মৃত পাখিদের গান — ৩য় পর্ব

অবিন সেন

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

চার

দুপুরে একটা সেমিনার ছিল পুলিশ ফোর্সে আইটি ইমপ্লিমেন্টেশান নিয়ে। এই সব সেমিনারে গিয়ে খুব ঘুম পায় অর্কর। এক ঘণ্টার সেমিনারে প্রায় চল্লিশ মিনিট সে ঝিমিয়ে নিয়েছে। না, তাতে করে তার মাথাধরা একটুও কমেনি। সেমিনার থেকে ফিরে সে ভাবল আজ আর কোনও কাজ সে করবে না। বিকেল বিকেল কেটে পড়ে বাড়িতে একটু জিরিয়ে নিয়ে তার পরে সে অন্বরের চেম্বারে যাবে। কিন্তু কথায় আছে বিধি বাম। সেমিনার থেকে ফিরতে না ফিরতেই জেসিপি-ক্রাইমের ফোন। তিনি কোনও এক সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য বেরিয়ে যাচ্ছেন, ফলে বিকেলে তাঁর যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল এক এনজিও-র আধিকারিকের সঙ্গে সেটা অর্ককে অ্যাটেন করতে হবে। অর্ক একবার বলার চেষ্টা করেছিল “স্যার, আজকে ওদের কাটিয়ে দিলে হত না!” কিন্তু উনি রাজি হলেন না। সিপি সাহেবের নাকি রেকোমেনডেশান আছে। অগত্যা অর্ককে বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত বসে থাকতে হবে। কোনও মানে হয়? অর্ক মনে মনে তার ভাগ্যকে অভিসম্পাত দিল।

এই সব এনজিওদের তার একেবারে ঢপের চপ বলে মনে হয়। সবকটা এক বা একাধিক প্রভাবশালী মানুষদের তাঁবেদারিতে চলে।

বসে থাকতে থাকতে সে তন্ময় সামন্তর রেখে যাওয়া কয়েকটা কাগজপত্র ওলটাচ্ছিল। সহসা এক জায়গায় তার চোখ আটকে যায়। রাহুল বৈদ্য যে পিস্তলের গুলিতে মারা যায় সেই পিস্তলের সঙ্গে চোরাচালানের পিস্তলের যেন মিল পাওয়া যাচ্ছে। সে ফাইলের কাগজের সঙ্গে পিন দিয়ে আটকানো পিস্তলের ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মুখের ভিতরে জিভ দিয়ে টগরায় একটা শব্দ করে নিজের মনে বলে

বাহ, রে… হুবহু একেবারে মিলে যাচ্ছে।

সে তৎক্ষণাৎ বেল দিয়ে অধীর গাঙ্গুলিকে ডেকে পাঠায়।

অধীর এলে তার সামনে অর্ক ছবি সহ ফাইলটা মেলে ধরে।

দেখছেন?

অধীর ফাইলটা টেনে নিয়ে মন দিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখতে থাকে। তারপরে পকেট থেকে মোবাইল বার করে মোবাইলের একটা ছবির সঙ্গে সেই ছবিটা মেলাতে থাকে। বিস্ময়ে তার চোখ সরু হয়ে আসে। চশমার ভিতর দিয়ে অন্তর্ভেদী চোখ মেলে সে বলে,

ঠিক, স্যার। হুবহু মিলে যাচ্ছে।

ঠিক। তবে সামন্ত তাদের মতো করে খুনের তদন্ত করুক। আপনি এই ফাইলটা রাখুন। একটু ভাবুন। অযাচিতভাবে আমাদের হাতে একটা লিড চলে এসেছে। এটা আমাদের হারালে চলবে না।

ঠিক স্যার। এটা একটা মিসিং লিঙ্ক। আমি স্যার এটা নিয়ে ভাবছি, কীভাবে এটা নিয়ে এগোনো যায়।

আরও কিছু টুকটাক আলোচনা সেরে অধীর বেরোল।

অর্ককে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল তার ভিজিটার্সদের জন্য।

বেয়ারার সঙ্গে যে ঘরে ঢুকল এরকম কাউকে আশা করেনি অর্ক। ভেবেছিল মহিলা কমিশনের মহিলাদের মতো জাঁদরেল চেহারার কেউ হবে।

