ইক্যুইভোকালি প্যাথলজিক্যাল

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য  

 

ভাবনার মৃত্যু   <->   মৃত্যুভাবনা

লাবণ্যময়ী প্রকৃতির সুললিত কুহুতানে নিতান্ত অসাড়, যোগেন্দ্র ও পুরুষশ্রেষ্ঠ পরশুরাম আশ্রমে প্রত্যাবর্তন পূর্বক দেখিলেন তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাগণ হতচেতন অবস্থায় ভূলুন্ঠিত হইয়া আছেন। পিতা চতুর্বিধশাস্ত্রজ্ঞানী ভার্গব জমদগ্নি তেজোবিচ্ছুরণ পূর্বক মাতা রেণুকার প্রতি কটাক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছেন। মাতা স্বভাবশরীরঅন্তর্হিতা হইয়া অত্যন্ত ক্লিন্নবদনে এবং নতমস্তকে পিতার তেজোরাশির সম্মুখে নির্বিরোধী ভঙ্গিমায় দন্ডায়মান। তাঁহার কলস ভূপতিত, উহার চতুর্দিকে মৃত্তিকা মায়াবৎ আর্দ্র। প্রিয় কনিষ্ঠকে আসিতে দেখিবামাত্র পিতা ক্ষোভমিশ্রিত এবং আজ্ঞাবহ কন্ঠনিনাদে ঘোষণা করিলেন, “বৎস, তোমার ব্রাহ্মীশ্রীবিবর্জিতা পাপাচারিণী জননীকে অবিলম্বে অকুন্ঠোচিত্তে হনন কর।” পিতার আজ্ঞা পালনার্থে মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া জামদগ্ন্য তাঁহার হস্তস্থিত পরশুর আঘাতে মাতার শিরশ্ছেদ করিলেন। ব্রাহ্মণপতি পুত্রের অবিচলিত পিতৃভক্তি দর্শন পূর্বক ক্রোধস্তিমিত অবস্থায় পর্যবসিত হইলে স্নেহভারী স্বরে কহিলেন, “বৎস, তুমি আমার আজ্ঞানুসারে অত্যন্ত দুঃসাধ্য কর্ম সম্পাদন করিয়াছ। তোমার এমত আচরণে আমি প্রীত। কহ বৎস, তুমি কি বর অভিলাষ কর?” পরশুরাম কৃতাঞ্জলিপুটে  পিতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করিয়া কহিলেন, “হে পিতা, ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, আমার মাতাকে আপনার অলৌকিক বিজ্ঞানপ্রভাবে পুনর্জীবিত করুন, আমার হস্তে নিহত হইবার স্মৃতিসমূহ যেন তাঁহার স্মৃতিকক্ষে স্থান না পায় এবং মাতৃহত্যার পাপ যেন আমায় স্পর্শ করিতে না পারে – আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদিগের স্ব-স্ব চেতনা ফিরাইয়া দেন, আমি যেন যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হইতে পারি এবং আমার যেন দীর্ঘায়ুপ্রাপ্তি হয়”। জমদগ্নি তৎক্ষনাৎ তাঁহাকে ঐ বরসকল উপহার দিলেন।

…পরন্তু মাতা জীবিত হইলেন না। পরশুরাম অত্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত হইয়া পিতাকে উদ্দেশ্য করিয়া কহিলেন, “পিতা, এ কী লীলা আপনার! জ্যেষ্ঠগণ সকলেই নিজ নিজ চেতনা ফিরিয়া পাইলেন। তথাপি মাতা কী কারণে পুনর্জীবন লাভ করিলেন না?” পিতা সৌম্যস্বরে হাসিয়া কহিলেন, “বৎস, তোমার বর আমি বিলক্ষণ প্রদান করিয়াছি। তুমি তাঁহার উপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হও। এই সমগ্র ভূখণ্ডে তোমার মাতার আত্মা পুনর্জীবিত হইয়াছেন, তাঁহার প্রকাশ অনুভব কর। এই বসুমতীর সেবা করিলেই তুমি মাতৃসেবাস্বরূপ পুণ্যফল অর্জন করিবে”।

কিন্তু মা! মা-তো এখনো মাটিতে পড়ে। মাথাটা গলা থেকে আলাদা হয়ে যেন আমির দিকেই অনিমেষে কাত্‌ হয়ে আছে। মুখটা সামান্য হাঁ। বাবা দূরে উকিলের পোশাকে দাঁড়িয়ে, যেন এখুনি মোকদ্দমা জিতে ফিরেছেন। বাবার ওপর আমির ভীষণ রাগ হল, তেড়ে গেল সে। বাবা নেই! কেউ নেই! শুধু একটা কাটা মুণ্ডু আর অবিকল মায়ের মুখ…

গলা শুকিয়ে কাঠ।

জল…জল…জল…হাতের হাতড়ানিতে বোতল মেঝেতে পড়ে যায়।

সকাল হয়েছে। খয়েরি পর্দার বাঁধা টপকে আলোর ছায়াময় প্রকাশে আবছা দৃশ্যমানতা পেয়েছে আমির ঘর। ক’টা বাজে ঘড়ি না দেখলে ঠিক করে বলা যায় না। সকাল সাতটা হতে পারে, আবার সাড়ে ন’টাও হতে পারে। ঘরের মধ্যিখান-বরাবর দেওয়ালের একদিক ঘেঁষে একটা খাট লম্বালম্বি করে পাতা। আমি তার ওপর দু’হাত ছড়িয়ে বুকে ভর দিয়ে ঘুমাচ্ছিল, ঘাড় ডানদিকে হেলিয়ে। ওই একই দিকে দাঁড়িয়ে খাট-লাগোয়া একটা ছোট টেবিল, তার ওপর নেভানো টেবিল-ল্যাম্প, মোবাইল আর জলের বোতল। তার ডান হাত জলের বোতল নিতে এগোলে ঘুমের বেয়াদব আচ্ছন্নতায় প্রায় ভরা বোতলটা দুম্‌ করে পড়ে যায় মেঝেতে।

