আপদবান্ধব জীবনের ইতিবৃত্ত

নাহার তৃণা

 

জঙ্গলের পশুরাজ্যে কোনো আইন কানুনের বালাই থাকে না। সেখানে আক্ষরিক অর্থেই জোর যার মুল্লুক তার। বনের কমজোর, নিরীহ পশুরা, শক্তিমান পশুদের শিকারের সহজ লক্ষ্য। বনের হরিণ শিকার হিসেবে সম্ভবত সবচে’ উপাদেয়। তার সুস্বাদু মাংস শুধু বনের পশুকে না মানুষকেও লোভী করে। আপনা মাংসে হরিণা বৈরী, আপদবান্ধব জীবন হরিণের।

এ তো গেল বন-জঙ্গলের পশুদের কথা। প্রাণী জগতের শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে খ্যাত মানুষের সমাজ কাঠামো জঙ্গলের ঠিক উল্টো। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্র কর্তৃক বেঁধে দেওয়া আইন কানুনের ভিত্তিতে সমাজ-সংসার পরিচালিত হয়। একটা দেশ বা সমাজে আইন ভঙ্গে শাস্তির বিধান থাকে। অপরাধের রকম ভেদে শাস্তি নির্ধারিত হয়। শাস্তির বিধান যেখানে বলবৎ, ধরে নেওয়া যায় সেখানে আইনের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার ঘাটতি থাকলেও শাস্তির ভয়-ভীতি জনগণকে আইন মান্য করতে উৎসাহিত করে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে দেশ যতবেশি কঠোর, আপোষহীন, সে দেশে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এর অহেতুক প্রদর্শনীর চল থাকার কথা না। অন্যদিকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রা যে সমাজে যত বেশি, সে সমাজের জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নত হবার কথা নয়।

শারীরিক শক্তিতে অধিকাংশ নারী পুরুষের তুলনায় কমজোর, এই শ্রেণীটির সাথে শিশু (ছেলে-মেয়ে উভয়) এবং ক্ষেত্র বিশেষে কিছু পুরুষও যুক্ত হন। একটি সমাজে সংশ্লিষ্টদের অবস্হান কিংবা জীবনের নিরাপত্তার মান কতটা উন্নত কিংবা হুমকির সম্মুখীন, সেটিই দেখার চেষ্টা থাকবে। এক্ষেত্রে আলোচনার প্রেক্ষাপট মূলত বাংলাদেশ। আলোচনার স্বার্থে অন্যান্য দেশের অবস্থানও প্রসঙ্গক্রমে আসবে।

পশুরাজ্যে শিকারের রেওয়াজ আছে, কমজোর প্রাণীকে ধর্ষণের নজির আছে কিনা জানা নেই। অথচ শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্ষণ-নির্যাতনের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস।

 

আদি পাপের ইতিহাস

সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক গ্রীস এবং রোমে ঔপনিবেশিক সময়ে ধর্ষণ, দেশদ্রোহীতা এবং হত্যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন ছিল। প্রচলিত আইনে সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পন্থাগুলো ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। দ্বাদশ শতাব্দীতে আদালত কর্তৃক ভুক্তভোগী পরিবারের হাতে দোষী ব্যক্তির শাস্তি কার্যকরের স্বাধীনতা দেওয়া হতো। চর্তুদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ইংল্যান্ডে ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগী, ধর্ষণকারীর চোখ উপড়ে নেওয়া বা অন্ডকোষ ছিঁড়ে নেওয়ার মতো শাস্তি প্রয়োগের স্বাধীনতা পেত। মনে করা হত প্রচলিত কঠোর শাস্তি ব্যবস্থার চেয়ে দোষের শাস্তি খানিক লঘু। মধ্যযুগে ইউরোপে নানা শ্রেণীর নারীদের ক্ষেত্রে যে ধর্ষণগুলো সংঘটিত হত, মামলা হিসেবে আদালতে সেগুলো দায়েরের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পায়। কারণ আদালতের বাইরে দু’পক্ষের মধ্যে সামান্য টাকার বিনিময়ে বিষয়টার নিস্পত্তি ঘটানো হত। যা বর্তকালে বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক দেশগুলোতে বেশ প্রচলিত। এসময়ে ইউরোপীয় সমাজে ধর্ষণের শিকার নারীটিকে জোর করে বিয়ে দেয়া হত। এতে করে নারীটির ধর্ষণ অভিযোগের স্বাধীনতা রহিত হয়। এটিও কমবেশি বর্তমান সময়ে প্রচলিত একটা ব্যবস্থা হিসেবে অনেক দেশে বর্তমান।

