রোমেল রহমান
মাংস নিয়ে আচমকা হাউকাউ রাক্ষস সমাজে! মানুষের মাংস! চিরকাল রাক্ষস ভোক্কস আর খোক্কসেরা এই মাংস খেয়ে আসছে! আচমকা টোক্কস প্রজাতি বলে উঠল, আগে দেখে নাও ওটা কীসের মাংস? রাক্ষস বলল, কেন মানুষের। খোক্কস বলল, হ্যাঁ মানুষের! ভোক্কস বলল, ঠিক ওটা মানুষের মাংস, আমরা এখন খাব ওটা! টোক্কস টের পেল এই তিন প্রজাতির দৈত্যদানো বিবর্তিত হতে হতে প্রাচীনকালের জাতপাত প্রথা নিয়ে মাথা ঘামায় না আর! টোক্কস বলল, বলছিলাম যে তোমাদের গোত্রের তো জাতপাত গেছেই, এবার অন্যদেরও সর্বনাশ করবে? আমাদের রাক্ষসকূলের ঐতিহ্য রক্ষা করার কাজটা করবে কে তাহলে? ধর্ম নাশ করে শুধু মাংস খেলেই হবে? তারা তিনজন বলল, বুঝলাম না! টোক্কস বলল, তা বুঝবে কী করে! খাও তো যাকে পাও তাকেই ধরে! খাওয়ার মধ্যে বাছবিচার নেই কোনও! ভোক্কস বলল, খুলে বলো! টোক্কস লকলকিয়ে বলে, ঐ যে মানুষের মাংস! ঐ মানুষটা কী? কে? খোক্কস বলল, কেন মানুষ! শেওড়াতলা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল আমরা গুম করে ধরে নিয়ে এলাম! এখন খাওয়াদাওয়া হবে! টোক্কস বিরক্তি নিয়ে বলল, বলছি যে ওটা হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-জৈন-শিখ-হাজং-গারো-ম্রো নাকি সাঁওতাল? রাক্ষস বলল, অ এবার বুঝেছি কিন্তু তা দিয়ে আমাদের কাজ কী? ওসব তো মানুষদের কাজকারবার! খোক্কস বলে উঠল, মানুষের নিম্ন রুচির পরিচয় ওসব! আমরা হচ্ছি রাক্ষস আমাদের ঐসব ছেনালি মানায়? ভোক্কস বলল, তার উপর যদি মানুষ আর আমরা একই কাজ শুরু করি তাহলে তো তফাৎ থাকবে না? এম্নিতে মানুষেরা যেরকম সাজপোশাক করছে আজকাল তাতে আর মানুষ না পিশাচ না দৈত্য না রাক্ষস বোঝা যাচ্ছে না! তখন এক রাক্ষুসি এসে হাজির হল। রাক্ষুসি এসেই বলল, কী ব্যাপার আজকে যে এখনও খাওয়াদাও শুরু করোনি, ব্যাপারটা কী? অতিথি টোক্কসকে পেয়ে এক ভদ্রতা দেখাচ্ছ নাকি? ভোক্কস বলে উঠল, আরে না! এই টোক্কস বেটা ঝামেলা পাকিয়েছে! সে বলছে আমরা নাকি এক মহা ভুল করে যাচ্ছি! জাত ধর্ম না দেখে মানুষ খাচ্ছি! রাক্ষুসি নাকি সুরে টেনে টেনে বলে ওঠে, উউউহ! জাত, ধর্মওওও! পেটে খাবার নেই, খাওয়ার মতন আস্ত মানুষ পাওয়া যায় না উনি এসেছেন আবার জাত-ধর্ম মারাতে! টোক্কসের এবার গায়ে লেগে যায়! সে বলে ওঠে, অমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না তো বাল! আমি তোমাদের মেহমান! টোক্কস প্রজাতির প্রতিনিধি আমি! রাক্ষস ধর্মের প্রাচীনপন্থী একজন গুরু আমি। এসেছি অনেক দূরের দেশ থেকে! তোমাদের বোঝাতে চাচ্ছি সাম্প্রদায়িক বিবাদের প্রয়োজনীয়তা! এটা যে একটা গুরুত্বপূর্ণ সূক্ষ্ম রাজনীতি এটা বোঝা দরকার! এর জন্যে আমি ঘুরে ঘুরে আমাদের সব কমিউনিটির কাছে যাচ্ছি! ভোক্ষস হাই তুলতে