আওয়াজের আচম্‌কা চমকে ভুরু দুটো তির্যক উঁচু হয়ে উঠলেও পরিস্থিতি টের পেতে তার কয়েক মুহূর্তের বেশি লাগে না। শান্ত মনে বিছানা থেকে ঝুঁকে পড়ে সে বোতলটা হাতে তুলে নেয় আর আধশোয়া অবস্থাতেই ঢক্‌ঢক্‌ করে অনেকখানি জল খেয়ে নেয়। বোতলটা টেবিলের ওপর রেখে সে খানিকটা সময় নিয়ে উঠে বসে। ম্‌-ম্‌-ম্‌-ম্‌ করে দম চেপে, হাতদুটোকে দুদিকে যত দূরে পারা যায় ছড়িয়ে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙে। খাট আর টেবিল অলক্ষ্যে থরথর করে কেঁপে ওঠে। কী আশ্চর্য রকম শান্ত ও দৃঢ় দেখাচ্ছিল তাকে! বোতলের জল তখনো আড়মোড়া ভাঙার তীব্রতায় এদিক-ওদিক দুলছিল। যদি খুব ভুল না হয় তবে একথা বলে রাখা ভালো, তার দৃষ্টি ক্ষুরের ধারের মত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল – বোতলের দিকে তাকাতেই বোতলটা মুখের কাছে চলে এল আর চোখের তারার সামান্য ঘূর্ণনে ঢাকনা গেল খুলে। বাকি জলটুকু অভিকর্ষকে হেলায় হারিয়ে তার হাঁ করা মুখে ঢুকে যেতে থাকল। অবাক করা দৃশ্য! জল শেষ হলে বোতলটা পড়ে গেল মাটিতে, ঠিক ঘুম ভাঙার হাতড়ানিতে যেখানে পড়েছিল, এবার মুখটা খোলা ও সম্পূর্ণ খালি। নিঃসন্দেহে ওই অতিরিক্ত জলপানই তার তৃষ্ণা মিটিয়েছিল।

কে-কে ওখানে! দরজার দিকে তাকাতেই দরজাটা দড়াম্‌ করে বন্ধ হয়ে যায়। দরজাটায় দু-আঙুল ফাঁক তৈরী হয়েছিল। দুটো সাদা চোখ যেন জ্বলজ্বল করছিল! একটা ক্ষীণ শব্দ … আহ্‌ …

আমি রোজ সকালে উঠে তার ঘর-লাগোয়া দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাবা-মা চলে যাওয়ার পর তার এই এক অভ্যেস হয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে লোকজনের সকাল-হুল্লোড়গুলো দেখলে তার সংকল্প আরো সুদৃঢ় হয়। বাজার-ফেরত মানুষদের থলি ছিঁড়ে যখন আলু-পটল রাস্তায় গড়াগড়ি যায়, সে শিশুসুলভ আনন্দে সামান্য হেসে ওঠে। সকলেই মনে করে রাস্তার এই ফুটকয়েক জমিতে একটা গোলমাল নিশ্চয়ই আছে। কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে শূন্যে চেয়ে থাকার পর যে যার বাজার কুড়িয়ে পকেটে আলু-পটল ভরতে থাকে। দুহাত বুকে চেপে ধরে যতটা পারা যায় শাক-সব্জি আগলে নিয়ে তারা বাড়ির পথে পা বাড়ায়, মাছের পলিথিন অনামিকা বেয়ে পেটের ধার ঘেঁষে ঝুলতে থাকে। জামায় বুঝি আঁশটে গন্ধ লেগে যায়।

আমির বারান্দার দিকে ঘাড় উঁচিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে তাদের বাগান; ঘাসগুলো অযত্নে এলোপাথাড়ি বেড়ে উঠেছে। ঠিক বারান্দার নিচেই গাড়ী রাখার গ্যারেজ – গাড়িটাও আছে, সাদা অ্যাম্বাসাডার; বাবা ছিলেন হাইকোর্টের নামজাদা উকিল; সেদিন ফেরার পর মায়ের সাথে তুমুল চেঁচামেচি করেছিলেন – ড্রাইভার মোহনের কাছে শোনা।

বিএ ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষা ছিল সেদিন; আমির ফিরতে একটু রাত হয়ে গেছিল। ফিরে দেখেছিল বাবা সোফার গা বেয়ে ঘাড় এলিয়ে পড়ে আছেন – দুটো পা সামনের দিকে ছড়ানো, চশমাটা কপালে বেখাপ্পা উঠে গেছে, হাতদুটো অবশ হয়ে মাটি ছুঁয়ে রেখেছে। মুখ দিয়ে বেরনো গ্যাঁজলা দুটো-বোতাম-খোলা সাদা শার্টটার কাঁধের চারপাশে শুকিয়ে গেছে। মা ডানদিকের সোফাতে পাথর হয়ে বসে আছেন, বাবার দিকে একভাবে তাকিয়ে। তাকে ঢুকতে দেখে মা শান্ত মনে বলেছিলেন, “ক’টা ভাত টেবিলে ঢাকা দেওয়া আছে – আগে খেয়ে নে, তারপর ডাক্তার ডেকে আন। আর নেই” – কোনো অভিব্যক্তি ছিল না তাঁর মুখে। আমি মনে মনে ঐ থালা ছুঁড়ে তাঁর গলা কেটে দিয়েছিল আর চুপচাপ ডাক্তার আনতে বেরিয়ে গেছিল।

