সোহম দাস
ছোট থেকেই শিক্ষক বাবার মুখে একটা ক্ষোভের কথা শুনতাম। “টিচারদের মাইনে বাড়লেই লোকের গা জ্বলে যায়।” সেটার কারণটা যে ঠিক কী, সেটা আজ অবধি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারলাম না। অল্প অল্প বুঝছি যে, আসলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে গণ-মূর্খামিটাই সবচেয়ে বেশি কাম্য। যে কারণে, মাসের পর মাস সেন্ট্রাল-স্টেট নির্বিশেষে ইউনিভার্সিটি, রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষণারত তরুণ গবেষকদের টাকা আটকে থাকে, দেশের নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বড় বড় করে নোটিশ বেরোয়— “ফান্ডিংয়ের অভাবে এমাসে শিক্ষক, গবেষক, অশিক্ষক কর্মচারী সকলকেই অর্ধেক মাইনে দেওয়া হবে। আবার যখন ফান্ডিং আসবে তখন পুরো মাইনে দেওয়া যাবে।” মানে, আদৌ কবে আসবে সেটা কারওই জানা নেই।
যাইহোক, আপাতত আমাদের স্ব-রাজ্যে এই গত প্রায় একমাস ধরে যে বিষয়টাকে খুব পরিকল্পনামাফিক সরকারপক্ষ-সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষগণ এড়িয়ে যাচ্ছেন, সেই অনশন আজ মোট দিনের সংখ্যার নিরিখে একদা দাপুটে নেত্রীর রেকর্ড হাসতে হাসতে ভেঙে দিল। তা এইভাবে ‘সিংহাসনচ্যুত’ হওয়ায় যদি কোনওপ্রকার লাজলজ্জার লেশমাত্রও দেখা দেয়, তবে তা আখেরে দুপক্ষকেই লাভবান করবে। তবে যা পরিস্থিতি, তাতে সেই দুয়ে-দুয়ে চার হওয়া আপাতত দিবাস্বপ্ন। আজ বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক-নিয়োগের ইতিহাসটি নজরে এল। তাতে মোটমাট বিষয়টি যা দাঁড়াল, ১৯৯৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে যারা শিক্ষকের আসনে বসতে পেরেছেন, এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে তাঁদের চেয়ে ভাগ্যবান আর কাউকে মনে হচ্ছে না।
পড়ুন — যে যেখানে লড়ে যায়
এসপ্ল্যানেড মেট্রোর সাত নম্বর গেট দিয়ে বেরোলেই বিধান মার্কেট। আজ্ঞে, মাননীয় ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নামাঙ্কিত বাজার। পশ্চিমবঙ্গের রূপকার। যাঁর আমলারা কিনা শিক্ষকদের রাইটার্সে ঝাড়ুদার পদে আবেদন করতে বলেছিলেন। তা সেই মহান ব্যক্তির নামাঙ্কিত স্থানটি থেকে একটু এগোলেই সারি দেওয়া দূরপাল্লার বাস। খৈনি-টেপা কন্ডাক্টর, ড্রাইভারদের রোজনামচা। সেসব সামলে-সুমলে ওই প্রেস ক্লাবের সামনে কী হচ্ছে, সেটা নিয়ে আদৌ স্থানীয় মানুষ ভাবিত নন, তা বোঝাই যায়। এনডিটিভিকে দেখলাম। একজন ভিডিওগ্রাফার, একজন প্রশ্নকর্ত্রী। ছেলে-কোলে মা। ছেলেটা কোনও কারণে কেবল হাসছে। হ্যাঁ, কাঁদতে দেখিনি তাকে। ফোটোগ্রাফারের পক্ষে ভালো ফ্রেম নয় বোধহয়। যাইহোক, সর্বভারতীয় চ্যানেলটি সেসবকে পাত্তা না দিয়ে দিব্যি বাইট তুলছে।
রাস্তার ধারের বড় অংশটার ওপর থেকে ছাউনিটা তুলে সরিয়ে দিয়েছে আজকেই। উদ্দেশ্য খুব সোজা। ওঠো, নয়ত এভাবে তিলে তিলে ওঠাব। কিন্তু রোদ, ঝড়, জল উপেক্ষা করা অভুক্ত দেহগুলো মাটি কামড়ে পড়ে থাকলে তাদের ভার এমনিই বেড়ে যায় বোধহয়। দৈহিক ওজনে নয়, আত্মবিশ্বাসে। সেখানে গিটার নিয়ে স্লোগান চলছে। এটা দুদিন আগে ছিল না। খোলা আকাশের তলায় সবাই জড়ো হয়ে গেছে। এপাশের ছাউনি দেওয়া মঞ্চটা সেই তুলনায় ফাঁকা-ফাঁকা। শেখ শাহরিয়র। ২০১৬ তে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ব্যাগে মাথা রেখে শুয়ে। “পাওয়ার ব্যাঙ্কটা দাও, চার্জ দিতে হবে।” মোবাইলে চার্জ দিতে কার্পণ্য নেই, অথচ নিজেদের পেটে আজ ছাব্বিশটা দিন দানা পড়ছে না।
শাহরিয়রকে কথাটা বলতে হাসেন। ভাইরাল ফিভার, টনসিলাইটিস, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন। হাসতে হাসতেই বলা। প্রথম দিন রাতে বুকের ওপর দিয়ে ধেড়ে ইঁদুর চলে গেল। লিঙ্কনকে আজ দেখিনি। আগেরদিন কথা হয়েছিল। লালা, পিত্তবমি। রাতে সকলে ঘুমোচ্ছে তখন। এদের সকলের গল্পটা মোটামুটি এক। ওদের নেতা। শেখ ইনসান আলি। দুর্বল শরীরেও গলার দাপট কমেনি। “কঙ্কাল হয়ে যাব, তাও ন্যায্য দাবী না মানলে অনশন থেকে সরব না। পুলিশ মারুক, আমাদের রক্তে কলকাতার মাটি পবিত্র হবে।” হঠাৎ নামা সন্ধের অন্ধকারে বড় উজ্জ্বল লাগে গলাটা শুনতে।
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
রাত দশটার ভেতর সুলভ বন্ধ। দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব। বেশিরভাগই মহিলা। এসে এসে ছবি তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে। অশ্রাব্য কটূক্তি। দৈহিক লড়াইয়ের ক্ষমতাও আর হয়ত নেই। শুধু সহ্য করে যাওয়া। কতদিন? ওঁদেরও প্রশ্ন। আর কতদিন? অনশনের রুগী দেখলেই এসএসকেএমে ডাক্তারের জ্ঞান-বিতরণ। স্যালাইনের ছুঁচ ফোটানোর সময় তিন-চার জায়গায় ফুটো করে দিচ্ছে। প্রেস ক্লাবের পাশে সার দিয়ে দাঁড়ানো চেনা চ্যানেলের স্টিকার লাগানো গাড়ি। শুধুই গাড়ি, মানুষ নেই। ওপারেই নিউ মার্কেটের রোজকার ভিড়। জনতার ভিড়ে মানুষের দেখা যাওয়া ভার। যারা পাশে দাঁড়াতে চাইছে, তাদেরকে নিরাপদ থাকার উপদেশ। “ওরা তো এসব ইচ্ছে করে করছে”, “রোজ দান করতে যাস নাকি?”, “বিজেপির ইন্ধন নেই তো? ওরা হঠাৎ এত জেগে উঠল কী করে! আজকাল আর কোনও আন্দোলন অরাজনৈতিক হয় না!”
প্রতিপক্ষ কি শুধুই রাষ্ট্র?