চুক্তিচাষ, আচ্ছে দিন, এবং অন্যান্য গল্প

রৌহিন ব্যানার্জি

 

গতকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাৎই নজরে পড়ল একটা খবর— গুজরাটে পেপসিকো কোম্পানি চারজন কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে— কারণ তাঁরা নাকি একটি বিশেষ প্রজাতির (FC5) আলু চাষ করছিলেন— যেটি পেপসিকোর নিজস্ব কৃষি গবেষণাগারের উৎপাদন বলে দাবি। এই আলু চাষ করার “অপরাধে” পেপসিকো চারজন কৃষকের প্রত্যেকের কাছ থেকে এক কোটিরও বেশি টাকা ক্ষতিপুরণ দাবি করে এলাহাবাদ হাইকোর্টে মামলা করেছে। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ফেসবুকে এবং অন্যান্য মিডিয়ায় প্রতিবাদ করেছেন, কৃষক সভা এই মামলায় সংশ্লিষ্ট কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সরকারের হস্তক্ষেপও চাওয়া হয়েছে (যদিও যথারীতি সরকার এখনও এ বিষয়ে নড়ে বসা জরুরি মনে করেননি)। অনেকে এই প্রশ্নও তুলেছেন যে যেহেতু ওটা পেপসিকোর নিজস্ব উৎপাদন, সুতরাং ওই প্রজাতির বীজ চাষ করলে কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা হতেই পারে, তাতে অন্যায় নেই। বরং ওই বীজ কৃষকের হাতে গেল কীভাবে সেটা জানা দরকার।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা তাহলে কোন দিকে দাঁড়াব? নাকি নিরপেক্ষ ভূমিকা নেব? অথবা দেশের অসংখ্য ঘটে যাওয়া ঘটনা যেমন, এ-ও তেমন— আমার কী বলে পাশ ফিরে শোব?

নিরপেক্ষ হওয়া সবচেয়ে সহজ কাজ— কারণ তাহলে আর নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করার ঝক্কিটুকু সামলাতে হয় না— আবার বিশেষজ্ঞের মতামতটুকুও বেশ দিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু নিরপেক্ষ হতে যে অপরিসীম চারিত্রিক ঢ্যামনামো লাগে তা সকলের পক্ষে আয়ত্ত করা অত সহজ হয় না— ফলে কিছুদিনের (সেরকম চাপে পড়লে কিছুক্ষণের মধ্যেই) মধ্যে নিরপেক্ষতার মুখোশ খুলতে শুরু করে। কারণ আমরা সকলেই মনে মনে বুঝি, তাত্ত্বিকভাবে স্বীকার করি বা না করি, যে সত্যিকারের নিরপেক্ষ বলে কিছু হয় না। তবুও যারা “নিরপেক্ষতা” বজায় রাখতে চান, তারা স্বাগত। এই লেখা তাদের জন্য নয়। এবং বলাই বাহুল্য, এই লেখা তাদের জন্যও নয় যারা পাশ ফিরে শোওয়াই মনস্থ করেছেন— অবশ্য তারা এতদূর অবধি পড়ছেন এমন ভাবারও কোনও কারণ দেখি না।

তাহলে পড়ে রইলেন দুই দল— কৃষকের পক্ষে অথবা পেপসিকোর পক্ষে। এইখানে একটা ব্যপার একটু পরিষ্কার করে নিই— “কৃষকের পক্ষে” মানেই এখানে “সর্বহারার পক্ষে”, সমীকরণটা এত সহজ নয়। যে কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা ঠিক সর্বহারা শ্রেণিতে পড়েন না, সম্পন্ন চাষিই তাঁরা। এবং আলোচ্য বীজটি কোনও ট্র্যাডিশনাল ফসল নয়, বরং পেপসি কোম্পানির নিজস্ব উৎপাদন, এই দাবিটি সম্ভবত সঠিক। এসব জানার পরেও কোন পক্ষে যাব, সেটা আমাদের ভাল করেই ভেবে নিতে হবে অবশ্যই। এবং এই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বর্তমান প্রতিবেদকের স্পষ্ট অবস্থান— কৃষকদের পক্ষে এবং পেপসিকোর বিরুদ্ধে। কেন, সেটা পরবর্তী অংশে বোঝানোর চেষ্টা করব— সেটুকুই এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য।