মা তারপর থেকে প্রায় একমাস কোনো কথা বলেননি। কি যেন মনে-মনে বিড়বিড় করে যেতেন খালি! জীবনে প্রথমবার মা’কে দেখে তার ভয়ানক দুঃখ হয়েছিল। বাবার শরীরটা মালায় মালায় ঢাকা পড়ে গেছিল আর মা নিজের গলাটা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরেছিলেন; চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, মুখখানা খাবি খাচ্ছিল। কেউ যেন মায়ের গলা কেটে দিয়েছে আর মা – প্রাণপণে ফিনকি দিয়ে বেরনো রক্ত সামাল দিচ্ছেন।

বাবার মৃত্যুর সময় মায়ের বয়স হয়েছিল আটচল্লিশ, একইরকম সুশ্রী মুখখানি যেন অকালযৌবন, কিছুটা আর্থিক শান্তি আর বাকিটা কস্‌মেটিক্স। মাঝে মাঝেই বারান্দায় গিয়ে বুক থাবড়ে চেঁচিয়ে উঠতেন, “আমি তো বেশ্যা…আমি তো বেশ্যা” – বড় কানে লাগত সেই আওয়াজ। মামা একজন মহিলা ঠিক করে দিয়েছিলেন। সে ঐ সময়গুলোয় মাকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে যেত আর রান্নাবান্নার কাজগুলোও সামলে দিত। সেরকমই একদিন বারান্দায় গিয়ে মা অনেক-ক্ষণ চেঁচিয়েছিলেন। দেখভাল করার মহিলাটি কামাই করেছিল সেদিন। রেলিং থেকে ঝুঁকে পড়ে সে এক প্রচন্ড চিৎকার; প্রায় মিনিটপাঁচেক পর আমি বারান্দায় পৌঁছেছিল। সে দেখেছিল মায়ের গলা নিখাদে যেতে যেতে শব্দগুলো কিভাবে অবলীলায় রেলিং টপকে পড়ে গেছিল নীচে, সুসজ্জিত বাগানে। মা ধপ্‌ করে বসে পড়েছিলেন মেঝেতে। তাঁর চোখ লাল কট্‌কটে, নিথর – আমির দিকে তাকিয়ে। ডাক্তার এসেছিল মামার সাথে একই গাড়িতে। তার ঘন্টাছয়েক পর শ্মশান…

মা-কে দাহ করে ফেরার পথে মামার বলা কথাগুলো আজও কানে বাজে, “দ্যাখ্‌, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। ইউ ক্যান্‌নট আনডু এনি অফ দিজ্‌। দিদি জামাইবাবুর যাওয়ার সময় হয়ে এসেছিল হয়তো… তুই এখন তোর কেরিয়ারে মন দে। জানি, এই সময়টায় নিজেকে ফোকাস্‌ড রাখা খুবই কঠিন। তবু চেষ্টা চালিয়ে যা, নইলে সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে যাবে। আমার তরফ থেকে যা যা হেল্প পাওয়ার, নিশ্চয়ই পাবি। শুধু হাল ছাড়িস না”…

দেখতে দেখতে সকালের ব্যস্ত পাড়ার গতি বেড়ে যায়। সামনের পার্কিং স্লটে একটা কালো হন্ডা-সিটি স্টার্ট দেওয়ার সাথে সাথে নাকি একটু আগেই হুশ্‌ করে এগিয়ে গিয়ে সামনের স্করপিওটায় ধাক্কা মারে। প্যাঁ-প্যাঁ-প্যাঁ-প্যাঁ করে স্করপিওর অ্যালার্ম বেজে ওঠে। তারের ওপর বসে থাকা একঝাঁক কাক-পায়রা-চড়ুই যে যেদিকে পারে উড়ে পালায়। আমি দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে ঘরে ঢুকে যায়।

এই অতিকায় ক্ষমতা তার মাথায় জেঁকে বসে আছে বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকেই। সে সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছে ব্যাপারটা – বিশেষ করে কাজের মাসির নজর থেকে। মামা রান্নাবান্নার জন্য একজন বয়স্ক মহিলাকে কাজে রেখেছিলেন। সেই অবলা মাসি আজও আছে, দুবছর পরেও … সকালে ঘুম ভাঙার পর নিয়মিত তার পড়ার টেবিলে চা চলে আসে।

এদিকে তার রোজকার সমস্যাগুলোর যেকোন একটার কথা বলতে হলে বলতে হয়, সকালে বাথরুমে গিয়ে দাঁড়ালেই তার প্রস্রাব হতে চায় না। মূত্রথলি এক অবিশ্বাস্য ভারে পরিণতিভ্রান্ত থাকে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে ক্রমাগত সি-সি করে আওয়াজ করা সত্ত্বেও তার মন তার আদেশ শোনে না। হায়! যে এক নজরে পাহাড় নড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তার এ কী অসহায়তা! শেষমেশ ছোটবেলায় মায়ের বলা উপায় মনে করে আমি আস্তে আস্তে নাভিতে ঠান্ডা জল দিতে থাকে… সেই শীতলতায় তার সমস্ত মেজাজ-নাড়ী শিথিল হয়। মূত্রথলি, মূত্রশিরা ভারমুক্ত হয় – চোখ বুজে আসে আরামে…

