আদালত ও একটি মেয়ে

কৌশিক দত্ত

 

ভারতের বিচারব্যবস্থা বিভিন্ন সময়ে নানারকম প্রতিকূলতা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। আইন ও বিচারের প্রতি দেশের নাগরিকদের আস্থা বা শ্রদ্ধাও সর্বোত্তম পর্যায়ে নেই অনেকদিন ধরেই। এই সবই সত্য। তা সত্ত্বেও বলতে হবে এই মুহূর্তে শীর্ষ আদালত তথা সমগ্র বিচারব্যবস্থা একটি অভূতপূর্ব সঙ্কটের সম্মুখীন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মাননীয় রঞ্জন গগৈ মহাশয়ের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন আদালতের একজন সদ্য-প্রাক্তন সহকারী। ১৯৯৭ সালের বিশাখা গাইডলাইন থেকে শুরু করে ২০১৩-র “Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition and Redressal) Act” হয়ে গত দুই-আড়াই দশকে ভারতীয় নারী শ্রমিকদের (অন্তত সংগঠিত ক্ষেত্রের শিক্ষিতা কর্মচারীদের) কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেবার ব্যাপারে কিছু অগ্রগতি অবশ্যই হয়েছে, কিন্তু সমস্যা আর বিতর্ক এই ক্ষেত্রটিকে আজও জড়িয়ে আছে। সব প্রতিষ্ঠানেই (যেখানেই দশজন বা তার বেশি মানুষ কাজ করেন) এই জাতীয় অভিযোগের শুনানি, তথ্যানুসন্ধান, বিচার ইত্যাদি সম্পন্ন করার জন্য নির্দিষ্ট কমিটি (Internal Complaints Committee) থাকার কথা এবং সরকারি উদ্যোগেও জেলাস্তরে (প্রয়োজনে ব্লক স্তরেও) স্থানীয় কমিটি (Local complaints committee)। সুপ্রিম কোর্টও একটি প্রতিষ্ঠান, অতএব সেখানেও অভ্যন্তরীণ কমিটি তথা “Supreme Court Sexual Harassment Regulations” নামক গাইডলাইন আছে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের নিষ্পত্তি করার জন্য। সমস্যা হল, ইতোপূর্বে কোনও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কখনও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠেনি, তাই ঠিক কীভাবে এরকম ক্ষেত্রে বিচারের আয়োজন করা উচিত, তার কোনও বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা নেই। তবে সব বিষয়ে লিখিত বিধি না থাকলেও সেখানে একটা নিয়মানুবর্তিতা থাকে, যা নির্ধারিত হয় মানুষের সাধারণ বোধ, এথিক্স এবং আইনের মৌলিক নীতিগুলোর দ্বারা। এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ঘটনা পরম্পরা অনেক নীতি এবং বোধকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

বিষয়টি এতটাই জটিল যে তা নিয়ে লিখতে চেষ্টা করাই আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। এই বিষয়ে লেখা উচিত কোনও অভিজ্ঞ নারীবাদী নেত্রীর অথবা আইনজ্ঞের। দুটোর মিশেল থাকলে সবচেয়ে ভালো। কিন্তু জানা গেল, সম্পাদক চাইছেন একদম সাধারণ মানুষের কথা, যে আইনজীবী নয় এবং নারীবাদের চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে, উপরন্ত বিষয়টি নিয়ে এতটাই বিভ্রান্ত যে বাদী বিবাদী কারও পক্ষ অবলম্বন করে ফেসবুকে একটিও পোস্ট করেনি। এরকম লেখক নির্বাচন করার একটা ভালো দিক হল এই যে তার কথা বেশিরভাগ সাধারণ ভারতবাসীর বোধ বা ধারণারই প্রতিনিধিত্ব করবে। সোশাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয় যে সকলে আমাদের মতো অনিশ্চিত নন, অনেকেই বিষয়টি নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন। একদল নিশ্চিত যে রঞ্জন গগৈ অপরাধী এবং তিনি নিজের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে অভিযোগকারিণীকে আরও বিপদে ফেলছেন। এক্ষেত্রে মূলত এই নারীবাদী নীতিতে আস্থা রাখা হচ্ছে যে অভিযোগকারিণীর বয়ানকেই প্রাথমিকভাবে সত্য বলে ধরে নিতে হবে (যদিও সেই নীতি এতটা নিশ্চিত হবার কথা বলে না)। আরেকদল (এই দল বোধহয় বৃহত্তর) ততটাই নিশ্চিত যে গগৈ নির্দোষ এবং তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে সন্দেহের তীর বিজেপির দিকে। বিজেপি এমনিতেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে আদালত, বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য বিখ্যাত এবং শ্রী রঞ্জন গগৈয়ের সঙ্গে সংঘ পরিবারের সম্পর্ক ভালো নয় বলে শোনা যায়, তার ওপর গগৈ সাহেবের কোর্টে নাকি আবার রাফাল মামলার শুনানি হবার কথা। সুতরাং দু’য়ে দু’য়ে চার করে বলাই চলে যে নির্বাচনের আগে মামলাটির শুনানি হতে না দেবার জন্য বিজেপি রঞ্জনবাবুকে মোক্ষম বাণ মেরেছে।