গ্রীক মিথিওলজিতে নারী/যুবা অপহরণ কিংবা তার প্রতি যৌনপীড়ন ভীষণ মামুলি বিষয় হিসেবে ওঠে এসেছে। দেবতা শ্রেষ্ঠ ‘জিউস’ এ কাজে ছিলেন অন্যান্যদের পথিকৃত। তিনি তার পৌরুষত্বের মহিমা সর্বপ্রথম প্রয়োগ করেন ইউরোপা (Europa) এবং গ্যানিমেড (Ganymede) এর উপর। অনিন্দ্য সুন্দর গ্যানিমেড ছিলেন ট্রয় নগরের স্বর্গীয় বীর। যৌন রঙ্গ তামাশায় ব্যস্ত জিউসের সাত খুন মাফ হলেও থীবসের রাজা লেয়াস (Laius) গ্রীক মিথিওলজির সম্ভবত প্রথম ধরা খাওয়া পাবলিক। ক্রিসিপাস নামের ঈল নগরের স্বর্গীয় বীরের প্রতি পৌরুষত্ব দেখানোর ফলকে প্রথম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই পাপের শাস্তি হিসেবে অমোঘ অভিশাপে আক্রান্ত হয় লেয়াস তার সন্তান এডিপাস (Oedipus), স্ত্রী জোকস্টা (Jocasta), পৌত্রী এ্যান্তিগোনে (Antigone) সহ পুরো পরিবার। ক্ষমতার অপপ্রয়োগ আজকের সমাজেও সমান তালে ঘটে চলেছে। যে কারণে ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধ করেও পার পেয়ে যায় বিকৃতমনস্ক অপরাধীরা।

প্রাচীন রোমে সর্বপ্রথম যৌনপীড়নের উদ্দেশ্যে জোরপূর্বক অপহরণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। তৃতীয় খৃষ্টাব্দে একে অপরাধ হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। সম্ভবত জুলিয়াস সিজারের সময়কালে ধর্ষণকে নারী/যুবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌনপীড়ন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। হিন্দু মিথিওলজিতেও নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনপীড়নের অসংখ্য ঘটনার বর্ণনা আছে। তাছাড়া উপমহাদেশের বহু সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে মেয়েদের যৌন অত্যাচারের সম্ভাবনা রয়েছে। মেয়েদের চার দেয়ালের ভেতরে বন্দী রাখার রেওয়াজ পুরুষতান্ত্রিকতা হলেও তাতে মেয়েরা বাইরে বের হলে ধর্ষিতা হবে এমন একটা ভীতি কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। সভ্য হবার এতটা পথ উজিয়ে এসেও ২০১২’র ১৬ ডিসেম্বরে দিল্লিতে গণ ধর্ষণের শিকার জ্যোতি সিংয়ের বিপক্ষীয় আইনজীবী এম এল শর্মার মতো মানুষদের ভাবনার জগতে তেমন একটা হেলদোল হয় না, ‘A woman means immediately put the sex in his (man) eyes (হুবহু এম এল শর্মার ইংরেজি)’।

নারীর জীবনও বুঝি হরিণের মতো আপদবান্ধব। সৃষ্টিকর্তা নারীকে কেবল শরীর দিয়েছেন, বর্মখানি ভুলে গেছেন দিতে! তাকে রক্ষার নামে তাই ঘটেছে নানান সামাজিক ভণ্ডামি-সংষ্কার।

‘কুমারী মেয়েকে যৌনপীড়ন থেকে বাঁচাবার স্বস্তি দায়ক একটা পথ হিসেবে গৌরী দান ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে বলে ধারণা করা হয়। ব্রাহ্মনেরা বিয়ের রাতে পুজার নাম করে নববধূকে স্বামীর কাছে যাবার আগেই ধর্ষণ করতো। উনিশ শতকের শেষদিকে এই প্রথা বন্ধ করা হয়। দক্ষিণাঞ্চলের গরিব ঘরের সুন্দরী মেয়েদের ধর্ষণ অনিবার্য জেনেও মন্দিরের সেবাদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হতো। রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের কিছু অঞ্চলে নট, রেডিয়া কুঞ্জর ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মেয়েদের যৌনসম্ভোগ করার পূর্ণ অধিকার উঁচু জাতের পুরুষদের এখনো চলমান। এক্ষেত্রে মেয়েদের সম্মতি গ্রহণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের গল্প প্রায় প্রতি আঞ্চলিক সাহিত্যে রয়েছে। চম্বলের ডাকাতরানী ফুলনদেবীর জীবনী পড়লে যৌন অত্যাচারের গভীরতা সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়।’ তাছাড়া লালসালুর আড়ালে ফকির বাবাদের কেরামতিতে কত শত নারীর জীবন ছারখার হয়েছে তার হিসাব সময়ের ধূলোয় চাপা পড়লেও এর সত্যতা অস্বীকারের উপায় নেই।

 

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নারীর অবস্থান

আইন প্রয়োগে দ্বিধাহীন ধারণা করা দেশগুলোতে নারী এবং শিশুরা অপার শান্তি সুখের কাঠামোয় বসবাস করে সেটা ভাববার কোনো কারণ নেই। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে নারী নির্যাতনের হার চমকে যাওয়ার মতো। অর্থনৈতিক বা ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এসব দেশে নারীর অবস্হান আগের তুলনায় বাড়লেও, নারীর বিপক্ষে সংঘটিত সহিংসতার খতিয়ান যথেষ্ট ভীতিকর।