মায়ের কথা মনে পড়লেই ভিড় করে আসে গল্প – প্রচুর-প্রচুর রূপকথা। মায়ের শোনানো সেই গল্পগুলো আজও যেন তার ছোটবেলাতেই পড়ে আছে। সেই সুখ-সুখ আর সুখে ভরা পালঙ্কের চাদর থেকে গল্পগুলোকে কোনদিনও মোছা যায়নি, হয়তো যাবেও না আর। তখন মা তাকে প্রায়ই নিজের দিদিমার গল্প শোনাতেন। আমির স্মৃতির কোলাহলে হারিয়ে যাওয়া কোনো এক স্নিগ্ধ দেশের রুক্ষরমণীর কাহিনী। কতই বা বয়স ছিল তাঁর, বিয়ে থা হয়ে তিন-তিনটে ফুটফুটে বাচ্চা প্রতিপালনের মায়া জন্মেছিল তাঁর কোলে। তাদের সমস্ত বাল্যকাল, বড় হয়ে ওঠার গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমির স্মৃতির আনাচে-কানাচে। মায়ের দিদিমার মায়ামমতায় মাখা জীবনে টিকে থাকার লড়াই তাঁর বয়স-বিবর্তনের সাথে সাথে এক রুক্ষ বিমূর্ত রূপ নিয়েছিল। সেই অরূপ আমির মনের মাটিতে তীক্ষ্ণ ফলার মত গেঁথে আছে আজও, যদিও সেই মাটি আজ ঢালাই হয়ে গেছে প্রাপ্তবয়স্কতার সিমেন্টে – শহরের উঁচু-উঁচু বহুতলের মত।

মায়ের কাহিনীর সেই মায়াবী বঙ্গনারী বয়সের সাথে সাথে কোনো এক গোপন আঁতাতে একটা বাতিকে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ধোয়া, চকচকে জামাকাপড়ও তাঁর কাছে ময়লা মনে হত। দু-তিন বার করে না কাচলে তাঁর মন কিছুতেই পোষাত না। রোজ পুকুরপাড়ে তাঁর রামধোলাই গোটা গাঁয়ে সাড়া জাগিয়ে তুলত। শুধু তাই নয়, অনিবার্য প্রয়োজনের মধ্যে ছিল চাঁদি-ফাটানো রোদ্দুর। ধোয়া কাপড়জামা রোজকারটা রোজ শুকোলে তবেই তৃপ্তি মিলত সেই নারীর … তবু অন্ধকার নামেই। সেই পরিষ্কার ধবধবে কাপড়জামা উঠানে শুকিয়ে যায়, দিদিমা ঘরে তুলে আনেন। এখানেই শেষ নয়, তাঁকে আগামী দিনের ব্যবস্থাও করে রাখতে হয়। রাতের তারা দেখে গিট বেঁধে রাখেন থানে, মনে মনে কামনা করেন বৃষ্টি যাতে না হয়। ঋতুকে বন্দি করে রাখা যেন! মেঘ তুমি এসো না এ দেশে, বৃষ্টি তুমি এসো না। এরকমই কোনো একবার গরমে টানা পাঁচমাস বৃষ্টি হয়নি, গ্রামে খরা হয়েছিল … মায়ের দিদিমা গুন্‌গুন্‌ স্বরে গান গেয়ে কাচাকুচি করতেন। মা বলতেন, আগুনের গান…

