বিষাণ বসু
দ্যাখ, অনশনটা বড় কথা নয়। অনশন তো যে কেউ যেকোনও সময়ে করতে পারে। কিন্তু, প্রশ্নটা হল, অনশনটা কোন ইস্যুতে। কখনও মেডিকেলের ছেলেরা হোস্টেলের দাবিতে অনশন করছে, কখনও কিছু ছেলেমেয়ে চাকরির দাবিতে অনশন করছে। এইসব ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে অনশনে বসে পড়লে অনশনের মতো একটা মহান প্রতিবাদী পন্থাকেই অগ্রাহ্য করা হয়, সেইটা বুঝিস? এরপর লোকে যে মোবাইল হারালেও অনশন করতে বসবে, তখন তোর স্ট্যান্ডপয়েন্ট কী হবে, ভেবে দেখেছিস?
না, মানে, ঠিক কী বলতে চাইছো, বুঝলাম না।
আচ্ছা, আরেকটু গুছিয়েই বলি। এই ধর, অনশন তো করতে হবে একটা বৃহত্তর স্বার্থে। এই ধর, সিরিয়ায় আইসিস-এর অত্যাচার বা প্যালেস্টাইন-এর উপরে ইজরায়েলের আক্রমণ, এরকম কিছু নিয়েও তো অনশন করা যেত।
কিন্তু, সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের কী করণীয় ছিল?
আঃ, এই তো তোদের মুশকিল। লার্জার ক্যানভাসটা বুঝিস না!! রাজ্য সরকার সেই প্রতিবাদে সামিল হত। প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ দাবানল হয়ে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ত। তা না, সেই পেটি ইস্যুজ-এর বাইরে বেরোতেই পারল না।
কিন্তু, এই ইস্যুগুলো তাহলে কে শুনবে??
কেন?? আদালত হ্যায় না!!
আদালত তো অনেক সময় আর অনেক খরচার ব্যাপার। তাছাড়া, রাজ্য সরকার তো এইসব ইস্যুতে রেগুলারলি আদালতের কাছে খিস্তি খাচ্ছে। তাতেও কি কিছু হচ্ছে?
দ্যাখ, গরমেন্ট ইজ ফর দা পিপুল, বাই দা পিপুল, অফ দা পিপুল। এইখানে পিপুল শব্দের অর্থ কোনও গাছ নয়, এইখানে পিপুল মানে জনগণ। জনগণের কাজ করতে গেলে বুর্জোয়া আদালতের কথায় কান দিলে চলবে?
কিন্তু, এরা তো চাকরি চাইছে না। এরা চাইছে, সরকার ভ্যাকেন্সির লিস্ট প্রকাশ করুক। চাইছে, মেরিট লিস্টের পাশে সবার প্রাপ্ত নম্বর দেওয়া থাক। অন্যায্য কী খুব??
এইখানে প্রশ্নটা ন্যায্য বা অন্যায্যের নয় রে। প্রশ্নটা ফিলজফির। প্রশ্নটা ইকনমিক্সের। শূন্যস্থান পরীক্ষার খাতা ছাড়া কখনও পূর্ণ হয়!! কখনও হয়েছে রে পাগলা!! তোর বাবা মরে গেলে শূন্যস্থান পূর্ণ করতে কি তুই পাশের বাড়ির কাকুকে ডাকবি? তাহলে, ওইসব ভ্যাকেন্সি লিস্ট দিয়ে কী করবি তুই? আর, দ্যাখ, গভর্নমেন্টের পয়সা মানে তো তোর আমার পয়সা। যে কাজ দুহাজার টাকায় করানোর প্ল্যান রেডি, সেইখানে একেবারে ফুল পে-স্কেলে টীচার রেখে পয়সা নয়ছয় করার যুক্তিটা কী!! দু-চারটে মন্ত্রীসান্ত্রীর ছেলেমেয়ে চাকরি পাচ্ছে, সেইটা পজিটিভলি দেখতে শেখ। আমাদের রাজ্যের মন্ত্রীরা এতটাই মানুষের কাছাকাছি, যে, তাঁদের সন্তানেরা স্কুলশিক্ষক হতে চান। মেসেজটার গুরুত্ব বোঝ। এগুলো দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। এই দেখেই মানুষ অনুপ্রাণিত হয়। আর, অনুপ্রেরণার সময় অতশত নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করলে চলে না।
তাহলে ছেলেমেয়েগুলো কী করবে? মানে, কী করতে পারত এরা?