সাধারণ গৃহস্থ নারীদের তুলনায় অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে থাকা নারীরা সহিংসতার বাতাবরণের বাইরে মনে করা হলেও, বাস্তবতা ভিন্ন গল্প শোনায়। ইউরোপীয় কাউন্সিলের পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলি এবং স্বতন্ত্র সদস্যদের সংগঠন ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন(IPU)’র জরিপকৃত একটি সমীক্ষায় নারী সাংসদ এবং কর্মীদের প্রতি তাদের পুরুষ সহকর্মীদের নানা আঙ্গিকের বৈরি আচরণের একটি হতাশাজনক এবং ভীতিকর চিত্র পাওয়া যায়।

২০১৮র জানুয়ারি এবং জুন মাসের IUP’র জরিপে ইউরোপের ১২৩টি দেশের ৪৫ জন অংশ নেন। যার মধ্যে ৮১ জন নারী সাংসদ এবং ৪২ জন সংসদের নারী কর্মী। ৮৫.২% সাংসদ জানিয়েছেন দায়িত্ব পালনকালে তারা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৪৯.৯% ভাগ হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের হুমকি পান। ৫৮.২% সোশ্যাল মিডিয়ায় যৌন হয়রানির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। ৭৬.৯% নারী হওয়ার কারণে তাদের বিভিন্ন আক্রমণাত্মক উক্তির সম্মুখীন হতে হয়। ২৪.৭% নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন এবং ১৪.৮%  শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানান। ১৩.৫% অর্থনৈতিক বৈষম্যের অভিযোগ করেন।

সংসদে কর্মরত নারী কর্মীদের জরিপেও উঠে আসে একই চিত্র। ৪০.৫% নারী কর্মস্থলে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন। এ হয়রানির সাথে যুক্ত ৬৯.২% পুরুষ সাংসদ। ৫০% নারী যৌনগন্ধী মন্তব্য দ্বারা উত্যক্ত হন বলে জানান। সেসব মন্তব্যকারীদের ৬১.৫% পুরুষ সাংসদ। ৫২.৩% নারী কর্মী মানসিক অত্যাচার এবং বুলিংয়ের শিকার- এসব অন্যায়ের সাথে পুরুষ সাংসদসহ নারী কর্মীর পুরুষ এবং নারী উভয় সহকর্মীরা জড়িত বলে অভিযোগ। ৭.১% শারীরিক নির্যাতনের শিকার। ৯.৫% অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার।

এই জরিপে অংশগ্রহনকারীদের ৯১.৪% কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। তার মধ্যে ৫০% ক্ষমতাসীন দলের, ৪১% বিরোধী দলীয় এবং বাকি ৭.৯% স্বতন্ত্র সদস্য। ৪০ বা তার চেয়ে কম বয়সি নারীরা এসব সহিংসতার শিকার হয়েছেন সবচেয়ে বেশি।

যৌন হয়রানির শিকার মাত্র ২৩. ৫ % নারী এমপি ও ৬% সংসদ কর্মী লিখিত অভিযোগ দায়ের করার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি গবেষণায় দেখা গেছে, লিঙ্গবৈষম্য দূরের পক্ষপাতী এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের কাজে যুক্ত নারীরাই এসব আক্রমণের শিকার হয়েছেন বেশি৷

ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েলা কুয়েভাস ব্যারন (Gabriela Cuevas Barron) জানিয়েছেন, ‘গবেষণার এই ফল দেখিয়ে দিয়েছে পার্লামেন্টে নারীর প্রতি সহিংসতা আমরা যেমন ভাবতাম তার চেয়েও বেশি খারাপ৷ এই তথ্য একজন নারী এমপি হিসেবে আমার জন্যও উদ্বেগের৷’ তিনি বলেন, ‘হয়রানি শুধু নারী অধিকারের চরম লঙ্ঘনই নয়, গণতন্ত্রের জন্যও ক্ষতিকর৷’

এই যখন উন্নত বিশ্বের অগ্রসর নারীদের দশা, সাধারণের অবস্থাটা কেমন সেটা সহজেই অনুমেয়। একশন এইড ইন্টারন্যাশনালের সমীক্ষায় বলায় হয়েছে বিশ্বব্যাপী প্রতি দশ জনের মধ্যে সাতজন নারী জীবনের কোনও না কোনও পর্যায়ে সহিংসতার শিকার হন। গ্যালপের(Gallup) ২০১৬’র এক সমীক্ষায় বলা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার হন। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী ২.৫ বিলিয়ন যৌন সহিংসতার রিপোর্ট দাখিল হয়েছিল জাতিসংঘের ড্রাগস এন্ড ক্রাইম অফিসে। এই রিপোর্টে জানা যায় অনেক দেশেই প্রতি লাখে একশ জনের উপর যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ হয়। ৭৭টি দেশের মধ্যে নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় অগ্রসর দেশগুলো হলো সুইডেন, যুক্তরাজ্য, বাতসোয়ানা, এবং অস্ট্রলিয়া। ওই একই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ধর্ষণের মাত্রা ছিল আশঙ্কাজনক।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজন, এবং ৭১ জন পুরুষের মধ্যে একজন জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে ধর্ষিত হন। National Sexual Violence Resource Center এর হিসাব মতে দেশটিতে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার নারী হলেন ৯১% এবং পুরুষ ৯%। প্রতি পাঁচ জনে একজন নারী, এবং ষোলজনে একজন পুরুষ কলেজ জীবনে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ৬৩% থানায় রিপোর্ট করা হয় না।