ঘরে এসে ল্যাপটপ চালিয়ে চায়ে চুমুক বসাতেই তার মন বলে ওঠে, আজই সেই দিন। এই দিনটার জন্যই এত অনুশীলন, এত প্রশ্রয়। আজ তাকে অবশ্যই একটা বিহিত করতে হবে। চটপট্‌ করে ব্রেকফাস্ট সেরেই সে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই অবস্থায় আমার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরঘুর করে – আমির এই বিপুল ক্ষমতার উৎস ঠিক কোথায়? তার ক্ষমতার উৎস কি তবে জ্ঞান? আমার মনে হয়না সেটা ভাবা যথার্থ হবে বলে। তার জন্য আছে ল্যাপটপ, ইন্টারনেট। বাকি সবার মত সে-ও দুনিয়া সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানতে পারে তার ল্যাপটপের সামনে বসেই। তার রুটিনের ওপর আমাদের খুব একটা আগ্রহ তৈরী হওয়ার কথা নয়, কারণ তাতে ঘুম থেকে ওঠা – বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ানো – ব্রেকফাস্ট করা – ল্যাপটপ – বসে থাকা – বসে থাকা – ল্যাপটপ – চান করা – খাওয়াদাওয়া – ক্ষমতার অনুশীলন – শুয়ে থাকা – বসে থাকা – ল্যাপটপ – বসে থাকা – রাতের খাওয়া – ক্ষমতার অনুশীলন – বসে থাকা – ল্যাপটপ – ল্যাপটপ – ঘুমিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। এই ল্যাপটপের সামনে বসেই সে বাইরের জগতের আর মানুষের মনের মধ্যে হয়ে চলা আইডিয়োলজিক্যাল ওয়ারগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়। সে নিজের মত করে বুঝে নেয় মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক – বাজারের সম্পর্ক – মানুষের সম্পর্ক। অত ভাবে না, ভাবলেই গা-হাত-পা জ্বলতে থাকে আর মাঝখান থেকে ঘরের ফ্যানটা বন্ধ হয়ে যায়, আমি ঘামতে থাকে, সামনে রাখা জামাকাপড়-বইখাতা দেদার উড়তে শুরু করে দেয়। তাই ভাবনায় চট করে নিজেকে সে জড়ায় না, ভয় হয় পাছে কাজের মাসীর নজরে চলে আসে সেই অ-দৃশ্য। তবে যা-ই বলা যাক না কেন, এই মানুষগুলোকে আমি দু-চক্ষে দেখতে পারেনা। সব কত ক্ষুদ্র! কত ছোট মন তাদের! অথচ তাতেই ওদের কী আনন্দ! সমস্ত পৃথিবীটাকে কী নির্দ্বিধায় ব্যবহার করে চলেছে। আমির গা জ্বলে যায়…অথচ তার পৃথিবী…! আমি এসব রোজ ভাবেনা, ভাবে সেই দিনগুলোয় যেদিন ওয়েবের মাধ্যমে জানতে পারে এই ক্ষুদ্রমনা মানুষগুলো নিজেদের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জয়ের আনন্দে নাচছে – কোনোকিছুর বিরুদ্ধে লড়ে তারা জিত হাসিল করেছে। কিসের এত আনন্দ তাদের? কী ক্ষমতা আছে তাদের! আমি যদি চায় এক নিমেষে ওদের শিক্ষা দিয়ে দিতে পারে। অথচ দ্যাখো! দু’বছর আগে তারও বাবা ছিল, মা ছিল, স্বপ্ন ছিল…এই সময়গুলোয় ভীষণ ঘুম পায় তার…

আজ আমি সকালের জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়ে। অবলা মাসিকে দেখে যায় অবাক হয়ে আকাশের পানে চেয়ে থাকতে। সে লক্ষ্য করে না মাসির কপালের বাঁদিক জুড়ে একটা বিচ্ছিরি কালশিটে পড়ে গেছে।

আমি চলতে থাকে বাস রাস্তা পেরিয়ে, মানুষের সকালব্যস্ততার মধ্যিখান দিয়ে। সে কী ভাবছে, তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়না। কারণ, আমার ও আমির মধ্যে আর কোনো ক্ষণিকপার্থক্য নেই। আমাদের সম্পর্ক এখন একমাত্রিক। আমি লিখছি, সে যাচ্ছে। সে যাচ্ছে, আমি লিখছি।

গাড়ি-রাস্তার দু্পাশে গজিয়ে ওঠা একটা স্থানীয় বাজারের মাঝখান দিয়ে আমি হেঁটে চলেছে। দুপুর একটা-দেড়টা নাগাদ বাজারটা উঠে যাবে, রাস্তা স্বাভাবিক রূপ পাবে গাড়িতে-গাড়িতে; কিন্তু এখন তার রমরমা দ্যাখে কে! আমি মাথা নিচু করে চলেছে। কারো দিকে চোখ তুলে দেখছে না অথচ সব্বাইকে খেয়াল করছে। আমির কি নিজেকে খানিক লম্বা মনে হয়? নইলে এমন নিচু চোখেও কিভাবে সবাইকে সে দেখতে পায়! তার নজরের নিচেই যেন মানুষের বাজার, দর-কষাকষি…

এই যাঃ! সে কী জন্য বেরিয়েছে জানার আগেই তার সাথে আমার সংযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। সে হয়ত বুঝে ফেলেছে তার লেখকের উপস্থিতি। অন্যরা হলে এই অবস্থায় তাদের আসল কাজটা বদলে নিত, সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু একটা করত। বুঝতে দিত না নিজেদের মতলব। আমি কিন্তু সে দলে পড়ে না। তার ক্ষমতা আছে, সে আমার সাথে সরাসরি যোগাযোগ কেটে দেয়। তার লক্ষ্যে সে অবিচল থাকে।

কিন্তু আমিও তো গল্পকার! আমারই বা ক্ষমতা কম কিসের! আমাকে খুঁজে বের করতে হবে এমন কোনো মানুষ যে আমির দিকে তাকাতেই তার মধ্যে একটা আবছায়া কিছু লক্ষ্য করবে। ব্যস, বাকি রহস্যময়তা আর আনুগত্য আমিই তৈরী করে দেব তার মনে।

বাজারটা শেষ হওয়ার পর মোড়টা ঘুরলেই একটা চা-নাস্তার দোকান। দোকানটায় বেশ ভিড়। ভেতরে মুখোমুখি দু-সারি বেঞ্চ পাতা। খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সবাই জাঁকিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে, নিশ্চয়ই কোথাও কিছু একটা ঘটেছে। বা বলা ভালো কোথাও কিছু একটা ঘটেই চলেছে। যারা বসার জায়গা পায়নি, দাঁড়িয়ে যে যার মত চায়ের ভাঁড় হাতে। এদের মধ্যে দুজন, একজন পঁচিশ-সাতাশের যুবক আর চল্লিশোর্ধ একজন ব্যক্তি, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তুলকালাম আড্ডা জুড়েছে। তাদের সঙ্গত দিচ্ছে গরমাগরম দু-ভাঁড় চা। পড়তো পড় ঐ চালশে চোখদুটোকেই পড়তে হল আমির ওপর!