আরে, যা ইচ্ছে করতে পারত, কিন্তু অনশন নয়। এই দেশে অনশনের একটা ঐতিহ্য আছে, জানিস সেসব কথা? গান্ধীজি, যতীন দাশ, মমতাজি। কিন্তু, ভেবে দ্যাখ, এনারা কেউই কিন্তু একটা ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে অনশন করেননি, এঁদের প্রতিবাদ ছিল বৃহত্তর স্বার্থে, একটা লার্জার ইস্যুতে। মহান আদর্শ নিয়ে অনশন করলে তার ইমপ্যাক্টই আলাদা। এই ধর, স্রেফ সেই আদর্শের তেজেই ছাব্বিশ দিন অনশনের পরেও মানুষ সুস্থ থাকতে পারে, এমনকি ওজন বাড়তেও পারে।
বৃহত্তর আদর্শ? আর, অনশনের পথ ধরে গদিটা?
আঃ, তোর আর বুদ্ধি হল না!! কোনটা বৃহত্তর লক্ষ্য আর কোনটা বাই-প্রোডাক্ট তাও বুঝলি না? এই ধর, দেশের গণতন্ত্র বিপর্যস্ত, এর প্রতিবাদে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী তো অনশন করতেই পারতেন। কিন্তু, করছেন না কেন? ভেবে দেখেছিস কখনও?
কেন? এই ইস্যু নিয়ে সবাইকে ছেড়ে খামোখা শিক্ষামন্ত্রী অনশন করতে যাবেন কেন??
আরে, একজন গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ হিসেবে করতেও তো পারতেন!! প্রশ্নটা সেইটা নয়। প্রশ্নটা, কেন করছেন না, সেই নিয়ে।
তুমিই বলো।
তিনি অনশন করলে, লোকে বলবে, উনি ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে করছেন। অনশনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে।
যাব্বাবা!! তা কেন?
এই তো তোর বুদ্ধি!! তিনি অনশন করলেই তো লোকে বলবে, যে, উনি অনশন নয়, ডায়েটিং করছেন। বড় বড় কথা বলে আসলে রোগা হওয়ার চেষ্টা করছেন। তুইই তো এইসব বলতে শুরু করবি।
মাইরি, ফালতু ভাট বোকো না। এই ছেলেমেয়েগুলোর অনশন নিয়ে খোরাক কোরো না, প্লীজ!!
আর কীই বা বলব বল? কী-ই বা আর বলার আছে!! মাসখানেক হতে চলল, আমাদেরই কিছু ভাই আর বোন না খেয়ে ফুটপাথে শুয়ে আছে, তাতেও কারও কোনও হেলদোল দেখছিস!! সরকার তাদের মাথার উপর থেকে ছাউনি কেড়ে নিয়েছে, একটা সামান্য ত্রিপল ছিল, সেইটুকুও। তারপরেও লোকে আইপিএল দেখছে, রাসেলের ছক্কা নিয়ে কথা বলছে। দোলে রঙ খেলে সেলফি পোস্ট করছে। এই অ্যাবসার্ড সময়টাকে নিয়ে আর কীই বা বলব? কীই বা বলার আছে খিল্লি করা ছাড়া। তা, রাজনীতির নেতাদের নিয়ে তো সবাই খিল্লি করে। আমি না হয়, এইসব নাদান ছেলেপুলেদের নিয়ে করলাম, যাদের এইটুকু বুদ্ধি বা কাণ্ডজ্ঞান নেই, যে, মানবিকতার আবেদন মানুষের কাছেই চলে, একপাল হিংস্র শ্বাপদের কাছে নয়।
না, কিন্তু, দ্যাখো, অনেকেই আস্তে আস্তে পাশে দাঁড়াচ্ছেন। ডাক্তাররা আসছেন। আস্তে আস্তে কবি-শিল্পীরা আসছেন। মিডিয়াও আস্তে আস্তে সপ্তম পাতার নীচের দিকে একটু একটু করে লিখছে।
জানি রে জানি। কিন্তু, তুইই বল, সংখ্যায় তারা কজন?? আরে ডাক্তারেরা তো ধান্দাবাজ, সমাজের শত্রু। বৃহত্তর সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর এইসব অনশন-টনে তারা তো যাবেই। কিন্তু, ইয়ার্কি ছেড়ে সিরিয়াসলি বলি, ডাক্তাররা তো আসছেন, কিন্তু বাকি পেশার লোকজনেরা? মিডিয়া? হ্যাঁ, জানি, নেশন ওয়ান্টস টু নো, নুসরত জাহান প্রচারের সময় মেক-আপ ব্যবহার করছেন কি না অথবা দেবের বিরুদ্ধে অসম্ভব সৎ ভারতী ঘোষ ঠিক কী বললেন। তবু, এইসব গুরুত্বপূর্ণ খবরের মাঝে এই ছেলেমেয়েগুলো কি আরেকটু জায়গা পেতে পারত না?? আর, আমাদের নেকুপুষু বুদ্ধিজীবীদের কথা আর বাড়াস না, প্লীজ। অনেক জল মেপে, ধীরে, বিচক্ষণ হয়ে তবে দু-চারজন ধর্ণামঞ্চে আসতে পেরেছেন। দুটো বিভূষণের টোপ পেলেই তাঁরা আবার উলটো গাইবেন, চিন্তা করিস না। দুটো মেয়ের গর্ভপাত হওয়ার পরেই এঁদের আসার কথা মনে পড়েছে। অন্তত এক-দুজন মারা না গেলে প্রতিবাদী কবিরা ফেসবুকে কবিতাটা সাঁটাতে পারছেন না। শকুনেরা মৃতদেহ না পেলে জড়ো হতে পারে না, জানিসই তো!!