নেশনমাস্টার (Nationmaster.com) এর পরিসংখ্যানে পৃথিবীর নানান দেশে সংঘটিত সহিংসতা এবং ধর্ষণের তুলনামূলক সূচকে দেখা যায়, উন্নত দেশের (অধিকাংশ) অবস্থান উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে অনেক বেশি। ২০১০ এ সংঘটিত ধর্ষণের পরিসংখ্যানের সূচকের শীর্ষে অবস্থান করছে দক্ষিণ আফ্রিকা- ১৩২.৪, সুইডেন- ৬৩.৫, অস্ট্রেলিয়া- ২৮.৬, বেলজিয়াম- ২৭.৯, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- ২৭.৩, নিউজিল্যান্ড- ২৫.৮, জার্মানি- ৯.৪। অন্যদিকে  থাইল্যান্ড- ৬.৭,  সেনেগাল- ৫.৬, উগান্ডা- ২.১, গ্রীস ১.৯।

 

আঞ্চলিক দেশগুলোর পরিস্থিতি

দক্ষিণ এশিয়ার জেন্ডারসমতা সূচকে মালদ্বীপ (১০৬), ভারত (১০৮), শ্রীলংকা (১০৯), নেপাল (১১১), ভুটান (১২৪) এবং পাকিস্তান (১৪৩) অবস্হান সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়।

ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হন। ২০১২’র ১৬ ডিসেম্বর দিল্লিতে জ্যোতি সিং নামের প্যারামেডিকেল ছাত্রীকে চলন্ত বাসের ভেতর বর্বরোচিত গণধর্ষণের জোর হিসেবে গোটা ভারত জুড়ে প্রতিবাদের যে ঝড় ওঠেছিল তা নজির বিহীন এক ঘটনা। এই ঘটনায় গোটা ভারত জুড়ে আন্দোলন ঝড়ের ঝাপটা লাগে কমবেশি পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও। ভারতের মতো একটা রক্ষণশীল সমাজে ‘ধর্ষণের’ মত আপাত নারীর একার সম্মান হারানোর লজ্জা লুকানোর মানসিকতায় না হেঁটে জ্যোতির কন্ঠ ছাড়বার জোরটা, তার হাতধরে ভারতের যুবসমাজের জ্বলে ওঠবার উদ্দাম এবং ফলশ্রুতিতে ধর্ষণের সংজ্ঞা সম্প্রসারণ ও আইনে সংশোধনের ঘটনা ঘটে। জ্যোতির ঘটনা পরবর্তী ভারতের নারী সমাজের উপর থেকে সহিংসতা- ধর্ষণের অভিশাপ লোপাট হয়ে গেছে এমন চিন্তা অবাস্তবই বটে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে যথারীতি বিপুল সংখ্যক সহিংসতার খবর পরিবেশিত হয়। মাটির মূর্তি কিংবা গোবাদি পশুর প্রতি মা মা রবে সম্মানের চূড়ান্ত করলেও কিছু মানুষ রক্তমাংসের নারীর প্রতি সম্মান দেখাতে এতটাই অক্ষম যে তাদের বলতে বাধে না ‘We have the best culture. In our culture, there is no place for a woman’ (এম এল.শর্মা) ‘Women are more responsible for rape than men.’ এমন মানসিকতা সম্পন্ন মানুষের হার সমাজে দিন দিন প্রকট হচ্ছে, ভয়টা সেখানেই।

সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতে নারীর নাজুক অবস্থানের কিছুটা ইঙ্গিত ২০১৭’র ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্টে পাওয়া যায়। জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে ভারত তার পূর্বের অবস্থান হারিয়ে অনেক নিচে নেমে যায়। পূর্বে ভারত ছিল ৭৮তম স্থানে। ২০১৭-এ সেটা ১০৮ চলে যায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ভারতের নারীরা পিছিয়ে আছেন। কর্মক্ষম নারীদের ৬৭% মজুরি পান না। স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকার উপকরণের ক্ষেত্রেও ভারত অনেক পিছিয়ে আছে, এ ক্ষেত্রে দেশটির বৈশ্বিক র‍্যাঙ্কিং ১৪১- সবচেয়ে নিম্নে অবস্থানকারী দেশটি থেকে মাত্র চার ধাপ উপরে।

