সত্যব্রত ঘোষ
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চারপাশে মানুষদের যে নিয়মিত মতবিনিময়, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্রুত মতদ্বৈধে পরিণত হচ্ছে। প্রকট এক অস্থিরতার কারণেই যে এমনটা ঘটছে, তা অনুভব করতে পারছি। আর এই অশান্ত পরিবেশকে মাত্রাতিরিক্ত সংবেদনশীল করে তুলছে নানান উৎস থেকে আসা বিশাল তথ্যভাণ্ডার, যার অধিকাংশই নির্মিত। গুজবের সমগোত্রীয় সেই তথ্যসমূহকেই শিরোধার্য করে নিয়ে সাধারণ মানুষ আজ পরস্পরকে ভুল প্রমাণ করতে ব্যগ্র। সচেতনতা জাহির করবার জন্য সেগুলিকেই আওড়াচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু সেই তথ্যের সত্যতা, এমনকি প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেই, আক্রমণ হানছে তারাই, যারা আমাদের আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন। এই সময়ে একান্তে যখনই পিছন পানে তাকাই, মনে পড়ে চেনা-অচেনা মানুষদের এই নখদন্ত শোভিত চেহারাগুলি শেষ দেখেছিলাম প্রায় ২৭ বছর আগে।
বাবরি মসজিদ ভাঙবার পর সারা দেশ তখন উত্তাল। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা এবং অবিশ্বাসের আঁচ এতটাই ছিল যে তা দগ্ধ করেছে সমগ্র মানবিকতাকেই। সীমিত বোধশক্তির উপর বারবার আঘাত আসছিল তখন। নৈরাশ্যে ভরা সেই ভীতিজনক পরিবেশে বুঝতে চেয়েছি, স্বদেশবাসীর প্রতি এত ঘৃণা কেমনভাবে লালন করছেন তথাকথিত শিক্ষিত, পরিশীলিত মানুষজন। গভীরে গিয়ে জেনেছি কুঞ্চিত লালাঝরা উচ্চবিত্ত যে মুখগুলি গল্ফ গ্রিন, ভবানীপুর, বালিগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলের সুসজ্জিত অ্যাপার্টমেন্টের মালিক সেজে বসে ঘৃণা ওগরাচ্ছেন, তাঁদের কেউই সংখ্যালঘু মানুষদের দ্বারা লাঞ্ছিত নয়। তাঁদের আগের প্রজন্মের কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দেশবিভাজনের স্মৃতিকে সম্বল করেই অনেকে সযত্নে সেই কটু বিষ ধারণ করে রেখেছেন। মধ্যবিত্তদের মধ্যে যারা উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করেন, আর্থ-সামাজিক চাপে সেই অংশটিতে আত্মপরিচিতির সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই তাঁরা মুসলমানদের অভিশাপ দিয়েই হিন্দুত্বের গৌরবধ্বজা উত্তোলনে মগ্ন। আর, উঞ্ছবৃত্তিকেই যারা জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য, আক্রমণাত্মক ভিড়ের অংশ হয়ে আঘাত হানলে ধরা পড়বার ঝুঁকি তো থাকেই না, বরং কপালে থাকলে অনেক ইচ্ছা পূরণ করা যায়। টিভি, ঘড়ি বা চেন জুটে যেতে পারে, আর নিভৃতচারিণীদের ভয় দেখিয়ে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি চরিতার্থ করবার সুযোগও মিলে যায়। শুধুমাত্র ধর্ষণ নয়, সামান্য একটি ক্ষুরের সাহায্যে, নিদেনপক্ষে একটা ব্লেড দিয়ে সম্মুখের ব্যক্তির রক্তপাতেও যে যৌনসুখ মেলে, তার হদিস পেয়েছিলাম এই অলস, আত্মমগ্ন, বিচারবুদ্ধিহীন হায়নারূপী কিছু সমবয়স্কদের থেকে।
