সৌমিত্র দস্তিদার
পূর্ব প্রসঙ্গ : জিন্নাহ ও দেশভাগ
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লেখা। অনেকদিন আগে পড়েছি, তাই পুরো লেখাটা আজ আর মনে নেই। কিন্তু লেখার স্পিরিটটা মনে আছে। ‘সেই সময়’ উপন্যাসটি শেষ হবার পরে উপসংহারে এক জায়গায় সুনীল লিখছেন– “এতদিন ধরে এতসব ঐতিহাসিক চরিত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে কখন যেন তাঁদের সঙ্গে একধরনের মানসিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এখন এই বিচ্ছেদ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে।”
আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বড়মাপের মানুষ নই। সামান্য একজন তথ্যচিত্রনির্মাতা। একটু আধটু লিখি, এই যা। তবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যন্ত্রণাটা অনুভব করতে পারছি, দেশভাগ নিয়ে কাজ করতে বসে। ‘মুসলমানের কথা’ ডকুমেন্টারি করা আমার জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। ওই ছবিটা না করলে কখনও বুঝতেই পারতাম না আমাদের চেনা পাঠে যে ইতিহাস আমরা স্কুল-কলেজে শিখি, তা অধিকাংশই বাবু-ভদ্দরলোকদের চোখ দিয়ে দেখা, স্রেফ তাঁদের নিজস্ব অনুভব, তাঁদের নির্মিত বয়ান। এই ইতিহাসে ‘অপরের’ কোনও জায়গা নেই। এ ইতিহাস মূলত ‘হিন্দু বিজয়গাথা’। এখানে হিন্দু বলতে অবশ্যই হিন্দু উচ্চবর্গের মাতব্বরদের কথা বলছি। মেকলে অনুসারী এই এলিটরাই উচ্চস্বরে ঘোষিত বঙ্গীয় রেনেসাঁর স্রষ্টা। এই বাবুজনেরাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাবাদী অংশ। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে কখনও কাজ করব ভাবিনি। ‘মুসলমানের কথা’ করতে গিয়ে বুঝলাম সেই দেশভাগ কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের মাজা ভেঙ্গে দিয়ে প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে দিয়েছে। আর এখন তো ঘোষিতভাবেই আসামে, এমনকি এই বঙ্গে আওয়াজ উঠেছে- হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্থান, মুসলিম ভাগো পাকিস্তান। এই প্রেক্ষিতেই ভারতভাগচর্চা, নতুন করে চেনা পাঠে, চেনা স্বাধীনতার মহামহিম সব চরিত্র– জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী, বল্লভভাই পাটেল, আবুল কালাম আজাদ এবং মহম্মদ আলি জিন্নাহ-র অবয়বগুলো আর একবার আলো ফেলে দেখার উদ্যোগ।
একইসঙ্গে বোঝা দরকার, একসময় যিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দূত, তিনি কোন পরিস্থিতিতে ও অপরাধে দেশভাগের একমাত্র খলনায়কে পরিণত হলেন। বস্তুত মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশই বঙ্গভঙ্গ চাননি। চাননি খোদ মহম্মদ আলি জিন্নাহও। অথচ আমরা এই সত্যিটা স্বীকার করি না। স্বীকার করি না ১৯০৫ সালের প্রথম বঙ্গভঙ্গের দৌলতে যে জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়েছিল সে ধীরে ধীরে কীভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদে বদলে গেল। ফলে দেশের বিরাট সংখ্যক মুসলমান অভিমানে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
