শুভার্থ মুখার্জ্জী
ঊনত্রিশ দিনে ভুখ হরতাল প্রেস ক্লাবের সামনে। অনেক রাজ্যবাসী হয়তো জানলেনই না, বিশেষত কলকাতার বাইরের লোকজন। শেষ তিন চারদিন কনভেনশন-মিছিল করে কলকাতার লোকজন একটু নড়েচড়ে বসল, ‘হলুদ’ মিডিয়ায় একটু আধটু সম্প্রচার হল খবর। সেই দেখে দেরি করে হলেও নাগরিক সহানুভূতি জেগেছিল, আশার কথা। অনশন চলছিল আঠাশে ফেব্রুয়ারি থেকে। এই নাকের ডগায় ধর্মতলায় যে এরম একটা ব্যপার হচ্ছে সেটা আমি জেনেছি মার্চের ষোলো-সতেরো তারিখ নাগাদ। সেও জনাকয়েক সিনিয়রের মুখে। সোশাল মিডিয়া, পেপারে লেশমাত্র উল্লেখ পাইনি। তারপর একদিন লোকজন মিলে যাওয়া হল। ‘সলিডারিটি লেটার’ দিয়ে পাশে থাকার কথা বলা হল মেডিকেলের ছাত্রছাত্রীদের তরফ থেকে। গোটাকয়েক গরম পোস্ট এল। ফেসবুক তেতে উঠতে থাকল। মহামান্যদের তাতে বিশেষ কিছু যায় আসে বলে মনে হয়নি। সামনে মসনদ দখলের লড়াই বলে কথা। রাম-বাবরির কাছে শিক্ষা-চাকরি কি ধোপে টেঁকে? ঊনত্রিশদিন যাবৎ অনশনের কথা লোকে জানুক আর না জানুক, ‘এগিয়ে থেকে এগিয়ে রাখে’র দৌলতে ন্যাতাদের পাওয়ার মিলের ফিরিস্তি মাথায় বিলক্ষণ গোঁজা আছে।
আর চাকরি দিয়ে সরকারেরই বা কী লাভ? হীরকের রাজা তো বলেই গেছেন ”এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে তত কম মানে।” নাই বা হল শিক্ষক নিয়োগ। গাঁয়ের জুনিয়র হাইস্কুল চলুক না একটা মাস্টার নিয়ে। বিজ্ঞানবিভাগ বন্ধ থাকুক টিচারের অভাবে। তাতে যদি ছেলেমেয়ে ক্লাস এইট বা টেনের পর পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হয় তো হোক। তাতে সরকার বাহাদুরের কিচ্ছুটি যায় আসে না। এইট পাশের দৌলতে দু-চারলাইন ইংরিজি লিখতে পারবে, যোগভাগগুণবিয়োগটা জানে। তা দিয়ে শপিংমলের দারোয়ান, তিনতারা হোটেলে একটা টেম্পোরারি কাজ জুটিয়ে নেওয়াই যায়। দুনিয়াজোড়া নয়া উদারনীতির যুগে কর্পোরেটের চাহিদামতো মজুরের জোগানটুকু হয়ে যায়।
আর এত শিক্ষক নিয়োগ করে হবেটাই কী? যত বেশি নিয়োগ তত বেশি খরচ। নিয়োগ হলে সবার বেতন চাই। তার জন্য সরকারি কোষাগার ফাঁকা হবে। তাই যদি হয়, বছরে গন্ডাখানেক মোচ্ছব আর মূর্তি বসানোর টাকাটা মিলবে কোথা থেকে?
আচ্ছা সে নাহয় আলাদা কথা, শিক্ষকের অভাবে যদি বন্ধ হয় একের পর এক সরকারি স্কুল, তাহলে কী উচ্চশিক্ষাও বন্ধ হয়ে যাবে?