পাকিস্তানে বিবাহিত প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় রিপোর্ট করেন। রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা হেতু নির্যাতনের সবটুকু আলোতে আসে না। তাছাড়া সেখানকার অধিকাংশ নারী মনে করেন স্বামী দ্বারা এমন হেনস্থা দাম্পত্যেরই অংশ। এমন পরিস্থিতিতে আশঙ্কা জাগে, সমাজের এই শ্রেণিটি বৈবাহিক ধর্ষণ বা Marital rape or spousal rape সম্পর্কেও হয়ত এমন ধারণাই পোষণ করেন। ফলে নির্যাতনের পুরোটা জানার ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা থেকেই যায়। অশিক্ষার কারণে নারীরা অনেক পিছিয়ে আছেন পাকিস্তানে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহন বেশ হতাশাজনক। নারীর প্রতি সহিংসতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথেরও হমুকী সৃষ্টি করে। মাত্র ২২% নারী কর্মক্ষেত্রে জড়িত। সহকর্মী বা বাইরের কারো দ্বারা নিগৃত হবার ঝুঁকি নিয়েই নারীরা কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হন।

২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আইন (EVAW Law) স্বাক্ষর করার পর দেশটির ৮৭% নারী যারা ইতিমধ্যেই নানাভাবে সহিংসতার শিকার, তারা ভেবেছিলেন সুদিন আগত। কিন্তু তাদের সে আশা আজও পূরণ হয়নি। কেননা আগফান ফৌজদারি অপরাধ ব্যবস্হা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার বিষয়টিকে পাত্তা দেবার প্রয়োজন মনে করে না। সুরায়া নাম্নী এক নারী স্বামী কর্তৃক শারীরিক নির্যাতন এবং শ্বশুর কর্তৃক ধর্ষিত হয়ে থানায় রিপোর্ট করতে গেলে থানা থেকে বলা হয়, এমন অভিযোগ তারা নথিভুক্ত করবে না, কারণ এটি তাদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়(!)। ইউএনএ’র গবেষণায় সে দেশের এমন ২৩৭ কেসের উল্লেখ আছে, যেখানে নারীরা সুরায়ার মতো বিচারের আশায় আহাজারি করছে। মোটকথা আফগানিস্তানে নারীদের সার্বিক অবস্হান অত্যন্ত শোচনীয়।

আঞ্চলিক অপরাপর দেশের নারী সমাজ সহিংসতাহীন কাঠামোতে যে বসবাস করেন না সেটা স্পষ্ট। ঝুঁকির পরিমাণ কোথাও মাত্রারিক্ত, কোথাও সামান্য কম এটাই যা পার্থক্য।

 

প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

‘নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অর্জন ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশের মেয়েরাও অনেক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দেশসমূহ থেকে এগিয়ে আছে।’ ২০১৭’র ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট অনুসারে এ উচ্ছাস হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের সার্বিক নারী সমাজের প্রতি দৃষ্টি রাখলে উচ্ছাসের পলেস্তরা খসে গিয়ে হতাশা ভর করে। নারীর ক্ষমতায়নের এ অর্জনের সার্বিক ফলাফল শূন্য মনে হয়, যখন দেশের নারীর সমাজের একটা বিরাট অংশের উপর সহিংসতার মাত্রা, হ্রাসের বিপরীতে অবস্হান করে।

২০১৭’র একশন এইড বাংলাদেশের গবেষণায় দেখা যায় দেশের শহরাঞ্চলে বসবাসকারী ৫৪.৭% নারী সহিংসতার শিকার। ৫৭ শতাংশের অভিযোগ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনি তাদের অভিযোগে গুরুত্ব দেয় না। ৬৫% নারী মনে করেন সহিংসতার জন্য দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য উল্টো নারীদেরই দায়ী করার মানসিকতা ধারণ করেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনির অধিকাংশ লোক। গবেষণায় দেখানো হয়, ৪৯% নারী গণপরিবহনে নিজেদের অনিরাপদ মনে করেন। স্বাস্হ্য সেবাসহ অন্যান্য সরকারি সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রেও ৪৮% নারী নিজের নিরাপত্তাহীন ভাবেন। নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে ১০টি দেশের তথ্য প্রকাশ করে একশন এইড। গবেষণার জরিপে ৩৯.৩২ পয়েন্ট নিয়ে সি গ্রেডে ষষ্ঠ অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত কঙ্গোর সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশের এই অবস্থান। গবেষণায় পাঁচটি সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়। এগুলো হলো – নারীর প্রতি সহিংসতা, সহিংসতা মোকাবেলায় আইনগত সুযোগ, নারীবান্ধব বাজেট, নারীবান্ধব নগর ও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা। এগুলোর মধ্যে নারীবান্ধব নগর ও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর শূন্য।

একশন এইডের ২০১৭’র জরিপে গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা সূচকের শূন্য স্কোর ২০১৮তে এসেও শুধু অপরিবর্তিতই ছিল না, ক্ষেত্রে বিশেষে আরো অবনতি ঘটে। গণপরিবহনে নারীর উপর সহিংসতা-ধর্ষণের বেশ কিছু খবর আমরা পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি। এসব ঘটনায় আক্রান্ত কয়েকজন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।