যুবকটি বয়সে ছোট হলেও দেখে মনে হয় ঐ বয়স্ক ব্যক্তির চেয়ে বেশি জানে, বেশি বোঝে। যুবকটির পরনে একটা ময়লা হাফ শার্ট, জিন্সের প্যান্ট। মুখভর্তি তার দাড়ি, চোখে চশমা আর বেশখানিক বুদ্ধিদীপ্ততা। হয়ত স্থানীয় কোনও মেসে থাকে, পড়াশুনা করে। ভদ্রলোকের পরনে পাঞ্জাবি, ফুলপ্যান্ট – চোখজোড়া ক্লান্ত। পাঞ্জাবির ফাঁকে ফাঁকে একটি রুদ্রাক্ষ উঁকি দিয়ে যায়। ভদ্রলোকের গালদুটো ঘামে ধুয়ে আপেলের মত চকচক করতে থাকে। আমরা জানতে পারি, ওর নাম বিশ্বনাথ। আর সঙ্গের ছেলেটি সৌহার্দ্য।

বিশ্বনাথকে বেশ উত্তেজিত হয়ে বলতে শুনি, “প্রায় দেড়মাস হয়ে গেল পুলুওয়ামার ঘটনার অথচ ভাবলেই কেমন শরীরটা রি-রি করে উঠছে। কিভাবে আমাদের চল্লিশটা জওয়ানকে ওরা মেরে দিল, বল্‌! ঐ উগ্রপন্থীগুলোর কি মানবিকতা বলে কিছুই নেই?” – একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায় তার অঙ্গভঙ্গির মধ্যে।

“না নেই তো। উগ্রপন্থীদের মানবিকতা না থাকাটাই স্বাভাবিক নয় কি! তবে পুলুওয়ামার ঘটনাটা একটা চরম ইন্টেলিজেন্স ফেলিয়োর। অথচ এই মতামতটাকে কেমন যত্ন করে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে দ্যাখো।”

“সে তুই যাই বল সৌহার্দ্য, আমাদের দেশ ওদের ওপর যে এয়ার স্ট্রাইকটা করল না! এরকম মাঝে-মাঝেই একটা করে করা উচিৎ। তাতে করে ওদের যারা শেল্টার দিয়ে রেখেছে, তাদের মনে ভয় ঢুকে যাবে। আর ওদের বেসগুলোও সব গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে।”

“দেখ বিশ্বদা, উগ্রপন্থীদের ডিকশনারিতে ভয় বলে কোনো শব্দ হয় না। ওরা নাম লেখায় মরার জন্যই। কিন্তু আমাদের দেশের ভেতর থেকে যারা উগ্রপন্থায় যোগ দিচ্ছে, আমার ভয়টা ওদের নিয়ে। আমরা তাদের কিভাবে চিনব? তারা তো তোমার আমার মতই সাধারণ মানুষ। অথচ কি মারাত্মক হিংসার মন্ত্রে ব্রেনওয়াশড্‌! পুলুওয়ামার অ্যাসাইল্যান্ট কিন্তু একজন ভারতীয় নাগরিক, এটা ভুলে গেলে চলবে না।”

বিশ্বনাথ খানিক মুখ কুঁচকে রুদ্রাক্ষে চাপা পড়ে যাওয়া ঘাড়ের চামড়া চুলকে নিয়ে বলে, “আমার তো মনে হয়, এইসময় পরশুরামজির মতো একজন অবতার পুরুষের প্রয়োজন। যিনি মর্ত্যধামে এসে এইসব যুদ্ধবাজদের গুনে-গুনে বিনাশ করবেন। নইলে এগুলোকে কোনওভাবেই থামানো যাবে না। আমাদের দেশকে আরোও রাউডি হতে হবে।” – এই বলে চায়ের অন্তিম চুমুক সিপ্‌ করে টেনে নিয়ে ভাঁড়টা টিপ্‌ করে ডাস্টবিনে ছুড়ে মারে সে।

সৌহার্দ্য তার কথায় সায় দেয় না। বরং নীরব থাকে। চুপচাপ ডাস্টবিনের সামনে গিয়ে চায়ের ভাঁড় ফেলে দিয়ে আসে।

বিশ্বনাথ একটু ব্যস্ত হয়ে বলে, “এই শোন, আজ আমি যাই বুঝলি। বেরোতে হবে। ওদিকে তোর বৌদি খ্যাঁচখ্যাঁচ করবে বেশি দেরী করলে। যাওয়ার সময় মনে করে একটু ফুল-মালাও নিয়ে যেতে হবে ঠাকুরের জন্য”। ঠিক এমন সময়ই বিশ্বনাথের নজর পড়ে আমির ওপর।

যদিও তাদের এই আলোচনা শুরু হয়েছিল চা অর্ডার করার পর, বিশ্বনাথের দেখা স্বপ্নকে কেন্দ্র করে। সে বেশ ঘাবড়ে গিয়েই  বলেছিল, “সৌহার্দ্য জানিস, কাল রাত্রে একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলাম। যতক্ষন না তোকে বলতে পারছি মনটা খচখচ করছে। একটা বিশাল কুয়োয় একটা পাগলা হাতি আর আমি। আর অনেক উঁচুতে কুয়োর চারপাশ ঘিরে প্রচুর মানুষ হো-হো করে চ্যাঁচাচ্ছে! যতদূর মনে হয় ওরা তামাশা দেখেই ওরকম করছিল। নইলে ঐ পাগলা হাতির ওপর কেউ ওভাবে ঢিল মারে, আমি পড়ে আছি দেখেও! সেই হাতির আবার শুঁড় ছিল না, বরং শুঁড়ের জায়গায় ঝুলছিল একটা বিষাক্ত সাপ। সেই সাপ নাচছে হিস্‌হিস্‌ শব্দ তুলে আর কুয়োর দেয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে – ঠিক এই সময় ঘুমটা ভেঙে গেল। একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছিলাম মনে মনে। কাদা না গোবর ঠিক বুঝতে পারলাম না! চোখ মেলে যখন তোর বৌদিকে পাশে শুয়ে থাকতে দেখলাম, বেশ ভরসা পেলাম জানিস। তারপর থেকে মনটাও বেশ শান্ত হয়ে আছে। আমার মত বয়সে এলে দেখবি জীবনের ভাঙাচোরা বিশ্বাসগুলো এই ভরসাটুকুনির জোরে কতটা প্রাণ পেয়ে যায় আচমকা”- বলতে বলতে হতভাগ্য অতীত তার গলার কন্ঠাবরাবর দু’তিনবার ওঠানামা করেই অদৃশ্য হয়ে যায়। সৌহার্দ্য মুখে কিছু না বললেও চোখেমুখে সহানুভূতি জানায়।

এরপর তাদের আলোচনা সামান্য এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে গোঁত্তা খেয়ে পড়েছিল পুলুওয়ামার ঘটনায়। সে যাই হোক, বিশ্বনাথ আমিকে প্রথম ঝলক দেখেই তার মধ্যে বেশ একটা রহস্যময় আবেশ লক্ষ্য করে। আর আমিও সেই সুযোগে তাকে ধরে ফেলি।

আমি ততক্ষণে হন্‌হন্‌ করে গঙ্গার দিকের রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। বিশ্বনাথও চট করে তার পিছু নিয়ে নেয়। মালা নিয়ে যে তাকে বাড়ি ফিরতে হবে সেসব হয়তো আমি তার মাথা থেকে বার করে দিতে পেরেছি। সৌহার্দ্য বিশ্বদার দুর্গতি দেখেছিল। একটা তির্যক হাসি হেসেই গল্পপট থেকে সে উধাও হয়ে যায়।

আমি মাথা নিচু করে গঙ্গার ঘাটের ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে। এখানে গঙ্গার তীরবরাবর অনেক মন্দির, নানান দেবতার। সেই বট, অশ্বত্থ আর মন্দিরের ভিড়ে এক পৌরাণিক ভয় তৈরী হয় মনে। আমি সেখান দিয়ে নির্বিঘ্নে বেড়িয়ে গেলেও সমস্যা হচ্ছিল বিশ্বনাথকে নিয়ে। অনেক কষ্টে তাকে প্রণাম করা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছিল। তার মনে তৈরী করতে হচ্ছিল অজানা ভয়, চাপা রহস্যজর্জরতা যা তাকে আমির অনুসরণে বাধ্য করে তুলবে। বেশ কিছুটা চলার পর একটা ফাঁকা ঘাট দেখে আমি দাঁড়ায়, পূর্ব-সূর্যের দিকে মুখ করে। বিশ্বনাথও দাঁড়ায় কিছুটা দূরে – গলার চামড়া চুলকোতে চুলকোতে, একটা রাজনৈতিক ব্যানারকে আড়াল করে।

আমি তার ডানহাত সূর্যের দিকে মেলে ধরে হাতের আঙুলগুলো দিয়ে সূর্যের আকৃতি বানায়। তারপর হাতটাকে নিজের বুক অবধি সজোড়ে ফিরিয়ে আনে আর সেখান থেকে দক্ষিণ দিক বরাবর ছুঁড়ে দেয়। মুহূর্তকয়েক পর, সে তার বাঁহাত টানটান করে গঙ্গার ওপর মেলে ধরে এবং মুষ্ঠিবদ্ধ করে ওপরের দিকে ছুঁড়ে দেয়। এরপর দাঁড়িয়ে থাকে। আমিও খানিক অভিভূত হয়ে যাই এসব কান্ডকারখানা দেখে।

এই ফাঁকে বিশ্বনাথের টনক নড়ে। “আরে আশ্চর্য! ঠাকুরের মালা নেওয়ার কথাটা বেমালুম ভুলে গেছি! আজ বোধ হয় বেরোনোটা গেল ভোগে। কী দেখতে যে দাঁড়িয়ে গেলাম! যত্তসব পাগল-ছাগল…”

আমিও আর ওকে আটকাইনি। সে যখন ফিরছিল প্রচণ্ড শীত-শীত করছিল তার। এমনকি আশেপাশে যাদের দেখা যাচ্ছিল, তারাও যে সেই একই অনুভূতির খপ্পরে পড়েছে তা টের পেতে বিশ্বনাথের বেশী সময় লাগে না। খানিক অবাক মনে সে পাঞ্জাবির বোতামদুটো লাগিয়ে নেয় আর গা গরম করতে দ্রুতবেগে চলতে থাকে…