অর্থাৎ, তথাকথিত ধর্ম বা জাতীয়তার যে আবেগকে বিজ্ঞাপিত করে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের অবস্থানকে পোক্ত করতে সংগঠিত, সেই আবেগের অনুভবেই যে দল-মত নির্বিশেষে হামলা চালায় সাধারণ মানুষ, তা কিন্তু নয়। বরং, এই লণ্ডভণ্ড করাটা যে রাজনৈতিক দলগুলির অন্যতম কার্যসূচি তা এখন অন্তত আমার কাছে স্পষ্ট। এবং এর জন্য আমি আনন্দ পটবর্ধনের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁর ‘রাম কে নাম’ ছবিটি ১৯৯২-এর সেই অস্থির সময়ে শুধু চিন্তার জট ছাড়াতেই সাহায্য করেনি। অসম্ভব এক ঘৃণা এবং সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করবার কাজে ধর্মকে ব্যবহার করবার বিরুদ্ধে আমার নিরন্তর প্রতিবাদের এক শানিত অস্ত্র হয়েছিল ‘রাম কে নাম’।
২৭ বছর পরে এই ডিজিটাল এজ-এ পোঁছে দেখছি অতীত আমাদের শিক্ষা দেয় না। তবে হিংস্র প্রবৃত্তিগুলিকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলতে অতীতের চেয়ে ভালো শিক্ষক আর নেই। সোশ্যাল মিডিয়াকেই ভাব আদান-প্রদানের জন্য আদর্শ বলে মেনে নিলেও অধিকাংশ পরিচিত মানুষের সংকট ক্রমশ বেড়েছে। প্রয়োজনীয় সব কিছুই তাঁদের আয়ত্তে আছে, এমন এক সবজান্তা ভাব জাহির করা সত্ত্বেও নিজেদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান বিষয়ে নড়বড়েই রয়ে গেলেন তাঁরা। এমনকি, নিজের বাস্তব অবস্থান নির্ণয় যে জরুরি, সেই বোধটিও তাঁদের মধ্যে অনুপস্থিত। প্রতি পদে নিজেদের অসুরক্ষিত ভাবকে লুকানোর জন্য হয় তাঁরা অরাজনৈতিক বা অ্যাপলিটিকাল হওয়ার ভান করছেন, নয়তো সেই রাজনীতিরই আশ্রয় নিচ্ছেন, যা তাঁদের চোখে অল্পক্ষণ আগেই ছিল দুর্নীতিগ্রস্তদের ডেরা।
বাহাত্তরে পোঁছে ভারতবর্ষ জরাগ্রস্ত হয়েছে কিনা জানি না। তবে সাধারণ ভারতবাসী এখন প্রকৃত অর্থেই বাহাত্তুরের শিকার। প্রবলভাবে রাজনৈতিক বাদানুবাদে অংশগ্রহণের স্পৃহা তাঁদের বেড়েই চলেছে। আক্ষরিক অর্থে তা হয় ব্যক্তিপূজার ঘটা, নয়তো ব্যক্তিঘৃণার উন্মত্ততা।
এভাবেই ভারতীয় সমাজে মেরুকরণ আজ প্রকটভাবে বাস্তব। এই মেরুকরণ ঘটবার নেপথ্যে গত পাঁচ বছরে যে বিভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা নিয়ে রচিত দলিল যতই তথ্যনিষ্ঠ হোক না কেন, তাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলবার লোকের অভাব ঘটবে না। বিশেষ করে তা যদি আনন্দ পটবর্ধনের মতো সচেতন, মানবধর্মী, যুক্তিনির্ভর এবং ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতার ফলস্বরূপ জনআন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বিশ্বাসী এক অভিজ্ঞ চলচ্চিত্রকারের নির্মাণ হয়। সেই চিহ্নিতকরণ সম্পর্কে আনন্দ ওয়াকিবহাল। তিনি জানেন বর্তমান ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে সঙ্কট যতই তীব্র হোক না কেন, তা ১৯৬৮-তে নির্মিত ফারনান্দো সোলানাসের ‘দ্য আওয়ার অফ দ্য ফারনেস’-এ দেখানো স্বৈরতন্ত্রের কারণে ত্রাহিরব তোলা তৎকালীন লাটিন আমেরিকার অনুসারী হবে না।
