সুদীপ বসুর কবিতা
রোববার
আমার মুঠোর মধ্যে তোমার দুহাত
ভাবি কী ধরে আছি
তারপর আসে রোববার
তারপর শীত
মনে পড়ে ছেলেবেলা অ্যালজেব্রার সমুদ্রে
হারিয়ে গেছিলাম
আবার হারিয়ে যাব? ভয় হয়
তুমি বলো ‘কী দিতে পারিনি তোমায়?
কী দিতে?’
আমার জীবন আমি রাজাবাজারের দিক থেকে দেখি
কারা হাসাহাসি করে দূরে?
কাকে নিয়ে হাসে?
ডনবস্কোর দিকে ধীরে ধীরে চলে যায় চাঁদ
ও আমার ১২ বছর ১৩ বছর ১৬ বছরের অন্ধ নির্জন
কী গো, কী ধরে আছি?
অরণ্যদেব
মা মারা যাচ্ছিল স্তনের ক্যানসারে, আর ইঞ্জেকশন নিতে চাইত না। একটা হলুদ আলো শুধু ছেলেমানুষের মতো ঘুরঘুর করত সারা বাড়ি। রান্নার বই মিলিয়ে মিলিয়ে যখন রান্না করত মা, প্রথম এসে চেখে দেখতেন অরণ্যদেব। জঙ্গলের দায়িত্ব তিনি দশ মিনিটের জন্য অন্য কাউকে দিয়ে আসতেন। মা যা খেত অরণ্যদেবকে দিয়ে খেত। বাবা হিসেব করে দেখেছিল দুটো কেমোর দামে এক পঞ্জাব লরি স্টোনচিপ্স হয়ে যায়। মা বলছিল সারাজীবন এত যে জুলুম করেছি এত যে কুকুর বলেছি তোমায় তার জন্যে এই কষ্ট। বাবা কিছু বলছিল না। শুধু দূর থেকে হাত নেড়ে নেড়ে জানাচ্ছিল কুকুর-টুকুরে তার কিছু যায় আসে না। চলে যাবার দিন একটা বিষ-তেতো ওষুধ দেওয়া হয় মাকে। মা ভাবছিল অরণ্যদেব এসে আগে চেখে দেখবেন। কেননা দ্রিম দ্রিম করে ড্রাম বাজছিল সন্ধেবেলা। ভাবছিলাম উনি তবে হাঁটা শুরু করলেন এইমাত্র। মা’র বডি আমরা আট ঘণ্টা ডিলে করিয়ে দিই। তবু শুধু দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম বেজে গেল সারা সন্ধেরাত –
বাবাকে
সেগুন কাঠের সামান্য বাড়ি, তাতে বাবা আর আমি
গোটা বাড়িটা একটা জঙ্গল, আমরা দুজন শিকারি
টেবিলে ঘষা কাচের ওপারে ফ্যামিলি অ্যালবাম
তা থেকে সযত্নে বাদ দেওয়া মায়ের ফটোগ্রাফ
ছেলেবেলার স্মৃতি বলতে একজন ছেড়ে যাচ্ছে আরেকজনের হাত
৩২ বছর ধরে বিশ্বাসঘাতক লুকিয়ে আছে গানের ভেতর
মৃত্যুর আগে কোনও এক দর্জির নোংরা বিছানায়
শেষবার জেগে উঠেছিল মা
সেখানকার গলিগুলো ছিল সরু আর শান্ত
সেখানে দিনের সাথে অনবরত বেইমানি করত রাত
শহরে শীতকাল, আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের
এই রেষারেষি
একদিন শোবার ঘর পাচার করেছিল এই অসুখ
বাবার শরীরে
রান্নাঘরে আজ পিস্তলের ভেতরের অন্ধকার
সেগুন কাঠের শুনশান বাড়ি, তাতে শুধু বাবা আর আমি
বাড়িটা মস্ত এক জঙ্গল, আমরা দুজন শিকারি
সে
পিঁপড়েরা ধার করে নিয়ে যায় আমাদের গান
এবার হেমন্তের গায়ে আর সার্কাস লিখব না
ভাবে একটি ছেলে –
তার মুখ তোমার মুখের খাপে এঁটে যায়।
তোমার মনে পড়ে সেই দিন
তোমাকে একলা ফেলে
প্রম্পটার চলে গেছে অন্য নাটকে
জুতোর ওপর তুমি বসে আছ
ভাবছ ‘একটাই তো লাইফ…’
সাবান
ফুরনো সাবানের গায়ে লেখা ছিল
‘কি গো, আমাকে মনে পড়ে?’