যারা এত স্বচ্ছভাবে ব্যাপারটা বুঝে ফেলতে পারেনি, তারা কীরকম বুঝেছে, কতটুকু বুঝেছে, তা এবার দেখা যাক। এই নির্দিষ্ট ঘটনাটির কথা এবং আইনের জটিলতা বাদ দিয়েও কয়েকটা মূল নীতি আমরা মোটামুটি বুঝি বা মানি।

  1. কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা মহিলাদের পেশাগত বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। হেনস্থার শিকার মহিলার মানসিক স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা প্রবল। অতএব এই বিষয়ে ওঠা যেকোনও অভিযোগ গুরুতর। সেগুলির যথাযথ বিচার হওয়া উচিত। দোষীর প্রয়োজনীয় শাস্তির পাশাপাশি, নির্যাতিতার ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থার দায়িত্ব চাকুরিদাতার এবং সরকারের।
  2. ভারতীয় সংবিধান অনুসারে সুবিচার পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার। তাই যে কেউ এখানে বিচার পাবার অধিকারী। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেও সাধারণ নাগরিক সুবিচার চাইতে পারেন। পাশাপাশি একথাও মনে রাখতে হবে যে অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত, উভয়েই সুবিচার পাবেন, এটাই সংবিধানসম্মত।
  3. আদালতের স্বাধীনতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সত্যি আদালত বা বিচারকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা বা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হচ্ছে কিনা, হলে কে করছে, তাও দেখা দরকার। আদালত এবং সংসদ, উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ। সংসদ শীর্ষ আদালতের চেয়ে বড়, এমন ধারণা কিছু মহলের আছে, কিন্তু সংসদ বা মন্ত্রীমণ্ডলী আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করলে তা অমঙ্গলজনক। যদি ব্যবসায়ী আর বাহুবলীরা সংসদের পাশাপাশি আদালতকেও নিয়ন্ত্রণ করেন (আজকাল করছেন বলে শোনা যায়), তবে তো মধ্যরাত্রি সমাগত।
  4. আদালত ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা জরুরি এই প্রতিষ্ঠান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেই। একই যুক্তিতে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ে কোনও ব্যক্তি বড় নন, এমনকি প্রধান বিচারপতিও নন। কোনও ব্যক্তি নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতেও পারেন না, এমনকি প্রধান বিচারপতিও না। অতএব প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগমাত্রকেই আমরা বিচারব্যবস্থার ওপর আঘাত বলে ধরে নিতে পারি না, ঠিক যেমন নরেন্দ্র মোদি সাহেবকে প্রশ্ন করা মানেই দেশদ্রোহিতা নয়।  অবশ্যই ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান বা অন্য কোনও দেশকে সাহায্য করার জন্য মোদিবাবুকে আক্রমণ করলে তা দেশদ্রোহ। তেমনি বিচারব্যবস্থাকে পঙ্গু করার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে ফাঁদে ফেললে তা বিচারব্যবস্থার ওপর আঘাত এবং একপ্রকার রাষ্ট্রদ্রোহ বলে গণ্য হতে পারে। কিন্তু এসব তকমা ব্যবহার করা যাবে তথ্যানুসন্ধান ও বিচার সম্পন্ন হবার পর। শুরুতেই এই ধরনের অতিকথন দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক নয়।
  5. কোনও ব্যক্তি উচ্চপদে আসীন, শিক্ষিত বা উচ্চবংশজাত বলেই তিনি বিচারের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না গণতান্ত্রিক দেশে। বিচারক অপরাধ করতে পারেন না, এমন ধরে নেবার কারণ নেই। ক্যান্সার চিকিৎসকও ধূমপান করেন এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞও হার্ট অ্যাটাকে মারা যেতে পারেন। পেশা মানুষের শারীরিক বা নৈতিক স্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ নয়।
  6. ছোটবেলায় দুনিয়ার সেরা বিচারক হিসেবে আমরা রাজা সোলেমানের গল্প পড়েছি। এমনকি তিনিও নিজের বিচার নিজে করতে পারতেন না। পারেন বলে দাবি করলেও একবিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে তাঁকে সেই অধিকার দেওয়া হত না।
  7. যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ, গৃহ-হিংসা ইত্যাদির ক্ষেত্রে অভিযোগকারিণীর  বয়ানকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, প্রাথমিকভাবে তাঁর কথাতেই ভরসা রাখা উচিত, এই নীতি আমি মানি। আমরা অনেকেই মানি। কর্মক্ষেত্রে সাধারণত হেনস্থার শিকার হওয়া মহিলা ক্ষমতার সিঁড়িতে কয়েক ধাপ নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন। সুতরাং তাঁকে কিছুটা প্রাথমিক সুবিধা না দিলে তিনি লড়তেই পারবেন না। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করা দুষ্কর এবং পুরুষতান্ত্রিক (পিতৃতান্ত্রিক না বলে পুরুষতান্ত্রিক বললাম বিশেষ কারণবশত) পরিবেশে শুনানি চলে এমন পদ্ধতিতে যাতে নির্যাতিতা দ্বিতীয়বার নির্যাতিত হন। সেই দ্বিতীয় নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে অনেকে প্রথম নির্যাতন মুখ বুজে মেনে নেন এবং তার ফলে বারবার একইরকম অপরাধের শিকার হতে থাকেন।
  8. এই যুক্তির পরিপূরক হিসেবে বলব, অভিযোগকারিণীর বয়ানে প্রাথমিকভাবে আস্থা রাখা মানে এই নয় যে শুরু থেকে শেষ অব্দি তাঁর সব কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করতে হবে। তাহলে তো বিচারের প্রয়োজনই নেই। মহিলারা মিথ্যে কথা বলতে পারেন না, এই বিশ্বাসও একরকম ধর্মীয় কুসংস্কার। বাস্তবে জরায়ুর সঙ্গে বিবেকের কোনও সম্পর্ক নেই৷