ছোটখাটো চেহারার অল্পবয়সী রুচিরাকে দেখে অবাক হয় অর্ক। এই পুঁচকে মেয়েটার অপেক্ষায় সে সব কাজ ফেলে বসে আছে! একটা অবজ্ঞার হাসি যেন তার ঠোটের কোণে খেলে যায়।

রুচিরা হাত তুলে ক্ষুদ্র নমস্কার করে।

অর্ক প্রতিনমস্কারও করে না। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পরে অর্কর মুখ থেকে অবজ্ঞার হাসিটা উবে যায় যেন। তার চোখে কী মুগ্ধতা!

রুচিরার চেহারা ছোটখাটো বলে তাকে খুব বাচ্চা বাচ্চা মনে হয়। সে একটু শ্যামবর্ণা। লোকে তাকে এক ঝলক দেখে হয়ত কালোই বলবে। কিন্তু এই মুখের থেকে চট করে চোখ সরাতে পারে না কেউ। এমনি আশ্চর্য তার লাবণ্য। আর তার হাসি যেন হাসির সীমানা ছাড়িয়ে যায়। ঘাড় পর্যন্ত অঢেল চুল, মাঝে মাঝে তা অবহেলায় তার মুখের উপরে চলে আসে। গত বছর সে জেএনইউ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে এসেছে। অনেক বড় বড় চাকরির হাতছানি এড়িয়ে সে তাদের এই “আবাদ” নামের ছোট্ট সংস্থাটাকে বড় কারার চেষ্টা করছে। স্মিত মুখে সে কথা বলে…

আমি রুচিরা বসু।

অর্ক যেন তার স্বগতোক্তি করে বলে,

আমি জানি। আপনি বসুন প্লিজ।

রুচিরা কি শুনতে পায়?

মৃদু হাসিতে সে বলে, যেন অবাক হয়ে বলে…

আপনি জানেন?

আমি এক রুচিরাকে জানি। শরদিন্দুবাবুর রুচিরা।

কথাটা বলে সে হেসে ওঠে। সারা দিনের পরে সে যেন এই প্রথমবার হাসল।

রুচিরাও জোরে হেসে ওঠে। তারপরে সে ভাবে, এমনটা তাকে কেউ বলেনি।

অর্ক তার মুখ থেকে হাসিটা মুছে নেয় না। সেই ভাবেই স্মিত মুখে বলে,

বলুন আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি।

আমাদের সংস্থার নাম “আবাদ”। আমরা পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কাজ করি। আমাদের সংস্থাটা ছোট, কাজের পরিধিও ছোট। সেন্ট্রাল থেকে সামান্য টাকা পাই তাতে করে স্মল স্কেলে কিছু কাজ করি। মোট এগারোজন আছি আমরা। এই সংস্থার প্রাণভোমরা হচ্ছেন আমার ঠাকুমা। ওঁর বয়স সেভেনটি ফাইভ পেরিয়েছে কিন্তু এখনও দারুণ ফিট।

অর্ক বলল…

পরিষ্কার বুঝলাম না। পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের কীভাবে রেসকিউ করেন? মানে আমি বলতে চাইছি কীভাবে তাদের ফিরিয়ে আনেন? এটা তো খুব ডিফিকাল্ট আর রিস্কি।

ঠিক স্যার। আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা ঠিক রেসকিউ করার কাজটা করি না। উদ্ধার হওয়া মেয়েদের যখন বিভিন্ন হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তখন আমরা তাদের বিভিন্ন ট্রেনিং-এর মাধ্যমে স্বনির্ভর করার চেষ্টা করি। তাদের বিভিন্ন জায়গায় কাজ পেতে সাহায্য করি। এরকমও হয়েছে সিনেমায় নামার নেশায় মেয়েরা দালালদের চক্করে পড়ে প্রস্টিটিউশানে নামতে বাধ্য হয়েছে, আমরা তাদের মূল স্রোতে ফিরতে সাহায্য করি।

অর্ক তার “স্যার” সম্বোধনটা লক্ষ করল। সে বলল,

এই কাজটিও তো দারুণ রিস্কি। বিপদে পড়তে পারেন যে কোনও সময়ে। বা ক্রাইমের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারেন।

রুচিরা হাসে।

সেই জন্যেই স্যার আপনার কাছে এসেছি। ইদানিং মনে হচ্ছে আমরা যেন শ্যাডো হচ্ছি।

কীরকম?