শুধু তোমার জন্য আমি রেখে গেলাম
জীবনের বাকি সব শিকারকাহিনী
ভুলে যাবে, ভুলে যাবে, ভুলে যাবে জানি।
বিচ্ছেদ
রাতের মনেস্ট্রি থেকে আমি গান ছুড়ে দিই
চাঁদের দিকে
আর তোমার দিকে।
চাঁদ
একমনে শোনে সেই গান
তারপর ঢেকে যায় অসেতুসম্ভব
আমাদের বিবাহের মেঘে
নাগপাশ
হিরণ, আমি যেতেই পারতাম
কিন্তু
এখনও যে আমার
রাস্তার কল থেকে বাবা-মা’র স্নান করবার জল
তুলে আনা বাকি
রাতের রান্না বাকি
বাসি কাপড়ের কথা নয় বাদই দিলাম
মৃত্যু বাকি।
একটা কুকুর
একটা কুকুর, বাদামি, পিছনের পায়ে সামান্য চোট, সামনে এসে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে। আমি তার চোখের করুণ নীল রঙে অনুবাদ করি। অভিমান করে বলি – ঘুমোতে দাও না কেন, রাতের পর রাতের পর রাত? সে বলে – লেখোও তো না, মাসের পর মাসের পর মাস। আমি চিৎকার করে বলি – ঘুমোতে দাও। সেও পালটা চিৎকার জানে – লেখো লেখো, যা দেখছ টুকে রাখো ইডিয়েট। আমি বালিশের ফাঁকে ঠান্ডা পিস্তল খুঁজি।
কুকুরের ক্রোধের আগুনে আমার সামান্য লেখা জল হয়ে যায়।
সাদা বাঘ
মেয়েটি ময়ূরের নকশা তুলতে আসত ছোটমাসির কাছে।
মেয়েটির মা ছিল না
বাবা ছিল না
সত্যিকারের নামও ছিল না কোনো।
শুধু খুব শীতে কুয়াশা দৈত্যের মতো এসে
আটকে থাকত লেবুগাছে –
লোকে তাকে ‘টেলারিং’ নামে ডাকত।
‘ছুঁয়ে দিলে মন কি কারেন্ট হয়ে যাবে?’
আমি ভাবতাম।
মেয়েটি শুধু সেলাই করত
আর কাঁদত।
তবু সন্ধেবেলা জলের নীল আয়নায় ঘুরে ঘুরে
কেউ তো তাকে ডাকত
‘টেলারিং… টেলারিং…’
একদিন একটা সাদা বাঘ
বনের ভেতর থেকে এসে
হঠাৎ ছিনিয়ে নিল তাকে
জীবনে সেই প্রথম আমার সাদা বাঘ দেখা
মাঝরাতে সুদীপের কবিতার নিরন্তর ‘হাউলিং’
নীলাঞ্জন হাজরা
উৎপলকুমার বসুর শেষ দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলাম আমি। সারা জীবনের লেখালিখি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষের দিকে এসে কতগুলি কথা বলেছিলেন, যা আজও মনে পড়লে গা শিরশির করে ওঠে — “কুকুর রাত্রে ডাকতে আরম্ভ করে, সে খুব অদ্ভুত। নিশ্চয়ই কোনও সঙ্কেত পাঠায়। অন্য কুকুরদের পাঠায়। হয়তো মানুষকেও পাঠায়। আমি নিশ্চিত, চাঁদ দেখে কুকুর যখন ডাকে হয়তো চাঁদকেও সঙ্কেত পাঠায়। কে জানে? এই সঙ্কেত আমি পড়তে চাই। বুঝতে চাই এর অর্থ কী? আমার কবিতাও হয়তো চাঁদের দিকে তাকিয়ে কুকুরের ডাকের মতো।”
সুদীপ বসুর কবিতা পড়লে আমার গা শিরশির করে ওঠে। উৎপলদার পরমাশ্চর্য কবিতা আমার কখনওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে কুকুরের ডাকের মতো মনে হয়নি। সুদীপের সমস্ত কবিতা আমার মনে হয় মাঝরাতে কুকুরের একটানা ডাক। সে ডাক চাঁদের দিকে তাকিয়ে, নাকি চাঁদের ওপর দিয়ে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের উড়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে, তা বুঝে উঠতে পারিনি। কবিতাপাঠে যদি সুখানুভূতির সুগন্ধী ধোঁয়ায় মনোজগত আকুল করতে চান, ভুলেও সুদীপের কবিতার বই ওল্টাবেন না।
