জয়াশিস ঘোষ
দেবেন মন্ডলের আত্মহত্যা
আত্মহত্যা করার কী কম হ্যাপা! দেবেন মন্ডল ফ্যানের সাথে দড়িটা আটকে ফাঁস তৈরি করলেন। দু একবার টেনেটুনে দেখেও নিলেন। তারপর গলায় পরে নিলেন লোকনাথ বাবার নাম করে। চোখ বুজে একবার বাবাকে ভাবলেন। মুখটা খুব ভালো মনে পড়ল না। লুঙ্গিটা ওপরে তুলে পাছা চুলকানোর একটা দৃশ্য মনে পড়ল। বউকে মনে করার চেষ্টা করলেন। বিছানায় শুয়ে থাকা একটা লাশ। মাঝে মধ্যে মাগো, তুলে নাও বলে চিৎকার। একবার চিত্তর সাথে সোনাগাছি গেছিলেন। সেখানে এক বেশ্যার শায়ার দড়িতে গিঁট খুলতে পারেননি বলে খিস্তি মেরেছিল। তাকেও মনে পড়ল।
এবার আসল কাজ। পা দিয়ে টুলটা ফেলে দিতে হবে। দুবার বর্ডার লাইনে গিয়েও পা আটকে গেল। ব্যথা লাগবে খুব? ডিপফ্রিজটা বন্ধ করেছিলেন তো? খবরের কাগজওয়ালার পয়সাটা দেওয়া হয়নি। না না, ওসব ভাবলে হবে না। বেঁচে থেকে হবেই বা কী! আদ্ধেক জীবন কেটে গেল বাবার পায়খানা পরিষ্কার করে। বাকিটা অসুস্থ বউয়ের সেবা করতে করতে। নিজে কী পেলেন? ঘণ্টা! কিন্তু কাজটা বেশ কঠিন। এই বয়সে অত ফিটনেস আসবে কী করে? ঘাম জমছে কপালে। এমন সময় বেল বাজল।
এরা শান্তিতে মরতেও দেবে না! বিরক্ত দেবেন মন্ডল ফাঁস আলগা করলেন। দরজায় কানে হেডফোন গোঁজা একটা ছেলে। ‘কাকু, পার্সেল আছে।’ পার্সেল? কে পাঠাল? ঠিকানা তো ঠিকই বলছে। খামের ওপর জ্বলজ্বল করছে সুন্দর হাতের লেখায় দেবেন্দ্রনাথ মন্ডল।
সেন্ডার লিস্টে নাম নেই কাকু। আপনার পুরনো গার্লফ্রেন্ড হতে পারে। নিন, এখানে সই করে দিন।
প্যাকেটের ভেতরে একটা আকাশী নীল পাঞ্জাবি। সাথে একটা চিরকুট। তাতে লেখা— ‘জানি ক্ষমা করতে পারবে না। তবু আমার চলে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তোমার চাকরি ছিল না। কবিতা লিখে সংসার চালাবে কী করে? কবিকে ভালোবাসা যায়, কিন্তু বিয়ে করা যায় না। তাই বাবার পছন্দ করা পাত্রকেই বেছে নিয়েছিলাম। লোভ হয়েছিল, জানো? সুখে আছি কিনা বলতে পারব না, তবে ভালো আছি। পাঞ্জাবিটা পরে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু উপায় নেই। আমার হাতে সময় খুব কম। তাই জানিয়ে গেলাম আমার ছেলে বাবুনের আসল বাবা তুমি।’
কবিতা, প্রেম, ছেলে— এসব কী! কবিতা টুকটাক লিখেছেন বটে। বাঙালি ছেলে মানেই লেখে। খাতার পেছন, স্কুলের ম্যাগাজিন… কিন্তু সে তো কারও জানার কথা না! বুক ধড়ফড় করছে। এই বয়সে এত চাপ সহ্য হলে হয়। ফ্রিজ থেকে বের করে এক বোতল ঠান্ডা জল খেলেন। ছেলেটা হল কী করে? শালা, বিয়ের আগে প্রেম তো দূরের কথা, কোনও মেয়ের দিকে তাকাননি পর্যন্ত। বউয়ের সাথে যা দু একদিন ঘষাঘষি হয়েছিল, ছেলে পয়দা হয়নি তাতে। তারপর তো অসুখ, ডাক্তার, প্রেস্ক্রিপশন এই নিয়েই জীবন। নারীসঙ্গ বলতে সেই সোনাগাছি এবং বেশ্যার খিস্তি। বউ মারা যাওয়ার পর নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে এই ভাড়াবাড়িতে উঠেছেন। ঠিকানা তো কেউ জানে না। এমনকি অফিসেও না।
তবু একটা ভেতরে ভেতরে আনন্দ হচ্ছিল বৈকি! কেমন একটা নারীর স্বাদ। অন্যরকমের উত্তেজনা। দেবেন মন্ডল যেন একটা উড়নচন্ডী বিপ্লবী কবি। উত্তাল প্রেমকাহিনীর নায়ক। অনুভব করছিলেন শেষ দেখার সেই দিনটা। সেই আশ্লেষে মিশে যাওয়া আদর।