এই কটি মৌলিক বোধের ভিত্তিতে এই নির্দিষ্ট ঘটনা বা “কেস”টি সম্বন্ধে আলোচনা করি। এতদিনে কেসটি সম্বন্ধে প্রায় সকলেই জানেন, তাই মূল ঘটনাগুলোর কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করলেই চলবে। এই মামলাটিতে ধাঁধা হল এই যে এখানে অভিযুক্ত স্বয়ং বিচারক এবং অভিযোগকারিণী স্বয়ং অভিযুক্ত। গুলিয়ে গেল তো? ভালো খবর। এই গোলানো থেকেই শুরু করা যাক।

উনিশে এপ্রিল তারিখটা এতদিন শুধু বাঙালিদের কাছে বিশিষ্ট ছিল প্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষের সৌজন্যে। এবার সেটি সর্বভারতীয় বিশিষ্টতা লাভ করল যখন ওই তারিখে শীর্ষ আদালতের এক প্রাক্তন মহিলা-কর্মী সরাসরি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনলেন। তিনি অভিযোগ জানানোর যে পদ্ধতি বেছে নিলেন, তা অভিযোগটির মতোই অভিনব। “দ্য ওয়্যার”, “স্ক্রল”, “ক্যারাভান” ও “দ্য লিফলেট” নামক চারটি ওয়েব পত্রিকার দপ্তরে তিনি একটি লিখিত এফিডেবিট পাঠালেন নিজের অভিজ্ঞতা বিশদে জানিয়ে। (“দ্য ওয়্যার”-এর জনৈক সাংবাদিক নিজের প্রতিবেদনে এই বিবরণকে “কাফকা সুলভ” আখ্যা দিয়েছেন।) সুপ্রিম কোর্টের বাইশজন বিচারকের কাছেও তিনি লিখিত অভিযোগ জানান প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে। চারটি সংবাদপত্র পত্রপাঠ রঞ্জন গগৈকে ইমেইল করে। সেখানে তারা একইরকম প্রশ্নমালা পাঠায় এবং দশ ঘণ্টার কম সময়ে উত্তর চায়। অভিযোগগুলি ওয়েব পত্রিকা মারফৎ প্রকাশ্যেও চলে আসে।

প্রশ্ন ও অভিযোগের মুখোমুখি হয়ে প্রধান বিচারপতি যা করলেন, তা আরও অভিনব এবং চমকপ্রদ। তিনি রাতারাতি একটি তিন সদস্যের বেঞ্চ তৈরি করে ফেললেন “এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে” জরুরি ভিত্তিতে শুনানির আয়োজনকল্পে এবং পরদিন (শনিবার, ২০ এপ্রিল) সকালবেলা নিজেই নিজের বিচারক হয়ে বসলেন। জাস্টিস অরুণ মিশ্র, জাস্টিস সঞ্জীব খন্না এবং নিজেকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চে তিনি নিজেই কথা বললেন, অভিযোগটিকে উড়িয়ে দিলেন, সেটাকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিলেন, নিজে সেই সওয়াল শুনলেন, রায় দিলেন এবং তাতে সই করলেন না। শীর্ষ আদালতের সেক্রেটারিও ততক্ষণে দায়িত্ব নিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে অভিযোগগুলি সর্বৈব মিথ্যা। ইন্দিরা জয়সিং, বৃন্দা গ্রোভারের মতো আইনজীবীরা বিচারপতি গগৈয়ের আচরণের সমালোচনা করলেন।