না বস। সরকারি ইস্কুল নেই তো কী হয়েছে? বড় বড় পুঁজিপতি-শিক্ষাব্যবসায়ীরা তো রয়েছেন নাকি? গোটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে হরদম প্রস্তুত প্রাইভেট ইস্কুলগুলো। তাতে পড়বে কারা? ঐ চাষার ছেলে, দিনমজুরের ছেলে, কর্পোরেশনের ঠিকাদারের অধীনে কাজ করা ড্রেন পরিষ্কার করা লোকটার ছেলে? নাকি বেকার স্বামী, কাজের মাসির ছেলেমেয়ে? নাঃ। অত টাকা কই? মাসে দশ-পনেরো হাজার খসিয়ে পড়ানোর দম যাদের নেই তারা পড়াও ঐ ‘ব্যাকওয়ার্ড বাংলা মিডিয়াম’ ইস্কুলে। শিক্ষক কম, পরিকাঠামো তলানিতে ঠেকা ইস্কুলে ধুঁকে ধুঁকে একটা দূর অব্দি পড়া চালিয়ে পড়াশুনার জগৎ থেকে পত্রপাঠ বিদায়। পড়াশুনো শুধু পয়সাওয়ালাদের জন্য। ফেলো কড়ি মাখো তেল।
শুধু কি ইস্কুল? টুয়েলভ পাশের পর জেনারেল লাইন নিয়ে পড়লে তোমার ভবিষ্যতের চাকরির দায়িত্ব ‘সরকার’ নামক প্রতিষ্ঠান নেন না। সুতরাং পছন্দের সাবজেক্ট নিয়ে পড়ার চিন্তা বাদ দাও। তোমার জন্য দুটিই রাস্তা খোলা। হয় ডাক্তারি, নয় ইঞ্জিনিয়ারিং। সেগুলোও এখন সর্বভারতীয় বোর্ডের, সিলেবাসের অধীন। সাধারণ মেধার, রাজ্যবোর্ডের সরকারি ইস্কুলে পড়া ছাত্রছাত্রীদের নাগালের বাইরে। তাহলে উপায়? তার জন্যও ব্যবস্থা খুলে রেখেছেন বেওসায়িরা। পাকাশ-টিটজিতে রয়েছে এক্কেবারে বাছাই করা মাস্টাররা, বাৎসরিক দেড়-দুলক্ষের বিনিময়ে।
আরও বড় টাকার খেল!
পড়ুন — যে যেখানে লড়ে যায়
কিছুদিন আগেই এক সহপাঠী-হোস্টেলমেটের সাথে কথা হচ্ছিল মেডিকেলের কোচিং নিয়ে। বারো ক্লাসে সে এক নামকরা প্রতিষ্ঠানে ঢুকেছিল নিটের প্রস্তুতির জন্য। আবাসিক; বার্ষিক দক্ষিণা দুই লক্ষ। সেখানে প্রথমে randomly নবাগত ছাত্রছাত্রীদেরকে (যাদের মোট সংখ্যা ৭-১০ হাজার) বিভিন্ন ব্যাচে ভাগ করা হয়। তারপর সাপ্তাহিক এমসিকিউ পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে এ, বি, সি, ডি নামাঙ্কিত ব্যাচে ভাগ করা হয়। এ ব্যাচে থাকে বাছাই করা উচ্চ মেধার ছাত্রছাত্রীরা। তাদের জন্য বরাদ্দ হয় নামকরা সব ‘হাইফাই’ (বন্ধুটির ভাষায়) টিচাররা। তাদের পিছনে ইন্সটিটিউট জান লড়িয়ে দেয় ভালো রেজাল্ট করানোর জন্য। তারপর সর্বভারতীয় পরীক্ষায় সেই ব্যাচ থেকে প্রথম দশের মধ্যে গোটাকতক ছেলে ওঠে নিশ্চিতভাবেই। পরদিনই ভারতে প্রকাশিত প্রত্যেকটা পেপারের একটা করে কাগজ বরাদ্দ থাকে সেইসব কৃতীদের ছবি ছাপানোর জন্য, বড় বড় করে লেখা থাকে এর পিছনে বিশাল অবদান রাখা সেই প্রতিষ্ঠানের নাম। পরেরবছর নতুন করে ব্যবসা শুরু করার রাস্তাটা পাকা হয়ে যায়।