ধান ভাঙ্গতে অনেকক্ষণ ধরে শিবের গীত গেয়ে চলেছি। তার একটা কারণ এই যে জিন্নাহ নিয়ে ধারাবাহিকের এটাই শেষ পর্ব। আমার অবস্থা এখন কিছুটা হলেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো। যা লিখেছি তা আদৌ জিন্নাহ চরিত নয়। জিন্নাহ-র গৌরব কাহিনীর বর্ণনাও নয়। জিন্নাহকে মহৎ করে চিত্রিত করাও নয়। বস্তুত মহম্মদ আলি জিন্নাহ কোনও মহৎ চরিত্রও নন। তবে দোষে গুণে তিনি অবশ্যই একজন বর্ণময় চরিত্র, অনেক ছায়া ও আলোর খেলা সে চরিত্রের কোণে কোণে। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, কোনওদিক দিয়েই তিনি ভারতভাগে একা দায়ী নন। খলনায়ক তো ননই। বরং কখনও কখনও জিন্নাহকে বেশ অসহায় লাগে। আমি নির্মোহভাবে সাদা ও কালো সেই আসল জিন্নাহকে দেখতে চেয়েছি মাত্র।
শুধু জিন্নাহ নয়, সময় সুযোগ পেলে দেশভাগের সময়কার সব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নিয়েই চর্চা করার ইচ্ছে আছে। মহামহিমদের নাম বলেছি। মহাকাব্যের মতো ধ্রুপদী এই দেশভাগের বিয়োগান্ত নাটকে অন্যান্য চরিত্রও কম আকর্ষণীয় নয়। সোহরাওয়ার্দী, সীমান্ত গান্ধি খান আব্দুল গাফফার খান, ফজলুল হক, শরৎ বোস, আবুল হাশেম মওলানা ভাসানি এবং অবশ্যই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল থেকে শুরু করে বাবাসাহেব আম্বেদকর সবাইকে নিয়ে নতুন করে চর্চা করা দরকার। হয়তো তার ফলে অনেক নতুন তথ্য আমাদের সামনে আসবে। তার জেরে ভিলেন নায়ক হবেন। নায়ক ভিলেন হতে পারেন। যাবতীয় মিথ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ভেঙে যাবে অনেক শাশ্বত বিশ্বাস। সত্য তো কঠিন। তবে ‘সে কখনও করে না বঞ্চনা’।
জিন্নাহ এই ক’বছর আমার সঙ্গী ছিলেন। আপাতত তাঁকে নিয়ে চর্চা একটু মুলতুবি থাকবে। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো স্থগিত নয়। আসলে আমি, অনেকেই জানেন, দেশভাগ নিয়ে একটা সিরিজ করছি খণ্ডে খণ্ডে। একধরনের পরীক্ষাধর্মী কাজ। ভিসুয়াল প্রবন্ধ নির্মাণ। ফলে ওই সময়টা আমার কাছে দীর্ঘদিন জীবন্ত থাকবে। হয়তো বা সারাজীবন। তবে একটা দুঃখবোধ আছেই। জিন্নাহ চরিত্রের প্রতি ঠিকঠাক ন্যায় করতে পারলাম কিনা তা ভেবে। আমি ইতিহাসবিদ নই। পণ্ডিত তো নই-ই। সিনেমানির্মাণের কাজ করতে গিয়ে যেটুকু বুঝেছি তা-ই লিখেছি। কিন্তু একটুও বানিয়ে বা জেনেবুঝে মিথ্যা একবর্ণ লিখিনি, এটা জোর দিয়ে বলতে পারি।
