অনিকেত চট্টোপাধ্যায়
‘ব্ল্যাক মিরর’ নামে একটা টিভি সিরিজ রয়েছে। রাষ্ট্র, টেকনোলজি, সোশ্যাল মিডিয়া ও বাজার আসলে কীভাবে মানুষের অনুভূতি, তার মানবিক প্রবৃত্তিগুলোকে পণ্য করে তোলে, মুনাফা লোটে এবং শেষে ছিবড়ে করে ফেলে দেয়, সেটাকে কেন্দ্র করেই এই সিরিজটা। এরই একটা এপিসোডে দেখেছিলাম, একজন ভদ্রমহিলা সকালে উঠে দেখেন তাঁকে মারার জন্য আততায়ীরা হন্যে হয়ে খুঁজছে। হাতে পেলেই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। ভদ্রমহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রাণভয়ে ছুটতে, সাহায্য চাইতে শুরু করেন। কিন্তু, আশেপাশের লোকজন সাহায্য করার বদলে তাঁর ছবি তুলতে থাকে দূর থেকে, ভিডিও তোলে, লাইভ স্ট্রিম করতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়াতে দলে দলে। সবাই আঙুল তুলে দেখায় দূর থেকে, দল বেঁধে ভিড় করে আসে দেখতে। তিনি মৃত্যুর হাত থেকে রাস্তায়-জঙ্গলে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে এই ‘লুপ’ শুরু হয় তাঁর। এপিসোডের শেষে দেখা যায়, মহিলাকে এই সিমুলেশনে রেখে আসলে এক ‘রিয়েলিটি শো’ চালাচ্ছে এক সংস্থা!
‘লুপ’ চলছে ওঁদেরও। খাবার ছাড়া, পর্যাপ্ত পানীয় জল ছাড়া, পরিচ্ছন্ন শৌচালয় ছাড়া, মাথার ওপর ত্রিপল ছাড়া গনগনে রোদে বসে থাকার লুপ। জায়গা খুব বেশি নয়, লোক কিন্তু সত্যিই খুব বেশি। ফলে চৌকো একফালি জায়গাতেই বসে থাকতে হচ্ছে ঠায়, সেটাকেই টেনে চওড়া করে শুয়ে থাকতে হচ্ছে রাতে, ওই জায়গাটুকু ধরে রাখতে ঝগড়া-কথাকাটাকাটি-মাথাগরমও হচ্ছে পাশের অনশনরত সাথীর সঙ্গে। দূরে একটা সুলভ শৌচালয়, তাতেই গোটা ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকার সঙ্গে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারতে হচ্ছে তাঁদের। সেই অস্বস্তিতে ঠায় গরমে বসে থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত জল খেতে চাইছেন না, হাতের ইশারায় ফিরিয়ে দিচ্ছেন বোতল। তারই স্বাভাবিক ফলশ্রুতি কিডনির ক্ষতি, মূত্রনালীর রোগ। ওঁরা কিন্তু এসব জেনে-না জেনে-উপেক্ষা করেও বসে আছেন প্রতিদিন। ‘লুপ’ চলছে বেদনাময় এক অপেক্ষার।
পড়ুন — যে যেখানে লড়ে যায়
ওঁরা এসএসসি উত্তীর্ণ। ২০১২ সালের পর এসএসসি হয় ২০১৬ সালে। সেই পরীক্ষায় বসার জন্য বিএড ক্লিয়ার করতে হয়েছিল। করেছিলেন। পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তারপর কিন্তু পুরোটাই ধোঁয়াশা। কোনও লিস্ট বেরোয়নি।
আমিও এসএসসির নিয়মকানুন বেশি কিছু জানি না। কিন্তু কাল অনশনকারীদের কথা থেকে একটা সহজবোধ্য দাবীর কথা উঠে এল। আগে এসএসসি পরীক্ষা হলে, লিখিত মৌখিকের বিভাজন সমেত মোট প্রাপ্ত নাম্বার দিয়ে মেধাতালিকা প্রকাশিত হত– যার মাধ্যমে সহজেই বোঝা যেত, কার পরে কে রয়েছে, কে চাকরি পাবে, কে প্যানেলভুক্ত হবে। এই সরকার মেধাতালিকা প্রকাশ তো দূরের কথা, কোনও তালিকাই প্রকাশ করেনি। এই এসএসসি উত্তীর্ণ আন্দোলনকারীরা তখন হাইকোর্টে RTI করেন, যার চাপে পড়ে একটা তালিকা বার করতে বাধ্য