দুম করে আবার বেল বাজল। বাড়িওয়ালা সুদর্শন ঘোষ তার ভাল্লুকের মত কালো মুখ বিস্তৃত করে হাসলেন—
‘অ্যাডভান্সটা নিতে এসেছি। তিন মাসের। আগের জন, কী যেন নাম ছিল… দেবু … দেবেন মন্ডল … তিন মাসের ভাড়া বাকি রেখেই ফুটে গেল। কী অবস্থা! গলায় দড়ি, মশাই। পুলিশ, নেতা, গিজগিজে লোক! আমার পেছন মারা গেল। তা আপনার নামটা কী যেন?’
দানো
দানোকে কেউ চোখে দেখেনি কখনও। আদৌ সে মানুষ কিনা সেটাও জানে না কেউ। কেউ বলে তার তিন মানুষ সমান পা। কেউ বলে তার হাতে দশটা করে আঙুল। মোটের ওপর বটুকপুর লাগোয়া গ্রামগুলোতে সন্ধের পর একা কেউ বেরোয় না দানোর ভয়ে।
কিন্তু আজকে উপায় নেই। দাঙ্গা লেগেছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ভিডিও হল। একের পর এক ভয়ঙ্কর খবর আসছে। মুসলিমদের গায়ে আগুন দিচ্ছে হিন্দুরা। হিন্দুদের কেটে ফেলছে মুসলমান। চাপা উত্তেজনা। সন্দেহ। দেখতে দেখতে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। পাশাপাশি হিন্দু মুসলিম ঘর। যে যা অস্ত্র পেল, নিয়ে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ত্রিলোচন নিরীহ পুরুত। বেগতিক দেখে পালিয়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল। চিৎকার, কান্না, হুঙ্কারের শব্দ থেমে যেতেই ত্রিলোচনের মনে দানোর ভয় চেপে বসল। আজকে আর রক্ষে নেই। দাঙ্গা থেকে যদিও বা বাঁচা গেল, দানোর হাতেই মৃত্যু আছে আজকে! ভয়ে পায়খানা পেয়ে গেল। জল নেই। তাতে কী! আপনি বাঁচলে বাপের নাম! ধুতিটা তুলে বসতে যাবে, এমন সময় পেছনে একটা সরসর করে শব্দ হল। কী একটা সরে গেল! চমকে গেল ত্রিলোচন। হাগা ঢুকে গেল ভেতরে। –‘কে? কে ওখানে?’ ভয়, কান্না, কাঁপুনি সব মিলিয়ে একটা গোঙানির মত শোনাল।
ওদিকে ঝোপটা একটু নড়ে উঠল। না, আজকে দানোর হাতেই প্রাণটা যাবে। ত্রিলোচন জোরে জোরে রামনাম শুরু করল। ঝোপের আড়াল থেকে কে একটা বেরিয়ে আসছে! হাতে অস্ত্র। জান্তব শব্দে ডেকে চলেছে একটানা। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল ত্রিলোচন।
ওদিকে ঝোপের ভেতর লুকিয়ে ছিল বদরুদ্দিন। মৌলবী। দূর থেকে ত্রিলোচনের ধুতি পরা চেহারা আর গোঙানির আওয়াজে নিশ্চিত ছিল এটাই দানো। ভয়ের চোটে আল্লাকে ডাকতে গিয়ে তার মুখ থেকেও একটা অতিপ্রাকৃতিক আওয়াজ বেরোচ্ছিল। তবুও একটা কচুগাছ ভেঙে সেটাকে বাগিয়ে প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করবে ভাবছিল। দুই পা এগোতেই ত্রিলোচন পৈতে ধরে চিৎকার করে উঠল—
‘জয় শ্রীরাম। জয় শিবশম্ভু। জয় মা কালী। রোজ তিনবেলা আহ্নিক করি। এগোলে ধ্বংস করে দেব।’
ওদিকে বদরুদ্দিন শূন্যে কচুগাছ ঘুরিয়ে বলে উঠল— ‘আমিও নামাজ পরা মুসলমান। এগোও দেখি। কেটে ফেলব।’
‘তাহলে তো দাদু ঠিক বলত। দানো মুসলমান। হিন্দু দেখলেই তুলে নিয়ে যায়।’
‘একদমই না। দানো হিন্দু। আমার আব্বু বলত মুসলমানের রক্ত চুষে খায়।’
‘হিন্দুধর্ম নিয়ে বাজে কথা বলবে না। আমরা তোমাদের মত নই। গরু মাতা পর্যন্ত… ছি ছি!’