সুদীপের কবিতার তিনটি বই আমার হাতে এসেছে — ‘মাধবী ও অন্ধকার’ (সপ্তর্ষি । ২০১৫), ‘আবার বিপাশা খাতুন’ (কলিকাতা লেটারপ্রেস। ২০১৫… যার মধ্যেই মিলেমিশে রয়েছে ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘বিপাশা খাতুন’ নামের বইয়ের কবিতাগুলিও, যদিও সম্পাদনার অদূরদর্শিতায় কোনগুলি আগের লেখা, কোনগুলি পরের, তা বোঝার উপায় নেই) এবং ‘সবুজ কাঠের পার্টিশন’ (কলিকাতা লেটারপ্রেস । ২০১৮)। এই বইগুলির কবিতা সফেদ পাতায় ছাপা নয়। নিশ্ছিদ্র রাতে ছড়ানো-ছিটানো, মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর মতো। সুদীপের কবিতাস্বর অমাবস্যার রাতে, পূর্ণিমার রাতে, দ্বিতীয়ার রাতে কিংবা যে কোনও মাঝরাতে কুকুরের নিরন্তর ডাক, যার তেমন জুৎসই বাংলা আমি খুঁজে পাচ্ছি না, যার মোক্ষম ইংরেজি — হাউলিং!
আমি যে সব স্বপ্ন দেখি
মা বাজারে গিয়ে বিক্রি করে দেয়
আমার শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে
মা দূর থেকে সেলাই করে
কাছেও ঘেঁষে নাএকটা লম্বা হাসপাতালে বাবা শুয়ে ছিল প্রায় ১১ মাস
কেউ দেখতে যেত না
অভিমানে অভিমানে শেষমেষ মাছ হয়ে গেলরাঙামামির কাছে মা বন্ধক রেখেছিল কান্না
আমার ভাইয়ের বান্ধবীদের কী সব নাম,
‘হটবেবি’, ‘সুইট লিপ্স্’, ‘হানিমুন’
আর তাদের কী সব অন্ধকার অন্ধকার মেলামেশাগল্ফগার্ডেনের কাছে বোনের সমাধি
প্রতি রোববার গিয়ে কুকুরের মতো কেঁদে আসিএকবার পাওনাদার হাঙর এসে বাবার দুটো আঙুল নিয়ে
চলে গেলএর মধ্যে আমি-ই যা একটু ভালো
কবিতা লিখি আর মোবাইলে আপনাদের শোনাই
খুব ঝড়ের রাতে আমি জন্তুর ডাক নকল করি
আমার আঁকা ছবি পুজোসংখ্যা ‘দেশ’-এর কভার হবে একদিনতা হলে ভাবুন কী ফ্যামিলি থেকে কত দ্রুত
উঠে এসেছি আমি।(সবুজ কাঠের পার্টিশন। ভূমিকা-কবিতা)
আমার পাড়ার এক বৃদ্ধা প্রতিদিন রুটিন করে সকাল আটটা নাগাদ নাড়ুদার চায়ের দোকান থেকে সস্তার থিন অ্যারারুট বিস্কুট গাদাগাদা কিনে পাড়ার নেড়ি কুকুরকে খাওয়ান। তেমন আনন্দঘন দৃশ্য আজকালের কলকাতায় খুব বেশি নজরে পড়ে না। বৃদ্ধা কি জানেন, এই আশ্চর্য নিরীহ দেখতে রোগা কুকুরগুলিরই কেউ কেউ সহসা মাঝরাতে ডেকে ওঠে, আর ডাকতেই থাকে। তখন আর এই কুকুরগুলো নিরীহ থাকে না। হিংস্র হয়ে ওঠে না। কাঁদে? সে কান্নায় বোধ করি শুধু শোক নেই। হয়তো বা যেমনটা উৎপলদা বলেছেন, অনেক সঙ্কেত আছে। সুদীপের কবিতা নেড়ি কুকুরের মতোই নিরাভরণ। রোগা রোগা। তার শব্দচয়নে গোল্ডেন রিট্রিভারের জেল্লা নেই, জার্মান শেফার্ডের ঘ্যাম নেই, গ্রেট ডেনের ভার-ভারিক্কি নেই। কবিতা পাঠের রোদ্দুর-মনে সে কবিতা ঘুরঘুর করে একেবারে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়ার খেয়ালই-না-করা নেড়ি