যশোধরা রায়চৌধুরী
ক্ষমতা কীভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে নানা চরিত্রের মধ্যে, সেটাই বলে দেয় কোন কাহিনিটি নারীবাদী আর কোনটি নয়। ক্ষমতার খেলাটা সমাজ চিরদিন নারীদের বিরোধিতায় ঘুরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু নারীরা যদি কলম তুলে নেন, আর পালটে দেন পাশা? পালটে দেন ক্ষমতার খেলা? ইলেকট্রিক লিটারেচার সাইটে এরিন বার্টনেট লিখেছিলেন, কীভাবে আন থেরিও প্রমাণ করেছিলেন, একদা রূপকথারা ছিল মেয়েদের কথা। কেতাবি সংস্করণে আসার পথে, ১৮১২ থেকে ১৮১৫-র ভেতরে, গ্রিম ভাইদের হাতে পড়ে প্রচুর পরিবর্তিত হয় রূপকথারা। মেয়েদের জীবন যৌবন যৌনতার সব উল্লেখ ধীরে ধীরে মুছে, কেবলমাত্র সুশীলা বালিকা, নিয়ম মেনে চলা ধর্মপ্রাণাদেরই একমাত্র জিতিয়ে দেওয়ার শুরু হল। ইচ্ছাময়ী, তীব্রভাবে স্বেচ্ছাচারিণীদের বিচিত্র ও ভয়ানক শাস্তি দেওয়া হতে থাকে গল্পের শেষভাগে। এভাবেই ডেটলে ধুয়ে ফিনাইলে মুছে রূপকথাদের আধুনিকীকরণ হয় আর আমরা পাই কামনাহীন স্নো ওয়াইট বা অত্যাচারিতা সিন্ডারেলাদের। হ্যাপিলি এভার আফটার তারাই পাবে যারা এই সব সামাজিক বিধিনিষেধ মেনে চলবে, এই আর কী!
থেরিও বলেন,
And so fairy tales began to feel less like women’s stories and more like a guidebook for how women were expected to behave.
বিংশ শতকের মেয়েরা আবার কলম হাতে তুলে নিলেন গল্পটাকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়ে। এমা ডনহিউ ‘কিসিং দ্য উইচ’-এ ১৩টি গল্প লিখলেন পুরনো রূপকথাকে নতুন রূপ দিয়ে। কুইয়ার বা বাঁকাচোরা করে বলা শুরু হল রূপকথা। সিন্ডেরেলা রাজপুত্র নয়, পরি মায়ের সঙ্গে চলে যায়, স্নো ওয়াইটের নিজস্ব কামনাবাসনার কথা আসে, আর জলপরি নিজের প্রেমকে জয়যুক্ত করে উঠতে পারে। মার্গারেট অ্যাটউড এইভাবে লিখেছিলেন, রবার ব্রাইড বইটি। জানাচেনা গল্পকে নারীবাদী বয়ানে বিনির্মাণের ঘরানা এভাবেই চালু আছে ইংরেজি সাহিত্যে অন্তত গত শতক থেকেই। অ্যান সেক্সটনের ‘ট্র্যান্সফরমেশন্স’ বইটিও একই ঘরানার, আরও এক গোছা বইয়ের খবর আমরা ইন্টারনেট ঘাঁটলেই পাব। সবাই “হ্যাপিলি এভার আফটার”-এর ঘরানাকে বদলাতে চেয়েছেন তাঁদের লেখায়।
আনন্দের কথা, বাংলা ভাষায়ও রূপকথা বিনির্মাণ অথবা পুনর্নির্মাণ শুরু হয়েছে হালে। শেষ যে বইটি হাতে আসে, সেটি ঈপ্সিতা হালদার ও সুমিতার লেখা বই। কুরূপকথাগুলি। ছোটখাটো বইটি। নাম নিজেই ওশকায়। তারপর দেখি, প্রথম ব্লার্ব বলছে, “মিথ, রূপকথা, লোককথা, ইত্যাদি প্রভৃতি। মুখফেরতা কিছু, কিছু পড়ে পাওয়া আনারদানা। লোকে শোনে, ফের বলে, ফিরে লেখে।”
এইবার এইসব কাহনের কথক হলেন এই লেখকেরা। খেলাটা এই— কখনও চিনতে পারা যাবে নকশাটা, কখনও চরিত্ররা চলতে শুরু করবে আদল ভোকাট্টা। চেনা গল্পের জানা ঠাট থাকবে, আবার চলেও যাবে আনজানা অপরিচয়ের আড়ালে, ধাঁধার মত উশকাবে। মশকরা করবে, ভীতও করবে। এই আর কি!
