সুমনা রহমান চৌধুরী
শওকত আলি। আসামের শোনিতপুর জেলার বিশ্বনাথ চারিআলি বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই একটি ভাতের হোটেল চালিয়ে আসছেন তিনি। গত সোমবার, ৮ই এপ্রিল সোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায় এক মাঝবয়েসি ভদ্রলোক জলকাদার মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন এবং তাঁর চারপাশে অনেক যুবকের ভিড়। ভদ্রলোককে বারবার আঘাত করা হচ্ছে এবং হুমকি ধমকিও দেওয়া চলছে। এক পর্যায়ে তাঁর মুখে জোর করে শুয়োরের মাংস গুঁজে দিয়ে সেটা খেতে বাধ্য করা হয়। এমন সময় দেখা যায় কিছু যুবক শওকত আলিকে প্রশ্ন করছে, “তুমি কি বাংলাদেশি? তোমার নাম এনআরসি’তে আছে? তোমার কি গরু বিক্রির লাইসেন্স আছে?” ইত্যাদি।
শওকত আলির ভাই সাহাবুদ্দিন জানান, “শওকত আলিকে বাংলাদেশি বলে দাবি করে কিছু যুবক তাঁকে বেধড়ক মারধর করে। এমনকি তাঁকে শুয়োরের মাংস খেতে বাধ্য করে। এমনকি গরুর মাংস বিক্রির অনুমতি দেওয়ায় বাজারের ইজারাদার কমল থাপাকেও মারধর করা হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।”
শওকত আলিকে বেধড়ক মারধর, হুমকি ধমকি দেওয়া করা চলছিল। মানুষ জড়ো হয়ে দেখছিল দেশপ্রেমী নামধারী কিছু মানুষরূপী জানোয়ারদের উন্মত্ততা। বাঁচাতে আসেনি কেউ। বরং হাততালি দিয়ে সমবেত জনতা উৎসাহ দিচ্ছিল ওই যুবকগুলোকে। ফোনে ভিডিও করছিল সমস্ত ঘটনা। গোঙাচ্ছিলেন শওকত, বাঁচার আর্তি জানাচ্ছিলেন। জোর করে তাঁর মুখে শুয়োরের মাংস গুঁজে বুঝিয়ে দেওয়া হয় সংখ্যালঘুদের গোঙাতে নেই। বাঁচার আর্তিও জানাতে নেই। চুপ করে শুধু মার খেয়ে যেতে হয়। রাস্তায় কাদাজলের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে দয়াভিক্ষা চাইছেন একজন ‘মানুষ’, যাঁকে রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু নাগরিকরা ঠিক ‘মানুষ’ বলে মনে করে না। যাবতীয় কর্মকাণ্ড শেষ হয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্রের পুলিশ পেয়েদারা উপস্থিত হোন, ততক্ষণে শওকত অপমান, আঘাত, ভয় শঙ্কায় অসুস্থ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। নাহ্, শুধু শওকত নন, ততক্ষণে চুড়ান্ত অ-সুখ নিয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে আমার দেশের সংবিধান, আইন, সভ্যতা, সর্বোপরি দেশ।
শুধু শওকত নন, আমরা এর আগে দেখেছি ঠিক একইভাবে জুনেদ, ওমর, আখলাক, পেহলু খান, আফরাজুল, আকবর সহ কয়েকশো সংখ্যালঘু (না সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যাগুরুদের ভাষায় যারা কৃমি কীট, যারা মানুষের মতো দেখতে হলেও ঠিক মানুষ নয়, খানিকটা উন্মানুষ টাইপ) গোরক্ষক বাহিনী, এন্টি রোমিও স্কোয়াডের হাতে নির্মমভাবে খুন এবং মারধরের শিকার হয়েছেন ২০১৫ সাল থেকে এখন অব্দি।
আমাদের মতো কিছু দেশদ্রোহীরা এতে সরকার আর রাষ্ট্রের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললে, তার জবাব ও বিজেপির বিধায়ক রাজা সিং দিয়েছিলেন। নিজের গোশালায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, “গরু বাঁচাতে গিয়ে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে মিডিয়া এমন ভাব করে যেন ভূমিকম্প হয়ে গেছে।” সংঘ নেতা ইন্দ্রেশ কুমার বলেছিলেন, “গোমাংস খাওয়া ছেড়ে দিন, তাহলেই গণপিটুনি বন্ধ হয়ে যাবে।” সঙ্গে হিতোপদেশ দিয়ে এটাও বলেন, “অবশ্যই গোরক্ষা করা এবং গোবরকে সিমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। তাহলেই অভাব আর গণপিটুনিতে পুর্ণচ্ছেদ পড়বে।”
আমরা দেখেছি এর আগেও, আফরাজুলের খুনিকে দেবতাজ্ঞানে রথে বসিয়ে রথ টানতে, আমরা দেখেছি সেই খুনির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আমাদেরই সহনাগরিকদের কাড়ি কাড়ি টাকা পাঠাতে। আমরা দেখেছি আলিমুদ্দিনকে যারা পিটিয়ে মেরেছিল তাদের ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করছেন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। আমরা দেখেছি আখলাকের খুনিদের সম্মান জানাতে সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত করা হয়েছে তাদের। আমরা দেখেছি জুনেদ থেকে আফরাজুল, আকবর থেকে আখলাক— প্রত্যেককেই “ভারত মাতা কি জয়” “জয় শ্রী রাম” এই স্লোগানগুলো উচ্চারণ করেই নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। আমরা দেখেছি নিউজ চ্যানেল এবং সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন ভিডিওতে, সংখ্যালঘু মানুষকে একদল উন্মত্ত ছেলে “ভারত মাতা কি জয়” বলানোর জন্যে বেঁধে রেখে মারধর করছে! ভিখিরি বয়স্ক দম্পতিকেও রেহাই দেয়নি তারা। আমরা দেখেছি অনেক কিছুই। তাই নতুন করে অবাক হওয়ার মতো বোধহয় আর কিছুই নেই।