এ ধরনের ঘটনা আমাদের সামাজিক সুস্থতা এবং নারীর নিরাপত্তা দুটোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক এক জরিপেও তার কিছুটা আভাস মিলেছে। দেশে গণপরিবহনগুলোতে ৯৪ ভাগ নারী যাত্রী মৌখিক, শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হন। নিপীড়িতদের অধিকাংশই প্রতিবাদ করেন না আরো হয়রানি হওয়ার ভয়ে। ব্র্যাকের সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গণপরিবহনে নারীর সুরক্ষায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নিচে। শ্রীলংকায় ৯০ এবং পাকিস্তানে ৮৫ শতাংশ নারী যাত্রী গণপরিবহনে নিপীড়নের শিকার হন।

মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদের তথ্যানুসারে ২০১৮ সালে দেশে মোট ধর্ষণের সংখ্যা ৯৪২, ধর্ষণের পর হত্যা- ৬৩, যৌন নির্যাতন – ১৪৬, যৌতুকের জন্য হত্যা ১০২।

২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮৭ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯ জনকে আর আত্মহত্যা করেছেন দুজন। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ২১ জন নারীর ওপর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

আসকের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এ তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ৪৬ জন। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৭ জন নারী। এর ফলে আত্মহত্যা করেছেন একজন, প্রতিবাদ করায় নিহত হয়েছেন দুজন পুরুষ। এছাড়া হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ৩২ জন নারী ও পুরুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন মাসে ৪২২টি শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৭১ জনকে হত্যা, ২৬টি শিশুর ক্ষেত্রে আত্মহত্যা। নিখোঁজের পর দুজন ও বিভিন্ন সময়ে ২০টি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

গর্ভপাতের সময় মৃত্যু হয়েছে একজনের। এছাড়া রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে ৭টি শিশুর। এসময় পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০৭ জন নারী। এর মধ্যে ৭৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন। এছাড়া শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৮ জন নারী। ৫৫ জন নারী যৌতুকের ছুতোয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১ জন। নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন চারজন। এছাড়া স্বামীর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ৯ জন নারীকে।

 

শোবার ঘর থেকে আদালত প্রাঙ্গণ

ধর্ষণের ক্ষেত্র এবং পরিধি অনেক ব্যাপক হলেও সাধারণ মানুষের মনে এই বিষয়ে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত। সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ভুল ধারণাটি হলো এটা কেবলমাত্র ঘরের বাইরে ঘটে এবং তা সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিসরে। অর্থাৎ রাস্তাঘাটে, মাঠে-ময়দানে, নিরালা যানবাহনে, যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটে অধিকাংশ মানুষের ধারণা তার ভেতরই সীমাবদ্ধ থাকে। অনেকে জানেন না যে একজন নারী তার শোবার ঘরেও আইনত বৈধ বলে ঘোষিত স্বামীর হাতেও ধর্ষিতা হতে পারেন। এই ধরনের ধর্ষণকে দাম্পত্য ধর্ষণ বলা হয়। বিশেষ করে উপমহাদেশে এমন ধর্ষণকে আইনগতভাবে বৈধ আচরণ বলে মেনে নিয়ে সংসার করছে লক্ষ লক্ষ নারী। অথচ জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের যে কোনও চেষ্টাই ধর্ষণের অন্তর্ভুক্ত, ধর্ষকপ্রবর আইনতঃ বৈধ স্বামী হলেও।

বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই এখন পর্যন্ত দাম্পত্য ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়নি। ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, যারা কাউন্সেলিংয়ের জন্য আসেন তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ‘দাম্পত্য কনফ্লিক্ট’ বিষয়ে কথা বলেন। এককভাবে সমস্যাগুলোর কথা শুনলে যৌন আচরণগত সমস্যার বিষয় আসলেও সেটাকে দাম্পত্য ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩৭৫ ধারায় আইনের ভাষায় ধর্ষণের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাতে ধর্ষকের ভূমিকায় স্বামীকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি (যদি মেয়েটির বয়স ১৮ বছরের নিচে না হয়)। অর্থাৎ স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করা স্বামীর জন্য কোনও অপরাধ নয়। যদিও আমাদের আইনে ১৮ বছরের নিচের কোনও মেয়ের বিয়ে আইনত বৈধ নয়(বিশেষ ক্ষেত্র বাদে)।’

জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ, ১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯, স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত নারী ও শিশুর সমঅধিকার নিমিত্ত পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, পারিবারিক সহিংসতা হতে নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ প্রণয়ন করা হয়।

এই আইনের ধারা ৩ মতে, পারিবারিক সহিংসতা বলতে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে এমন কোনও ব্যক্তি কর্তৃক পরিবারের অপর কোনও নারী বা শিশু সদস্যের ওপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বোঝায়। সুতরাং, নারীকে শুধু শারীরিকভাবে নিপীড়ন নয়, বরং মানসিক অত্যাচার, যৌন নির্যাতন এবং আথির্কভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হলে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইনের অধীনে স্বামী এবং স্বামীর পরিবারের যে কেউ অভিযুক্ত হবেন।