এত দূর তো বেশ ভালোই শোনাল। কিন্তু বাকি ব্যাচগুলো? শেষের দিকে তাদের জন্য নিযুক্ত হয় অনেক কম কোয়ালিফায়েড লোকজন, তাদের অনেকে আদতে শিক্ষকই নন। অনেক ক্ষেত্রে অন্য কোনও ডিগ্রিপ্রাপ্ত কর্মহীন যুবক। ফলত তুলনামূলক নিম্নমেধার ছাত্রছাত্রী, যারা খবরের কাগজে ঐসব বিজ্ঞাপন দেখে আর লোকমুখে নাম শুনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা করে এসেছিল ডাক্তারি প্রবেশিকায় চান্স পাবার আশায়, তাদের প্রয়াস মাঠে মারা যায়। অনেকেই বাধ্য হয় পরের বছর আবার ঐ পরিমাণ টাকা দিয় ভর্তি হতে (আশায় মরে চাষা গোছের), যা পরের বছরের ব্যবসার চক্রে অতিরিক্ত টাকার যোগান হিসাবে যায়। আর অনেকেই বিপুল অর্থখরচ সত্ত্বেও ‘পরাজয়ের’ গ্লানি নিয়ে হোস্টেল রুমের ফ্যানে গলায় ফাঁস লাগিয়ে, হাতের শিরা কেটে বা ঘুমের ওষুধ খেয়ে দুনিয়া থেকে মুক্তি নেয়।
এ শুধু টাকা নয় বাবুসাব, মানুষমারার খেলা। এ খেলা কিন্তু পয়সাওলার ছেলেপুলেকেও রেহাই দেয় না!
শুধু কি স্কুলস্তরের শিক্ষাব্যবস্থাতেই কোপটা পড়ছে? আজ্ঞে না। একটু পরিসংখ্যানটা দিই। চোদ্দো সাল অব্দি সরকারি শিক্ষাখাতে খরচ ছিল বার্ষিক ১৬৯০০০ কোটি টাকা। মোট জিডিপির খুবই ছোট্ট অংশ (৩.৭২ শতাংশ)। আচ্ছে দিনের দাপটে সেটা হয়ে দাঁড়াল ১৫০০০০ কোটি। সর্বশিক্ষা অভিযান গোছের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প যে কটি চালু ছিল স্কুলস্তরে, সেগুলোকেও ক্রমশ রুগ্ন করা হতে থাকল। কলেজস্তরেও কমতে থাকল বরাদ্দ। গবেষণার খরচে কাঁচি পড়ল। টাটা ইন্সটিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের গবেষকদের ভাতা রাতারাতি কমানো হল ৫০ শতাংশ। কেরল ইউনিভার্সিটিতে নির্দেশ পাঠানো হল সরকারের পছন্দমতো বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে গবেষণা করা যাবে না। জেএনইউতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সিট এগারোশো থেকে এক ধাক্কায় কমিয়ে ১৯৪ করা হল। বন্ধ হতে চলল উইমেন্স স্টাডিজ, সমাজতত্ত্বের মতো বিষয়গুলি। এল অটোনমি বিল। কড়া ভাষায় জানান দিল কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য নতুন কোনও বিভাগ খুলতে গেলে কোনওপ্রকার অর্থসাহায্যের ভার সরকার নেবে না। অর্থাৎ সেই বেসরকারি পুঁজি ভরসা।
আর কোচিং? ঠিক ধরেছেন। সে ঠিক ওঁৎ পেতে বসে পড়েছে। ডাক্তারির সাড়ে চার বছরের পড়াশুনোর জন্য ‘বিকল্প’ খুলে বসেছে টাটিয়া-ড্যাগস। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলিতে অনেকক্ষেত্রেই পর্যাপ্ত ডাক্তার-শিক্ষক ও পরিকাঠামোর ঘাটতি রয়েছে, বিশেষত জেলার কলেজগুলিতে। সমান্তরালভাবে গড়ে উঠছে টাটিয়া-ড্যাগসের ব্যবসা। অর্থাৎ ডাক্তারির পাঠ নিতে তোমায় কলেজ না গেলেও চলবে। তার থেকে অনেক উন্নতমানের ভিডিও লেকচার-লাইভ লেকচার-ব্যাকআপ ক্লাসের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ফার্স্ট ইয়ার টু ফাইনাল ইয়ার কমপ্লিট প্যাকেজ মিলছে ১৫০০০০ টাকার বিনিময়ে। নামীদামী শিক্ষকরা ক্লাস নেন। ‘পড়াশোনার ফোকাস ঠিক রাখতে’ ডাক্তারি পড়ুয়ারা যায় সেসব জায়গায়। ফার্স্ট-সেকেন্ড ইয়ার থেকে কেরিয়ারের পিছনে ছুটছুটছুটছুট সে এক দুর্দম লড়াই! আমাকে যেতে হবে সবার আগে। যে ছেলেটা হোস্টেলে বসে আড্ডা মারে সে সময় নষ্ট করছে। You are in absolutely right place. Your career is far more bright than them!