শুধুমাত্র মুসলমান হলেই পিটানো যায়, খুন করা যায়। খ্রিস্টান, দলিত, আদিবাসী, শ্রমিক, কৃষক হলেই তাদের সাথে যা খুশি তা করা যায়। এটাই নরেন্দ্র মোদির ‘নয়া ভারত’। ‘নয়া ভারতে’ স্রেফ গরুর মাংস খাওয়ার কারণেই একজন মানুষকে মেরে ফেলা যেতে পারে প্রকাশ্যে। নয়া ভারতে নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সহযোগী ভক্তরা ঠিক করে দেন দেশের জনগণ কী খাবেন, কী পরবেন, কীভাবে হাঁটবেন— সবকিছু। যে সংবিধানে লেখা আছে, যারা গরুকে দেবতুল্য সম্মান দেয়, তাদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি যেরকম সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, ঠিক সেইভাবে অন্য ধর্মের মানুষ, যারা গরুকে দেবতা মনে করেন না, তাদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শনের কথা— সেই সংবিধান ‘নয়া ভারত’ মানে না। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের ভিতকে পায়ের নীচে দুমড়ে মুচড়ে নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর টিম “হিন্দু-স্থান” গড়ায় মন দিয়েছেন। কোন হিন্দু-স্থান? যেখানে বেদ চর্চার কারণে শূদ্রপুত্র শম্বুককে খুন করা হয়। আরেক শূদ্রপুত্র একলব্যের ধনুর্বিদ্যা শেখার গুরুদক্ষিণা বুড়ো আঙুল কেটে শোধ দিতে হয়।
গত পাঁচবছরে নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল, শাখা সংগঠনগুলো ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষের মনে খোদাই করে দিয়েছেন— দেশে যাবতীয় যা কিছু হচ্ছে তা খুব স্বাভাবিক এবং সবার জন্যে ভালো। বৃটিশ যাওয়ার পর থেকে এত ভালো আর দেশে কোনওদিন হয়নি। সবার সেটা মানতেই হবে এবং কোনওরকম প্রশ্ন করা যাবে না। এবং তারপরও বেয়াড়ার মতো প্রশ্ন করলে জাস্ট গুম করে দেওয়া হবে জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির ছাত্র নাজিবের মতো, অথবা খুন করে দেওয়া হবে গৌরী লঙ্কেশ বা দাভোলকরদের মতো। আরবান নকশাল দাগিয়ে অ্যারেস্ট করা থেকে শুরু করে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে, পুড়িয়ে মারা হবে এবং সেই মারার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে সোশাল মিডিয়ায়। তাই মানতেই হবে যা হচ্ছে সব ভালো হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদি ভগবান।
হিন্দু রাষ্ট্র, হিন্দু সভ্যতা এবং হিন্দুত্বের যা যা ব্যখ্যা দেবেন নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দল, সেটাই সবাইকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। যা খেতে না করা হবে, তা খাওয়া চলবে না। যা পরতে না করা হবে, তা পরা চলবে না। যা যা করতে মানা করা হবে সেগুলো করা একদম চলবে না। হাঁস অক্সিজেন ছাড়ে কিংবা মহাভারতের যুগের ইন্টারনেট অথবা গরুর মুত্রে সব রোগ সেরে যায়, টেস্টটিউব বেবি, রাবণের এয়ার বেস্— এইসব তথ্য সবাইকে মেনে নিতেই হবে। বাঙালিরা ভারতীয় নয়। বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে এই দেশে থাকলেও, সেই থাকার ইতিহাস, প্রেক্ষাপট সব থাকলেও— সব নেহেরুভিয়ান ভুল ইতিহাস দাগিয়ে বাঙালিকে হিন্দু বাঙালি-মুসলমান বাঙালি হিসেবে দু-ভাগ করে বাংলাদেশি, বিদেশি সাজিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্প নামক জেলে পোরা হবে মরার জন্যে। এবং এইসব কিছুকেই সবার খুব স্বাভাবিক বলে মানতে হবে। এভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছে ‘নয়া ভারতের” স্বৈরাচারের তাত্ত্বিক ভিত্তি।
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
ভবিষ্যৎ ভারত আরএসএসের পোস্টার বয় নরেন্দ্র মোদির হিন্দু ভারত হবে নাকি নতুন ভারত গড়ে উঠবে, বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক সামাজিক সমতা ন্যায়ের ভারত, শান্তি ও সম্প্রীতি, বৈচিত্রের মধ্যে একতার সহিষ্ণু ভারত, সেটা ঠিক হবে এই নির্বাচনে। শওকত, আফরাজুল, আখলাক থেকে নাজিব, রোহিত ভেমুলা, দাভোলকর থেকে গৌরী লঙ্কেশ, পানসারে, আত্মহত্যা করা কৃষক থেকে কাটুয়া, উন্নাও, ডিটেনশন ক্যাম্পের আত্মহত্যা করা বাঙালি সুরেন্দ্র বর্মণ থেকে সোনাম আলি— প্রত্যেককে ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার একটাই অস্ত্র— ইভিএম। গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রকে বহাল করতে হলে, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হলে আরএসএসের পোস্টার বয় নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর দলের চুড়ান্ত অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শকে এই নির্বাচনে পরাজিত করতেই হবে যে কোনও মূল্যে।