হয় সরকার— কিন্তু সেই তালিকা মেধাতালিকা নয়! কেবল পরপর র্যাঙ্কগুলো জুড়ে দায় সারা হয়েছে। তবে শেষ এখানেই নয়! বেরোনোর পরপরই হঠাৎ ওয়েবসাইট থেকে উবে যায় সেই লিস্ট এবং যাবতীয় ভ্যাকেন্সি। সেই জায়গায় চলে আসে এমন একটা লিস্ট, যার মাথায় জ্বলজ্বল করছে এক তৃণমূল নেতার কন্যার নাম— ঠিক ধরেছেন, এই নামের অস্তিত্বও ছিল না আগের লিস্টে। অনশনকারী প্রতাপবাবুর কথায়, ‘প্রতি বছর প্রায় ১৫ থেকে ২০০০০ ভ্যাকেন্সি হবার কথা, তাহলে ২০১২ থেকে ২০১৬ কত ভ্যাকেন্সি হবার কথা বলুন তো!’
স্কুলে শিক্ষক নেই, চাকরিপ্রার্থীরা পরীক্ষায় যোগ্যতা প্রমাণ করে বসে আছেন ধর্মতলার রাস্তায়— তাহলে এই রাস্তা থেকে ক্লাসরুমে ‘ট্রানজিশন’-এর পথে বাধাটা কোথায় হচ্ছে? যদি ধরে নিই দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, টাকা খাইয়ে চাকরি দেওয়া— তাহলে এ কেমন ‘ইনএফিশিয়েন্ট দুর্নীতি’, যেখানে স্কুলে বছরের পর বছর ধরে শিক্ষকই নেই! আগেরদিনই এক বন্ধু বলল, তার পিসিকে গত পরশু স্কুল থেকে নোটিস দেওয়া হয়েছে চাকরি ছেড়ে দেবার জন্য, যে চাকরি তিনি টাকার বিনিময়ে পেয়েছেন দুবছর আগে। হট্টগোল উঠেছে এসএসসি নিয়ে, তাই তড়িঘড়ি ‘ম্যানেজ’ দেওয়া হচ্ছে!
অর্থাৎ, শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যেটা চলছে পশ্চিমবঙ্গে, জুম আউট করে দেখলে গোটা দেশেই, সেটা হচ্ছে দায়িত্বজ্ঞানহীন ‘ছেলেখেলা’— যেখানে পরীক্ষা নেবার দায় সরকারের নয়, ফলাফলের দায় সরকারের নয়, পরীক্ষার্থীদের দায় তো নয়ই! দায় কেবল জোড়াতাপ্পি মেরে, ডোনেশন দিয়ে, ভাতা দিয়ে, বাবা-বাছা করে, মাথায় হাত বুলিয়ে, টুপি পরিয়ে ভোটব্যাঙ্ক আর গদি বাঁচিয়ে রাখার! কঠিন থেকে কঠিনতম রোগের ট্রিটমেন্ট হবে ‘সিম্পটম্যাটিক’! শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি এই দায়হীন উদাসীনতা কি এই দশকের নয়া ‘ট্রেন্ড’ হয়ে উঠছে? কেন্দ্রে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে উচ্চশিক্ষায় বিপজ্জনকভাবে বাজেট কমে চলেছে, স্কুলস্তরে বিভিন্ন প্রকল্প সবার অজান্তেই বন্ধ হয়ে গেছে বা টিমটিমে ফান্ডে চলছে, রিসার্চের কাজে যুক্ত পড়ুয়াদের স্টাইপেন্ড দেওয়া হচ্ছে না, বদলে বেড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রাইভেট শিক্ষা বেচার জায়গা আর তৎসম্পর্কিত ‘ঘাপলা’! কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া জিকেসিআইইটি আন্দোলনই তার বড় প্রমাণ— কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ডিগ্রি, কিন্তু তার আসলে কোনও দাম নেই, কোনও স্বীকৃতি নেই! রাজ্য সরকারও এই খামখেয়ালিপনার পথেই হেঁটে চলেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজাল্ট বেরোয় না, পরীক্ষা এগিয়ে পিছিয়ে যায়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও প্রায় প্রতি বছরই আন্দোলনে নামতে হয় সুষ্ঠু পরীক্ষা এবং ফলপ্রকাশের দাবিতে, বাদবাকি শিক্ষাঙ্গনগুলোর অবস্থাও শোচনীয়! তার সঙ্গে আছে তোলাবাজি, টাকার খেলা আর মাস্তানতন্ত্র!