এর পর উল্টে পাল্টে দেখি বইটি। দুভাগে লেখা হয়েছে। প্রথমাংশে ঈপ্সিতার লেখা গল্পগুলো। রেড রাইডিং হুড, অরুণ বরুণ কিরণমালা, অয়েদিপাউস ইয়াকোস্তা, রাম অহল্যা। রাধা কৃষ্ণ। মেদেয়াজেসন। অপু দুর্গা। তারপর সুমিতার লেখা। কাঞ্চনমালা সূচরাজার গল্প, পরশুরামের মাতৃহত্যা, সিন্ডারেলা, ট্যান্টালাস, শাহরিয়ার শেহরাজাদির গল্প, বিসর্জনের গল্প, ট্রয়ের কাসান্দ্রার গল্প।
আসলে লেখাকে মেধার আতশকাচের ভেতরে রেখে যেরকম পড়া যায়, আবার আগে পিছের কোনও অনুষঙ্গ ছাড়াও একটি নিছক গল্পের বই হিসেবেও পড়া যায় বইকি। এ বইয়ের প্রতিটি গল্প তাদের শুরুর ব্যাখ্যা বাদ দিলেও পাঠবস্তু হিসেবে চমৎকার। যদিও নিখুঁত নিটোল গোল গল্প নয়, লেখনের ভেতরে আমাদের সমসময় উঁকি মারে। একেবারেই যেন আজকের খবরের কাগজ থেকে উঠে আসে একের পর এক কাহিনি। অহল্যাবাঈর স্বামী তাই হয় গোতুমলাল, লোহা কারখানার কর্মী, পুরন্দরিয়া আসে গোতুমলালের রূপ ধরে অহল্যাবাঈকে ছলাকলা করে রেপ করতে, আর এনজিও-র শ্রীরাম দেশপান্ডে এসে গোতুমলালের বাড়ি থেকে আটকে রাখা অহল্যাবাঈকে উদ্ধার করেন। নিটোল এক দেহাতি গল্পে হিন্দি বাংলার বুনোট থেকে ঝরে পড়ে অধুনান্তিক। রাধা হয়ে যায় রাধাকাকিমা। ঈপ্সিতার লেখায় এইভাবে জেগে ওঠে কাহিনিরা, মোচড় খায় প্রাচীন কথা, পুরাণ, মিথ, রূপকথা। আবার সুমিতার গল্পে মাতৃহন্তারক পরশুরাম হয়ে যায় পি রাম। সিন্ডারেলা হয় মুক্তিপদ মুখুজ্জের আট নম্বর মেয়ে চায়না। ন’দির শ্বশুরবাড়িতে থাকে। রাত বারোটার শেষ বাসে চটি হারানো চায়না ছুটে চলে যায় পুরুষদের সঙ্গে।
নতুনত্ব এবং ভাষার জোরালো অভিঘাতে গল্পগুলো নিজেরাই পড়িয়ে নেয় নিজেদের। প্রতি গল্পে প্রায় ভাষা পালটে পালটে নেন লেখকেরা। সুমিতা কখনও বলেন বাঙাল ভাষায়, কখনও সাধু ভাষায়, কখনও বা উন্মাদনার ভাষায়।
উল্টোদিকে ঈপ্সিতা দারুণ একটা খেলা খেলেন, রূপকথা আর এই সময়কে মিলিয়ে দেন বালিকা ও সেইসব নেকড়েরা গল্পে। দাদা বাবা জ্যাঠা বসবার ঘরে বসে খবরের কাগজ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে কীভাবে নেকড়েরা খাচ্ছে ছিঁড়েখুঁড়ে মেয়েদের… আর তারপরই অনায়াসে উঠে আসছে রানি মুখার্জি বিপাশা বসু বাস ট্রাম এগরোলের গন্ধ, জিন্স আর শাড়ি আর নারীবাদের প্রসঙ্গ। অবলীলায় গতিপথ বদল করছে গল্প আর শেষটা হয়ে উঠছে মেয়েদের জন্য মুক্তির। অপু দুর্গার পুনর্নির্মাণের কাহিনিতে বিভূতিভূষণের ভাষা জীবন্ত হয়ে উঠেছে ঈপ্সিতার কলমে, কাশির পুরি কচুরি চেখে চেখে খাওয়ার মত করে পড়ি এই সময়দাগ চিহ্নিত অপরূপ মায়াকলমের ভাষা। আর আনন্দ পাই দুর্গার মৃত্যুকে ঘুরিয়ে দিতে পারার দক্ষতায়।
এই বই অনন্য হয়ে ওঠে সব মিলিয়ে তাই। দুই হাত বাড়িয়ে একে ডেকে নিতে হয়। কৃতি-প্রকাশনার কৃতিত্বে বইটির আপাদমস্তক গোছানো, সুন্দর। ছবি প্রচ্ছদ সহ।
এখন মনে হয়, এই অভিনব বই আরও অনেকের হাতে পৌঁছতে পারা দরকার। হয়ত তাহলেই লেখার ঝরনাতলায় আরও অনেক জলকেলি শুরু হতে পারবে।