ড. কনক প্রামাণিক
যথেষ্ট আশঙ্কা এবং উত্তেজনার মধ্য দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের ভোটযাত্রা শুরু হল। পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্টের বদলি, কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মূহুর্মূহু সিদ্ধান্ত বদল, নির্বাচন-কর্মীদের নিরাপত্তার দাবি— সব মিলিয়ে লোকসভা নির্বাচন এবার অন্যরকম। পঞ্চায়েত বা বিধানসভা নির্বাচনে যে উত্তেজনা থাকে তার খানিকটা আঁচ এবারের প্রথম দফার লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া গেল। মোদি-ঢেউ বঙ্গে কার্যকরীভাবে আছড়ে পড়ল না কি স্তিমিত হল, দিদি প্রধানমন্ত্রী হবেন নাকি তাঁর অস্তাচলে যাওয়ার সময় হল, বামেরা তাঁদের হৃতশক্তি পুনরায় ফিরে পাবে নাকি আরও অপেক্ষা করতে হবে– তা সময়ই বলবে। তবে এ বছরের সাধারণ নির্বাচন আক্ষরিক অর্থেই সর্বসাধারণের নির্বাচনে পর্যবসিত হয়েছে। প্রায় সর্বস্তরের জনগণের নির্বাচন ঘিরে উদগ্র কৌতুহল, তাদের ভালোবাসা অথবা ঘৃণায় মোড়া সুস্পষ্ট মতামত, জাতীয় রাজনীতিতে কতটা কার্যকরী ভূমিকা নেবে জানি না তবে গণতন্ত্রের পক্ষে এ যে শুভ তা বলাই বাহুল্য।
এ বারের নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সংগঠনের থেকে প্রোপাগান্ডা এবং সত্যমিথ্যে মাখানো বিজ্ঞাপন ও শাসক দলের হুজ্জুতি সাধারণ নির্বাচনকে যে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে প্রথম দফার ভোটে ৮১% ভোটার্স টার্ন আউট রিপোর্ট তা প্রমাণ করে— গতবার যেটা মাত্র ৬৭% এর আশেপাশে ছিল।
উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক চেতনা দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় কম, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও কম। কথায় কথায় ধরনা-বিক্ষোভ বা দাবি আদায়ে সাধারণ জনগণকে খুব একটা সংগঠিত হতে দেখা যায় না। তবে স্যোশাল মিডিয়ায় আইটি সেলের গবেষকদের দৌলতে, কেন্দ্র এবং শাসকদলের বদান্যতায় মজ্জাগত জাতি বা ধর্মবিদ্বেষ বঙ্গের ভোট ময়দানে দশ নম্বর জার্সি পরে নেমে পড়েছে। ভাতের লড়াই শেষ হয়নি জাতের জন্য নেমে এসেছেন সর্বস্তরের মানুষ। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটন, যোগাযোগব্যবস্থা এখনও ভয়াবহ। অথচ এ সবের দাবিদাওয়াগুলো আজও বড় ক্ষীণ।
জাতপাতের বা মেরুকরণের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে সেভাবে কখনও ছিল না। উত্তরবঙ্গে তো নয়ই। নমঃশুদ্র এবং তফশিলি জাতি উপজাতি অধ্যুষিত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে বামেদের দুর্বল সংগঠনের সুবাদে বিজেপি হু হু করে ঢুকে পড়ছে। এই কিছুদিন আগেও যে সব বিষয়গুলো নিয়ে মজা করা যেত সেগুলো এখন বলতেও ভয় হয়। ধর্মের আফিম খাওয়া লোকজন চায়ের দোকান থেকে বড় অফিস কাছারি, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছেন। উগ্র দলবাজি এখন উগ্রজাতিবাদ এবং ধর্মবাদে পর্যবসিত। বঙ্গের রাজনীতির এই আনুভূমিক সরণ এখন বর্তমান বঙ্গীয় রাজনীতির চালচিত্র।
কেন এই সার্বিক বিদ্বেষের রাজনীতি? কিসে ভয়? ধর্ম কি সত্যই পেটে লাথি মারছে? বালাকোট কি দেশের সামাজিক বা আর্থিক রূপরেখা নির্ধারণ করবে? দেশের বহু দলীয় রাজনীতিতে মুসলিম জনগোষ্ঠী কি অংশগ্রহণ করে না যে সমস্ত হিন্দুদের এক পার্টির ছাতার নিচে আসতে হবে? দেশের লোকজন এত অবোধ যে হেলিকপ্টারে করে ক্ষেতে নেমে দুটো ধান গাছ হাতে নিয়ে নেতাদের ‘আমি তোমাদেরই লোক’ গোছের নাটক বিশ্বাস করে? উত্তরগুলো বাতাসেই ভেসে বেড়ায়।
তবু, এই যে সাধারণ মানুষের বাস্তব অবাস্তব সাধারণ আবেগ যার জন্য লোকসভা নির্বাচনের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়েছে এর আশু ফলাফল আছে কিনা জানি না তবে অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষ অর্থনীতি, বিদেশনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, জাতীয় নিরপেক্ষ সংস্থাগুলোর ওপর দলীয় রাজনীতির প্রভাবের মতো জটিল বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে, এ আমার স্থির বিশ্বাস।