অর্ক ডিটেলে জানতে চায়।

বেয়ারা একটা গ্লাসে এক গ্লাস জল রেখে গিয়েছিল রুচিরার সামনে। কথা শুরু করার আগে রুচিরা কয়েক ঢোক জল খেয়ে নেয়। হাতের ছোট্ট ব্যাগটা থেকে একটা রুমাল বার করে মুখটা মুছে নেয় একবার।

অর্ক বসে বসে রুচিরার ভঙ্গিগুলো লক্ষ করছিল। কী সুচারু আর ছন্দময় তার ভঙ্গি! অর্ক মনে মনে ভাবল।

ধীরস্থিরভাবে রুচিরা শুরু করে,

গত বছর দুটি মেয়েকে আমরা টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় কাজ দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম। একজন মেকআপ আর্টিস্টের কাজ পেয়েছে। আর একজনকে ওই লাইনেরই এক ক্যাটারিং সংস্থায় কাজে দিয়েছি আমরা। কিন্তু সমস্যাটা মেকআপ আর্টিস্ট রেখা দাশকে নিয়ে। রেখার একটা পাস্ট আছে। সে এক সময় সিনেমায় নামার নেশায় এক দালালের খপ্পরে পড়ে আনোয়ার শাহ রোডের গলির ভিতরে তলিয়ে যাচ্ছিল। এই রেখা দাশকে আমরা সরাসরি অন্ধকার মানুষদের হাত থেকে উদ্ধার করি। সেই সময় আমাদের বেশ সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। আবার পরে তা মিটেও গিয়েছে বলে আমরা ভেবেছিলাম। কিন্তু তা মেটেনি। মেকআপ আর্টিস্টের কাজের সঙ্গে সঙ্গে সে আমাদের “আবাদ”-এর কিছু কাজও করে দেয়। কয়েকদিন থেকে তার মনে হয়েছে কেউ তাকে ফলো করছে। আমরা লোকাল থানায় গিয়েছিলাম। কিন্তু স্পেসিফিক কোনও প্রমাণ না থাকায় একটা জিডি নিয়ে তারা ছেড়ে দেয়। তার পরে ঠাকুমা সমরেশ মামাকে ফোন করে। সমরেশ মামার সূত্রেই আমাদের সিপি স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়।

অর্ক মন দিয়ে রুচিরার কথাগুলো শুনল। তার পরে বলল,

রেখা দাশ কোথায় থাকে? তার ঠিকানা আমাকে দিন। আমি দেখছি।

সে টালিগঞ্জের রিজেন্ট কলোনির ভিতরে একটা ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে একাই থাকে।

রুচিরা তার ব্যাগ থেকে যখন একটা ছোট্ট ডাইরি বার করে রেখার ঠিকানা খুঁজে বার করছিল তখন অর্ক বলল,

এক কাজ করুন ঠিকানাটা আমাকে এসএমএস করে দিন। সে তার নাম্বার বলে।

রুচিরা তার মোবাইলে নাম্বারটা সেভ করে নিলে অর্ক বলে,

আমার একটু তাড়া আছে আজ, এক ডাক্তারের কাছে যাব….

কথাটা সে শেষ না করেই যেন হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়।

রুচিরা ব্যস্ত হয় যেন…

সরি স্যার। সে উঠে পড়ে।

অর্ক বলল,

ফোন নান্বার তো রইল। আপনি আমাকে ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিয়ে একটা ফোন করে দেবেন।

রুচিরা মৃদু হেসে যেন তার কথায় সায় দেয়। তার পরে বেরিয়ে যায়।

অর্ক তার চলে যাওয়াটা দেখল।

 