তথ্যচিত্রের নির্মাতা যে চরিত্রগুলিকে ক্যামেরার সামনে আনেন, তাঁদের জন্য সংলাপ রচনার প্রয়োজন নেই। বিশেষ পরিস্থিতির নিরিখে তাঁদের নিজস্ব উপলব্ধি থেকে জাত বক্তব্য, এমনকি মৌনতাও ছবিটির অন্যতম উপাদান হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে নির্মাতার অন্যতম দায়িত্ব হল, বক্তার মনে সেই আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করা, যা তাঁকে ছবিটির বিষয় এবং তাতে চরিত্রটির বাস্তব ভূমিকায় নিজেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যক্ত করতে সাহায্য করবে। কাজটি অত্যন্ত কঠিন। বিশেষ করে ছবির বিষয় যদি এমন কিছু ব্যক্তির হত্যার প্রেক্ষাপট নিয়ে হয়, যা সাম্প্রতিক কালে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে লাঞ্ছিত মানুষের মর্মকথাকে তথ্যচিত্রে রূপ দিয়েছেন আনন্দ। তৎকালীন বোম্বেতে উচ্ছেদ হতে যাওয়া ঝুপড়ির সম্বলহীন পরিবারগুলিকে নিয়ে যখন তিনি ‘বোম্বে হামারা শহর’ (১৯৮৫) বানাচ্ছেন, তখন দিনের পর দিন খুব কাছের থেকে দেখেছেন মানুষগুলির রাগ, দুঃখ এবং অসহায়তা। তেমন একটি পরিবারের সদ্যজাত শিশুটির মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন, শিশুটির সৎকার কার্য তিনি চিত্রায়িত করবেন। ছবিটি যারা দেখেছেন, শুধু তাঁরা নন, ছবিটির অন্যতম চিত্রগ্রাহক রঞ্জন পালিতের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে সেই মুহূর্তটি যখন চাটাই মোড়া ছোট্ট দেহটিকে ঝুপড়ি থেকে বার করে আনছেন সন্তানহারা বাবা এবং তাঁর সাথীরা বিধ্বস্ত মায়ের হাহাকারকে পিছনে ফেলে। পেশাদারিত্বের উৎকৃষ্ট নমুনা হিসেবে দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করলেও, সেই ক্রূর বাস্তবের মর্মবিদারক অভিঘাত রঞ্জনদার মনে এখনও সজীব।
আনন্দ জানেন তিনি কেন ছবিটি বানাচ্ছেন। এবং তার জন্য তিনি সব ধরণের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। ‘রাম কে নাম’ (১৯৯১) ছবিতে এক মদ্যপ করসেবককে আমরা দেখি। রাজনৈতিক প্ররোচনায় হিন্দুত্বের মিথ্যা গর্বকে সোচ্চার করতে করতে সে অযোধ্যায় আসছে ইট নিয়ে। বেসামাল মানুষটির উদ্ধত আচরণকে সহ্য করে আনন্দ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তাঁর ছবিতে আনেন সেই ভাঁড়ামি যা লুম্পেন শ্রেণির রামের নামকীর্তনের সৌজন্যে বীভৎস এক বাস্তবে পরিণত হয়েছিল।
এহেন আনন্দ ‘রিজন/বিবেক’ (২০১৯) ছবিটিতে কিন্তু অতি সংযত। দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক প্রেক্ষাপটের ভরকেন্দ্রটির হদিশ জানা এক প্রাজ্ঞ মানুষের যেমনটা হওয়া প্রয়োজন। ভারতবর্ষে যে মেরুকরণ ঘটমান, অন্যদের মতো তিনিও তা প্রত্যক্ষ করছেন। এবং তার কার্যকারণ সম্পর্কে তিনি সচেতন। একই সঙ্গে তিনি অনুভব করেছেন সারা দেশ জুড়ে তৈরি হওয়া অসহিষ্ণুতার তপ্ত বাতাবরণে স্বাভাবিক বোধ এবং যুক্তির পথ থেকে সরিয়ে সাধারণ ভারতবাসীকে অবয়বহীন ভিড়ে পরিণত করা চলছে। জংলি কুকুরের হিংস্রতা নিয়ে যে ভিড়ের একটি অংশ ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এমন মানুষদের উপর, যারা সৌহার্দের কথা বলেন। বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনাকে ছাত্রছাত্রী এবং তরুণ প্রজন্মের মনে সঞ্চারিত করাকেই যারা জীবনের উদ্দেশ্য বানিয়েছেন। অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোয় পৌঁছানোর জন্য যারা বারবার স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতাদের মুখে লাগানো সমাজসেবীর মুখোশ খুলে দিয়েছেন হ্যাঁচকা টানে। এবং শেষ অবধি সেই নেতাদেরই নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন তাঁরা।
