নবেন্দু গুহ
এখন যে বড় সুখের সময় নয়, তা আমরা প্রতিদিনই মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করছি। এই সময়, অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচনের সময় নেতা-নেত্রীদের মুখনিঃসৃত যে সমস্ত অমৃতবাণী আমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে, তা মোটেই সুখপ্রদ নয়। নিচের পর্যায় থেকে উপরের সারি পর্যন্ত নেতা-নেত্রীদের শ্রীমুখ থেকে প্রতিনিয়ত যে ধরনের মন্তব্য ছিটকে আসছে চলতি নির্বাচনী হাওয়ার মাঝে, তা হজম করাটা সত্যিই মুশকিল। তবু শুনতে তো হয়ই। হাজার চেষ্টা করেও এহেন নির্বাচনী প্রচারকালে ব্যবহৃত ভাষা এড়িয়ে যাবার কোনও উপায় নেই। আর আমাদের রাজ্যে এ ব্যাপারে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টি। অ্যাক্কেবারে কট্টর দলীয় কর্মী সমর্থক ছাড়া বাকি সাধারণ মানুষ নেতা-নেত্রীদের এই ধরনের বাণী কতটা ভালোভাবে নিচ্ছেন বা পছন্দ করছেন, তা নিয়ে অবশ্যই মাথাব্যথা নেই কারও। অবশ্য মাথাব্যথা থাকবেই বা কেন? চটজলদি ভাষণ দিয়ে যদি দলীয় কর্মী-সমর্থকদের হাততালি এবং বাহবাধ্বনি পাওয়া যায়, তাহলে আর সেই পথ থেকে নেতা-নেত্রীদের থামায়টা কে? অতএব আকথা-কুকথা বর্ষণ অব্যাহত থাকে।
এহেন আকথা-কুকথার রাজনীতি সারা দেশজুড়ে চলছে। তার মধ্যে এগিয়ে অবশ্যই আমাদের রাজ্য। অবশ্য এটা ঘটনা যে এমনতরো আকথা-কুকথার রাজনীতি আমাদের দেশে নতুন ব্যাপার কিছু নয়। এই গালমন্দের রাজনীতির সুবাদে যে উসকানি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে মারদাঙ্গা এবং খুনখারাপির ঘটনা ঘটে যায়। মুখে আমাদের নেতা-নেত্রীরা ভীষণভাবে গণতন্ত্রের পূজারী। অহিংসার কথাও প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয় এদের মুখ থেকে। এমনটাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের রাজনীতি ক্ষেত্রে হিংসাত্মক ঘটনাবলির এত-শত বাড়বাড়ন্ত কেন? শুধু নির্বাচনের সময়েই নয়, অন্যান্য সময়েও রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেই চলেছে। আবার, শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের নিচের সারির নেতাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের প্রেক্ষিতেও দিব্যি চলে নিজেদের মধ্যে মারপিট, বোমাবাজি, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার, এবং খুনখারাপির ঘটনা। অন্য শিল্প আসুক না আসুক, আমাদের রাজ্যে বোমা বানানোর শিল্পের যে বেশ রমরমা বাজার, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মুঙ্গের বা বিহারের অন্য কোনও স্থান থেকে এখন আর পাইপগান বা দেশি পিস্তল আনতে হয় না। সম্প্রতি এই শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্টই যে এগিয়ে গেছি, তা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযান থেকেই স্পষ্ট।
অবশ্য আমাদের রাজ্যে হিংসাত্মক ঘটনাবলির এই আধিক্য কিন্তু হঠাৎ করে হয়নি। এই ঐতিহ্য সমানে চলছে। আমরা রাজ্যবাসীরা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক বলে ঢাক পেটাই। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা আমাদের এই বঙ্গদেশেও তো কম কিছু হয়নি। ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল কলকাতা এবং নোয়াখালিতে, তা অবশ্যই বাঙালির পক্ষে লজ্জাজনক। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’র নামে যে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল, তাতে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন বহু মানুষ। লক্ষাধিক মানুষকে ঘরছাড়া হতে হয়েছিল। সেই বছরই অক্টোবর মাসে বীভৎস দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল পূর্ববঙ্গের নোয়াখালিতে। সেখানেও পাঁচ হাজারের বেশিসংখ্যক মানুষের জীবনহানি হয়েছিল। ঘরছাড়া হন লাখো মানুষ।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালেও আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও অন্যান্য হিংসার ঘটনা নেহাত কিছু কম হয়নি। বামপন্থীদের খাদ্য আন্দোলনের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন অনেকে। আবার আন্দোলনের নামে ট্রাম-বাস পোড়ানো হয়েছে অনেক। এটাও হিংসাত্মক রাজনীতি। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে যুক্তফ্রন্ট। সেই যুক্তফ্রন্টে সিপিআইএম-এর দাপট ছিল বেশি। সেই আমলেই শুরু হয় হিংসাত্মক নকশালবাড়ি আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে ক্ষমতায় আসে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট। তখন নকশালবাড়ি আন্দোলন রীতিমতো তুঙ্গে। একদিকে সিপিআইএম, একদিকে কংগ্রেস, একদিকে নকশালপন্থীরা। এই বাংলার তখন রীতিমতো বেহাল অবস্থা। এই সময়টা যাঁরা প্রত্যক্ষ করেননি, তাঁরা বুঝে উঠতে পারবেন না যে সামগ্রিক পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু হয়। এর আগে ১৯৬৮ সালেও এ রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি ছিল কিছুদিনের জন্য। রীতিমতো টালমাটাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেই সময়কাল জুড়ে।
১৯৭২ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত হয় রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। রীতিমতো গা-জোয়ারি করে, অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনিয়ে-দেখিয়ে আসলে সেবার নির্বাচনের নামে বিশাল প্রহসনই হয়েছিল। আবার রাষ্ট্রপতি শাসনকালে এবং পরবর্তীতে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের শাসনকালে এ রাজ্যে নকশাল আন্দোলন দমনের নামে যে পথ অবলম্বন করা হয়েছিল, তাতে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়েছিল রাজ্যবাসীকে। অবশ্য নকশালপন্থীদের হাতেও কম কিছু খুনখারাপির ঘটনা ঘটেনি। আমাদের রাজ্যে সেই খুনোখুনির রাজনীতির ইতিহাস সত্যিই ভয়াবহ। এরপর ১৯৭৫ সালে সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধি। সেই সুবাদেও রাজনৈতিক অত্যাচারের ঘটনাও কিছু কম নয়।
১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচন জিতে এ রাজ্যে সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। ৩৪ বছরের বাম আমলেও বহু রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটেছে আমাদের রাজ্যে। কলকাতায় বিজন সেতুর ওপর ১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ১৬ জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসী ও একজন সন্ন্যাসিনীকে। ১৯৭৯ সালে মরিচঝাঁপিতে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের উচ্ছেদ করতে বামফ্রন্টের পুলিশ যে নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছিল সেটাও ছিল অভাবনীয়। পরবর্তীকালেও বাম শাসন চলাকালীন হিংসাত্মক ঘটনাবলি ঘটেছে অনেকই। নেতাই-এর ঘটনা, সিঙ্গুরের ঘটনা, নন্দীগ্রামের ঘটনা ভুলে যাবার কথা নয় কারও।
শেষমেশ পরিবর্তন তো ঘটল ২০১১ সালে। এমনটা হবারই ছিল। ক্ষমতায় এল তৃণমূল কংগ্রেস। সাধারণ মানুষের অনেকটাই ভরসা ছিল তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। কিন্তু সেই আস্থা, সেই বিশ্বাস, সেই ভরসাক্ষেত্রে ধীরে হলেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। গতবছর পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় ধরে গণতন্ত্র যেভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে শাসকদলের দৌরাত্মে, তা রীতিমতো অভাবনীয়। এক তৃতীয়াংশ আসনে প্রার্থীই দিতে পারেনি বিরোধী দলগুলি। তাছাড়া নির্বাচনের সময়েও তো ব্যাপক হিংসার ঘটনা ঘটেছে, প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। রাজ্যে বিভিন্ন পুরসভা নির্বাচনেও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে বিস্তর। নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক অজয় নায়েক তো এবারের বিধানসভা নির্বাচনের হালহকিকত দেখে বলেই ফেলেছেন যে এসব কিছু দেখে শুনে দশ-পনেরো বছর আগেকার বিহারের নির্বাচনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এতে করে আমাদের শাসক দলের নেতানেত্রীরা লজ্জিত হওয়ার বদলে রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। দেশের আর কোনও রাজ্যেই নির্বাচনী চিত্র আমাদের রাজ্যের মতো নয়। তাতে কারও কোনও লজ্জাবোধ নেই। বাম আমলে নির্বাচনের সময় রিগিং, মারদাঙ্গার ঘটনা যেমন ঘটত, বর্তমানকালেও সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত।