সম্পর্ক মণ্ডল
সেই মৌর্যযুগের সময়ে ভারত-ভ্রমণে বের হয়ে মেগাস্থিনিস এসে পৌঁছেছিলেন কাটোয়ার তীরে, তিনি কাটোয়াকে ‘কটদুপা’ বলে তার ইন্ডিকা গ্রন্থে উল্লেখও করেন। অনেক পরে গ্রিক ঐতিহাসিকদের গ্রন্থ থেকে এই তথ্য খুঁজে পাই আমরা। এখানে কাটোয়া তীর মানেই গঙ্গা আর অজয়ের মিলনস্থল, যে মিলনস্থলে ছিল বিখ্যাত কেশব ভারতীর আশ্রম, যেখানে গঙ্গাতীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে উপস্থিত হয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব, কেশব ভারতীর কাছে তিনি এই মিলনস্থলেই মস্তকমুণ্ডন করে দীক্ষালাভ করেন। কালের গর্ভে সেই আশ্রম ভেঙে গেলেও আজও আমরা সেই মিলনস্থলে উপস্থিত হতে পারি। এখানে গঙ্গা-অজয়ের মিলনস্থল বলার উদ্দেশ্য হল এই দুই নদীর মিলনস্থলের একদিকে কাটোয়া শহর, অন্যদিকে শাঁখাই ঘাট। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে জ্যা দ্য ব্যারির ম্যাপেও সমৃদ্ধ কাটোয়ার পাশে শাঁখাই ঘাটের অবস্থান ধারণা করা যায়। ডাচ অভিযাত্রী ব্রোকের ম্যাপেও কাটোয়া বিকিহাটের উল্লেখ আছে, সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ঘাট হিসাবে শাঁখাইয়ের কথা জানা যায়। এছাড়াও ভোলানাথ চন্দ্রের ‘দ্য ট্রাভেল অফ হিন্দু’ ও রেভারেন্ট লঙের ‘অন দ্য ব্যাঙ্ক অফ ভাগীরথী’ বইতেও কাটোয়া মহকুমার তথা এই অঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া যায়। অবস্থানগতভাবে ভাগীরথী তীরবর্তী কাটোয়ার বিভিন্ন ঘাটগুলোর মধ্যে শাঁখাই ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ, তার অনেকগুলি কারণ ছিল। এক, অজয় ও গঙ্গার সংযোগস্থল হওয়ায় এখানে বীরভূম তথা রাঢ়ের আরও দক্ষিণে জঙ্গল অঞ্চলের সঙ্গে নদীয়া তথা পূর্ববঙ্গের যোগাযোগের সেতু ছিল শাঁখাই ঘাট। দুই, অজয় নদ মালভূমি অঞ্চল থেকে সৃষ্ট হলেও ভাগীরথী বরফ গলা জলে পুষ্ট, তাই ভাগীরথীর জলের নাব্যতা নষ্ট হত না সহজে এবং কাটোয়ার কাছে ভাগীরথীর সুতীব্র বাঁক থাকার জন্য বন্দর তৈরিতে সুবিধা ছিল। কাটোয়ার বাকি ঘাটগুলোও এই কারণে বিখ্যাত ছিল। তিন, উত্তরবঙ্গের নৌকার দক্ষিণে যাওয়ার পথে বা দক্ষিণবঙ্গের নৌকার উত্তরবঙ্গে যাওয়ার পথে সাময়িক বিশ্রামস্থল হিসাবে শাঁখাই ঘাটের প্রশস্তি যুগে যুগে ছিল। এই প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট প্রমাণ হল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরে যাওয়ার জন্য ভাগীরথী নদীকে ব্যবহার করতেন এবং ভাগীরথী থেকে বাবলা নদ হয়ে ময়ুরাক্ষীতে প্রবেশ করে তিনি গুনুটিয়া ঘাটে নেমে পালকি করে বোলপুরে পৌঁছাতেন, পথে কলকাতা থেকে ফেরার ও আসার সময় সাময়িকভাবে শাঁখাই ঘাটে বিশ্রাম নিতেন। চার, উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে মেসার্স হোর মিলার অ্যান্ড কোম্পানি গঙ্গাবক্ষে স্টিমার চালু করলে কাটোয়ার অন্যান্য ঘাটের মতো শাঁখাইও ছিল স্টিমারগুলোর রাতের আশ্রয়স্থল, কারণ ভাগীরথীতে তৎকালীন সময়ে বিপুল পরিমাণে জলদস্যুদের উৎপাত বাড়ে, তাতে এই বন্দর অঞ্চলই ছিল সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। পাঁচ, অবস্থানগত গুরুত্বের জন্য এখান থেকে বাণিজ্য করায় সুবিধা ছিল। মুঘল আমল থেকেই শাঁখাই ঘাটের গুরুত্ব বিশেষ বাড়ে। ইংরেজ আমলে এখানে নীলকুঠি স্থাপন করে এডিস নামক একজন ইংরেজ সাহেব এবং সেই নীলকুঠিতে চাকরিসূত্রে যুক্ত ছিলেন রাঢ়বঙ্গের বিখ্যাত পাঁচালিকার দাশরথি রায়। নীল চাষের জন্য চাষিদের জোরজুলুমের ইতিহাসও এখানে শোনা যায়। নীলকুঠিটির ভগ্নাবশেষ কিছুদিন আগেও শাঁখাই গ্রামে দেখা যেত কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে তা লুপ্তির পথে। রাজনৈতিক সুবিধার স্থল হিসাবেও শাঁখাইয়ের গুরুত্ব ছিল, তাই বাংলার নবাবি আমলে এখানেই নবাবি দুর্গ ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের সেনাদলের আশ্রয়স্থল। যুদ্ধের মশলা ও খাদ্যসামগ্রী এখানে প্রচুর পরিমাণে মজুত থাকার কথা আমরা ইতিহাস থেকে পাই। জানা যায়, ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের সময়ে রাতের অন্ধকারে গঙ্গার অপর পার দিয়ে ইংরেজ সেনারা পলাশীর দিকে যাত্রা করেছিল, পরে ১৭৬৩ সালে বক্সারের যুদ্ধে যখন কাটোয়া-গিরিয়া-উধুয়ানালা যুদ্ধে কেঁপে ওঠে, তখন কাটোয়ার যুদ্ধের অধিকাংশ এই শাঁখাইয়ের বজরাডাঙার মাঠে হয়। বজরাডাঙাতে রবার্ট ক্লাইভ তার বজরা এনেছিলেন বলে তখন থেকেই এই স্থানটির নাম বজরাডাঙা বলে পরিচিতি পায়। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের কাছেও শাঁখাই খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান কারণ, এখানেই প্রথম রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তিকে আনা হয় রাজস্থানের জয়পুর থেকে। যখন ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণ শুরু হয়, একের পর এক হিন্দু মন্দির ভেঙে ফেলা হয়, দেবতার মূর্তিকে উৎখাত করা হয়, তখন মথুরা-বৃন্দাবন থেকে প্রচুর হিন্দু দেবতার মূর্তিকে জয়পুরে সরিয়ে দেওয়া হয়। অনেক পরে প্রভু নিত্যানন্দের নাতি প্রেমানন্দ গোস্বামী সেই রাধাকৃষ্ণ যুগল একটি মূর্তিকে জয়পুর থেকে বৃন্দাবন হয়ে গঙ্গার উজানে নৌকাযোগে এসে শাঁখাই ঘাটে নামেন এবং শাঁখাই-তে একটি রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন, বলা যায় তার আগে এই রাঢ়বঙ্গে কৃষ্ণের সাথে রাধার পুজো হত না যুগলমূর্তি হিসাবে। শ্রী বঙ্কিম চন্দ্র ঘোষ তার ‘রাঢ়ের বৈষ্ণব পরিক্রমা’ গ্রন্থে লিখেছেন যে এই শাঁখাই থেকেই রাধাকৃষ্ণ যুগল এবং জগন্নাথদেবের ভ্রাম্যমাণ পুজো গোটা রাঢ়দেশে চালু হয় এবং শাঁখাইয়ের পর ভ্রাম্যমাণ পুজোর কেন্দ্র হিসাবে নল্যাপুর বা বর্তমান নলিয়াপুরে শুরু হয়, এই নল্যাপুর ছিল প্রভু নিত্যানন্দের জামাই ‘শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গল’-এর রচয়িতা শ্রীমাধব চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীপাটভূমি। অন্যদিকে সাহিত্যেও শাঁখাই ঘাটের প্রশস্তি পাওয়া যায় মঙ্গলকাব্যগুলিতে, কখনও ‘শঙ্খিনী ঘাট’, কখনও ‘শঙ্খধ্বনির ঘাট’, কখনও বা ‘সাখাই ঘাট’ নামে আমরা শাঁখাই ঘাটের কথা খুঁজে পাই। জনশ্রুতি অনুযায়ী, বীরভূমের কেঁদুলি থেকে পৌষ সংক্রান্তির ভোরে এই শাঁখাই ঘাটে গঙ্গাস্নান করতে আসতেন ‘গীতগোবিন্দ’র কবি জয়দেব গোস্বামী, একবার তার শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি আসতে পারেননি শাঁখাই ঘাটে। তাই মা গঙ্গা নাকি নিজেই অজয় দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জয়দেবের গৃহনিকটবর্তী কদমকুন্ডি ঘাট পর্যন্ত গিয়েছিল, তাই আজও মানুষ পৌঁষসংক্রান্তির দিন কেঁন্দুলির মেলাতে ভিড় করে পুণ্যস্নানের আশায়। শাঁখাই ঘাটকে নিয়ে আরেকটি জনশ্রুতি হল, কথিত আছে, প্রভু নিত্যানন্দের দ্বাদশ গোপালের অন্যতম তথা একমাত্র শুদ্র গোপাল উদ্ধারণ দত্তকে মা গঙ্গা তার মেয়ে রূপে দেখা দিয়েছিলেন এবং শাঁখা পরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শাঁখার দাম মেটাতে গেলে মা গঙ্গা দেবী অদৃশ্য হয়ে যান। তাই আজও এখানে বীরভূম-বর্ধমান-মুর্শিদাবাদের বহু স্নানযাত্রিনী শাঁখাই ঘাটে শাঁখা পরেন। নববিবাহিত মহিলাদের কাছে এই ঘাটে শাঁখা পরাটা খুব পবিত্র কাজ হিসাবে দেখা হয়। যদিও উদ্ধারণ দত্তের মুখ্য খ্যাতিলাভ তথা সাধনস্থল হল উদ্ধারণপুর, যিনি প্রথম জীবনে লক্ষণ সেনের তাম্রশাসনখ্যাত গ্রাম নৈহাটিতে সামন্তরাজা নৈরাজার দেওয়ান ছিলেন। প্রাচীনকাল থেকেই তাই এই ঘাটের নাম মানুষের মুখেমুখে ফেরে। সেই শাঁখাই ঘাট, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ফেরি পারাপারে এক পার থেকে অন্য পারে যান, যেখানে প্রতিদিন বীরভূমের গঙ্গাস্নান-যাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকে। পূর্ব বর্ধমান-নদীয়া-মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের সংযোগস্থল হিসাবে সেই প্রাচীনকাল থেকে বহু ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে ইতিহাসকে বুকে নিয়ে আজও অক্ষত রাঢ়ের উল্লেখযোগ্য ঘাট হিসাবে শাঁখাই ঘাট।