সমালোচনার ক্ষেত্রটি দেখা যাক। বিচারপতি গগৈ প্রাথমিক শুনানির বেঞ্চে রীতিমত উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও রায়ে সই করেননি। বলা যেতে পারে, কেউ কীভাবে নিজের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনও রায়ে সই করতে পারে? কোনও বিচারক যদি কোনও কারণে নিজেকে বিচার প্রক্রিয়া থেকে কোনও সময়ে সরিয়েও নেন, শুনানির সময় বেঞ্চে উপস্থিতির স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁর স্বাক্ষর থাকার কথা। পরবর্তী প্রশ্ন হল, রায়ে সই করতে আটকায় যে নীতিতে, সেই একই নীতি অনুযায়ী কেউ কি নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের শুনানি নিজেই পরিচালনা করতে পারেন? অত তাড়াতাড়ি শুনানির প্রয়োজন ছিল কি? সোমবার ঠান্ডা মাথায় সব ব্যবস্থা করা যেত না? প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলে এটাই প্রত্যাশিত যে প্রবীণতম বিচারকেরাই তাঁর বিচার করবেন। অথচ বেঞ্চে রাখা হল অনেক কমবয়সী সঞ্জীব খন্নাকে? কেন? তিনি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না বলে? অভিযোগকারিণীকে চিঠি না দিয়ে তাঁর অনুপস্থিতিতে একতরফা এরকম একটি শুনানির আয়োজন করে সেখানে অভিযোক্তার চরিত্রহনন করা কি অনৈতিক নয়? এরকমভাবে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবার পরে এই সন্দেহ তো জাগতেই পারে যে অভিযোগকারিণী আদৌ সুবিচার পাবেন না, কারণ সুপ্রিম কোর্ট নামক প্রতিষ্ঠানটি গোড়া থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে।

কোর্ট বা বড় কোনও শক্তি যে তাঁর বিরুদ্ধে, তা অভিযোগকারিণী ইতোমধ্যে টের পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। নিজের বিস্তারিত বয়ানে তিনি জানিয়েছেন কীভাবে বিচারপতি গগৈ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পক্ষপাত দেখাতে শুরু করেন, জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিতে থাকেন, তারপর একদিন তাঁকে লাইব্রেরি থেকে নিজের বাসভবনের অফিসে বদলি করেন, তাঁকে ও তাঁর স্বামীকে বড় বড় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেন, নিজের স্ত্রী ও মেয়ের পরেই তাঁকে সবচেয়ে আপনজন বলে ঘোষণা করেন এবং শেষে একদিন শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেন। এই ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসের ১০ ও ১১ তারিখে। ঘনিষ্ঠতার মুহূর্তের বিশদ বর্ণনা আছে অভিযোগে, যার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে একেবারে অবিশ্বাস্য তেমন কিছু নেই। তিনি প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েও পরে শারীরিকভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন দেখা যাচ্ছে এবং তাঁর ধাক্কায় প্রবীণ বিচারক সামান্য আহত হন বলেও জানা যাচ্ছে। এরপর থেকেই শুরু হয় তাঁর দুঃখের দিন। তিনি প্রধান বিচারপতির বাসভবন থেকে বদলি হন প্রথমে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড প্ল্যানিং-এ, তারপর মেটিরিয়াল সেকশনে এবং শেষে আবার লাইব্রেরিতে। উনিশে নভেম্বর তাঁকে একটি মেমোরান্ডাম দেওয়া হয় এবং তিনটি অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য ১৩ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় ইনকোয়ারি অফিসার সূর্য প্রতাপ সিংহের সামনে হাজির হতে বলা হয়। তিনি না এলে তাঁকে বাদ দিয়েই (ex parte) অনুসন্ধান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে জানানো হয়। ১৩ ডিসেম্বর তিনি কোর্টে হাজির হয়েও ঠিক শুনানির আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হাসপাতালে চলে যান৷ এরপর ২১ ডিসেম্বর লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়ে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। (যে তিনটি অভিযোগের কথা তিনি জানিয়েছেন এবং তাদের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে অপরাধগুলোকে খুব গুরুতর মনে হয় না। তবে আসল অপরাধ বা অভিযোগের চরিত্র ঠিক তাঁর ভাষ্য অনুসারী নাও হয়ে থাকতে পারে এবং সুপ্রিম কোর্ট নিয়মানুবর্তিতার ব্যাপারে কতটা কড়া হয়ে থাকেন, তাও আমরা সঠিক জানি না।)