পাঁচ

পুলিশ সেই যে ঘরটা সিল করে দিয়ে গিয়েছিল, কয়েকদিন এমনি বন্ধ থাকার পরে এই আবার খোলা হল। ভিতরটা তাই কেমন একটা ভ্যাপসা গুমোট গন্ধে ভরে গিয়েছে। হঠাৎ করে এই গন্ধটা নাকে লাগলে পেটের ভিতরটা ঘুলিয়ে ওঠে। প্রবাল তাড়াতাড়ি গিয়ে একটা জানালা খুলে দিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা করে একটা শ্বাস নেয়। লম্বা শ্বাসে অনেকটা বাতাস বুকে ভরে নেয় সে। তার মনে হয় এমনটা যেন মৃতের গন্ধ। সে আগেও অনেকবার এমন গন্ধ অনুভব করেছে।

অফিস থেকে বের হতে হতে তাদের সেই দুপুর হয়ে গিয়েছে। আকাশ সকাল থেকেই মেঘলা। দুপুরের পরে সেই মেঘ যেন আরও ঘন আর কালো হয়ে গিয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। প্রবাল বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখল। জানালা থেকে পাশের একটা বাড়ির ছাদ দেখা যায়। ন্যাড়া ছাদ। বাড়িটাও পুরানো।

ঘরে আরও একটা জানালা ছিল। তন্ময় সামন্ত সেটাকে খুলে দিয়েছে। তার পরে প্রবালকে লক্ষ করে বলে,

সারা দোতলা জুড়ে রাহুল আর বিশাখা থাকত। তিনতলাটা ছিল রোহণের। রোহণ মারা যাবার পরে সেটা তালা বন্ধই পড়ে আছে। আর একতলায় থাকে রাহুলের মা আর দূর সম্পর্কের কাকা বলাইবাবু। ওঁদের সঙ্গে আমরা পরে কথা বলব। গ্রাউন্ড ফ্লোরের সামনেটা গ্যারাজ আর পিছন দিকটা গুদামঘর ভাড়া দেওয়া আছে। ওপরে যাবার সরাসরি একটা সিঁড়ি। মেন দরজা দিয়ে ঢুকে নিচের কাউকে ডিস্টার্ব না করে সরাসরি উপরে উঠে যাওয়া যায়। রাহুল হয়ত নিজের সুবিধার জন্যই এমন ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

সামন্ত একটু থেমে আবার শুরু করে,

প্রতিটা ফ্লোরে তিনটে শোবার ঘর, একটা কিচেন। কিচেনটা বড়, খাবার ব্যবস্থা সেখানেই। বসার ঘরটা বড়। তিনটে ঘরের সঙ্গেই লাগোয়া বাথরুম। একটা কমন বাথরুম। পিছন দিকে একটা টানা বারান্দা।

প্রবাল চিন্তামগ্নভাবে সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে ভালো করে। বসার ঘরের একদিকে থ্রি সিটার সোফা সেট। সলিড উডের সেন্টার টেবিল। এক দিকে ছোট একটা বার। মেঝেটা পুরু কার্পেটে মোড়া। আর এক দিকে কাচের পাল্লা দেওয়া কাঠের আলমারি। তাতে রকমারি জিনিস সাজানো। বারের সামনে চারটে কাঠের টুল রাখা আছে। সাজানো ঘরটাকে মনে মনে তারিফ করে প্রবাল।

সে বলল,

বডি কোথায় পাওয়া গিয়েছিল?

দেওয়ালের দিকের সোফাটার কাছে গিয়ে সামন্ত বলল,

ঠিক এই সোফায় বসা অবস্থায় ছিল বডি।

এলিয়ে ছিল?

না। একেবারে স্ট্রেট। তবে ঘাড়টা পিছন দিকে হেলানো ছিল।

হাতের পজিশন কীভাবে ছিল?

ডান হাত কোলের উপরে এলিয়ে ছিল। হাতে পিস্তলটা ধরা ছিল।

প্রবাল সোফাটার সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবল। তার পরে বলল,

আর ঠিক কপালে গুলি করা হয়েছে। স্ট্রেঞ্জ!

ঠিক কপালের যে জায়গাটায় টিপ পরে মেয়েরা, গুলি করা হয়েছিল ঠিক সেখানে।

এভাবে নিজের কপালে নিজে গুলি করা সম্ভব?

