বিষাণ বসু
পরিস্থিতি জটিল। খুবই জটিল। ময়দানে দলবদলের মরসুমে অনেকরকম ব্যাপার হত বলে শুনেছিলাম। জীবন-পল্টু জুটি নানা কিসিমের ট্যাকটিক্সে প্লেয়ার তুলে আনতেন। রোমাঞ্চকর সেসব গল্প। কিন্তু, বিখ্যাত বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ধরে বলা যায়, সেসব এখন অতীত। ময়দানি ক্লাব, দলবদলের উত্তেজনা সবই স্পনসরদের দয়ানির্ভর।
কাজেই, ওই রাজনীতির ময়দানটুকুই ভরসা। সেইখানেও, ইদানিং, খেলা খুব প্রেডিক্টেবল। বিদ্যাচরণ শুক্লার মতো উঁচুমানের প্লেয়ার এখন আর কই, যিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে জানতে পারতাম, উনি এই ভোটে অমুক দলের প্রার্থী ছিলেন!! তেমন করে একদম সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ দলবদল করতে পারার উদারতা আজ বিরল। অথবা রাজ্যের এক তরমুজ নামে খ্যাত নেতা, যিনি কখন কংগ্রেস, কখন তৃণমূল, সে রীতিমতো ক্যালেন্ডারের পাতায় মার্ক করে না রাখলে বোঝা মুশকিল।
কিন্তু, এখন, কী আর বলব মশাই, মিডিওক্রিটির রমরমা। সেই মানের প্লেয়ার নেই। সব্বাই প্রেডিক্টেবল। চুরির দায়ে সিবিআই ধরতে এলেই দলবদল। আবার দলবদল করার সাথে সাথেই পুরনো দলের নেতারা জানাবেন, উনি তো আগাগোড়াই কোরাপ্ট ছিলেন, অসামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে, ওই আর কি, খেলাটায় মজা থাকছে না, সাসপেন্স তো নেইই।
প্রায় ওই রাহুলজি-মোদিজির লেভেলে প্রেডিক্টেবল। একজন যদি ধর্মীয় উসকানি দেন, বা দাঙ্গা বাধিয়ে বা দাঙ্গা নিয়ে চুপ থেকে ভোটের ফায়দা তোলেন, তো আরেকজন ভোটের মুখে বিচিত্র সনাতনী সাজে মন্দিরে মন্দিরে হত্যে দিয়ে “ধর্মনিরপেক্ষতার” পরাকাষ্ঠা দেখান। কাজেই, কী বুঝলেন? এদিকে, একটুআধটু আনপ্রেডিক্টেবিলিটি না থাকলে ভোটের আগের দিনগুলো কাটানোই তো মুশকিল!! এমনকি, প্রকাশবাবুর মতো ক্যারেক্টারও প্রকাশ্যে নেই, যিনি কিনা জয়ললিতা-মায়াবতীকে নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে পারেন (অবশ্য, জয়ললিতাজিও তো আর নেই)।
তাহলে কি আমরা এমনভাবেই বোর হব? শেষমেশ অমিতজির ভাষণের ক্লিপিংস দেখেই কাটবে ভোটের আগের সন্ধে? যোগী আদিত্যনাথকেও সিরিয়াসলি নিতে হবে স্রেফ সন্ধেটুকু পার করার স্বার্থে!!!
অন্যদিকে, আপনাকেও বলি, একখানা রাজ্যজুড়ে কয়েক সপ্তাহ জুড়ে দাঙ্গা বাধানোয় অভিযুক্ত নেতা যে দেশে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, সেইখানে সামান্য একখানা বিস্ফোরণের অভিযোগ থাকার কারণে আরেকজন প্রার্থী হতে পারবেন না, এ আপনার কেমন বিচার!! আরে সামান্য অভিযোগই তো, জেল-হাজত-ফাঁসি তো আর হয়নি। ভোটের প্রচারে গিয়ে একজন যদি বলেন যে, তিনি সাধুসন্ত মানুষ, তাঁকে ভোট না দিলে তিনি অভিশাপ দেবেন, বা আরেকজন নিজের অভিশাপের অব্যর্থতা প্রমাণ করতে যদি এক কিংবদন্তি পুলিশ অফিসারের মৃত্যুর প্রসঙ্গ তোলেন, তাইতেও অবাক হওয়ার যুক্তি আছে কি?? আপনি যদি এইসবে সিরিয়াসলি বিচলিত হন, তাহলে মানতেই হবে, আপনি একেবারেই নাদান, আপনি এমনকি এও বিশ্বাস করে বসতে পারেন, যে, নির্বাচন কমিশন সত্যিসত্যিই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করাতে চাইছেন!