এতেই ব্যাপারটা থেমে থাকে না। ভদ্রমহিলার স্বামী এবং ভাসুর দিল্লি পুলিশের চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন। তাঁর এক দেবর, যিনি প্রধান বিচারপতির নিজস্ব কোটায় চাকরি পেয়েছিলেন, তিনিও বরখাস্ত হন। শেষ অব্দি ভদ্রমহিলা নিজে গ্রেপ্তার হন। কেন? নবীন কুমার নামক হরিয়ানা নিবাসী এক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন যে এই মহিলা তাঁকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টে একটি চাকরি পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে শেষ অব্দি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। ভদ্রমহিলা জানান যে এই অভিযোগ মিথ্যা এবং গ্রেপ্তার করার সময় তিলক মার্গ থানার পুলিশ তাঁর ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। পরে তিনি যখন জামিনে ছাড়া পান, তখন দেখা যায় তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া এবং প্রতারণার মামলাটি দিল্লি পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চকে দেওয়া হয়েছে এবং সেই বিভাগ তাঁর জামিনের বিরোধিতা করেছে, কারণ ইতোমধ্যে শ্রী নবীন কুমার নাকি অভিযোগ করেছেন যে তাঁকে ভয় দেখানো হচ্ছে।

এই অব্দি পড়ে মনে হয়, এক বড় শক্তি ষড়যন্ত্র করে একটি অসহায় মেয়েকে ক্রমশ গ্রাস করছে। স্পষ্টত প্রধান বিচারপতি যৌন প্রত্যাখ্যান ও প্রতিবাদের প্রতিশোধ নিচ্ছেন। এটা সত্যি হতেই পারে। বস্তুত এমনটা হয়েই থাকে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারা যৌন হেনস্থার শিকার যে মহিলারা হয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা এরকম। ক্ষমতাবান পুরুষ বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে দুর্বল মানুষ এভাবেই কোনঠাসা হয়ে যায়। সুতরাং এই ক্ষেত্রেও তেমনি হয়ে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। তবু কিছু বিষয়ে খটকা থাকতে পারে তদন্তকারীদের মধ্যে।