আইসিডিডিআরবি এর এক সমীক্ষা বলছে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের ৩৭% নারী কোনও না কোনও সময়ে স্বামীর হাতে যৌনপীড়নের স্বীকার হয়েছেন। জরিপে মাত্র ১০% পুরুষ ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। পুরুষদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় যে তারা এমন আচরণ কেন করেন? ৮০% পুরুষই মনে করেন তাদের স্ত্রীদের উপর তাদের সীমাহীন যৌন অধিকার রয়েছে।

জাতিসংঘ পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ। বাংলাদেশে ৪৭%, ভারতে ৩৪% নারী স্বামী দ্বারা নির্যাতিত হন। আফ্রিকার দেশ গিনিতে এ মাত্রা আরো ভয়াবহ, ৭৩%। জাতিসংঘের এই সমীক্ষানুযায়ী ৪২ দেশের অর্ধেকের বেশি দেশে প্রতি ৩ জনে ১ জন করে নারী স্বামীর মাধ্যমে যৌন এবং মানসিক পীড়নের শিকার।

 

অপরাধের বিপরীতে শাস্তির হার হতাশাজনক

সরকারি পক্ষ থেকে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা-ধর্ষণের মামলাগুলো আইনের আওতায় নেয়া হচ্ছে বলা হলেও সংশ্লিষ্ট অপরাধের শাস্তির ক্ষেত্রে ফলাফল মোটেও আশাব্যঞ্জক না।

নিম্নের উল্লেখিত খতিয়ানের মাধ্যমে সেটি প্রকট হয়ে ওঠে –

‘একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা জেলার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৪টি। এসময় মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪ হাজার ২৭৭টি। সাজা হয়েছিল ১১০টি মামলায়। অর্থাৎ বিচার হয়েছিল ৩ শতাংশের কম। বাকি ৯৭% মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস পেয়ে গেছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর ৪১% ক্ষেত্রে আসামিরা বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে। আর ৫৫% মামলায় সাক্ষ্য শুনানির শেষে আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছে। কিছু মামলা নিষ্পত্তির কারণ নিবন্ধন খাতায় লেখা নেই, কয়েকটির নিষ্পত্তি হয়েছে আসামির মৃত্যুতে। এভাবে ৯৭%  মামলার আসামির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

আরেক হিসাব অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পুলিশের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঁচ হাজার তিনটি ধর্ষণের মামলা হয়। এর মধ্যে রায় ঘোষণার হার ৩. ৬৬% এবং সাজার হার ০. ৪৫%। সর্বশেষ প্রাপ্ত হিসাবে ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশে ৪৩ হাজার ৭০৬টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার মামলায় এক লাখ আসামি খালাস পেয়েছে। আর ধর্ষণ মামলায় খালাস পেয়েছে ৮৮. ৩৫% আসামি। নারী নির্যাতনের মামলায় আসামি খালাসের পরিমাণ ৯৫%। নারীপক্ষের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে করা তিন হাজার ৬৭১টি মামলায় মাত্র চারজনের সাজা হয়েছে।’

 

সামাজিক অবক্ষয়ের আগ্রাসন

দেশে শিশুদের অবস্থাও তথৈবচ। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশে ৩ হাজার ৮৪৫ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে শিশুহত্যা বেড়েছে ২৮% এবং শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ৩৩%। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩০.৮% শিশু (০-১৪ বছর)। শিশুরা কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বা তারা অনেকটাই যৌন আবেদনহীন; তাই শিশু খুন বা ধর্ষণের হার শূন্যের কাছাকাছি হওয়ার কথা। কিন্তু ধারণার সবকিছু উলট পালট করে দিয়ে প্রায় পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে শিশু কিংবা নারী নির্যাতনের খবর।

সেসব খবরে সংঘটিত সহিংসতার এমন নিষ্ঠুর বিবরণ উঠে আসে যা মানুষ হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পশুরাজ্যের বাসিন্দা হলে লাজলজ্জার তোয়াক্কা না করলেও চলে যেত। কিন্তু মানুষ হবার দায় তো এড়ানো যায় না! আমরা লজ্জিত হই, ক্ষুব্ধ এবং ব্যথিত হই।

সম্প্রতি নুসরাতের ঘটনাটি এই সমাজের গালে একটা কঠিন চড় কষিয়ে দিয়েছে। মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিল তারই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজুদ্দৌলা নামের দানবটি। সেই ঘটনার প্রতিবাদ করে নুসরাত। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার পরিবার। যে কারণে ৬ এপ্রিল নুসরাত পরীক্ষার কেন্দ্রে ঢোকা মাত্র সুপরিকল্পিত ভাবে ডেকে নিয়ে মাদ্রাসার ছাদেই আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়। নুসরাত বাঁচতে চেয়েও পারেননি। ঘটনটি ঘটে এমন একটি জায়গায় যেখানে নুসরাতের সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা ছিল। নির্জন বাস নয়, নির্জন পার্ক নয়, নির্জন ট্রেন নয়, ছাত্রছাত্রী শিক্ষক পুলিশে ভরপুর একটি পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্রের দালানের ছাদে, তারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, তারই মতো শিক্ষার্থীর হাতে কেরোসিন দিয়ে তাকে পোড়ানো হয়।

