প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
“সুপ্রভাত! যদিও আপনাদিগের শুভ রাত্রি! আমার শুভেচ্ছা লইবেন!”
তার সাহেবি টান খুব একটা তার বাংলা কথা বলার মধ্যে বোঝাতে দেন না জেমসন। বাংলা তিনি ভালোই বলতে পারেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে খানিক টেনে টেনেই কথা বললেন তিনি এখন।
রাধামোহন বিনীতভাবে মাথা নত করে বললেন, “কী সেবা করতে পারি আপনার বলুন?”
“আমি আজ সকালে জোড়াদীঘির মাঠে বুলবুলির লড়াই দেখিয়া খুব প্রীত হইয়াছি। আপনাদের থেকে কিছু বুলবুলি কিনিতে চাই!”
রাধামোহন একবার সরেজমিনে জরিপ করল সাহেবকে। দেখে ঠিক সন্দেহ করতে প্রাণ চায় না। তবে রাধামোহন রাজা ইন্দ্রকমল সিংহের ডানহাত। তাকে অন্য সকলের থেকে বেশি সতর্ক হতেই হবে।
“এজ্ঞে, এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্য!”
এইটাই বলতে যাচ্ছিল রাধামোহন। কিন্তু থমকাল। এত সহজে এত বিনয় দেখানো চলবে না সিংহদের কুঠিবাড়িতে। স্বয়ং ভগবানও যদি কোনওক্রমে এই কুঠির দরজায় এসে দাঁড়ান, তাহলেও কেউ মাথা নোয়াবে না তার কাছে। এই কুঠিবাড়িতে শেষ কথা বলেন একজন, তিনিই রাজা, তিনিই ঈশ্বর। তার নাম রাজা ইন্দ্রকমল সিংহ।
তবে এ কুঠিবাড়িতে লুকোনো ছিল এক অজানা সত্য। সে রাতে যার খোঁজ পেয়েছিল জেমসন ও মোহন।
রাধামোহনেরও আচমকা মনে পড়ল সেই গোপন সত্যের কথা। এবং খানিক সতর্ক হয়ে উঠল সে।
তার এও মনে পড়ল যে আজ রাত ইন্দ্রকমলের শিকারের রাত। মেয়েটিকে অতিকষ্টে চুপ করানো গেছে। এমতাবস্থায় এই উটকো সাহেবের আগমন…
“অনেক দূর থেকে আসিয়াছি! শীঘ্রই ফিরিতে হইবে! আপনাদিগের আপত্তি না থাকিলে আজিকে রাত্রে আমি আপনাদিগের আতিথেয়তা গ্রহণ করিতে চাই!”
এ তো আচ্ছা গায়ে পড়া। রাধামোহনের বিরক্ত লাগল। কী যে উত্তর দেবে তা ভেবে পাচ্ছিল না সে। যতই হোক, সাহেব বলে কথা!
“সিংহবাড়ির আতিথেয়তার তো এমন সুখ্যাতি নেই যে এত রাতে সাহেব এবাড়িতে এসে হাজির হবেন!”
রাধামোহন আমতা আমতা করে বলল।
“ভুল!”
একটা রক্তজল করা কণ্ঠস্বর জেমসন এবং রাধামোহন দুজনকেই চমকে দিল। রাধামোহন পেছনে ফিরল।
হাতে একটা মণিমুক্তাখচিত মাথাসম্বলিত ছড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্দ্রকমল সিংহ।
ঐ ছড়িটিও তার একটি পারিবারিক অভিজ্ঞান।
সচরাচর এই ছড়িটি সঙ্গে রাখেন না ইন্দ্রকমল। বিশেষ বিশেষ রাত ছাড়া।
সে রাত ছিল তেমনই এক বিশেষ রাত।
রাধামোহন উদ্যোগী হয়ে বলতে গেল, “এজ্ঞে হুজুর এই সাহেব…”
“কতদূর থেকে আসছেন আপনি?”
“শ্রীরামপুর, রাজামশায়!”
“আসার হেতু?”
“এজ্ঞে হুজুর, ওরা আমাদের বুলবুলি কিনতে এসেছেন!”
রাধামোহন ফুট কাটল।
“আমি আমার পোষা বুলবুলি বিক্রি করি এমন কথা তো শুনিনি!”
“ক্ষমা করিবেন, তবে আজিকে জোড়াদীঘির মাঠে আপনাদিগের লড়াই দেখিয়া এই ক্রীড়াটির প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ জন্মিয়াছে। সুতরাং…”
“মহাশয়ের বাংলা শেখা হয়েছে কোথায়?”
ইন্দ্রকমলের প্রশ্ন শুনে একটু হাসলেন জেমসন!
“সংস্কৃত কলেজের গৌরমোহন তর্কালঙ্কারের কাছে!”
