষগুলির স্নেহচ্ছায়ায় এই অঞ্চলে টিঁকে রয়েছে বন্যপ্রাণীর জন্য দু দু-খানা অভয়ারণ্য— কার্লাপট ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি এবং কোটগড় ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। ডোঙ্গারিয়াদের বিশ্বাস নিয়মগিরির ঢালে চাষবাস করবার অধিকার তাদের অর্পণ করেছেন স্বয়ং নিয়মরাজা। এই ঐশ্বরিক অধিকার কেড়ে নেবার হিম্মত পৃথিবীর কোনও মানুষের নেই। বন থেকে তারা আহরণ করে দুশোর বেশি খাদ্যবস্তু এবং নিজেরা চাষবাস করে ফলায় আরও একশ রকম। আনারস, কাঁঠাল, আম, কলা, কমলালেবু, মধু, ভেষজ উদ্ভিদ ভর্তি বনভূমিতে আশ্রয় পায় অনেক পশুপাখি। এত স্বয়ংসম্পূর্ণ এই উপজাতি, নিজেদের ভেষজ চিকিৎসার ধারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তারা, নিরাময় করছে আর্থরাইটিস, আমাশা, ম্যালেরিয়া, হাড়ভাঙা এবং সর্পদংশন। বোঝাই যায় এই কন্ধভূমি নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে বিস্তীর্ণ এলাকার বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়া।
ঠিক তাই-ই হতে যাচ্ছিল ২০১২ সালে, যখন নিয়মগিরি রেঞ্জের মাটিতে প্রচুর জমে থাকা বক্সাইটের লোভে এই অঞ্চলে নজর পড়ে বিশিষ্ট কর্পোরেট-শকুন, বেদান্ত রিসোর্সের মালিক অনিল আগরওয়ালের। ভারতে নিও-লিবেরাল অর্থনীতির আগমন তখন এদের সামনে সদ্য তুলে ধরেছিল অবাধ লুণ্ঠনের অধিকার। তারই সদ্ব্যবহারে কালক্ষেপ না করে ডোঙ্গরিয়াদের বাসভূমিতে শুরু হয়ে যায় সার্জিকাল স্ট্রাইক, বক্সাইট থেকে ছেঁকে অ্যালুমিনিয়াম তোলবার কারখানা।
প্রথমেই দখল হয় লাঞ্জিগড়। কত দুঃসাহস এই আধুনিক বানিয়াদের যে বক্সাইট খননের নিয়মমাফিক সরকারি অনুমতি পাবার আগেই সংশোধনাগার খুলে বসে সবুজ ডোঙ্গরিয়া গ্রামটির বুকের ওপর। সরকারকে কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে এই সংশোধনাগারের জন্য বনভূমিকে বিন্দুমাত্র ধ্বংস করবে না। কিন্তু মুনাফা আর মিথ্যার বেসাতি যখন ক্রমে বেড়েই চলে, কথা রাখবার দায় তার কোথায় থাকে! প্রথম খেপেই বেদান্ত ৬০ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করে সংশোধনাগার তৈরি করে এবং সরাসরি পাহাড় থেকে বক্সাইট আনবার জন্য দৈত্যাকৃতি কনভেয়ার বেল্ট বসায়। চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায় লাঞ্জিগড় এবং কিনারি গ্রাম। রিহ্যাব কলোনিতে পুনর্বাসন দেওয়া হয় কন্ধদের। নদী ঝরনা পাহাড়বিহীন কুৎসিত কংক্রিটের খুপরি, নানা রোগের ডিপো আর স্বরাট সম্রাট প্রকৃতির সন্তানের পরিবর্তন হয় কিছু শোষিত কুলিকামিনের কঙ্কালে। বাদবাকিরা সব-হারানো দিন আনি দিন খাইয়ের দলে।
দাবানলে তো দেবালয়েরও রেহাই নেই, তাই সংশোধনাগার থেকে দূষিত বর্জ্য অন্যান্য গ্রামেও নানা চর্মরোগ নিয়ে আসে, সঙ্গে গবাদি পশুর মড়ক। ভূগর্ভে সঞ্চিত জলও রেহাই পায় না দূষণের হাত থেকে। বংশধারা নদী যা কন্ধদের জীবনরেখা, লাল হয়ে যায় দূষিত বর্জ্যে। বেদান্ত কিন্তু আশ্বাস দিয়েছিল খনন সম্পূর্ণ হবার পর অনেক গাছ পুঁতে বনভূমি ফিরিয়ে দেবে। তবে সে কেমন খনন? দিনে ১৬ ঘণ্টা, সপ্তাহে ৬ দিন, ২৩ বছর ধরে চলবে