পড়ুন — যে যেখানে লড়ে যায়
আঃ, তুমি বড্ড রেগে আছ দেখছি। একটু পজিটিভ কথা তো বলো।
দ্যাখ, দেশের মধ্যে অনেক জায়গায় উগ্রপন্থী হামলায় মানুষ মরলেও লোকজন তেমন বিচলিত হয় না, কিন্তু মুম্বাই হামলায় হয়েছিল। কেন বল তো? কেননা, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মনে হয়েছিল, ওইটা আমিও হতে পারতাম। মানে, ওই অফিস ফেরত লোকাল ট্রেনের ভিড়ে, বা রেলস্টেশনে, বা একদিন বউ-বাচ্চা নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে, কিম্বা অফিসের কাজে গিয়ে আমার ছেলেটাও তো ওইরকম পাঁচতারাতেই বিজনেস মিট করে। আর, মিডিয়াও সেইভাবেই লাইভ কভারেজ দিয়েছিল। যারা বেঁচে বেরোচ্ছিল, তাদের মুখগুলোর সাথে আমাদের মুখগুলো একাকার হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু, এইবার? এইখানে?
এর সাথে অনশনের সম্পর্ক কী?
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
ভাব, ভাব, ভাবা প্র্যাক্টিস কর। খেতে না পেয়ে লোধা-শবর মরলেও আমরা তেমন বিচলিত হই না, চাষিরা সুইসাইড করলেও আমরা ওই ফেসবুকে দুলাইন লিখে পোলাও-কালিয়া প্যাঁদাতে পারি। কেন? কেন না, তারা ঠিক আমরা নই। আমরা কখনওই ওই লোধা-শবর-না-খেতে-পাওয়া-চাষিদের সাথে নিজেদের রিলেট করতে পারি না। কিন্তু, এইবার? এই ছেলেমেয়েরা তো আমাদেরই ঘরের ছেলে। পড়াশোনা করেছে। পরীক্ষা পাশ করেছে। আর, তারপর? দেখছে, নেতামন্ত্রীর আত্মীয়রা তাদের টপকে চাকরি পাচ্ছে। দেখছে, তারা চাকরি না পেলেও কোনো এক অলৌকিক বাঁহাতের খেলায় বাকিরা….. আর, এইসব দেখেশুনে তারা অনেক ঘাট ঘুরে নিরুপায় হয়ে রাস্তায় বসেছে, অনশন করছে। একমাস হয়ে গেল, তাদের এই অনশন। অনেকে গুরুতর অসুস্থ, কারও গর্ভপাত, কেউ হাসপাতালে। সরকার নিস্পৃহ, নিরাসক্ত। কিন্তু, আমজনতা? পাব্লিক? তারাও তো একইরকম হেলদোলহীন!! তাহলে তো সত্যিই বলতে হয়, যে, হ্যাঁ, দিস গভর্নমেন্ট ট্রুলি রিপ্রেজেন্টস ইটস পিপল।
আর, হ্যাঁ, বলছিলি না, পজিটিভ কিছু?? পজিটিভ তো আছেই। অন্ধকার যখন গভীরতম, ঠিক তখনই ভোরের শুরু। ওই যে একজন-দুজন করে এগোচ্ছেন, এরকমভাবেই শুরুটা হয়। তারপর, ঠিক তারপরেই…..
দেখা যাক। তুই বা আমি তো কালকেই মরছি না। শুরু যখন দেখেছি, হ্যাপি এন্ডিং-টাও দেখে যেতে পারব আমরাই।
কী বলিস?