সেই তালিকায় আছেন মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতির সভাপতি ডাঃ নরেন্দ্র অচ্যুৎ ডাভোলকর যিনি ২০১৩ সালের ২০শে আগস্ট পুনের রাস্তায় অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে প্রাণ হারান ১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১৫-য়। একইভাবে অজ্ঞাত বাইকচালকের উদ্যত বন্দুকের গুলিতে গোবিন্দ পানসারে এবং তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। শিবাজি মহারাজের বিতর্কিত জীবনী ‘শিবাজি কৌন হতা’র রচয়িতা এই আইনজীবী এবং বামপন্থী রাজনীতিবিদকে ডাভোলকরের অসম্পূর্ণ কাজের দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি হিন্দু রাষ্ট্র সেনা। নির্মোহ ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মারাঠা নায়ক শিবাজির মুসলমান ঘৃণাকে তুলে ধরাটাই ছিল পানসারের অন্যতম অপরাধ। আনন্দের ‘রিজন/বিবেক’ তথ্যচিত্রের প্রথম তিনটি পর্ব এনাদের হত্যার প্রেক্ষাপট নিয়েই। চতুর্থ পর্বে আনন্দ আমাদের দেখান ডাভোলকর এবং পানসারে যে কুসংস্কার-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের অবর্তমানে সেই জনআন্দোলন মহারাষ্ট্রে তথা সমগ্র ভারতে কী অভিঘাত সৃষ্টি করে। সেই সময়ে এই আন্দোলনের বিপ্রতীপে সনাতন হিন্দু সংস্থার যে আচারভিত্তিক প্রচার চলে, আনন্দের ছবির পঞ্চম পর্বটি তা নিয়েই। এখানে আমরা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা জয়বন্ত আঠবালেকে বলতে শুনি, স্বর্গ থেকে এক দৈবশক্তি ধরণীতে নেমে অচিরেই ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করবে। এবং তা গণপতি এবং বিষ্ণুর মূর্তিপুজার মাধ্যমেই যে ঘটবে, তাঁর সঙ্কেত পাওয়া যায় ষষ্ঠ পর্বে। উৎসবের জোয়ারে মানুষের এই ভেসে যাওয়া দেখানোর মাঝখানে বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে আনন্দ স্পষ্টভাবে জানিয়ে এই মূর্তিগুলিতে ব্যবহৃত রঙে যে পরিমাণ পলিমার আছে, তা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
পরবর্তী পর্বটিতে আনন্দ আমাদের দেখালেন কেমনভাবে ইন্টারনেটে লাইভ স্ট্রিম করে সনাতন হিন্দু সংস্থা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে যাচ্ছে। অষ্টম পর্বটিতে দেখতে দেখতে আমাদের মনে পড়বে উত্তর প্রদেশের দাদরি গ্রামে গোমাংসকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালে কেমনভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপট রচনা করা হইয়েছিল। গণপিটুনিতে নিহত মহম্মদ আখলাখের বাড়ির ফ্রিজে রাখা মাংসটি যে গরুর নয়, তা পরবর্তীকালে প্রকাশ্যে আসে বটে। কিন্তু হিন্দু রাষ্ট্রবাদীদের হিংস্র কার্যকলাপ তখন থেকেই নতুন করে আবার ছড়িয়ে পড়ে দেশে। এরপর ২০১৬ সালে গুজরাটের উনা গ্রামে সাতজন দলিত যুবকের উপর বর্বর আক্রমণ শানায় উচ্চশ্রেণির হিন্দু-নন্দনেরা। গোমাতার প্রতি প্রেম এবং দলিত শ্রেণির মানুষের প্রতি ঘৃণা যে আরএসএস প্রতিষ্ঠানের হিংস্র সাম্প্রদায়িকতার এপিঠ আর ওপিঠ, তা আনন্দের ছবির পরবর্তী দুটি পর্বে বিস্তারিত হয়। একাদশ পর্বে আনন্দ আমাদের নিয়ে যান হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে। যেখানে ২০১৬-র ১৭ই জানুয়ারি