মশাই, মোদ্দা কথাটা বুঝুন, আপনি হাজার চাইলেও আমড়া গাছে হিমসাগর আম ফলবে না। আর, চোখ বুঁজে প্রার্থনার শেষে তাকিয়ে গাছভর্তি আমড়া দেখে যদি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, তাহলে তো……
এদিকে খেয়াল করেছেন কি, সামনের মুখোশগুলো বড্ড প্রেডিক্টেবল এবং কোনও-কাজের-নয় প্রমাণ হওয়ার আশঙ্কায় আসল খেলোয়াড়েরা ড্রেসিংরুম থেকে সরু করিডোর ধরে হাঁটা শুরু করেছেন!!! স্টার অভিনেতা ডুবিয়ে দিতে পারেন, এই আশঙ্কায় স্বয়ং পরিচালক সাজঘরে— সিনেমাটা বাঁচানো যাবে কি এ যাত্রা!!! কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা শুনিয়ে দিই তাহলে।
রতনবাবু, মানে আমাদের রতন টাটা, দুটি বছর আগেই জানিয়েছিলেন, মোদিজির দক্ষ নেতৃত্বে দেশের চেহারা বদলে যাবে। ভুক্তভোগীমাত্রেই সে বিষয়ে সহমত হবেন অবশ্য। পাঁচটি বছরেই দেশের চেহারা বদলে গিয়েছে, আর পাঁচটি বছর হয়ে গেলে তো দেশটিকে নিজের দেশ বলে চেনবার জো থাকবে না।
রতনবাবু এককথার মানুষ। দুবছর আগের সেই সভায়, সঙ্ঘপ্রধান জানিয়েছিলেন, রতনবাবু ব্যক্তিগত সম্পদের লোভে নয়, দেশের উন্নতির জন্যে কাজ করেন, তিনি কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী, কর্মযোগী মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি।
হ্যাঁ, আবারও মনে করিয়ে দিই, রতনবাবু এক কথার মানুষ। এই ভোটের বাজারে তিনি আবার হাজির হয়েছেন সঙ্ঘের অফিসে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, ওরফে আরএসএস। কারণ? আঃ, আপনি কি একেবারে কিছুই বোঝেন না!!! এইসব কেসে যা হয়, সৌজন্য সাক্ষাৎ।
আরেক দিকে, পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার গতি বদলানোর বিষয়টিও আছে। মানে, সিচ্যুয়েশন অনুযায়ী খেলা। বড় প্লেয়ারদের অন্যতম গুণ— একদিকে তাঁরা ম্যাচটাকেই কন্ট্রোল করতে পারেন, অন্যদিকে ম্যাচের পরিস্থিতি অনুসারে তাঁরা নিজেদের খেলাটাকে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারেন।
অতএব, আমাদের মুকেশজি, পারিবারিক বিবাহ-অনুষ্ঠানের হইহট্টগোল পার করে একটু থিতু হয়েই জানিয়েছেন, দক্ষিণ মুম্বাই লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থীই উপযুক্ত। কী বুঝলেন??
অবশ্য, এত বোঝাবুঝিরই বা আছেটা কী?? নির্বাচন-সরকার এইসব তুচ্ছ জাগতিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোরই বা আছেটা কী!!
স্বয়ং সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত জানিয়েছেন, সরকার নিয়ে ভেবে লাভ কী!! সরকার পাঁচ বছর বাদে বাদে বদলে যেতেই পারে, এই সরকারও পারে। সেই নিয়ে ভাবা নিষ্প্রয়োজন। সামাজিক সংগঠনগুলিকে সরকারের কথাবার্তা না ভেবেই কাজ করে চলতে হবে, নিজেদের দায়িত্ব নিজেদেরই সামলাতে হবে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ একটি বিশেষ দর্শনে বিশ্বাস করেন, এবং অন্যদেরও সেই দর্শনে বিশ্বাস করাতে চান— এই কথা তো, এমনকি আপনিও জানেন।
কিন্তু, এমন দার্শনিক সঙ্ঘপ্রধান দেখেছেন কি? বা, বলা ভালো, সঙ্ঘপ্রধানকে এমন দার্শনিক রূপে পেয়েছেন কি??
এগুলো স্রেফ কিছু ছোট ছোট টুকরো, আপনার ছুটির সকালটা কাটানোর জন্যে। এইবার আপনি যদি এইসব টুকরোগুলোকে জুড়ে জিগ-শ পাজলের স্টাইলে একখানা বড় ছবি পেতে চান, তার দায়িত্ব আপনার— সেই ভাবনার জন্যে কোনওভাবেই কোম্পানি দায়ী নহে।
আরে, আপনিই তো বলছিলেন, বোর হচ্ছেন খুব!! সেইজন্যেই না এত্তসব গল্প ফেঁদে বসলাম।
ব্যস, তাহলে আর দোটানার কী আছে, এইবার পোস্ট করেই দিন, ফিলিং হ্যাপি উইথ লোকসভা দুহাজার উনিশ।