জিন্নাহ-র রাজনৈতিক সামাজিক জীবনের পুরো সময় মোটাদাগেই তিন ভাগে বিভক্ত। লন্ডনে পড়তে পড়তেই জিন্নাহ দাদাভাই নওরোজির প্রভাবে জাতীয়তাবাদের প্রতি অনুরক্ত হন। দেশে ফিরে এসেই তিনি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দূত। কট্টর দেশপ্রেমিক একজন ভারতীয়।মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নানা বিষয় মতবিরোধ সত্ত্বেও আগাগোড়া ধর্মনিরপেক্ষ পথের অনুসারী। জিন্নাহ বলতেন- আমি আগে ভারতীয়, পরে মুসলমান।দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। প্রথম দিকে মুসলিম লীগে যোগ দেননি জিন্নাহ। পরে যোগ দিলেও সে অর্থে কখনও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেননি। নামাজ রোজা বা অন্যান্য ধর্মীয় আচরণে জিন্নাহ-র বিশ্বাস ছিল না কোনওদিন, যা অন্য কোন ভারতীয় বিশেষত সেই সময়কার মুসলিম নেতার পক্ষে তখন কেন, এখনও এক অভাবনীয় বিষয়।
প্রথমত, দুটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে জিন্নাহ-র ধর্মনিস্পৃহ কিন্তু সুযোগসন্ধানী চরিত্রও স্পষ্ট হয়। এক তো বোঝাই যাচ্ছে যে ধর্ম তাঁর কাছে ছিল ক্ষমতাদখলের এক অস্ত্র মাত্র। ধর্মে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না, অথচ ধর্মীয় রাষ্ট্র চাই- এ এক পুরোদস্তুর ভণ্ডামি, শঠতা ও লোভের প্রকাশ। জিন্নাহ চরিত্রের সবথেকে নেতিবাচক দিক নিঃসন্দেহে এই দ্বিচারিতা। প্রথম প্রথম না হলেও পরের দিকে জিন্নাহ-র এই ক্ষমতালিপ্সা ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।
প্রবীণ গান্ধিবাদী শৈলেশ বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্নাহ সম্পর্কে তাঁর বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন- জিন্নাহ তখন সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী। কাজের ছেলেটি বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছে। জিন্নাহ জানতে চাইলেন- কী খাবার? ছেলেটি খুশি খুশি গলায় বলল- ভাবী আপনার জন্য নিজের হাতে শুয়োরের মাংস করে পাঠিয়েছেন। জিন্নাহ একলাফে সামনে চলে এসে ছেলেটির মুখে চাপা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন- থাম থাম। কেউ শুনে ফেললে আমার জামানতটুকুও থাকবে না।
আরেকটি ঘটনা। আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল পাকিস্তান জন্ম নিচ্ছে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭। জিন্নাহ কূটনৈতিক মহল ও চেনামহলের বিশিষ্টজনকে তার আগের দিন দাওয়াত দিলেন মধ্যাহ্নভোজের। শুভানুধ্যায়ীরা মনে করিয়ে দিলেন যে তখন রোজা চলছে। ফলে দুপুরে খাওয়া সম্ভব নয়। জিন্নাহ ভুল শুধরে তাড়াতাড়ি দিনের বদলে রাতে সবাইকে খেতে ডাকলেন।
জিন্নাহ সাহেবের আর একটি মস্ত খারাপ দিক ছিল অসম্ভব আত্মম্ভরিতা। ভাঙব তবু মচকাব না। বড়ো বেশি আত্মকেন্দ্রিকও ছিলেন। ভেতরের চিন্তাভাবনা অন্য কারওর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া ধাতে ছিল না। দেশভাগ হবে কিনা তাই নিয়ে যখন সারা দেশ উত্তাল। জিন্নাহ স্বয়ং নিজ সম্প্রদায়ের বাঁশিওয়ালা হয়ে বহু বছরের স্বপ্ন, স্বাধিকার, নিজভূমি প্রতিষ্ঠায় সতত সক্রিয়। ততদিনে কিন্তু জিন্নাহ জেনে গেছেন তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। টিবি হয়েছে, তখনকার সময়ে যা দূরারোগ্য অসুখ।কাউকে, এমনকি ঘনিষ্ঠতম বোন ফতিমাকেও ঘুণাক্ষরেও কিছু জানাননি। জানতে পারলে হয়তো দেশভাগের মতো গুরুতর সংকট থেকে উপমহাদেশ অন্তত সে যাত্রায় বেঁচে যেত। মহম্মদ আলি জিন্নাহ-র মতো মাপের আর কোনও নেতা তখন মুসলিম লীগে ছিলেন না যিনি দেশভাগের মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