আমরাও তাই ভাবছি স্যার।

প্রবাল তার দিকে কটমট করে তাকায়।

তন্ময় সামন্ত হেসে ফেলে। শুধরে নিয়ে বলে,

প্রবালবাবু।

সামন্ত আবার বলে,

তবে এভাবে গুলি করা একেবারে অসম্ভব নয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পিস্তলটা দু হাত দিয়ে ধরতে হত।

ঠিক তাই। এক হাতে এইভাবে গুলি চালানো সম্ভব নয়। ছবিতে তো দেখেছি বাঁ হাতের পজিশন। পিস্তল থেকে অনেক দূরে সে হাতটা সোফার উপরে এলিয়ে ছিল।

তাদের কথার মাঝে ঘরে এসে ঢুকল এই কেসের আইও টালিগঞ্জ থানার এসআই প্রবীর পাল। সামন্তর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। বলল,

সামন্তদা ভালো আছেন?

সামন্ত হৈ হৈ করে হেসে বলল,

ভালো ভালো, তা প্রবীর ছবিগুলো এনেছ? প্রবালবাবুকে দেখাও।

প্রবীর প্রবালের দিকে তাকিয়ে জোড় হাতে নমস্কার করল।

আপনার কথা অনেক শুনেছি। এবার সামনে থেকে দেখার সুযোগ পাব।

প্রবাল তার কথায় একটু কাঁধ ঝাঁকায়। বলে,

যে ছবিগুলোর কথা বলছিলেন সেগুলো দেখি।

একজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে সামন্তর হাতে একটা ফাইল দিলে সেটা থেকে সামন্ত কয়েকটা ছবি বার করে প্রবালের হাতে দেয়। বলে,

দেখুন দু হাতে কবজির কাছে একটা দাগ। দাগটা খুব হালকা। তবু বোঝা যাচ্ছে।

প্রবাল মন দিয়ে ছবিটা দেখে। তার পরে মুখ তুলে প্রবীরের দিকে তাকিয়ে বলল,

ডেড বডি তো আপনি দেখেছেন। এই দাগ দুটো দেখেছিলেন।

হ্যাঁ। এটা দেখেই প্রথমে আমার সন্দেহ হয় এটা হয়ত সুইসাইড কেস নাও হতে পারে!

আর একটা ছবি বার করে সে প্রবালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বলে,

প্রবালবাবু এই ছবিটাতে দেখুন কানের পাশেও এমন একটা দাগ। মনে হয় কানের পাশ দিয়ে কিছু একটা পেঁচিয়ে বাঁধা ছিল।

প্রবাল এক মনে কী যেন ভাবছিল। ছবিটা ফিরিয়ে দিয়ে সে ঘরের এদিক থেকে ওদিকে পায়চারি করে। প্রবীরের দিকে ফিরে বলে,

বডি প্রথম কে আবিষ্কার করছিল?

বলাইবাবু। পরদিন ছিল রবিবার। রাহুল রোজ নিচে গিয়ে তার মা’র কাছে বসে সকালের চা আর সামান্য জলখাবার খেত। সেদিন অনেক বেলাতেও যখন রাহুল নামেনি তখন বলাইবাবু উপরে উঠেছিল রাহুলের খোঁজ নিতে।

তার মানে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল না।

না।

জানালা দুটো?

বন্ধ ছিল। পর্দা টানা ছিল। বলাইবাবু এসে পর্দা সরায়।

তার মানে মনে হচ্ছে ঘরে আলো জ্বলছিল না। আলো জ্বললে ঘরে ঢুকেই সে মৃতদেহ দেখতে পেত। পর্দা সরাতে সে যেত না।

সে নিজের মনেই বলল,

বলাইবাবুর কাছ থেকে আমার ধারণাটা মিলিয়ে নিতে হবে।

সে আবার সামন্তর দিকে ফিরে বলল,

পিস্তলটার লাইসেন্স ছিল?