‘কালীপুজোয় তো ছাগলে চুমু খাও তোমরা! দানো বলছ কাকে? আমি তো মাছ মাংস খাই না। ধর্মপ্রাণ মুসলিম।’
এবার বদরুদ্দিন আরও দুই পা এগিয়ে এল। ত্রিলোচন একটা ভাঙা গাছের ডাল কুড়িয়ে নিল।
‘পেছোও… পেছোও বলছি। তুমি দানো। তোমার বাপ দানো। চোদ্দপুরুষ দানো। ভুলিয়ে ভালিয়ে ডাকবে তারপর ঘাড় মটকে দেবে।’
এমন সময় বৃষ্টি নামল। দুজনে দে দৌড়। দুদিকে দুটো দেশ দৌড়চ্ছে। মাঝে নো ম্যান্স ল্যান্ড রাস্তাটুকু। পায়ে পায়ে তৈরি হয়েছে। রাস্তার ঠিক মাঝাখানে একটা বিশাল বটগাছ। হাঁপাতে হাঁপাতে তার তলায় আশ্রয় নিল দুজন। মস্ত বড় গুঁড়ি। এদিকে ত্রিলোচন। ওদিকে বদরুদ্দিন। সাড়াশব্দ না পেয়ে ত্রিলোচন বলল—
‘ও ভায়া, আছ নাকি? ও মুসলমান ভায়া…’
‘তুমি তো আজব লোক হে! একবার দানো, একবার মুসলমান! আমার কি নাম নেই নাকি?’
‘আমার দাদু বলত…’
‘রাখো তোমার দাদু! দানোর কোন ধর্ম নেই! ওই যে জানোয়ারগুলো মানুষ মারছে, ওরাই সব দানো..’
‘ঠিক বলেছ। একটু জল হবে তোমার কাছে?’
‘খাওয়ার আছে, হাগার নেই! কিন্তু মুসলমানের ছোঁয়া…’
ততক্ষণে দু পা করে এগোতে এগোতে দুজনে পাশাপাশি। বৃষ্টি থেমেছে। অন্ধকার সরে গিয়ে হালকা আলো। যেন দানো চলে যাচ্ছে তার রাজ্যপাট রেখে…
হোম ডেলিভারি
প্রচন্ড জোরে একটা বাজ পড়ল। বিকেল থেকে ঝোড়ো হাওয়া। সাথে অবিরাম বৃষ্টি। নীচে দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ। নির্ঘাত বিরিয়ানির ডেলিভারিটা এসেছে। আগে এই মফঃস্বল এলাকায় এসব ছিল না। এখন মাঝরাতে বললেও গরমাগরম খাবার নিয়ে কেউ না কেউ চলে আসবে।
সোমেশবাবু লুঙ্গির ওপর ফতুয়াটা পরে ধীরেসুস্থে নীচে নামলেন। চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। ছেলেটি অল্পবয়সী। কোম্পানির দেওয়া টি-শার্ট বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। বিরিয়ানি দিয়ে বলল— ‘এক গ্লাস জল হবে, কাকু?’ আহারে, কত কষ্ট এদের! রোদে, ঝড়ে এমনকি মাঝরাতে পর্যন্ত খাবার সাপ্লাই করতে হচ্ছে। ভেতরে আসতে বললেন সোমেশবাবু। ছেলেটা খুব খুশি। জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেল।
‘দেড়শো টাকা স্যার।’
সোমেশবাবু ভেতরে গিয়ে আলমারি খুলে দুশো টাকার একটা নোট এনে ছেলেটাকে দিলেন। হাত দিয়ে ইশারা করে খুচরোটা রেখে দিতে বললেন। কৃতজ্ঞ ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক দেখছিল। হাল্কা মায়াবী আলোয় যেটুকু বোঝা যাচ্ছিল, ভদ্রলোক খুব শৌখিন। মোটা মোটা বই ভর্তি দেরাজ, সাবেকি আসবাব।
‘এত বৃষ্টিতে যাবে কী করে? বসে যাও একটু।’
ছেলেটা সোফাতে গিয়ে বসল। সোমেশবাবু হুইস্কির বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে এলেন। –‘বর্ষার রাতে চলবে নাকি ভাই একটু?’ ছেলেটার চোখ চকচক করে উঠল। ঘাড় এলিয়ে সম্মতি দেওয়ার আগেই পেগ বানিয়ে ফেললেন সোমেশবাবু।
‘খাওয়া হয়েছে কিছু সকাল থেকে?’