এক-একসময় মনে হয় জিন্নাহ-র নেতিবাচক দিকগুলো অধিকাংশই আরোপিত। মানুষ জিন্নাহ হয়তো অত ক্রুর ছিলেন না। আপনি বলতে পারেন যে মশাই কি গনৎকার না মনোবিদ যে জিন্নাহকে ক্লিনচিট দিচ্ছেন!! না, ক্লিনচিট দিচ্ছি না। জিন্নাহর মধ্যে আসলে এত অসংখ্য জিন্নাহ যে কোনজন আসল আর কোনটি মেকি তা বোঝা বেশ কঠিন হয়ে যায় মাঝেমাঝে। এত পরস্পরবিরোধী চরিত্র খুব কম লোকের মধ্যে দেখা যায়। জিন্নাহকে যা যা গর্হিত ‘অপরাধে’ কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় তার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই তাঁর পক্ষের যুক্তিও পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। পাকিস্তান হওয়ার পরে পরেই তৎকালীন পুববাংলায় গিয়ে মহম্মদ আলি জিন্নাহ যে ঔদ্ধত্যে ঢাকায় বাংলাভাষাকে গুরুত্বহীন করে ঊর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার নিদান দিয়ে ছিলেন, তা শুধু মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতাকে কাছে নিয়ে আসেনি তাই নয়, গোটা বাঙালি জাতির চেতনায় জিন্নাহ চিরকালের মতো ঘৃণিত হয়ে বেঁচে রইলেন।
অথচ ঠান্ডা মাথায় ভাবুন যে জিন্নাহ কিন্তু আচমকা এমন সিদ্ধান্ত নেননি। ১৯৩৭ সাল অর্থাৎ উপমহাদেশের স্বাধীনতার এক দশক আগে থেকেই মুসলিম লীগের ঘোষিত নির্বাচনী ইস্তাহারে দাবি করা হয়েছে যে ক্ষমতা পেলে হিন্দি ও অনান্য ভাষার বদলে উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা ।তখন কিন্তু বাঙালির আবেগ জেগে ওঠেনি। আসলে দেশভাগের রাজনীতি নিয়ে বাঙালি মুসলমানের ভুমিকা নিয়ে আলাদা করে আরও বিস্তারিত গবেষনা করা প্রয়োজন।
সত্যি করে বলতে কি, দেশভাগের পিছনে ধর্ম অন্যতম কারণ। তবে একমাত্র নয়। মুসলিম লীগের রাজনীতিও একমাত্রিক নয়। বহুমাত্রা লীগের অভ্যন্তরেই খুঁজে পাওয়া যায় যদি নতুন করে আলো ফেলা যায়। ১৯০৫ সালে ঢাকার নবাববাড়িতে যে মুসলিম লীগ জন্মেছিল, তার সঙ্গে রংপুর দিনাজপুর বা মুর্শিদাবাদের গরীব চাষি বা ক্ষেতমজুরের কোনও সম্পর্কই ছিল না। পঞ্জাবে জমিদাররা মিলে যে মুসলিম সংগঠন গড়ে তুলেছিল তার সঙ্গেও বাংলার হতদরিদ্র কৃষকদের সম্পর্ক ছিল না। খণ্ড খণ্ড বিবিধ পরস্পরবিরোধী শ্রেণিস্বার্থের মুসলমান জনতাকে ‘স্বপ্নের দেশ’ পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখানোর পিছনে জিন্নাহ-র কৃতিত্ব সত্তর ভাগ হলেও বাকি তিরিশ নিঃসন্দেহে অন্যদের। বাঙালি মুসলিমদের লীগের পতাকার তলায় নিয়ে আসার পুরো কৃতিত্ব মওলানা ভাসানী, আবুল হাশেম, ফজলুল হকের। আমরা যখন দেশভাগের কথা বলি তখন ভেবে দেখি না কোন সে কারণ যার ফলে ভিন্ন ভিন্ন ধারার গোষ্ঠী একস্বরে পাকিস্তানের ডাকে সাড়া দিয়েছিল!
