সুজন ভট্টাচার্য
শ্রীলঙ্কায় চার্চ এবং হোটেলে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সারা বিশ্বজুড়েই তোলপাড় শুরু হয়েছে। এক দশক আগেও দ্বীপরাষ্ট্রে এমন হানাদারি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, এলটিটিই-র হাতযশে। তাই প্রাথমিকভাবে একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছিল, তারাই আবার নতুন করে সংগঠিত হল কিনা। তারপরেই জানা গেল ‘ন্যাশনাল থাওহিদ জামাথ’ বলে একটি অপরিচিত সংগঠন আর তার পরিচালক জাহরান হাশিমের নাম। কয়েকদিন পরে আইএসআইএস ভিডিও বার্তায় এই আক্রমণের দায় স্বীকার করে নিল।
এটা বাস্তব, বিশ্বজুড়েই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ একটা উৎকট সমস্যা হয়ে উঠেছে। এবং আইএসআইএস কিংবা বোকো হারামের মতো নামগুলো এর পিছনে বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে। সব সত্যি। কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠে আসছেই। কেন শ্রীলঙ্কা? আর কেনই বা চার্চ? শ্রীলঙ্কা তো খৃস্টান-গরিষ্ঠ দেশ নয়। বরং এখানে জনসংখ্যার ব্যাপক গরিষ্ঠাংশ হল বৌদ্ধ। বছরখানেক আগে বৌদ্ধ-মুসলিম সংঘর্ষও হয়েছিল। তাহলে চার্চে আক্রমণ কেন?
এর উত্তরে এল ক্রাইস্টচার্চের হামলার বদলার প্রসঙ্গ। মাসখানেক আগেই নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয়েছিল। শ্রীলঙ্কায় নাকি তারই বদলা নেওয়া হল। হিংসার উত্তরে হিংসা-য় যারা বিশ্বাসী, তাদের যুক্তি হিসাবে ঠিকই আছে। কিন্তু বদলাটা খৃস্টান-গরিষ্ঠ কোনও দেশেই হওয়াটা আরও যৌক্তিক এবং কার্যকরী হত না কি?
আর এখানেই উঠে আসছে দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান লচিত্রের প্রসঙ্গ। ভারত-বাংলাদেশ-মায়ানমার সহ গোটা অঞ্চলে আজ ধর্মীয় রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক উসকানির রমরমা চলছে। বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার প্রায়শই ব্যর্থ হচ্ছে। ভারতে আগ্রাসী হিন্দু মৌলবাদ প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক মদত পাচ্ছে। আবার মায়ানমারে আরাকানি-বিরোধিতার নামে দাপাচ্ছে বৌদ্ধ-মৌলবাদ।
শ্রীলঙ্কায় প্রভাকরনের নেতৃত্বে মানববোমা একটা আর্টে পরিণত হলেও তামিল টাইগারদের গায়ে কেউ হিন্দুত্বের স্টিকার লাগায়নি। আবার মায়ানমারেও কোনও বৌদ্ধ চৈত্যে হামলা করেনি কেউ, কিংবা পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধ দেশগুলোতে। শ্রীলঙ্কার পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিস্ফোরণের মূল পান্ডা জাহরান হাশিম নাকি দীর্ঘদিন তামিলনাড়ুতে ছিল এবং সেখান থেকেই নাকি জেহাদি তত্ত্বের আমদানি করেছিল শ্রীলঙ্কায়।
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
বোঝাই যাচ্ছে, ষড়যন্ত্রের জাল আজ আর কোনও একটা বিশেষ দেশে সীমাবদ্ধ থাকছে না। সবথেকে বড় কথা, সন্ত্রাসীদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থনে বাজার গরম করার জন্য একদল রেডি হয়ে আছে। আবার বিপরীতে যারা নিন্দা করছেন, তারা সকলেই যে খুব নিরপেক্ষ, এমনটাও কিন্তু নয়। তাই একদল যখন শ্রীলঙ্কার ঘটনায় নিন্দায় পঞ্চমুখ, ক্রাইস্টচার্চের সময় অখণ্ড নীরবতা বজায় রেখেছিলেন। আবার আরেকদল ক্রাইস্টচার্চ কিংবা আরাকানিদের বিষয়ে সোচ্চার হলেও, শ্রীলঙ্কা নিয়ে নীরব।
মোদ্দা কথাটা হল, ধর্মীয় রাজনীতি দিয়েই আজ বাজার মাত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই খেলায় কেউ আগ্রাসী, কেউ বা সুচতুর কায়দায় নিজেকে আড়াল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এদের সকলেরই গেম প্ল্যান একই। প্রতিটি ঘটনাকেই এরা দেখান আগের কোনও একটা ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসাবেই। এটা ঘটনা, প্রায় চার দশক ধরেই মুসলিম মৌলবাদ আগ্রাসী ভূমিকায় আছে, সেই আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসনের সময় থেকেই। কিন্তু সেদিন তালিবান আর আল কায়েদাকে গুছিয়ে মদত দিয়েছিল কে? নিজস্ব ফায়দার অঙ্কে তাদের অন্য কিছু ভাবার সুযোগ ছিল না। আজ সেই পুতুলই হয়ে দাঁড়িয়েছে দানব। ভবিষ্যতে তারা যে আবার অন্য কোনও মৌলবাদকে, এমনকি মুসলিম মৌলবাদকেও তোল্লাই দেবে না, তারও কোনও গ্যারান্টি নেই।
শ্রীলঙ্কার ঘটনার প্রসঙ্গে কেউ কেউ সোনাপানা মুখ করে বলছেন, ওরা ওরকমই। আমরা খুব সুশীল, অমনটা আমরা করি না। ঠিকই তো। ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদকে আমরা একটা অঙ্ক দিয়েই চিনতে শিখেছি। সেখানে আক্রমণ করে পাঁচজন, মরে পঞ্চাশজন। কিন্তু যখন পঞ্চাশজন আগ্রাসী মিলে একজনকে খুন করে ধর্মীয় প্রশ্নে, সেটা কি সন্ত্রাসবাদ নয়? দুক্ষেত্রেই তো একটাই উদ্দেশ্য, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ভয় দেখানো। সেই কারণেই উত্তররদেশের মহম্মদ আখলাখ আর শ্রীলঙ্কার নিহত মানুষেরা এক হয়ে যান। যেমন এক হয়ে যায় আইএসআইএস আর গো-রক্ষকেরা। হ্যাঁ, মাত্রার পার্থক্য অবশ্যই আছে; কিন্তু চিন্তা ও চেতনায় তারা পরস্পরের সহোদর।