কুকুরের মতো। তারপর ধীরে ধীরে শুরু হয় তার খেলা। কখন যেন হৃদয় থেকে মনে ঘনিয়ে আসে রাত। রাতের অমোঘ ডাক। ডাকের অযুত সংকেত। সংকেতের অনিশ্চয়। ভীষণ অনিশ্চয়। সেটা আদিম। তখন চাঁদের দিকে বা চাঁদের ওপর দিয়ে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের উড়ে যাওয়ার দিকে ডেকে ওঠা নেড়ির স্বর নেকড়ের রাত্রিকালীন ডাকের আদিম জাদুবাস্তবে বিলীন হয়ে যায়। তাই সেটা আমাদের, পাঠকদের, অস্থির করে। ঠিক সেই মুহূর্তে সুদীপের কবিতার চেহারাটা গৌণ হয়ে যায়। মনের গলিঘুঁজির মধ্যে পাক খেতে থাকে — হাউলিং । তা তন্দ্রাচ্ছন্নকে ঘুম থেকে তুলে নিশুতি রাতের পথে টেনে আনে। তারপর কোথায় হাজির হব আমি, পাঠক, সুদীপের কবিতা তা কদাচ ঠিক করে দেয় না। সে ঝুঁকি সম্পূর্ণ আমার, পাঠকের।
কে যেন ফিস ফিস করে বলল:
‘পড়ে পড়ে ঘুমোস কেন
বাচ্চা ছেলে
কীসের এত ঘুম?চেয়ার টেবিল ঘুমোয়?
উড়োজাহাজ ঘুমোয়?’কাটা চাঁদ আকাশের মাথায় উঠে এল
একটা আগুনচোখা বেড়াল রাস্তা ক্রস করছে
লক্ষীপেঁচা চিৎকার করে উঠল হঠাৎএছাড়া আর যা কিছু সব
রাত্তির রাত্তির রাত্তির
এছাড়া আর যা কিছু সব
কালো কালো কালো‘তোর কীসের এত ঘুম?
ওঠ
হাত ধর
চল’(কে যেন ফিসফিস করে। সবুজ কাঠের পার্টিশন। পৃ ৭১)
সুদীপের কবিতা আমার, পাঠকের, সুখি-শুয়োর — হ্যাপি পিগ — ঘুম সহ্য করতে পারে না।
ভয়ঙ্কর সব সঙ্কেত পাঠিয়ে ঘুম ছারখার করে, এবং বাথরুম সেরে এসে আরেকবার ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ দেয় না, রাত্রিকালীন এক অন্য জেগে থাকার দুনিয়ায় নিয়ে চলে যায়, যে দুনিয়াটা শহুরে পাড়ায়-পাড়ায় একেবারে একদিন-প্রতিদিনের একঘেয়ে যাপনের উল্টো পিঠ, যা আমরা কোনও এক ভীষণ সত্য জেনে যাওয়ার আশঙ্কায় কদাচ উল্টে দেখি না। দেখি না পাছে সব-দিব্যি-মিলে-গেছে ভানের হিসেবগুলো গরমিল হয়ে গিয়ে দারুণ অস্বস্তিকর সব প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ছোরার মতো, রাষ্ট্র আর হরেক কিসিমের ‘বাদ’ যা আমাদের ভুলে থাকতে অভ্যাস করায় সাফল্যের নিজ-নিজ সংজ্ঞায়, সেই সব সংজ্ঞার বুকে।
কয়েকটা হিসেব শুধু মেলানো গেল না। মুখোমুখি
মোকাবিলা বাকি থেকে গেল।একশো বাইশে হাওয়া ছিল না সেদিন। ডলি কাঁদছে।
মা বলছে আরো কাঁদ, ধিঙ্গি মেয়ে,
আরো আরো কাঁদ। ক্যামেরা অন্ ছিল। তুমি
পালিয়েছিলে কোথায়?তোমার শানানো ছুরি উদ্যত। আমরা প্রস্তুত। দমবন্ধ
করে আছে অন্ধকার কতবার ফস্কে গিয়েছেমাঝরাত সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতে। একা কথা
বলতে বলতে বাড়ি ফিরতে। গা শিরশির গন্ধ
নিয়ে বাড়ি ফিরতে।চাদরের ওপার থেকে দেখতাম তোমার
ঘৃণার চোখে ঝড়।সবার স্বপ্নকে তুমি মাঝপথে হাত দিয়ে
ঘুরিয়ে দিয়েছ। তারপর তলপেট লক্ষ্য করে
সে কি হাসি তোমার।না চাইতেই ঝনঝন্ করে বাজিয়ে দিয়েছ গান