রোহিত ভেমুলা আত্মহত্যা করেন। আমাদের মনে পড়বে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ তার কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুজফফরনগর বাকি হ্যাঁয়’ তথ্যচিত্র প্রদর্শনে শুধু বাধাদানই করেনি, কর্তৃপক্ষ এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির কাছে আয়োজকদের বিরুদ্ধে লিখিত নালিশ জানায় এবং তার জেরে রোহিত সহ আর চার ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাসপেন্ড করা এবং হোস্টেল থেকে বিতারিত করবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সরকারি সেই আদেশ এসে পৌঁছানোর পরই রোহিত আত্মহত্যা করে। আনন্দের ছবির পরবর্তী তিনটি পর্ব হল ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে মোদি সরকারের প্রকাশ্য যুদ্ধের বিবরণ। মনে পড়বে হয়তো, রিপাবলিক টিভি-র অর্ণব গোস্বামীর চিল চিৎকারে ‘টুকরা টুকরা গ্যাং’ শব্দটি ভারতীয় রাজনীতির অভিধানে তখন থেকেই যুক্ত হয়। জেএনইউ-তে কানহাইয়া কুমার এবং উমর খালিদকে কারাবাস করতে হয় এই অপরাধে যে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ভারতবিরোধী স্লোগান দেন। এখান থেকে আনন্দ ফিরে আসেন তাঁর ছবির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুতে। কট্টর হিন্দুবাদ যে সন্ত্রাসবাদেরই এক রূপ, তার বিশদ আলোচনায়। বীর সাভারকারের হিন্দুত্ব প্রচারের বিপজ্জনক দিকগুলি সম্পর্কে দর্শকদের সচেতন করবার মধ্যে দিয়েই ছবিটি শেষ হয়।
না, আনন্দ পটবর্ধন এই ছবিটিতে কোনও এমন কথা বলেননি, যা আমরা জানি না। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন সময়ে আমরা এই ঘটনাগুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখে উত্তেজিত হয়েছি, বিকল্প রাজনীতির প্রতি আস্থা রেখেছি, নিরাশ হয়েছি এবং সম্ভবত ভুলে গিয়ে হিন্দুত্বের এই নব উত্থানকে নিয়তির মতো মেনে নিতেও শুরু করেছি। আনন্দ সেই ঘটনাগুলিকেই ষোলটি পর্বের একটি মালা সাজিয়ে ঐতিহাসিক একটি ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। পর্বগুলির নির্মাণে যে যুক্তিনিষ্ঠা আনন্দ দেখিয়েছেন, তা অভিপ্রেতই ছিল। কিন্তু এটাও ঠিক, যে সাম্প্রতিক কালে ঘটা ইঙ্গিতবাহী কিছু ঘটনার এমন শীতল ব্যবচ্ছেদ তার দীর্ঘসূত্রিতার কারণেই হয়তো কিছুটা ক্লান্তির জন্ম দেয়। কারণ, চিত্রনির্মাতা এখানে আদৌ নতুনের পিয়াসী নন। পর্বগুলি দেখতে দেখতে কেন জানি না মনে হচ্ছিল এমন একটি পরিসরে পৌঁছে গেছি, যেখানে চারপাশের মানুষজন আধুনিক সময়ের খণ্ডিত সত্তাকে আপন করে নিতে ব্যগ্র। তার মাঝখানে প্রাজ্ঞ এক মানুষ ধীরেসুস্থে সবাইকে বোঝাচ্ছেন গতকাল যা ঘটেছে, তা তুচ্ছ নয়। কারণ, আজ আমরা যা হয়েছি, তা ওই গতকালের জের। আর আজ আমরা যা কিছু করে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করব, আগামীকাল আবার তা আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনবে।
‘রিজন’ ছবির পর্বগুলির ইউটিউব লিংক
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব
সপ্তম পর্ব
অষ্টম পর্ব
নবম পর্ব
দশম পর্ব
একাদশতম পর্ব
দ্বাদশতম পর্ব
ত্রয়োদশতম পর্ব
চতুর্দশতম পর্ব
পঞ্চদশতম পর্ব
ষোড়শতম পর্ব