জিন্নাহ-র সঙ্গে গান্ধীর বিরোধের মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক রণকৌশল। জিন্নাহ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে মোটামুটি আইনি পথে, আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে সমাধান করতে আগ্রহী ছিলেন ।কিন্তু গান্ধী ছিলেন অহিংস অথচ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার পক্ষে। নেহরু, প্যাটেল ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে জিন্নাহ-র সংঘাতের অন্যতম কারণ রাজনীতি ও প্রশাসনে অতিকেন্দ্রায়নের বিরোধীতা করা। জিন্নাহ চাইতেন কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস। প্রস্তাবিত স্বাধীন ভারতে ফেডারেল সরকার ছিল জিন্নার দাবি। জওহরলাল নেহরু ও অন্যান্য নেতারা কোনওদিনই তা মানতে চাননি। দেশভাগের জন্য মতাদর্শগত এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কারণ, আমাদের চিরাচরিত চেনা আখ্যান তা বলে না।সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এখন বিরোধী বিভিন্ন দল যে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবি তুলছেন, পরাধীন ভারতে মহম্মদ আলি জিন্নাহ তার অগ্রপথিক ।
জিন্নাহকে আমরা ‘খলনায়ক’ বানাই ১৯৩৭ সালের পর থেকে। নিঃসন্দেহে ওই সময় জিন্না এদেশের রাজনীতির এক টার্নিং পয়েন্ট। কিন্তু বহুদিন ধরে যিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদের অন্যতম স্তম্ভ, তিনি হঠাৎ বিনা কারণে রাতারাতি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেলেন; এই ব্যাপারটা ঠিক দাঁড়ায় কি? তবু এটা অনস্বীকার্য যে ৩৭ থেকে ৪৭-এর আগস্ট অবধি অতীত জিন্নাহ-র পরিবর্তে আমরা এক অন্য জিন্নাহকে দেখতে পাই। সেই জিন্নাহ পাকিস্তানের জনক কায়েদ-এ-আজম। ধূর্ত। প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ক্ষমতা লোভী। উদ্ধত। একগুঁয়ে। অসহিষ্ণু। এই বদলে যাওয়া জিন্নাহও কিন্তু ক্ষমতা নিয়ে কংগ্রেস ও বৃটিশের সঙ্গে দরকষাকষির সময় এমন সব দাবিদাওয়া পেশ করছেন তা অনেক আধুনিক বামনেতাদের চমকে দিতে পারে। অথচ জিন্নাহ কোনওদিন ভুলেও বামপথে হাঁটেননি। জিন্নাহ ছিলেন যাকে বলে মডারেট বুর্জোয়া। মুসলিম লীগের মধ্যে যে বামঘেষা অংশ ছিল তা কিন্তু একান্তই বাংলার লীগ নেতাদের। তাঁদের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা মুসলিম তরুণ মনে বিপুল প্রভাব ফেলেছিল। আবুল হাশেমকে বিরুদ্ধবাদীরা কমিউনিস্ট মনে করতেন। কট্টর ইসলামপন্থীরা তরুণদের হাশেমের সঙ্গ এড়িয়ে যাবার পরামর্শ দিতেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন বাম-অনুরাগী। সবমিলিয়ে লীগ রাজনীতিতে কৃষক-শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার যে দাবি-সনদ, তা নিঃসেন্দহে বাংলার আমজনতার চাপেই জিন্নাহ স্বয়ং মেনে নিয়েছিলেন বা বলা ভাল মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বারেবারে বলছি ভারতীয় রাজনীতির খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ১৯৩৭ সাল। আসন্ন প্রাদেশিক নির্বাচন নিয়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হতে থাকে। দুই তরফের নেতারাই পরস্পরের প্রতি খোলাখুলি গালিগালাজ করতে থাকেন। পরিস্থিতি গরম হতে থাকে।এই সময়েও জিন্নাহ লাহোর ছুটে যান শিখ ও মুসলমানের মসজিদ নিয়ে এক বিবাদে মধ্যস্থতাকারী হয়ে। এবং প্রকাশ্যে শিখদের এক মহান সম্প্রদায় বলে প্রশংসা করেন। তার ঠিক পরে পরেই লীগের অধিবেশনে ভারত শাসন আইনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আসন্ন প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যে মূল নীতি সামনে রেখে লীগ লড়াই এ অংশ নেবে জানিয়ে দেয় তা এইরকম- ১। প্রদেশে প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় সংবিধানের বদলে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাই, ২। সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে জনগণের কল্যাণে লীগ প্রতিনিধি কাজ করবে, ৩। লীগের কর্মসূচির সঙ্গে একমত এমন দলের সঙ্গে বোঝাপড়া করা যেতে পারে।