গাছপালা উৎপাটিত করে, মানুষ পশু মেরে বক্সাইট তোলার নামে ধরিত্রীর এই লাগাতার ধর্ষণ। সে সবের শেষে গুটিকয়েক ইউক্যালিপটাসের সদ্য পোঁতা চারা গরম বাতাসে কচি মাথা নাড়াবে— এই-ই হয়তো ছিল বেদান্তের ক্ষতিপূরণ আর বনভূমি সৃজনের ধারণা! পয়সা হজম তো খেলও খতম! হারিয়ে যাওয়া নদী ঝরনা, বাস্তুতন্ত্রের কী হবে সে ব্যাপারে বেদান্ত চুপ। পরিবেশের এই অপূরণীয় ক্ষতি আর একটা দুর্ভিক্ষপীড়িত কালাহান্ডির জন্ম দেবে কিনা ওড়িশায়, সে প্রশ্নে তার মাসতুতো ভাই সরকার বাহাদুরও চুপ। এ সবই বোধহয় কোল্যাটারাল ড্যামেজ। সভ্যতার নির্মাণ আর প্রকৃতি লুণ্ঠনের সময় এসব-ই হয়, বারবারই হয়েছে।
ডোঙ্গরিয়াদের লড়াই
হয় বলে হতেই হবে তা তো নয়। এবার প্রতিরোধ গড়ে তুলল ডোঙ্গরিয়া কন্ধেরা। হাত মেলাল কিছু পরিবেশকর্মী, অন্য কিছু সচেতন মানুষ যাদের শহুরে নকশাল বলে ডাকাটা আজকালকার ফ্যাশন। পাশে দাঁড়াল কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। রাস্তা অবরোধ, গ্রামসভা, মিটিং মিছিল, গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের সব চেষ্টার পরেও যখন বেদান্তের জিপ পৌঁছে গেল পাহাড়চূড়ায়, ঠিক যেখানে নিয়মরাজার বাস বলে কন্ধদের বিশ্বাস, দলে দলে ক্ষিপ্ত ডোঙ্গরিয়া আগুন ধরিয়ে দিল সেই জিপে। আন্তর্জাতিক খবর হয়ে উঠল এই অসম লড়াই। এবার নড়েচড়ে বসে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ওই অঞ্চলের সমস্ত গ্রামসভাকে নির্দেশ দেওয়া হয় গ্রামবাসীরা কী চায় তা জানবার। বারোটি গ্রামসভায় একজোট হয়ে গ্রামবাসীরা জানায় তারা বেদান্তের কারখানা চায় না। আর দেরি করেনি কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক। বন্ধ করে দেওয়া হয় বেদান্তের বাড়াবাড়ি, সবুজ বনভূমি ধ্বংস করে কুৎসিত খোলামুখ খনি তৈরি ও মুনাফা লোটার পরিকল্পনা।
তার আর পর নেই
একটা গণতান্ত্রিক, কল্যাণকামী রাষ্ট্রে এইভাবেই মধুরেণ সমাপয়েত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দেশটার নাম ভারত। তাই ডোঙ্গরিয়াদের কাহিনী এইখানেই শেষ নয়, বরং আরও যেন নিঃশেষ হল তাদের লড়াই। কারণ এইবার শুরু হল হাতে না পেরে ভাতে মারার কাহিনী, আর তাতে নতুন করে জড়িয়ে যেতে থাকল এই বিশাল দেশের কোণায় কোণায় থাকা অসংখ্য আদিবাসী, উপজাতীয় মানুষজন।
কর্পোরেটকে জল-জমিন-জঙ্গলের অধিকার পাইয়ে দেবার প্রবণতা মসনদে শাসক বদলের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে আরও প্রকট হয়েছে। এমন তো নয় যে লাঞ্জিগড়ের রিফাইনারি বন্ধ হয়ে গেছে। তা চলছে বহাল তবিয়তেই। বেদান্ত এ দেশের অন্য জমি খুঁড়ে, কখনও দেশের বাইরে থেকে বক্সাইট আনিয়ে রিফাইনারি চালু রেখেছে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর যা বন্ধ হয়েছে তা হল সম্প্রসারণ। ১১২টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি আবার খনন শুরু হয়। সেগুলোতে আবহমান কাল ধরে বসবাস করছে ডোঙ্গরিয়া ও কুটিয়া কন্ধরা। এছাড়াও আছে কিছু দলিত। এদের সবাইকে নিয়ে পরিবেশ রক্ষার্থে তৈরি হয়েছে নিয়মগিরি সুরক্ষা সমিতি। ২০১৬ সালে দেশের গৃহমন্ত্রক