নুসরাতের ঘটনায় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ স্তম্ভিত হয়েছেন। অধিকাংশ বলছি এ কারণেই, এমন জঘন্য ঘটনায় সমাজের বুদ্ধিজীবী, আলেম শ্রেণি, কিংবা সাধারণ ছাত্রছাত্রী অর্থাৎ গোটা দেশের সমস্ত মানুষের যুথবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়ার কথা ছিল। ততটা এক্ষেত্রে দেখা যায়নি। ঘটনাটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে যতটা তোলপাড় হয়েছে, বাস্তবে তার অল্পই ঘটেছে। ঘটনাটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হওয়ায় গুরুত্ব পায়। নইলে আর দশটা নির্যাতনের কাহিনির সাথে এটিও চাপা পড়তো।

১১ এপ্রিল নুসরাত হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তবে যেতে যেতেও তার উপর সংঘটিত জঘন্য সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন কন্যা সাহসিকা নুসরাত! ছুড়ে দিয়েছেন এই অসুস্হ বর্বর সমাজের দিকে কিছু প্রশ্ন। নুসরাতের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার যখন তোড়জোড় চলছে, তখন আরো একটি ধর্ষণ পরবর্তী খুনের ঘটনা ঘটে এবং সেটি তেমন গুরুত্ব পেতে ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এছাড়াও ধর্ষণের পেছনে ভূমিকা রাখছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং অপরাধের রাজনীতিকরণ। অপরাধী যদি রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকে তাহলে সে বিচারের হাত থেকে বেঁচে যায়। এখন যে কোনো অপরাধীই অপরাধ করার পর কোনও না কোনো ক্ষমতাবানের আশ্রয় লাভ করে। ধর্ষণের অপরাধটা হলো সবচেয়ে সহজ অপরাধের একটি, যাতে আক্রান্ত নারী অনেক সময় সামাজিক নিগৃহীতার শিকার হবার ভয়ে প্রকাশ করতে চায় না। প্রকাশিত হওয়া ধর্ষণের চেয়ে অপ্রকাশিত ধর্ষণের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বেশি। এটার আরেকটি কারণ হল এদেশের আইন ও বিচার প্রক্রিয়া নারীটিকে আরও কয়েকবার সামাজিকভাবে ধর্ষণ করে সপরিবারে।

প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণ সংবাদ। একটা ঘটনার জের শেষ না হতেই আরেকটি ঘটনা। একটি ঘটনা যেন আরেকটি ঘটনাকে উৎসাহিত করে। পুরোনো ঘটনাকে চাপা দিয়ে জন্ম নেয় নতুন ঘটনা। ধর্ষকেরা সব এই সমাজেরই সদস্য। পরিবহন শ্রমিক থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, এমন কি জন্মদাতা বাবা পর্যন্ত, যে কেউ যে কোনও সময় মুখোশ খুলে ধর্ষক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আরো ভয়ানক ব্যাপার হলো সেই ধর্ষকেরও সমর্থক আছে। ফেসবুকে ধর্ষণ ঘটনার আলোচনায় অনেক ভদ্রবেশী পুরুষের মন্তব্য পড়ে আশঙ্কা জাগে জগতের বড় অংশের পুরুষই সম্ভাব্য ধর্ষক কিনা। যারা ধর্ষকের দোষ না দেখে কোনও না কোনওভাবে নারীর খুঁত বের করে দোষী সাব্যস্ত করে। এমন সমাজ একজন নারীর জন্য কতটা নিরাপদ? নারী কার কাছে নিরাপদ? নারী হয়ে জন্ম নেওয়াই কী অপরাধ? পচে যাওয়া ক্ষয়ে যাওয়া বিকৃত মানসিকতার এই সমাজকে মেরামত করার কোন দায়িত্ব নেই মানুষের, রাষ্ট্রের, সভ্যতার? ধর্ষণের বিপদ মাথায় নিয়ে নারী জন্ম পার করার এই তামস সময়ের অবসান কবে হবে!

 

সৌজন্য স্বীকার:

  1. Southasian monitor -November, 2017
  2. IPU – Issues Brief – October, 2018
  3. History of Sex- Wikipidia
  4. Domestic violence in Asian Indian context by Shamita Dasgupta
  5. The war on Weman by Deidre McPhillips
  6. Nationmaster : Crime > Rape rate: Countries Compared
  7. National Sexual Violence Resource Center- 2012-2015
  8. Addressing violence against women in Pakistan: time to act now By Uzma Quresh
  9. Afghan Government Ignoring Violence Against Women- by Heather Barr              
  10. প্রথম আলো- ১০ এপ্রিল ২০১৮
  11. দৈনিক পূর্বকোণ – ১৭ মার্চ, ২০১৯ (প্রকাশিত)
  12. আইন ও শালিস কেন্দ্র- ১২ জানুয়ারি, ২০১৭
  13. ভোরের কাগজ – ২৪ এপ্রিল, ২০১৮(প্রকাশিত)
  14. ডেইলি স্টার- ৩০ নভেম্বর, ২০১৭
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...