ভোটে লীগের চোদ্দ দফা দাবির উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি দেখুন– ১। মিলিটারি খাতে খরচ কমাতে হবে, ২। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে, ৩। কৃষিঋণ কমাতে হবে ইত্যাদি। বলে না দিলে মনে হতেই পারে যে কোনও বামপন্থী দলের নির্বাচনী ইস্তাহার। সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের অধিকারের পাশাপাশি সমস্ত কালো আইন প্রত্যাহারের দাবিও তোলা হয়েছিল।
নির্বাচনে কংগ্রেস ভালো আসন জিতেছিল। লীগও মোটের ওপর খারাপ ফল করেনি। দুপক্ষের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতাও ছিল। বস্তুত ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক বড় জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার সুযোগ ছিল।মুসলিম লীগের আশা ছিল মন্ত্রীসভায় তাদের প্রতিনিধি জায়গা পাবে। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু কংগ্রেস একাই সরকার গঠন করতে উদ্যোগী হওয়ায় জাতীয় ঐক্য অধরাই থেকে যায়। জিন্নাহ তারপর থেকেই পাকিস্তানের দাবি নিয়ে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে জাতীয় নন, হয়ে ওঠেন নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের নেতা- যাদের সঙ্গে কোনওদিনই সে অর্থে তাঁর কোনও আত্মিক যোগ ছিল না।
৩৭ সাল, যখন থেকে জিন্নাহ মুসলিম স্বার্থে আওয়াজ তুলছেন তখন দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত একটু দেখে নেওয়া যাক। কংগ্রেসের মধ্যে হিন্দুত্ববাদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ছিল একথা আগেই বলেছি। ১৯৩৭-এ হিন্দু মহাসভার সভাপতি সাভারকর বললেন- ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ নয়। এদেশে মূলত দুটি জাতি- হিন্দু ও মুসলিম। মহাসভার কলকাতা সম্মেলনেও দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর জোর দিলেন। তিনি মনে করতেন একসঙ্গে থাকার দিন শেষ। আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি দেশভাগের কথা বলেননি বটে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলিম জনতার দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়া ছাড়া আর অন্য উপায় নেই। নানা বাকচাতুরির আড়ালে হিন্দু মহাসভার হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্য বুদ্ধিমান জিন্নাহ-র বুঝতে ভুল হয়নি। মনে রাখবেন তখন আর এস এস-এর শক্তিও ক্রমবর্ধমান। তাদেরও ঘোষিত লক্ষ্য হিন্দু ভারতের নির্মাণ। জিন্নাহ বুঝে গিয়েছিলেন মুসলিমদের অবস্থা একদম কৌরব রাজসভায় পাণ্ডবদের মতো। বিনাযুদ্ধে সূচাগ্র মাটি পাওয়ার সম্ভাবনা মুসলমানদের নেই। তাই নিতান্তই বাধ্য হয়েই তাঁর ‘রাজ করেগা পাকিস্তান’ স্লোগান তোলা।
আমাদের দেশে মানুষের মনে মহাভারতের পাণ্ডবদের জন্য কত সহানুভূতি, চোখের জল আর একই পরিস্থিতি অথচ জিন্নাহ হয়ে গেলেন চিরকালের খলনায়ক। আসলে ইতিহাস বড় নির্মম। কখন যে কে তার বিচারে নায়ক বা ভিলেন হন বলা আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা দায়।