“If you want to destroy a nation, just spoil its education system”— রাজ্য আর কেন্দ্র একযোগে এই কর্মযজ্ঞেই নেমেছে।
এসবেরই মাঝে, নিজেদেরকে এই মরণখেলায় বাজি রেখে বসে আছেন ওঁরা। দড়িটানাটানি চলছে ক্ষমতার আর মনুষ্যত্বের। ওঁরা জানেন, একটু এদিকওদিক হয়ে গেলেই সেই দড়ির ফাঁস চেপে বসবে গলায়। কিন্তু বেকারত্ব-ডিপ্রেশন-অ্যাংজাইটির সঙ্গে লড়তে থাকা মানুষগুলোর কাছে উপায়ই বা কী? নামী প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত যে যুবক আজ মাসিক মাত্র ২০০০ টাকা বেতনে ‘শিক্ষক’ তকমা বহন করে চলেছেন, ‘সিভিক টিচার’ বাক্যবন্ধটা তাঁর কাছে ঘুরেফিরে আসে প্রত্যেক রাতে, প্লাস্টিকের ওপর এপাশওপাশ করার সময়।
অনশনে বসে আছেন ওঁরা। প্রায় ৪০০ জন। দিনাজপুর, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, হুগলি থেকে এসে বসে আছেন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, গাদাগাদি করে, অমানবিক অবস্থায়। একের পর এক দিন কাটছে। সকালবেলা উঠে পোস্টার লিখছেন, লোকজনের ভিডিও ক্যামেরার সামনে ঘটনা-পরিস্থিতি বর্ণনা করছেন, আর বাকিসময়টুকু ঝিম মেরে পড়ে আছেন। দিন কাটছে, পরের দিন আসছে। এও এক অদ্ভুত ‘লুপ’। এক অদ্ভুত অপেক্ষা। মৃত্যু তাড়া করছে রোজ। আগে ঘরে বসে থাকতেন, এখন রাস্তায়। এ কেমন ‘রিয়েলিটি শো’ চলছে, ৪০০ জন পরীক্ষার্থীর জীবনকে ক্যামেরার সামনে ধরে? ক্যামেরার উল্টোদিকে চোখ রেখে কে বা কারা উপভোগ করছে এই ‘স্যাডিস্টিক’ উল্লাস?
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
মুখ্যমন্ত্রী নাকি রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন অনশনের। এরপর নাকি স্কুল শিক্ষা দপ্তর ব্যবস্থা নিতে পারে। এরকমই সব ‘নাকি’র ওপর ভরসা করে ওঁরা বসে আছেন। গণতন্ত্র শব্দটার ‘গণ’ অংশটার ওপর আস্থা রেখে।
এখনও ধৈর্য্যের বাঁধুনিতে, নাগরিক শুভবুদ্ধিতে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলছে।
এখনও….