হারিয়ে যাচ্ছে একসঙ্গে খেতে-ঘুরতে যাওয়া, বাৎসরিক হোস্টেল পিকনিকে হইহই করতে করতে যাওয়া, দাঁত কেলিয়ে আড্ডা মারা, ইয়ারমেটদের সাথে ফালতু আজেবাজে গল্প করতে করতে গোটা রাত কাটিয়ে ভোরবেলায় ঘুমোতে যাওয়া।
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
অনেকটা বাজে বকে ফেললাম। কী যেন বলছিলাম….. অনশন চলছিল শিক্ষকের পদে নিয়োগের দাবীতে। আচ্ছা, যদি ধরে নিই জুন মাসের এক সুন্দর সকালে সব দাবী মেনে নিয়ে কর্মসংস্থানের দায়িত্ব সরকার নিল। সকলের জন্য শিক্ষা, গবেষণার খরচের দায়িত্ব সরকার নিল, শিক্ষকের ভ্যাকেন্সি অনেকাংশেই পূর্ণ হল, গাঁয়ের হাইস্কুল মাস্টার পেল, প্রত্যেক কলেজে উপযুক্ত পরিকাঠামো হল, চাষি-চামারের ছেলেটা পড়ার সুযোগ পেল নিজের পছন্দমত বিষয় নিয়ে যতদূর খুশি। দেশ ও দশের সামগ্রিক মঙ্গল হল।
কী হবে তাহলে? বেসরকারি শিক্ষাব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে। শিক্ষাক্ষেত্রের দরজায় বেসরকারি পুঁজির জন্য তালা পড়বে চিরকালের জন্য। পুরো একটা সেক্টর হাতছাড়া হবে কর্পোরেটদের হাত থেকে।
তা তো হতে দেবেন না প্রভুরা। যে কর্পোরেট প্রভুদের সমর্থন ছাড়া সরকার, থুড়ি এই গোটা ব্যবস্থাটাই চলতে পারে না তাঁরা কীভাবে হতে দেবেন এসব? সুতরাং সেই স্বপ্নের দিন ঘুমেই রইল। বাস্তবে আর ফলল না।
জনৈক বন্ধুর দাবী ‘মমতা হঠাও মোদি লাও’। আরেকজনের মতে সিপিএম ক্ষমতায় আসলে নাকি ব্যাপকহারে চাকরি দেবে। তাই কি মনে হয়? সরকারে যে রং-ই আসুক, সামগ্রিক সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকরা কি এতটাই দয়ালু, যে মানবকল্যাণের স্বার্থে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুঠারাঘাত করবেন?
ন্যায্য দাবী আদায়ের একটাই উপায়। নিরন্তর সংগ্রাম। একটাই রাস্তা। রাজপথ। অনশন চলেছিল ঊনত্রিশ দিন। এত যাদের জেদ, তারা জিতবে না তাও কখনও হতে পারে?