এর আগেও জিন্নাহর প্রস্তাব ১৯২৮ সালে কংগ্রেস অধিবেশনে অবহেলার সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল কংগ্রেস, বস্তুত কংগ্রেসের মধ্যেকার হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী, যারা ততদিনে একদা ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেসের কর্তৃত্ব দখল করে ফেলেছে। জিন্নাহর অভিযোগ ছিল কংগ্রেস ক্রমেই স্রেফ একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হয়ে যাচ্ছে। জিন্নাহ-র অভিযোগ না হয় সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। বরং আরেকজনের কথা থেকে উদ্ধৃতি দিই। ইনি ১৯৪৭ সালের জুন মাসে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীকে চিঠি লিখে সরাসরি যে অভিযোগ করছেন তাকে উপেক্ষা সামান্য মুশকিল। তিনি লিখছেন– “আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে কংগ্রেস একদিন একটি মহান জাতীয় প্রতিষ্ঠান ছিল তা দ্রুত শুধুমাত্র হিন্দু প্রতিষ্ঠান হয়ে যাচ্ছে।” তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মেজদা প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসু। ততদিনে শরৎ বসুর আবুল হাশেম সোওয়ারাবর্দীদের সঙ্গে জোট করে অখণ্ড বাংলার দাবি কংগ্রেস হাইকমান্ড খারিজ করে দিয়েছে। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আগাগোড়াই বলে এসেছেন ভারত ভাগ না হলেও বাংলা বিভাজন করতেই হবে। হিন্দু পুঁজিপতিরাও কালনেমির লঙ্কাভাগ নিয়ে প্রবল উৎসাহে নেমে পড়েছেন। বিড়লা তো কবে থেকেই দেশভাগ চাইছিলেন। হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ভারতীয় পুঁজি যে মদত দিতেন এ তথ্য আগেই সামনে এসেছে। তাই দেশ ভাগের জন্য একমাত্র মহম্মদ আলি জিন্নাহ দায়ী এ অভিযোগ ধোপে টেঁকে না।। এ অভিযোগ শুধু মিথ্যে নয়, বরং তা ইচ্ছে করে অন্য রঙের সাম্প্রদায়িকতাকে আড়াল করার মাত্র।
১৯৩৭ সালে লীগ প্রতিনিধিদের মন্ত্রী সভায় জায়গা না দিয়ে কংগ্রেসের মিথ্যাচারের পরেও ১৯৪৬ সালে কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে নিয়ে জিন্না শেষ চেষ্টা করেছিলেন দেশভাগের মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত না করতে। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ যেভাবে ছলচাতুরি করে প্রাচীন লোকবিশ্বাসের মতো রাহুকেতুর মতোই মুসলিমদের অমৃত থেকে বঞ্চিত করে নিজেরাই সবটুকু আত্মস্মাৎ করার চেষ্টা করছিলেন তা মানা জিন্নার পক্ষে কঠিন হত। জিন্নাহ-র নিজের সম্প্রদায়ের লোকেরা কখনও তাহলে কায়েদ-এ-আজমকে ক্ষমা করতে পারতেন না। খানিকটা বাধ্য হয়েই জিন্নাহ এই মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর দিলেন। তাই কোনওমতেই জিন্নাহ ভারতবিভাগের জন্য একমাত্র দায়ী নন। এমনকি বহুচর্চিত ১৯৪০-এর লাহোর অধিবেশনে দ্বিজাতিতত্ত্বের ঘোষণাকে সামনে আনা হোক না কেন, মূলত এটি ছিল কংগ্রেসের ওপরে দরকষাকষির একটি কৌশল মাত্র, মৌলানা আজাদের মতো লোকও সেটা স্বীকার করেছেন। এই চাপসৃষ্টির কৌশল মেনে নিয়ে কংগ্রেস যে সত্যি সত্যি এইভাবে ও এতদ্রুত দেশভাগের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে জিন্নাহ বোধহয় তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। তা সত্ত্বেও শোনা যায় দেশভাগের মাত্র একবছরের মধ্যেই মৃত্যু যখন জিন্নাহ-র খুবই কাছে, তখন তিনি ডাক্তারের হাত ধরে অনুশোচনা করেছিলেন-দেশভাগে রাজি হয়ে ভুল করেছি। কথিত আছে যে প্রকাশ্যে জিন্নাহকে মাত্র দুবার চোখের জল ফেলতে দেখা গেছে। একবার স্ত্রীর মৃত্যুর সময়।অন্যদিকে শেষবারের মত জিন্নাহ আবেগ সামলাতে না পেরে কেঁদে ফেলেছিলেন পাকিস্তানের এক হিন্দু শরণার্থী শিবির দেখার পর।
সেই চোখের জল অবশ্য অভিশপ্ত জিন্নাহ-র শাপমুক্তি ঘটাতে পারেনি। স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও তিনি জাতির পাপের একমাত্র ভাগীদার হয়েই রয়ে গেছেন।
তথ্যসূত্র:
১। জিন্না/পাকিস্তান নতুন ভাবনা — শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২। Jinnah: India-Partition Independence — by Jaswant Singh.
৩। The Sole Spokesman by Ayesha Jalal.
৪। এছাড়া অনীক পত্রিকা জিন্নাহ ও দেশবিভাগ-বিতর্ক সংখ্যা। সেপ্টেম্বর ২০০৫।
৫। সীমান্ত আখ্যান তথ্যচিত্র। পরিচালনা — লেখক।
৬। বদরুদ্দিন উমর ও সুগত বসুর একাধিক সাক্ষাৎকার।