  1. নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে অভিযোগ না জানিয়ে ভদ্রমহিলা হঠাৎ বাছাই করা চারটি সংবাদপত্রের দ্বারস্থ হলেন কেন? কেনই বা বাইশজন বিচারককে চিঠি লিখলেন? বলা যায়, তিনি হয়ত সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী আচরণ দেখে আর সুবিচার আশা করছিলেন না, তাই অভিযোগ সর্বসমক্ষে এনে চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তবে এই পদ্ধতি অবলম্বনের পিছনে অভিজ্ঞ ও ধুরন্ধর মস্তিষ্কের অবদান রয়েছে, তা অনুমান করা যায়।
  2. ভদ্রমহিলাকে যেসব অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তা আপাতদৃষ্টিতে লঘু, কিন্তু তিনি কেন অনুসন্ধান কমিটির মুখোমুখি হওয়া এড়িয়ে গেলেন, তা স্পষ্ট নয়। তাঁর দাবি অনুসারে তিনি ঠিক শুনানির প্রাক-মুহূর্তে  অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন এবং তাঁকে রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি হাসপাতালের কাগজ দেখিয়েছেন সাংবাদিকদের। ভদ্রমহিলা কোর্টে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং আইনের ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। আইনি প্রমাণ তিনি সঠিক পদ্ধতিতেই সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসক তাঁর অজ্ঞান হবার সত্যতা সম্বন্ধে কিছু জানাননি। হাসপাতালের কাগজে লেখা আছে যে তাঁর সঙ্গীরা জানিয়েছেন যে তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। চিকিৎসক হিসেবে পরীক্ষার আগে, সাংসারিক অশান্তির ফলে বা কোনও বিশেষ চাপের মুহূর্তে এরকম অজ্ঞান হয়ে যাওয়া দেখার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা আছে। সুতরাং বিচারপতির আচরণকে যে আতসকাচ দিয়ে দেখা হচ্ছে, এই অজ্ঞান হয়ে যাবার পর্বটিকেও সেই কাচ দিয়েই দেখতে বাধ্য হচ্ছি। তবে একথা জোর দিয়ে ধরে নেবার কোনও কারণ নেই যে তিনি ইচ্ছাকৃত নাটক করছিলেন। ভয়েও অসুস্থ বোধ করে থাকতে পারেন, এমনকি সত্যি অজ্ঞানও হয়ে থাকতে পারেন।
  3. ভদ্রমহিলা বলেছেন যে বিচারপতি গগৈ তাঁকে কিছু নোট লিখতে বলেন, যাতে মনে হয় মহিলা নিজেই শারীরিক ঘনিষ্ঠতা চেয়েছেন। তিনি তা লিখেও দেন। বোঝা যাচ্ছে বিচারকের কাছে অভিযোগকারিণীর হাতের লেখায় এমন কিছু থাকতে পারে, যাতে প্রমাণ হবে যে ঘনিষ্ঠ হবার প্রস্তাব অভিযোগকারিণীর দিক থেকেই এসেছে। কুটিল ও অভিজ্ঞ বিচারক একজন সন্ত্রস্ত মেয়েকে বোকা বানিয়ে বা জোর করে এসব লিখিয়ে নিয়েছেন, এমন হতেই পারে। কিন্তু সম্ভবত এই বিষয়ে আমরা পরস্পরবিরোধী দাবি শুনব। কে সত্যি বলছেন, তা নিশ্চিতভাবে বোঝার উপায় কী?
  4. এই ঘটনার পরেই তিলক নগর থানার পুলিশ ভদ্রমহিলার পাড়ার ওয়েলফেয়ার কমিটির সেক্রেটারিকে ফোন করে খোঁজ নেন, মহিলার সঙ্গে তাঁর স্বামীর কলহ মিটেছে কিনা। যদি ধরে নেওয়া যায় যে বিচারপতি গগৈ এই ফোন করিয়েছিলেন, তাহলে প্রশ্ন জন্মায়, “কেন?” হঠাৎ এরকম আজব ফোন কেন? ভদ্রমহিলার স্বামীকেও ইতোপূর্বে বিচারপতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, বাদ দেবার চেষ্টা করেননি। তবে কি দাম্পত্য অশান্তি বা গার্হস্থ্য নির্যাতন জাতীয় কিছুর কথা বিচারপতিকে জানিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা? অভিযোগের এফিডেবিটে সেই বিষয়ে কিছু বলা নেই।
  5. পুলিশের চাকরি থেকে সাসপেন্ড হবার পর ভদ্রমহিলার স্বামী বিচারপতি গগৈয়ের কাছে ক্ষমা চাইবার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত আপ্তসহায়ক এইচ কে জুনেজাকে ফোন করেন। জুনেজা সাহায্য করতে রাজি হননি, উপরন্তু পুলিশে কিছু অভিযোগ করেন। পরবর্তী সময়ে তিলক মার্গ পুলিশ পোস্টের স্টেশন হাউজ অফিসার নরেশ সোলাঙ্কির মধ্যস্থতায় তাঁরা প্রধান বিচারপতির বাড়িতে পৌঁছাতে পারেন৷ সেখানে তাঁরা বিচারপতির স্ত্রীর মুখোমুখি হন এবং নাকখত দিয়ে ক্ষমা চান। কেন এই ক্ষমা চাইবার উদ্যোগ? কোন অপরাধের জন্য ক্ষমা? ভদ্রমহিলা বলেছেন যে বিচারপতির স্ত্রী তাঁকে নাকখত দিতে বলায় তিনি বুঝতে পারেন যে গগৈ সাহেব ইতোমধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে স্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে রেখেছেন। কেন নাকখত দিতে হবে না বুঝেও তিনি বাধ্য হয়ে কাজটি করেন। কিন্তু বিচারপতির সঙ্গে দেখা করার এবং ক্ষমা চাইবার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল এর অনেক আগে থেকেই। সেটা কেন, তা পরিষ্কার নয়। উল্টোদিকে এভাবেও ভাবার কারণ আছে যে ভদ্রমহিলার পরিবার তথা দিল্লি পুলিশের কিছু অফিসার বুঝতে পারছিলেন যে বিচারপতির রোষেই ভদ্রমহিলার স্বামী ও ভাসুর সাসপেন্ড হয়েছেন।
  6. নরেশ সোলাঙ্কি যখন এঁদের সাহায্য করার চেষ্টা করছিলেন, তখন এঁরা গোপনে সেই কথপোকথন রেকর্ড করেন, যা পরে সাংবাদিকদের দেওয়া হয়েছে। এতক্ষণ ভদ্রমহিলা বা তাঁর পরিবারকে যতটা সরল, অসহায় মনে হচ্ছিল, এই কাজটির মধ্যে সেই কিছুই বুঝতে না পারা সারল্য অনুপস্থিত। এই রেকর্ড করার পরেই তাঁরা বিচারপতির বাড়ি গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। ততক্ষণে অন্তত তাঁরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করেছেন, এটা স্পষ্ট। সুতরাং সেখানে একজন ভদ্রমহিলার আদেশে একেবারে হতভম্ব হয়ে যাবার কথা নয়। অবশ্য ভয় পেয়ে থাকতেই পারেন।
  7. ভদ্রমহিলার পরিবার আরএসএসের কিছু নেতার ঘনিষ্ঠ এবং তাঁদের মাধ্যমে দিল্লি পুলিশকে এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে ফোন করিয়েছেন এই বিষয়টি নিয়ে। অতএব এঁরা সমাজের দুর্বলতম অংশের মানুষ নন এবং নবীন কুমার নামক চতুর্থ শ্রেণির কর্মপ্রার্থীকে ভয় দেখানোর ক্ষমতা তাঁদের আছে। অবশ্য নবীন ব্যক্তিটি আদ্যন্ত মিথ্যাবাদী হতেই পারেন।
  8. ভদ্রমহিলাকে যেসব অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তা আপাতদৃষ্টিতে মামুলি হলেও যে অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, তা গুরুতর। সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে ঘুষ নেওয়া মারাত্মক অপরাধ। প্রশ্ন উঠেছে, যিনি ঘুষ দিলেন, তিনি গ্রেফতার হলেন না কেন? এই বিষয়ে বহু আলোচনা হয়েছে দুনিয়া জুড়ে। ঘুষদাতা যদি ক্ষমতাশালী কর্পোরেট কর্তা বা মালিক শ্রেণির কেউ হন, তবে তাঁকে গ্রেফতার করাই উচিত। এক্ষেত্রে কিন্তু সেই যুক্তি খাটে না। চাকুরিপ্রার্থী দরিদ্র ব্যক্তিটিকে গ্রেফতার করার বদলে ঘুষ নিয়ে চাকরি দেবার চক্রে যুক্ত অফিসারদের আটক করা সম্ভবত বেশি যুক্তিযুক্ত এবং মানবিক।

পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলেছেন উৎসব বাইন্স নামক আরেক উকিল। তিনি দাবি করলেন যে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্তের প্রমাণ তাঁর কাছে আছে, তাঁকে বিপুল পরিমাণ ঘুষ দেওয়া হচ্ছিল কেসটি করার জন্য (প্রথমে পঞ্চাশ লাখ, পরে দেড় কোটি)। তিনি সৎ ব্যক্তি, সেই ঘুষদাতাকে বিতাড়িত করেন। তিনি আরও দাবি করেন যে অনিল আম্বানির বিরুদ্ধে কোর্টের নির্দেশ গোপনে বদলে দেবার অভিযোগে বরখাস্ত অন্য দুই কর্মীর সঙ্গে যোগসাজশে এই ষড়যন্ত্র হয়েছে। উৎসববাবু ভারি সৎ আর ভালোমানুষ। তাতে আমরা খুশি, কিন্তু তাঁর কিছু আচরণ গোলমেলে। যেমন তিনি প্রধান বিচারপতির বাসস্থানে গিয়েছিলেন, তা মোবাইলের লোকেশন থেকেই বোঝা যাবে, কিন্তু বিচারপতির দেখা পাননি বলে যে দাবি করছেন, সেটার স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ নেই। বিচারপতি গগৈয়ের সঙ্গে বসেই এই পুরো বক্তব্য তিনি রচনা করে থাকতে পারেন, আবার নাও করে থাকতে পারেন। সত্য কী, তা তিনিই জানেন। আবার এত অভিযোগ করার পর সব প্রমাণ দিতে রাজি হননি এবং ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের ১২৬ ধারায় প্রিভিলেজড কমিউকেশন হিসেবে কিছু কথা গোপন করতে চাইছিলেন, যা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত নয়।

এই পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট নিজের মর্যাদা রক্ষা করার মতো কিছু কাজ করতে পেরেছে। জাস্টিস অরুণ মিশ্র, জাস্টিস রোহিনটন নরিম্যান এবং জাস্টিস দীপক গুপ্তর বেঞ্চ উৎসব বাইন্সকে যথেচ্ছ সুযোগ দিয়ে গগৈ সাহেবকে বাঁচানোর পথে হাঁটেননি। বদলে তাঁকে সব প্রমাণ জমা দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগের তথ্যানুসন্ধান করতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ কে পট্টনায়কের নেতৃত্বে বিচারবিভাগীয় কমিটি গঠিত হয়েছে। সিবিআই ও আইবির শীর্ষ কর্তারা বিচারপতি পট্টনায়ককে সাহায্য করবেন।

বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত ও বিচার করতে তিন সদস্যের বেঞ্চ গঠিত হয়েছে। প্রথমে সেই বেঞ্চে ছিলেন জাস্টিস এস এ বোডবে, জাস্টিস এন ভি রামানা এবং জাস্টিস ইন্দিরা ব্যানার্জি। অভিযোগকারিণী এতে আপত্তি জানিয়ে বলেন যে জাস্টিস রামানার সঙ্গে জাস্টিস গগৈয়ের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ, তাই এই বেঞ্চের কাছে তিনি সুবিচার আশা করেন না। জাস্টিস রামানা অবিলম্বে সরে দাঁড়ান। জাস্টিস ইন্দু মালহোত্রা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। এটি অবশ্যই একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। যৌন হেনস্থার কেসের শুনানিতে তিনজনের মধ্যে দুজন মহিলা বিচারকের উপিস্থিতিও অভিযোগকারিণীকে কিছু স্বস্তি দেবে আশা করি।