সেদিন বিশ্বনাথ না দেখলেও আমি দেখেছিলাম আসলে আমি কী করতে গঙ্গার ঘাটে গেছিল। বিশ্বনাথদের এটা দেখবার কথাও নয় বা ওরা এগুলো দেখতে চায়ও না খুব একটা। যেমন সে দেখেনি তার পেছনের ব্যানারটাতে দেশের প্রধানমন্ত্রী কি অসাধারণ মহিমায় শোভা পাচ্ছিলেন। তাঁর স্থির-তর্জনী যেন অবিকল শ্রীকৃষ্ণ; কেউ আবার তর্জনীর চারপাশে সোনালি রঙ দিয়ে সুদর্শন এঁকে দিয়েছিল। বিশ্বনাথের সামনেই একটা লোক চান করে উঠে মাথা মুছছিল। গামছায় ঢাকা সেই মাথা এক অবিশ্বাস্য পৌরাণিক চিত্রকল্পের আভাস দিয়ে যাচ্ছিল। যেন মাথা নেই, পাপীর ধড় থেকে সে এক অনির্বচনীয় অস্ত্রে পৃথক হয়ে গেছে। পাপী মানুষটা তার দেহ আঁকড়ে ধরে ছটফট করেই চলেছে, করেই চলেছে। এরকম আরো অনেক কিছুই বিশ্বনাথের চোখ এড়িয়ে গেছিল…

আমির পূর্ব-ইতিহাস জানার সুবাদে আমার কাছে তার সবচেয়ে বড় রহস্যটা পরিষ্কার ছিল, আর সেটা ছিল তার ক্ষমতা। তার প্রভাব যে বিশ্বনাথ দেখতে পায়নি সেটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ তা আমি আমাদের বাস্তবিক আমুদে জগতে প্রয়োগ করেনি, করেছিল আমাদের সাইকোলজিক্যাল প্লেনে। একজন লেখক হিসেবে সেই নির্মাণ আমি প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলাম। তা ব্যক্ত করেই আমি আমার লেখা শেষ করতে চাই। বিষয়টা একটু অবাস্তব শোনাতে পারে, তাই আগেভাগে সতর্ক হয়ে যাওয়া ভালো।

আমি সূর্যের দিকে হাত মেলে আঙুলগুলো দিয়ে সূর্যকে তার মুষ্ঠিতে আবিষ্ট করে। সেই হাত যখন নিজের বুক অবধি ফিরিয়ে আনে, সূর্যও সাথে সাথে কক্ষ্যচ্যুত হয়ে পৃথিবীর অনেক কাছাকাছি চলে আসে। আর আমারও বুঝতে বাকি থাকে না যে তার এই পরিকল্পনা সুনির্মিত। সে সূর্যকে পাঠিয়ে দেয় দক্ষিণ মেরুতে, বরফমহাদেশে। তারপর বাঁহাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে পৃথিবীপৃষ্ঠের সমস্ত জলরাশিকে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেয় সে। আমি এইসময় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিরতি নেয়, যে অবস্থায় আমরা তাকে শেষ অবধি দেখি। প্রথমে সে ভাবে, একদিকে সূর্যের নৈকট্যে আর তাঁর প্রচন্ড উত্তাপে যখন সমস্ত মেরুদেশীয় বরফ গলে জল হতে থাকবে, তখন ঐ প্রলম্বিত ও প্রচুরেরও অধিক জলরাশিকে সে সজোরে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করবে। জলে ধবংস হবে সভ্যতা। কিন্তু আরও খানিকক্ষণ তার দাঁড়িয়ে থাকা দেখে বোঝা যায়, সে তার ছক বদলেছে। সে বরং ভাবছে ঐ প্রলম্বিত জলরাশিকে ঠিক ওভাবেই যদি রেখে দেওয়া যায় আর সূর্যকে নিজের মনের মত চালনা করে তার প্রখর তেজের সাহায্যে যদি পৃথিবীপৃষ্ঠের সমস্ত বরফকে বাষ্প করে দেওয়া যায় তবে সেই পদ্ধতি অনেক বেশী কার্যকর হবে। সে এরকম ব্যবস্থাও করে দিতে চায় যাতে সেই উবে যাওয়া বাষ্প প্রলম্বিত অবস্থাতেই থেকে যায় মেঘে-মেঘে মিশে। ব্যস আর কী! সবক’টা জলের অভাবে তিলে-তিলে মরবে। এই প্রলম্বিত জল ব্যবহারের ক্ষমতা না আছে গাছপালার, না জীবজন্তুর। এককথায় আমি গোটা আবহাওয়া ও জলবায়ুর চক্রকেই নিয়ন্ত্রণ করার ছক কষে ফেলে। শুধু সেই খেলাটুকুই প্রকৃতি দেখাবে যা আমি তাঁকে দেখাতে বাধ্য করবে…

এখন এই অবধি এসে বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে এই লেখাটাকে তছনছ করে দেওয়াই যায়। অন্যদিকে উন্নয়নবাদীরাও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে এই সমস্যা মোকাবিলা করার উপদেশ দিতে পারেন। কিন্তু পাঠক, এখানে কথা হচ্ছে বস্তুজগৎ নিয়ে আর সেই জগতেরই অংশীদার বিশ্বনাথবাবু কিচ্ছু দেখতে পাননি সেদিন। যদিও একথা ভুললে চলবে না, বাড়ি ফেরার সময় তার শীত-শীত করেছিল। অর্থাৎ কোথাও না কোথাও কিছু না কিছু নিশ্চয়ই ঘটে গেছিল, নইলে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে সেই অকালশীতেরই বা অর্থ কী!

সবশেষে কোনটা যে প্রকৃতপক্ষে বাস্তব, তা নিয়ে এক বিস্তর আলোচনার অবকাশ থেকেই যায়…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...