তুলতে বলে ওঠে, সাম্প্রদায়িকতা জিনিসটা আবার কী? সম্প্রদায় তো দুটো। এক, রাক্ষস; দুই, মানুষ! টোক্কস বলে ওঠে, ওর মধ্যেই কারবার! বিচিত্র হিসেব নিকেশ! এটাই বুঝতে হবে! এই যে মাংস খাচ্ছ এই মাংসের আছে বিচিত্র গুণাগুন! মাংসের আছে রাজনীতি! কোনটা কে খাবে, কোনটা কে খাবে না সেটা হিসেব করে মানুষেরা! পশুর মাংসকে কেন্দ্র করে তারা বিভাজিত হতে পেরেছে! এটা একটা ভয়াবহ উদাহরণ! আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? আমরা কেন মানুষের মাংসে বিভাজনের রাজনীতিকে গ্রহণ করব না? কেন আমরাই ভোদাই থেকে যাব? আমাদেরও উচিৎ মনুষ্য সভ্যতা থেকে সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা নেয়া! খোক্কস বলে, তাহলে তো ইলেকশনও করতে হবে? ইলেকশনে জয়পরাজয় নিয়ে একটা হ্যাঁচড়প্যাঁচড় লাগাতে হবে? কী যেন বলে, ওহ হ্যাঁ দাঙ্গা বাঁধাতে হবে! তাই না? টোক্কস বলে, বাহ! ভালোই তো জানো তুমি, কিছু পড়ালেখাও আছে মনে হয় সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিষয়ে? তাহলে চিন্তা কীসের! এসো আমরা এখানে এই অঞ্চলের জন্য প্রথমে একটা ‘গোঁড়া সাম্প্রদায়িকতা উজ্জীবন কমিটি’ খুলে ফেলি? খোক্কস বলে, তাতে লাভ কী? রাক্ষুসি বলে, সেই কমিটির কাজ কী হবে? টোক্কস বলে, লাভ অনেক! এই যে আমাদের একটা ঐক্য তৈরি হল! আমরা আমাদের সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ক সকল রাক্ষসীয় আচার উপাচারের প্রয়োগের নিরিখে একটা সমাজ বানাব! রাক্ষস বলল, তা আমাদের লড়াইটা কার বিরুদ্ধে? টোক্কস একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, মানুষের বিরুদ্ধে! রাক্ষস বলল, তুমি বাঁড়া রাক্ষস প্রজাতির নাকি অন্য কোনও জাতির? এলিয়েন ফেলিয়েন নাকি? উদ্ভট সব কথাবার্তা বলছ! আরে ভাই মানুষ তো আমাদের আলোচ্য নয়! আমরা তো রোজ মানুষ ধরে ধরেই খাচ্ছি! ওরাও আমাদেরকে ভয় পাচ্ছে! কিন্তু এই যে ‘গোঁড়া সাম্প্রদায়িকতা উজ্জীবন কমিটি’ করে আমাদের রাক্ষস সমাজের লাভটা কী? আমরা লড়ব কার বিরুদ্ধে সেটা জানতে চাচ্ছি! খোক্কস বলে ওঠে, ঐযে আমরা যে শ্রেষ্ঠ এবং খাঁটি সেটা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে আমরা আমারই লড়াই করব এবং মরব! টোক্কস ঢোক গিলে বলে, আসলে আমাদের মধ্যে প্রথমে গোঁড়ামি প্রতিষ্ঠা করতে হবে! এবং যার প্রথম ধাপ বা কাজ হচ্ছে, সব প্রজাতির মানুষ ধরে ঘাড় মটকে খাওয়া যাবে না! বিশেষ বিশেষ ধর্মের মানুষদের মাংস নিষিদ্ধ! তবে ক্ষমতাবান মার্কিনদেশি বা অন্য বণিকদেশি বা যাদের পারমাণবিক মাল আছে সেইসব দেশি মানুষেরা প্রথম ধাপে বাদ মানে ছাড় পাবে! কিন্তু এখন জিজ্ঞাসা হচ্ছে, কেন এই মাংস বিষয়ক বাছবিচার? এটাই তো প্রশ্ন? কারণ হচ্ছে আমাদের