প্রথমে প্রাপ্ত তথ্যগুলিকে আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

  1. কিছু সম্পন্ন কৃষক পেপসি কোম্পানির গবেষণাগারে আবিষ্কৃত FC5 প্রজাতির আলু চাষ করেছেন নিজেদের জমিতে।
  2. পেপসিকো সেই কারণে চারজন কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রত্যেকের কাছে এক কোটির কিছু বেশি ভারতীয় টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছে।
  3. কৃষক সভা ওই কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং বিষয়টিতে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছেন।
  4. সরকার এখনও এই প্রার্থনায় সাড়া দেননি।
  5. FC5 প্রজাতিটি পেপসিকোর গবেষণাগারের ফসল হলেও এর “পেটেন্ট” পেপসিকোর নেওয়া আছে কিনা, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য বর্তমান প্রতিবেদকের কাছে এখন অব্দি জানা নেই।
  6. পেপসি (ইন্ডিয়া) মূলত একটি বহুজাতিক কোম্পানি যারা বিভিন্ন নরম পানীয়, পট্যাটো চিপস ইত্যাদি তৈরি করে বাজারজাত করে।

সবার প্রথমে যে প্রশ্নটা উঠে আসে, এই বীজ যদি পেপসি কোম্পানির নিজস্ব সম্পত্তিই হবে, তবে তা ওই কৃষকদের কাছে গেল কী করে? এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর পেপসি (ইন্ডিয়া) দেয়নি, সংশ্লিষ্ট কৃষকেরাও দেননি। ফলে আমাদের সামনে কিছু যুক্তিসঙ্গত অনুমানই পড়ে থাকে। সেই অনুমানে আসতে গেলে প্রথমে আমাদের পেপসির মত বহুজাতিক কোম্পানিগুলির ব্যবসার ধরন একটু বুঝে নেওয়া দরকার। কোক বা পেপসি, এদের আমরা মূলত ঠান্ডা পানীয় (কোল্ড ড্রিঙ্কস) প্রস্তুতকারক সংস্থা হিসাবেই চিনি। এই ঠান্ডা পানীয়গুলি বিভিন্ন কারণে আমাদের এবং বিশেষ করে আমাদের বাচ্চাদের শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর, এ তথ্যও আমাদের মধ্যে অনেকেই জানি। এবং আমরা অনেকেই এটাও জানি যে দীর্ঘদিন ধরে এরা মাটির নীচের জলসম্পদ বিপুল পরিমাণে তুলে চলেছে নিজেদের কাঁচামাল হিসাবে, যা প্রকৃতিকে ফিরিয়ে দেবার প্রায় কোনও ব্যবস্থাই এরা রাখেনি, ফলস্বরূপ যেখানেই কোক বা পেপসির মত কোম্পানির কারখানা আছে প্রায় সর্বত্র মাটিতে জলস্তরের উচ্চতা বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পেয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই এলাকার কৃষিব্যবস্থা এবং বাস্তুতন্ত্র। কিন্তু এর পাশাপাশি এই বহুজাতিক সংস্থাগুলির আরেকটি ব্যবসায়িক মূলমন্ত্র হল ছড়িয়ে পড়া। এক ধরনের ব্যবসায়ে টাকা না ঢেলে বহু ধরনের ব্যবসায়ে ঢালা। পেপসিকোর ক্ষেত্রে, তাদের পেপসি বা মিরিন্দা যতটা জনপ্রিয়, প্রায় ততটাই বা তার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় প্রোডাক্টটির নাম লে’জ। লে’জ কোনও ঠান্ডা পানীয় নয়— আলুভাজা, যাকে আমরা আদর করে পট্যাটো চিপস বলে ডাকি।

পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯

এই আলুভাজার ব্যবসা একটা দুর্দান্ত লাভজনক ব্যবসা। সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় এ তো বেশ ভালই ব্যপার— কত আলুচাষি প্রতি বছর আত্মহত্যা করেন ফসলের ঠিকমত দাম না পেয়ে— লে’জ-এর আলুভাজার জন্য যে বিপুল কাঁচামাল দরকার, তা কিনলেই তো আলুর বিক্রি অনেক বেড়ে যাবে, চাষিও ন্যায্য দাম পাবেন। পেপসি এ-ও জানায় যে তারা চাষিদের সঙ্গে চুক্তিতে চাষ করবে, চাষিভাইদের দেবে প্রয়োজনীয় বীজ এবং ট্রেনিং, তারপর উৎপন্ন ফসল আগে থেকে ঠিক করা দামে তারা নিজেরাই কিনে নেবে। চাষিও দাম পেলেন, পেপসিও পেল কাঁচামাল— যাকে পেপসির মত কর্পোরেটরা “উইন উইন সিচুয়েশন” বলে থাকেন— রাজনীতিকেরা আচ্ছে দিনও বলতে পারেন। কারণ আমাদের পরিচিত আচ্ছে দিন-এর মতই, আপাত চমকপ্রদ ভালোর আড়ালে এখানেও লুকিয়ে থাকে ভয়ঙ্কর ছোবল— চুক্তির শর্তাবলী। আচ্ছে দিনের মূল্য।

