দেবাশিস দাশগুপ্ত
অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে, কাঠ খড় পুড়িয়ে জাতীয় নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবঙ্গে সাত দফায় লোকসভা ভোটের ব্যবস্থা করেছে। ভাবখানা এমন যেন, সাত দফায় ভোট করলে কোনও ঝামেলা হবে না, ভোট লুঠ হবে না। পাশাপাশি তারা এই প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল, এবার রাজ্যের লোকসভা ভোট হবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে। সাত দফায় ভোট হলে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনে কোনও সমস্যা হবে না। ইতিমধ্যে রাজ্যে দুই দফার ভোট হয়ে গেল। আমরা কেন্দ্রীয় বাহিনীর তেমন কোনও উপস্থিতি টের পেলাম না। ১৮ তারিখে রায়গঞ্জ আর চোপড়ায় যথারীতি ভোট লুঠের চেষ্টা হল। ভোটারদের আটকানোর চেষ্টা চলল। বুথ দখলের খবর করতে গিয়ে চোপড়ায় আর গোয়ালপোখরে সাংবাদিকরা আক্রান্ত হলেন। বুথে ভোটারদের নিরাপত্তা দেওয়ার যে কাজ কিংবা ছাপ্পা ভোটার আটকানোর যে কাজ পুলিশ প্রশাসনের করার কথা, তা করতে দেখা গেল সাংবাদিকদের। তবে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফার ভোটে সাধারণ মানুষের রুখে দাঁড়ানোর মেজাজটা চোখে পড়েছে। নিজের ভোট নিজেই দেব, কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া ভোট নয়, এই ধরনের প্রত্যয় নিয়ে মানুষ ওইদিন ভোট কেন্দ্রে গিয়েছেন। তাঁদের প্রতিবাদী মেজাজের সামনে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে শাসক দলের দুষ্কৃতীরা। এই ছবি বহুদিন পর দেখল বাংলা।
আর একটা বিষয়ও এবার তাৎপর্যের। এই প্রথম নিরাপত্তার দাবিতে ভোটের অনেক আগে থেকেই সরব হয়েছেন ভোটকর্মীরা। প্রায় গোটা রাজ্যেই ভোটকর্মীরা প্রশিক্ষণের আগে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি তুলে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তাঁরা আওয়াজ তুলেছেন, ‘নো সেন্ট্রাল ফোর্স, নো ভোট’। তাঁদের এই আন্দোলনে প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন নড়েচড়ে বসেছে। তারা ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী দেওয়া হবে বলে ভোট কর্মীদের আশ্বস্ত করেছে। প্রথম দুই দফার ভোটে ভোটকর্মীদের উপর তেমন কোনও চাপ আসেনি। তাই বলে বাকি পাঁচ দফার ভোটে তাঁদের উপর হামলা হুজ্জুতি হবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। তবে নির্বাচনের আগে কমিশনের এক বড় কর্তা সুদীপ জৈন বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, এই রাজ্যে ভোট কেমন করে করতে হয়, দেখিয়ে দেব। এই দু’দফার ভোট কেমন হল, তা তো আমরা দেখলাম। সেই বুথ দখলের চেষ্টা, ভোটারদের বুথে যেতে না দেওয়া, আগের দিন রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি। সবই হল। কেন্দ্রীয় বাহিনীর রক্তচক্ষু রাজ্যবাসী দেখতে পেল না। জানি না, বাকি পাঁচ দফার ভোট কেমন হবে।
আসলে এই রাজ্যে ভোটের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। ১৯৭১-৭২ সালে দেখেছি, পাড়ার ছেলেরা রাতারাতি নব্য কংগ্রেস হয়ে গেল। আর ভোটের আগে চেনা ছেলেদের অপরিচিত ভূমিকা। তখন সিক্স সেভেনে পড়ি। বাড়ির বড়রা কাজে বেরিয়েছেন। বাড়িতে আমরা ছোটরা। আর আছেন মা, দাদু, ঠাকুমা। পাড়ার সেই নব্য কংগ্রেসিরা ভোটের আগের দিন হাতে পাইপগান, বন্দুক নিয়ে বাড়িতে এসে শাসিয়ে গেল, ‘কাল যেন বুথে না দেখি।’ আমার দাদু ছিলেন ডাকাবুকো ধরনের। দাদু বললেন, ‘সেটা তো আমরা ঠিক করব। তোমরা বলার কে হে।’ ওই ছেলেদের মধ্যে কেউ একজন দাদুকে একটা বাজে গালাগাল দিল। আমরা দাদুকে কোনও রকমে ঘরে টেনে আনলাম। সেই কংগ্রেস ১৯৭৭ সালে কোথায় ভেসে গেল। ৭৭ সালে বামেরা ক্ষমতায় আসার পর কয়েক বছর বেশ ভালই চলছিল। তারপর তারাও ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে লাগল। এলাকায় এলাকায় ছোট বড় সিপিএম নেতারাই শেষ কথা। পারিবারিক ঝামেলাতেও তাঁরা নাক গলাতে শুরু করলেন। পাড়ায় পাড়ায় সিন্ডিকেটের দাপাদাপি শুরু হল। পাশাপাশি লোকসভা থেকে শুরু করে বিধানসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েত ভোটে তাঁদের সব আসন চাই। তার জন্য সেই কংগ্রেসি কায়দায় ধমক চমক, বিরোধী এজেন্টদের বুথে বসতে না দেওয়া— ইত্যাদি সব চলতে লাগল। মানুষ একটা সময় বামেদের এসব অপকর্মে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠল। পুলিশকে পাশে পেয়ে সিপিএম গুন্ডা মস্তানদের প্রশ্রয় দিতে লাগল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করলেন। কংগ্রেসে থাকতেই তিনি ‘নো ভোটার কার্ড, নো ভোট’ স্লোগান তুলে হইচই শুরু করেছিলেন। ২০০৬ আর ২০১১ সালের বিধানসভা ভোট হল কেন্দ্রীয় বাহিনীর বন্দুকের ডগায়। বিরোধীরা কোনও রিগিং, ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ করতে পারলেন না। তারপর এল পরিবর্তনের পালা। আর ক্ষমতায় এসেই তৃণমূল হাতে মাথা কাটতে শুরু করল। সেই সিপিএমের মতোই তাদেরও সব দখল করতে হবে। বিরোধী বলে কিছু থাকতে দেওয়া হবে না। লোকসভা থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত, এমনকী স্কুল কলেজেরও ভোটে বিরোধীরা যেন দাঁড়াতে না পারে, সেটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠল। তাই তারাও সিপিএমেরই কায়দায় ভোটে কেরামতির খেল দেখাতে নেমে পড়ল। সব ভোটের আগে বিরোধীদের হুমকি, মনোনয়নে বাধা, প্রচারে বাধা, ভোটের দিন বিরোধী এজেন্টদের বসতে না দেওয়ার মতো নানা অপকর্মে লিপ্ত হল তারাও। খোদ নেত্রী রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার ডাক দিলেন। আর তাঁর চেলাচামুণ্ডারা দিদির ডাকে সাড়া দিতে মাঠে নেমে পড়লেন। গত পঞ্চায়েত ভোটে প্রায় ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা লড়াইয়ে জিতে গেল শাসক দল। প্রায় দুই কোটি মানুষ তাই তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগই করতে পারলেন না। কথায় কথায় যিনি গণতন্ত্র লুণ্ঠনের অভিযোগ আনেন, তিনি নিজেই আজ গণতন্ত্র লুণ্ঠনের অন্যতম কাণ্ডারী হয়ে উঠেছেন।
সিপিএম নেতা গৌতম দেব একটা সময় স্বীকার করেছিলেন যে, তাঁদের সব কিছু দখলের মানসিকতাই বিপর্যয় ডেকে এনেছে। একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অনিল বিশ্বাসকে অনেকবার বলেছি, কী দরকার ছিল আমাদের সব দখল করার। আমি দলের ছাত্র নেতাদেরও বলি, একটা দুটো কলেজে যদি বিরোধীরা থাকে তো ক্ষতি কীসের।’ আজ মনে হয়, গৌতমবাবু ঠিকই বলেছিলেন। আরামবাগ লোকসভা ভোটে প্রয়াত অনিল বসুর প্রায় ৬ লক্ষ ভোটে জেতা, মেদিনীপুরের কোনও এক বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিএমের নন্দরানী দলের রেকর্ড ভোটে জেতা কিংবা কলকাতা পুরসভার ভোটে ২ নম্বর ওয়ার্ডে ধনঞ্জয় বিশ্বাসের মাত্রাছাড়া ভোটে জয়লাভ করা ইত্যাদি পরবর্তীকালে সিপিএমের পক্ষে বুমেরাং হয়ে গিয়েছে। তখন ক্ষমতার মোহে অন্ধ ছিল বলে তারা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেনি। আজ তার ফল ভুগতে হচ্ছে।
যে রোগে সিপিএমের পতনে ৩৪ বছর সময় লেগেছে, তৃণমূলের সেই রোগ ধরেছে মাত্র আট বছর বয়সেই। আমি একাই সব, আর কেউ কিছু নয়, এই চিন্তাধারা গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক। তাই একটা সময় যেখানে ভোটে দাঙ্গাহাঙ্গামা, খুনোখুনি, ভোট লুঠের জন্য কুখ্যাত ছিল বিহার, উত্তরপ্রদেশ, আজ সেখানে বদনামের জন্য জায়গা করে নিয়েছে পশ্চিমবাংলা। গত বছর পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল শূন্য। আর আমাদের রাজ্যে গত পঞ্চায়েত ভোটের সময় মৃত্যু হয়েছে ৮২ জনের। সাধে কি বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক অজয় নায়েক বলেছেন, এই রাজ্যের অবস্থা দশ বছর আগের বিহারের থেকেও খারাপ। এই লজ্জা আমরা রাখব কোথায়? এ আমার লজ্জা। এ তোমার লজ্জা।
শাসক দলের এবার বোধহয় সংযত হওয়ার সময় এসেছে। আশার কথা একটাই। মানুষ এবার প্রতিরোধে নামছে। নিজের ভোট নিজে দেব, এরকম একটা জেদ চেপে বসেছে মানুষের মনে। তারই প্রতিফলন দেখা গেল ১৮ তারিখে দ্বিতীয় দফার ভোটে। এর থেকে তৃণমূল কোনও শিক্ষা নেয় কিনা, সেটাই দেখার। না হলে তাদেরও মুখ থুবড়ে পড়তে হবে। ইতিহাস তো তাই বলে।