রাক্ষস সমাজের মধ্যে আমরা শুদ্ধতা জারি করতে চাই! আমাদের রক্ষস সংস্কৃতিতে আদিম প্রথা ফেরাতে চাই! যেটাকে আমরা বলছি, ‘গোঁড়ায় ফেরো’ কর্মসূচি! ভোক্কস ফিচকে সুরে বলে ওঠে, জামাকাপড় খুলে নেংটু হতে চাওয়া, তাই না? টোক্কস শক্ত সুরে দাঁতে দাঁত ঘষে বলে ওঠে, বেয়াদবি করবে না! রাক্ষুসি শক্ত স্বরে বলে ওঠে, দেখুন বেশি হ্যাজাবেন না! এম্নিতে আমাদের খিদে লেগেছে! সামনে তাজা মানুষ রয়েছে সেটা খাব তার মধ্যে আপনি মেহমান হয়ে এসেছেন ভালো কথা! কোথায় আপনাকে একটু ভালো দেখে ধরে আনা মানুষটার শরীর থেকে মগজ, কলিজা ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করব সেটা ফেলে আপনি বালের সাম্প্রদায়িকতার এক কুটিল ডিস্কোর্স খুলে নিজে নিজেই পেঁচিয়ে ফেলছেন! তার চেয়ে খুলে বলুন যে, আপনারা টোক্কসেরা ইলেকশন করতে চাইছেন রাক্ষস সমাজের মধ্যে! আপনারা সমাজপতি হতে চাইছেন। ক্ষমতার লোভ আপনাদের গ্রাস করেছে! টোক্কস সম্প্রদায়ের এই পেজগি আমরা বুঝতে পেরেছি! এই উদ্দেশ্যে আপনারা রাক্ষস ধর্মকে ব্যবহার করছেন! সাধারণ রাক্ষস, খোক্কস, ভোক্কসদের ধর্মানুভূতি ব্যবহার করে আপনারা খাম্বার মাথায় উঠতে চাচ্ছেন তাই তো? টোক্কস বলে ওঠে, দিদি! আপনি কি আমাদের সেন্ট্রাল কমিটির কেউ? রাক্ষস হেসে দিয়ে বলে, কেন? উনি তো আমার বউ! তোমাদের সেন্ট্রালের কেউ হতে যাবেন কোন দুঃখে? টোক্কস বলে ওঠে, না মানে উনি আসল কথাটা বলে ফেলেছেন! উনি এত কিছু জানেন কী করে? খোক্কস বলে, ওটা আমাদের সবারই জানা! রোজ দেখতে হয়, মানুষ যা করছে! গরু, খাসি, মুর্গি, পাঁঠা, শূকর নিয়ে ঘেন্নাকর রাজনীতি! ফলাফল মানুষের হাতে মানুষ মরছে! এক দেশ, এক সীমানার মানুষের মধ্যে ঐক্য নষ্ট হচ্ছে বলেই আপনার মতন ফরেন মালেরা এসে ঢুকে যাচ্ছে! কেনাবেচা করছে ইত্যাদি ইত্যাদি! টোক্কস বলে ওঠে, আমি তো আপ্নাদেরই লোক! ভোক্কস বলে, লাথিটা কি কোমরে মারব নাকি পাছায়? টোক্কস বলে ওঠে, বেয়াদবি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! রাক্ষুসি খেঁকিয়ে বলে ওঠে, আমাদের মধ্য মানুষের মাংস নিয়ে বিবাদ বাঁধাতে এসে আবার আমাদেরকেই হুমকি দিচ্ছেন? রাক্ষস বলে, তুমি বিদেয় হও নইলে মার খাবে! আর যাবার আগে এটুকু জেনে নাও, অন্য পথে গেলেও আমরা অন্তত মানুষের মতন সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পথে যেতে রাজি নই! ঐ গরু মহিষ উট পাঁঠা ভেড়া শূকর দুম্বা দিয়ে নিজেদের ভাগ করার বা রক্তপাতের যেই ঐতিহাসিক ঘেন্নাকর রাজনীতি তারা করে আসছে সেটার বীজ আমরা অন্তত রাক্ষস সমাজে প্রতিষ্ঠা হতে দিতে রাজি নই! আমাদের কাছে মানুষের মাংস মানে মানুষের মাংস! ওটা আমরা খাই, এবং খাব!
রাক্ষস সমাজে চোক্কসরে ডুকায় দেও ওদের চেতনা অনেক কৌশলী হয়।