যে কোনও চুক্তিচাষেই একটি প্রধান শর্ত, চুক্তি লাগু থাকাকালীন চুক্তিবদ্ধ চাষি পেপসির (বা অন্য চুক্তিকারী কোম্পানির) চুক্তির বাইরে অন্য কোন ফসল চাষ করতে পারবেন না, ওই জমিতে অন্য কোনও কাজও করা চলবে না। এবং চুক্তিকারীর দেওয়া বীজ, সার, রাসায়নিক ছাড়া অন্য কোনও কিছু ব্যবহার করতে পারবেন না। এই চুক্তিগুলো ক্ষেত্রবিশেষে এক, তিন বা পাঁচ বছরের হতে পারে। প্রথমত এর ফলে আলু চাষের চুক্তিবদ্ধ কৃষক চাইলেও নিজের ক্ষেতে ধান বা অন্য কোন শস্য উৎপাদন করতে পারেন না— তাকে তা বাজার থেকে কিনতে হয় বাধ্য হয়ে। এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই, বিশেষত একটু মধ্য/দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় চুক্তির শেষে সেই জমিটির চরিত্র আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেছে এবং তখন ঐ বিশেষ ফসলটি ছাড়া অন্য কিছু ওই জমিতে ফলানো কার্যত অসম্ভব। বহু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে জমি অনুর্বর হয়ে পড়েছে এমনও দেখা গেছে। চুক্তি শেষ হয়ে গেলে যেহেতু কোম্পানির কোনও দায় থাকে না, সংশ্লিষ্ট কৃষক পড়ে যান অথৈ জলে।

এক্ষেত্রে যেটা হয়ে থাকতে পারে বলে বর্তমান প্রতিবেদকের অনুমান, তা হল এই কৃষকেরা প্রত্যেকেই এককালে পেপসিকোর চুক্তিবদ্ধ কৃষক ছিলেন যাদের চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হয়ে গেছে। এবং বর্তমানে তাদের জমির চরিত্র পরিবর্তন হয়ে যা দাঁড়িয়েছে তাতে ওই বিশেষ প্রজাতির (FC5) আলু ছাড়া অন্য ফসল ফলানো সম্ভব নয়। এবং ঐ কৃষকেরা চুক্তিচাষের সময়ে তাদের কৃষকীয় তাড়নায় (ইনস্টিংক্ট) উৎপাদিত ফসলের বীজ সংগ্রহ করেছিলেন (যা আবহমান কাল ধরে কৃষকেরা করে থাকেন) এবং সেই বীজই বর্তমানে তাদের জমিতে কর্ষিত হয়েছে। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে এই বীজগুলি “পেপসির গবেষণাগারের উৎপাদন”-এর দাবি ততটা জোরদার থাকে না। এবং যদি পেপসির পেটেন্ট না নেওয়া থাকে তবে এই মামলা নেহাৎই পেপসিকোর শক্তি প্রদর্শন— কেন্দ্রে এবং রাজ্যে সরকার এবং প্রশাসন দিনান্তে তাদেরই সমর্থনে থাকবে এই ভরসা থেকে যে শক্তির উদ্ভব। আর পেটেন্ট নেওয়া থাকলেও সেই আইনে এই চাষকে বে-আইনি বলা যায় কিনা তাতে সন্দেহ আছে।

ঠিক এরকমটাই হয়েছে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না ঠিকই— কিন্তু এটাকে ঠিক আষাঢ়ে গপ্পও বলা চলে না বোধ হয়। কেউ যদি বলতে চান বলতেই পারেন, তবে সেক্ষেত্রে এর বদলে কী হয়ে থাকতে পারে, সে বিষয়ে একটা শ্রাবণী গপ্প তিনি শোনাবেন এই আশা প্রকাশ করা খুব অন্যায় হবে না নিশ্চই? অন্যদিকে এই চাষের ফলে “পেপসিকো” ঠিক কতটা এবং কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল, সেই ভাদুরে গপ্পটুকুও আমাদের শোনা বাকি আছে। যে দেশের মাটিতে তারা ব্যবসা করছে তারই প্রকৃতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে, তাদেরকে তারা ঠিক কী ফিরিয়ে দিচ্ছে, সেটা আমাদের জানা দরকার বই কি। আচ্ছে দিন তো চিরদিন থাকবে না।

সো, দ্যাটস নট অল, মি লর্ড।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...