‘আমরা খাবার সাপ্লাই করি স্যার। নিজেদের খাওয়া সেরকম হয় না।’
সোমেশবাবু ভেতরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জগু, একটু মাংস নিয়ে আয় তো। বাচ্চা ছেলেটা না খেয়ে শুকিয়ে গেছে। ভালো করে খাওয়া ওকে।’
একটা বড় গামলা ভর্তি মাংস নিয়ে যে ঢুকল তাকে দেখে ছেলেটা আঁতকে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। সোমেশবাবু খুব একটা অবাক হলেন না। জগুকে দেখলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। গোরিলার মত চেহারা। আফ্রিকা থেকে নিয়ে এসেছিলেন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে।
‘কী হল? ভয় পেয়ে গেলে নাকি? ও খুব শান্ত। কিছু করবে না। পেট ভরে খাও।’
জগু সাদা দাঁত বের করে হাসল। তারপর চলে গেল ভেতরে। ছেলেটা ঢকঢক করে হুইস্কির গ্লাসটা শেষ করে ফেলল। সোমেশবাবু আরও একটা পেগ বানালেন। তারপর নিজের গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক মেরে বললেন—
‘আরে, বেশি করে মাংস খাও। মাংস না খেলে চেহারা হবে কী করে?’
কাবাবের পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে। ছেলেটা একটা মাংসের টুকরোয় কামড় দিয়ে বলল—
‘স্যার, কিছু মনে করবেন না। আপনার ঘরে এত মাংস। আপনি বিরিয়ানি অর্ডার করলেন কেন?’
‘লোভ হল। মাংসের লোভ আমার খুব। যেমন তোমার ভালো জীবনের প্রতি।’
‘আমার?’
‘আমি কি জানি না, টাকা আনার সময় তুমি আমার টেবিলে রাখা কয়েকটা পাথর সরিয়েছ? ঠিকই আন্দাজ করেছ। ওগুলো খুব দামী।’
চশমার মোটা কাঁচের আড়ালে সোমেশবাবুর চোখ দুটো জ্বলছে। ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গেছে। প্যান্টের পকেট থেকে পাথরগুলো বের করল। সোমেশবাবু বিকট শব্দে হেসে উঠলেন।
‘রিল্যাক্স ভাই, রিল্যাক্স। আমি লোভ বুঝি। সম্মান করি। গরীব ছিলাম। মাংসের লোভ, বুঝলে? পাশের ঘরে রান্না হত পেঁয়াজ রসুন কষিয়ে। আর ঘরে খিদে চেপে মা আর আমি। কতদিন সহ্য করা যায় বলো? না পেরে চুরি করলাম। ধরাও পড়ে গেলাম। মায়ের চুল ধরে চড় মারল। মা পারেনি। আমি পারলাম। বাঁচতে হবে তো! তবে মাংসের লোভটা বেড়ে গেল। যাও ভাই, ফ্রিজ থেকে একটু বরফ নিয়ে আসো।’
ছেলেটা উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল। ফ্রিজ খুলেই ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেল ওর। মানুষের হাত, পা, অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ। মাথাটা ঘুরছে। পড়ে যাওয়ার আগে শুনতে পেল সোমেশবাবুর গলা— ‘পাথরগুলো তুলে রাখ জগু। ভালো করে পোড়াস। ভেতরে যেন কাঁচা না থাকে…!’