নাহ। বেআইনি অস্ত্র।

প্রবাল গুটি গুটি পায়ে কমন বাথরুমের সামনে গিয়ে দরজা ঘুলল। বাথরুমটা বড়। ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে।

তার পিছনে পিছনে এসে সামন্ত বলে এই বাথরুমের বেসিনের তাকে একটি খালি মদের গ্লাস রাখা ছিল। যাতে কোনও হাতের চাপ পাওয়া যায়নি।

প্রবাল তার দিকে তাকায়।

মুচকি হাসে। বলে,

সামন্তবাবু সেইদিন যতগুলো ছবি তোলা হয়েছিল সবগুলো ছবি আমার দরকার। ঘরের কোথায় ঠিক কোন জিনিস ছিল তার একটা স্কেচ আমাকে করতে হবে। ছবিগুলো কবে পাব?

আগামীকালই পেয়ে যাবেন।

এবার অন্য ঘরগুলো ঘুরে দেখা যাক। নায়িকা নিখোঁজের কোনও ক্লু পাওয়া যায় কি না দেখি!

সামন্ত বলল,

হ্যাঁ, চলুন প্রবালবাবু। আমরা অবশ্য খুঁজে দেখেছি। সেরকম কিছু পাইনি। একটা জিনিস খেয়াল করবেন প্রবালবাবু।

প্রবালবাবু কথাটা বলতে এখনও যেন সামন্তর গলায় বাধে। ছোট বড় সবাইকেই সে সময়ে অসময়ে স্যার বলে ডাকে। কিন্তু প্রবালের নিষেধ তার সেই অভ্যাসকে যেন ক্রমাগত পীড়া দিয়ে চলেছে। বাধ্য হয়ে সে বলল,

প্রবালবাবু বলতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে স্যার। ‘স্যার’-ই বলছি কিছু মনে করবেন না স্যার।

কথাটা বলে সে নিজে হেসে ওঠে। ঘরের বাকি সকলেও হেসে ওঠে।

হাসিটা থেমে গেলে সামন্ত বলে,

একটা জিনিস দেখুন স্যার, রাহুল আর বিশাখার আলাদা আলাদা শোবার ঘর ছিল। মাস্টার বেডরুমটা বিশাখার। আর একেবারে এই বসার ঘরের লাগোয়া একটু ছোট ঘরটা রাহুলের। প্রতিটা ঘরেই দারুণ ইন্টিরিয়রের কাজ করানো।

মাস্টার বেডরুমে ঢুকতে ঢুকতে প্রবাল বলল,

এর ফলে বসবাসকারী মানুষদের সঠিক রুচির আন্দাজটা পাওয়া যায় না।

বিশাখার ঘরের পুরো দেওয়াল জুড়ে ওয়াল ফার্নিচার করানো। তার সঙ্গেই মানানসই ড্রেসিংটেবিল আয়না একদিকে। ঘরে বইপত্র কিছু কোথাও নেই। আধুনিক ডিজাইনের কুইন সাইজ বেড।

প্রবাল দেওয়াল ওয়ার্ডরোবের পাল্লা খুলে খুলে দেখল। শুধু থরে থরে সাজানো পোশাকআশাক। সাজার জিনিস। একটা ডাইরি পাওয়া গেল একটা খোপে। পাতা ওলটাতে মনে হল সেটা তার শুটিঙের ডেট লিখে রাখার ডাইরি। প্রবাল সেটা তার নিজের কাছে রাখল। পরে সেটা সে ভালো করে দেখবে, যদি কিছু পাওয়া যায়।

অন্য ঘরগুলো তারা ঘুরে ফিরে দেখল। প্রবাল যেন সবকিছু তার মাথার ভিতরে ছবি তুলে রাখছে। পরে সে ভাববে সেসব নিয়ে।

প্রবাল বলল,

চলুন সামন্তবাবু, রাহুলের মা আর কাকাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করি।

একতলার ঘরগুলো তেমন সাজানো গোছানো নয়। তবে ছিমছাম। যতটুকু না করলে নয় ততটুকু।

রাহুল বৈদ্যর মা কমলাদেবীর বয়স প্রায় সত্তর পেরিয়ে গিয়েছে। তার থেকেও বড় কথা বয়সের ভার, পুত্রশোক তাঁকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে। চলতে ফিরতে বিশেষ পারেন না। চোখের দৃষ্টি একেবারেই ক্ষীণ, তার উপরে কানেও শুনতে পান না। বাইরে থেকে মনে হয় তিনি যেন মৃত; শুধু আশ্চর্য প্রাণটুকু কেবল বুকের ভিতর ধুকপুক করছে। তাঁকে দেখাশোনা করার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার এক আয়া আছে। দুলুমাসি। তারও বয়স হয়েছে। তবে কৃষ্ণকায় শক্তপোক্ত চেহারা।