ঝন্ঝন্ করে কান্না।সবাই জানত আসছে আসছে আসছে। তুমি
আসতে না। বাবা, কতদিন তুমি আসতে না।তোমাকে কাঁদাব বলে রাস্তায় রাস্তায় কত
ঘুরে বেড়িয়েছি। সবুজ কাঠের ঘোড়া
ক্ষেপে গেছে আমার ভেতর।পর্দা টানা থকত। পর্দার ওপারে হারমোনিয়াম।
পর্দার ওপারে মেয়েলি হাসির শব্দ।বেঁচে ছিলে যে ভাবে দৈত্যের চাপাকান্না
বেঁচে থাকে বাচ্চাদের গল্পে।মা সারাদিন ধরে কোত্থেকে যে জোগাড় করত ভালোবাসা
টের পেতে না।
একমাত্র তুমিই জানতে নেতাজি আর ফিরে
আসবে না কোনোদিন।এখন তুমি শুয়ে আছো চুপচাপ, বেশি
বৃষ্টিতে ভেজা মানুষের মতো। অন্তু খবর দিতে গেছে।যাও, যেখানে যাচ্ছ যাও। সাবধানে। ছত্রিশ বছর
পর দেখা হবে।(বাবার মৃত্যুতে। মাধবী ও অন্ধকার। পৃ ১৫)
সুদীপের কবিতা সমস্ত সাফল্যের সংজ্ঞার দিকে তাকিয়ে, প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে হাউল করে, করতেই থাকে। মাঝরাতে। সুদীপের কবিতা পড়ে এক কৃষ্ণাঙ্গিনীর স্বর মনে পড়ে —
I’ve spent my nights
Where the sleeping dogs lie
Not by your side
It feels so lonely
Once again I’ve left too much to chance
In matters of the heart…I have no harsh words for you
I have no tears to cry
If the moon were full
I’d be howling inside
It only hurts
In matters of the heart…(Matters of the Heart. কথা, সুর, কণ্ঠ ট্রেসি চ্যাপম্যান)
ট্রেসি চ্যপম্যান কখনও আমাদের ভুলতে দেন না —
Our own ancestors
Are hungry ghosts
Closets so full of bones
They won’t closeCall it upward mobility
But you’ve been sold down the river…(Material World. কথা, সুর, কণ্ঠ ট্রেসি চ্যাপম্যান)
সুদীপের কবিতাও। সাফল্যের সংজ্ঞাগুলো যখন, সংজ্ঞাগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে নেওয়ার অভ্যাস যখন তছনছ, তখন অপার লোনলিনেস-এর মধ্যে হাত ধরতে চাই। হঠাৎ মনে হয় মিথ্যে এ সমষ্টিগত যাপন কিচ্ছু দেবে না, দিতে পারে না কিচ্ছুটি অভিজ্ঞান করে রাখার মতো। বরং ব্যক্তিগত যাপনচিত্র একটা তৈরি করে নিয়ে পালিয়ে যাই তাতে। সেই শ্রেয়। কিন্তু সুদীপের কবিতা সেই পালিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়েও ডেকে ওঠে। আর ডাকতেই থাকে। মাঝরাতে। ধরতে পারার মতো সব হাত অনিশ্চয়ে ঝাপসা হয়ে যায়।
নকল গয়নার ঘরে কার লম্বা ছায়া তুমি জানো
জানো জানো জানো ওই ডাকাতের ঘরবাড়ি জানো
ভালোবেসে জানোয়ার হয়ে যেতে চেয়েছিল বিপাশা খাতুন
শাদাকালো মুখ তার কুয়াশার পেরেকে টাঙানো(আবার বিপাশা খাতুন। ধানসিঁড়ি, ২০১৫। পৃ ১৬)
নিস্তার নেই। সুদীপের কবিতার পর কবিতার পর কবিতায় কোনও নিস্তার নেই। কুকুরগুলো যখন স্বরে স্বর মিলিয়েও ডাকে, দলবেঁধে, মাঝরাতে, সে স্বর এত একা মনে হয় কেন? সুদীপের কবিতায় এত পাড়াগত কলকলে জীবনের ছবি, প্রত্যেককে এত একা মনে হয় কেন? মাঝরাতে?