অভিযোগকারিণীর তরফে আগাগোড়া সবচেয়ে সোচ্চার প্রখ্যাত আইনজীবী শ্রীমতী ইন্দিরা জয়সিং। তিনি পূর্বতন সরকারের আমলে অ্যাডিশনাল সলিসিটর জেনারেল ছিলেন। শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের সুস্বাস্থ্যের কারণেই তিনি মামলাটিতে উৎসাহী হতে পারেন। কিন্তু ওটুকুই নয়, চারটি সংবাদপত্রের একটি “দ্য লিফলেট” তাঁর হাতে তৈরি। সম্ভবত শুরু থেকেই অভিযোগকারিণীকে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে বলব, অন্যায় কিছু করেননি। একজন নারীবাদী আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে যৌন নিনির্যাতনের শিকার বলে দাবি করা একজন মহিলাকে সাহায্য করা তাঁর কর্তব্য, বিশেষত যদি তাঁর কর্মক্ষেত্রে মহিলা অত্যাচারিত হয়ে থাকেন। কেউ কেউ তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান। আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্দিহান না হলেও সন্দেহগুলিকে গুরুত্ব দেব। কিছু নারীবাদী কর্মী বলেছেন ইন্দিরা জয়সিং-এর মতো ব্যক্তি টাকার লোভে বা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে সামিল হয়ে কোনও অন্যায় করতেই পারেন না। এই ধরনের যুক্তি খুব একটা মজবুত নয়। আমরা প্রধান বিচারপতির চরিত্রে সন্দেহ করব, কিন্তু প্রিয় একজন নামজাদা আইনজীবীকে জোর করে সবরকম সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখব, এই দুটো একসঙ্গে না করাই ভালো।

সব শেষে “বিজেপির চক্রান্ত” তত্ত্বটি সম্বন্ধে দু-এক কথা। বিজেপি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর খবরদারি করতে চায়, একথা সত্য। রাফালের শুনানি আটকে গেলে তাদের সুবিধা, তাও ঠিক। একজন দায়িত্বশীল বিচারক যদি দেখেন দেশের স্বার্থহানি করে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা থেকে তাঁকে কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আইনের হাত থেকে অপরাধীদের রক্ষা করার অপচেষ্টা চলছে, তবে তাঁর ক্রুদ্ধ হওয়া এবং রুখে দাঁড়ানো অনৈতিক কিছু না। বিচারপতি গগৈয়ের প্রথম দিনের বেঞ্চ গঠনের তাড়াহুড়ো দৃষ্টিকটু হলেও এই দিক থেকে দেখলে কিঞ্চিৎ সহজে সহ্য করা যায়। কিন্তু এই মামলার শুরু থেকেই সরকার পক্ষের আচরণ এই চক্রান্ত তত্ত্বের পক্ষে যায় না। মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল এবং সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা প্রথম থেকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আদালতে উপস্থিত থেকে প্রধান বিচারপতিকে সমর্থন দিয়েছেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ইন্দিরা জয়সিং এই কারণে অ্যাটর্নি জেনারেলের সমালোচনা করেছেন। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও কার্যত বিচারপতি গগৈকে ষড়যন্ত্রের শিকার বলে এই পুরো ঘটনাকে বামপন্থীদের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিষয়টি, অতএব, ততটা সরল নয়।

এই কচকচি এক জায়গায় শেষ করতেই হবে। সেখান থেকে ফিরে যেতে হবে মূল নীতিগুলোর কাছে। প্রত্যেক মানুষ সুবিচার পাক। কোনও মহিলা বা দুর্বল মানুষকে যেন অন্যায়ের শিকার হতে না হয়। বিচারব্যবস্থা যেন অত্যাচারিতের বুকে বল-ভরসা জোগায়। সর্বোচ্চ আদালত যেন ভুল, নীতিবিগর্হিত বা রীতিবহির্ভূত পদক্ষেপ নিয়ে নিজের সম্মানহানি না করে। পাশাপাশি তার স্বাধীনতাও যেন বজায় থাকে। যদি সুপ্রিম কোর্টের অন্দরে ঘুষ ও প্রতারণার চক্র ঘাঁটি গেড়ে থাকে, অর্থ আর পেশিশক্তি যদি শীর্ষ আদালতকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে থাকে, তবে তারও মূলোচ্ছেদ হোক। শুভমস্তু।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

আপনার মতামত...