প্রবাল কমলাদেবীকে কী আর জিজ্ঞাসা করবে? সে তাঁর ঘরে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল। ঘরের ভিতরটা ভালো করে লক্ষ করল। বিশেষত্ব বলে কিছু নেই, সাধারণ বড় পালঙ্ক, একটা গডরেজের আলমারি, আলনা, একটা ওয়ার্ডরোব। ওয়ার্ডরোবের মাথায় একটা ছবি বাঁধিয়ে রাখা, রাহুল আর রোহণের। কমলাদেবী তো চোখে ভালো দেখতে পান না। এই ছবি তবে কার জন্য?

প্রবাল ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের জন্য বলাইবাবু বসার ঘরে অপেক্ষা করছিলেন।

বলাইবাবুর চেহারাটা শুকনো দড়ির মতো। মাথার সব চুল শাদা। গাল দুটো গর্ত হয়ে যেন মুখের ভিতর ঢুকে গিয়েছে। চোখ দুটো কোটরগত। কপাল জুড়ে অজস্র বলিরেখা মুখটাকে ভীষণ কুটিল আর কর্কশ করে তুলেছে। সারা মুখের উপরে একটা লাম্পট্যের ছাপ বিশ্রীভাবে স্পষ্ট। তার গলার স্বরও কর্কশ।

প্রবাল বলল,

বসুন বলাইবাবু।

বলাইবাবু একটা সোফায় বসল।

প্রবাল ঘুরে গিয়ে ঠিক তার উল্টোদিকের সোফায় বসল। বলাইবাবুর মুখোমুখি। তার চোখে চোখ রেখে বসে থাকল। বলাইবাবু কিন্তু প্রবালের চোখে চোখ রাখতে পারলেন না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ফতুয়ার পকেটে কী যেন একটা হাতড়াতে হাতড়াতে শেষে যেন কিছু না পেয়ে বাধ্য হয়ে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে প্রবালকে কোনওক্রমে একটা সিগারেট অফার করে নিজেই একটা ধরিয়ে নিলেন।

প্রবাল নিজের পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে সেন্টার টেবিল থেকে বলাইবাবুর লাইটারটা নিয়ে সেটা ধরায়। দুটো লম্বা টান দিয়ে বলে,

বলাইবাবু আপনি সেদিন রাহুলের ঘরে ঢুকে আলো না জ্বালিয়ে জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সারাতে গেলেন কেন? অথচ লাইটের সুইচ তো দরজার পাশেই ছিল!

প্রবাল এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

বলাইবাবু যেন ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গিয়েছেন এমনি ভঙ্গিমায় সিগারেটে পর পর কয়েকটি টান দিয়ে নেন। তার পরে আমতা আমতা করে বলেন,

আসলে ঘরে ঢুকে কেমন একটা গন্ধ পেলাম তাই জানালা খুলতে গেছিলাম।

কিন্তু জানালা তো আপনি খোলেননি। পুলিশ ঘরে ঢুকে সব জানালা বন্ধ দেখেছিল।

বলাইবাবু যেন আরও অসহায় হয়ে পড়েন। তিনি একবার সামন্তর দিকে একবার প্রবীরের দিকে তাকিয়ে শেষে বলেন,

কী জানি মনে করতে পারছি না। রাহুলবাবাকে ওইভাবে দেখার পরে আমার আর কিছু মনে ছিল না।

প্রবাল তার চোখে চোখ রেখে বলে,

তাই কি? আপনি আগেই জানতেন রাহুল মরে গিয়েছে।

তার পরে সে উঠে পড়ে। কঠিন গলায় বলে,

আচ্ছা আজ আমরা চললাম। আমরা পরে আসব। আপনি কিন্তু একদম পালাবার চেষ্টা করবেন না।

বলাইবাবু মরা মাছের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

 

ক্রমশ

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...