হঠাৎ এই সমিতিকে মাওবাদী প্রভাবিত আখ্যা দেয়। তার উদ্দেশ্য কী সে তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। জমির ওপর অধিকার কায়েম রাখবার দুই হাতিয়ার হল ল্যান্ড একুইজিশন অ্যাক্ট, ২০১৩ এবং ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট, ২০০৬। এইসব মানবিক আইনি অধিকার ক্রমাগত সংশোধনের চেষ্টা চলছে সরকারি তরফে। বলা বাহুল্য সে সংশোধন কর্পোরেটের কোলেই ঝোল টেনে দিচ্ছে। ২০১৫ সালে সংশোধিত হয়েছে মাইনস অ্যান্ড মিনারেল অ্যাক্ট। এই সংশোধনের জোরে বেদান্ত খোয়াব দেখছে প্রাকৃতিক সম্পদের নিলামে অংশগ্রহণ করে নিয়মগিরিতে আবার থাবা বসাবার। দশ হাজার কোটি টাকা ইনভেস্টমেন্ট করেছে সে ঐ রিফাইনারির পেছনে। এত সহজে তা ত্যাগ করার প্রশ্ন আসে কি, বিশেষত শাসক যখন তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। তাই সে আজও অবলীলায় উৎপন্ন করে চলেছে রিফাইনারি থেকে বার হওয়া টক্সিক বর্জ্য রেড মাড। লাঞ্জিগড়ের আশেপাশের বাতাস বিষিয়ে যাওয়া আজও চলছে অবাধে। শুধু তাই নয়, ২০১৬ সালে ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশন চেষ্টা চালায় ২০১৩-এর সুপ্রিম কোর্টের রায়, যা গ্রামসভার রায়কে প্রাধান্য দান করেছিল, তাকে পুনরায় বিবেচনা করাবার। যদিও তাদের সে চেষ্টা ধোপে টেঁকেনি তবুও তা বয়ে এনেছে এক অশনিসংকেত। নিয়মরাজার প্রজারা ভীত সন্ত্রস্ত যে নতুন করে খোলা খনিমুখ থেকে যাবতীয় দূষণ গলগলিয়ে বেরিয়ে এসে পণ্ড করে দিতে পারে তাদের এতদিনের সংগ্রাম।
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
মাওবাদী ছাপ্পা যখন পড়েই গেছে তখন লোকাল বাজারগুলোতে বনজ দ্রব্য বিক্রি করতে আসা ডোঙ্গরিয়াদের কেন রেহাই দেবে সিআরপিএফ আর ওড়িশা সরকারের অ্যান্টি-মাওয়িস্ট ট্রুপ? প্রায়ই জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে তাদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, পুছতাছ চলে। মিথ্যে চার্জ এনে গ্রেপ্তারিও চলে। মাওবাদী আর রাষ্ট্রশক্তির মধ্যে স্যান্ডুইচের অবস্থা শান্তিকামী ডোঙ্গরিয়াদের।
তাদের গ্রামগুলিতে আজও কোনও পাকা রাস্তা হয়নি সরকারি উদ্যোগে। না হয়েছে স্কুল বা হাসপাতাল। উন্নয়নবিরোধী তকমা লাগিয়ে দিয়ে গ্রামবাসীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে নাগরিকের পাওনা সুযোগসুবিধার প্রাথমিক স্তর থেকেও।
রাষ্ট্রশক্তি এবং কর্পোরেটের এই ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের নতুন রায়— অরণ্যের অধিকার আইন ২০০৬ মোতাবেক যে বনবাসীরা জমির পাট্টা পায়নি তারা আর বনভূমিতে বাস করবার অধিকারী নয়। এই রায় কার্যকর হলে ষোলটি রাজ্যের দশলাখের ওপর আদিবাসী/বনাঞ্চলবাসী পরিবার মূলচ্যুত হবে। পাট্টার জন্য আবেদনই করেনি বহু মানুষ। তার প্রধান কারণ খবর না রাখা। বনবাসী মানুষগুলির সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ না থাকা এবং শিক্ষার অভাবই অনেকাংশে এই বিচ্যুতির জন্য দায়ী বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু প্রজার সুরক্ষার দায় তো রাজার। তার ভূমিকা কী ছিল?
সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়ে চারদিকে শোরগোল পড়ে গেলে আপাতত মুলতবি রাখা হয়েছে এর বাস্তবায়ন। কিন্তু তিন প্রজন্ম ধরে বসবাস করা গ্রাম্য মানুষগুলির ন্যায্য অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দেবার জন্য রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার কী করেছে এই প্রশ্ন গোটা ব্যাপারটার মধ্যেকার ফাঁকফোকরগুলিকে উন্মোচিত করে দেয়। কেউ কিছুই করেনি, এখন পালা সব দায় ঐ মানুষগুলোর ওপর চাপিয়ে দেবার। সত্যি কার গাফিলতিতে তাদের দখলিস্বত্ব নথিভুক্ত করা গেল না তা খুঁটিয়ে দেখবে কে? পুরনো ফরেস্ট আইনকে সংশোধন করতে সরকার এত মরিয়া কেন সে প্রশ্নেরও জবাব নেই। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অরণ্যের অধিকার আইনকেই কি প্রকারান্তরে অকেজো করে দিচ্ছে না?
পথের শেষ কোথায়
উত্তরগুলো সব জানা বলেই দিকে দিকে ফেলা নাগিনী-নিঃশ্বাসের আঁচ থেকে বাঁচার সম্ভাবনা যেন দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। জল-জমিন-জঙ্গল যেন হরির লুটের তিন বাতাসা, বিলিয়ে দেওয়া চলছে দেদার। সর্বশেষ সংযোজন, ছত্তিশগড়ে গৌতম আদানিকে নিবিড় অরণ্যের ইজারা দেওয়া। উনি বন সাফ করে সেখানে খোলামুখ কয়লাখনি পত্তন করবেন। হাসদেও আরান্দ নামে এই অতি গভীর প্রাচীন অরণ্যের ৮৪১.৫৩৮ হেক্টর (৮০০টি ফুটবল মাঠের সমান) জমি এর মধ্যেই সাফ হয়ে গেছে।
এইভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশ ধ্বংসের ভাইরাস আর তার মোকাবিলায় নিয়মগিরির গান। লড়াইয়ের ময়দানে ছত্তিশগড় বাঁচাও সমিতি আর নিয়মগিরি সুরক্ষা সমিতি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে। সোনি সোরির পাশেই আছেন তরুণ ডোঙ্গরিয়া নেতা ড্রেঞ্জু। ধর্মযুদ্ধের শঙ্খনিনাদ ছড়িয়ে পড়ছে আকাশেবাতাসে। আমাদেরও পক্ষ নিতে হবে। নির্ভুল চিনে নিতে হবে কে লড়ছে আমার লড়াই। কারণ এই লড়াইয়ে নিষ্পক্ষ থাকার অর্থ শত্রুকে সাহায্য করা।
আমি কাঁদি গাছেদের জন্য,পাখিদের জন্য,হারিয়ে যাওয়া নদীদের জন্য..আর আগামীর জন্য..