একথা ভুল নয় বটে। উনিশ শতকের গোড়ায় ইংরেজ সিভিলিয়ানরা বাংলায় কাজ চালাবার সুবিধার্থেই বাংলা শিখেছিল। কেরি সাহেব, মার্সম্যান সাহেব, শ্রীরামপুরের পাদ্রিরা চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। তারও আগে এক রুশ সাহেব এখানে এসে বাংলা শিখে মলিয়েরের নাটক অনুবাদ পর্যন্ত করে ফেললেন। যা হোক, বাংলায় গোয়েন্দাগিরি করতে গেলেও বিবিধ শ্রেণির মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে হয়, তাই তার জন্য বাংলা ভাষা, বাঙালির আদবকায়দা রপ্ত করতে হয়। হ্যালিডে সাহেবের ব্যাকরণ ছিল বটে, তবে গৌরমোহন না থাকলে তার বাংলায় এই মুন্সিয়ানা তৈরিই হত না।
“সিংহদের কাছে স্বয়ং বড়লাট হেস্টিন সাহেব (ইন্দ্রকমলের উচ্চারণ মোতাবেক) আতিথেয়তা পেয়েছেন। আপনিও পাবেন। আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি থাকবে না। আসুন ভেতরে!”
“আপনার অসীম কৃপা!”
রাধামোহন একটু ইতস্তত করে বলল, “এজ্ঞে, আপনার সঙ্গে আরেক সাহেব আছেন না?”
জেমসন খানিক থমকালেন। চট করে ভেবে নিলেন মোহনকে ঢোকানোর ঝুঁকির বিষয়ে। আজ সকালে জোড়াদীঘির মাঠের বাইরে সবাই তাকে দেখেছে। বিশেষত ইন্দ্রকমল! কারণ তার মোসাহেবের ওপরেই চড়াও হয়েছিল মোহন!
বুক ঠুকে তবু তাকে ডেকেই নিলেন জেমসন।
মোহন সাহেবের বেশে এসে দাঁড়াল।
না, রাধামোহন চিনতে পারেননি।
আবছা আলোয় আঁধারে ইন্দ্রকমলের পাথুরে চোখে কোনও নড়াচড়া দেখতে পেলেন না জেমসন!
“আসুন!”
ইন্দ্রকমলের কণ্ঠস্বরও তার দৃষ্টির মতন পাথুরে ঠেকল।
একটা চাপা আলো অন্ধকারের মধ্যে চার্লি প্যাটন আর দেবীলালের ক্রুর শয়তান মুখগুলো দেখতে পাচ্ছে কালীনাথ। তার সর্বাঙ্গ রাগে অস্থির। এইমুহূর্তে চরম আক্রমণ করতে ইচ্ছে করছে এই নরাধমগুলোকে। কিন্তু ওর শরীরে সাড় নেই।
প্যাটনের হাতে একটা ছড়ি। সেটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে কালীনাথের সামনের লণ্ঠনের আলোটা অতিক্রম করে এসে দাঁড়াল প্যাটন।
কালীনাথ অতিকষ্টে মুখ তুলে দেখল আদিনাথের কালো অবয়ব। প্রকৃতই দানবীয় লাগছে তার চেহারাটা। প্যাটনের আসল সত্তাটা যেন এইবারে শারীরিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
কালীনাথের মুখের ওপর ছড়িটা বোলাল প্যাটন। কালীনাথ ঘেন্নায় ওই অন্ধকার অবয়বের মুখ লক্ষ্য করে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে তার প্রত্যুত্তর এল। ছড়িটা সজোরে এসে লাগল কালীনাথের মুখে।
বিশ্রীভাবে হেসে উঠল চার্লি।
কালীনাথের মুখে যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ বোঝা গেল না অন্ধকারে। তবে সে অনুভব করল প্যাটনের মুখে নারকীয় তৃপ্তি। আর তার গালের একপাশ দিয়ে একটা রক্তধারা নামছে।
কালীনাথ তার শক্ত দড়িতে বজ্র আঁটুনিতে বাঁধা হাত ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করল। এমন সময় ঘরে ঢুকল এদের দুই পেয়াদা, সঙ্গে এক নারী, হাত পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায়, যাকে দেখে চিনতে পারল না কালীনাথ, কিন্তু এক অজানা আশঙ্কায় ভরে গেল তার বুক।
চার্লি একটা ধূর্ত হাসি ছুঁড়ে দিয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করল দেবীলালকে।
মুখ খুলল দেবীলাল।
“শম্ভুর বউকে চিনতে পারছ কালীনাথ? এহ হে, ভুলেই গিয়েছিলুম তুমি তোমার বাপের ওই দোষটা পাওনি। পেলে এ গাঁয়ের সব চাষার ঘরের মেয়েমানুষদের চিনতে!”
হাসির রোল উঠল ঘরে। এমনকি পেয়াদাদুটোও হেসে উঠল।
কালীনাথের মুখ অপমানে কালো হয়ে গেল। জমিদারি অহঙ্কারে ঘা লাগা আর নিজের বাবার প্রতি বিরক্তিকে ছাপিয়ে গেল তার নিজের অপমান। সত্যিই, তার বাবার লাম্পট্য তাকে যে কত লজ্জায় ফেলবে! এখন সময় বদলাচ্ছে। কৃষকরা জেগে উঠছে। নীলকরদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটছে। দুদিন পর নীলকররা থাকবে না। এই অবস্থা চলতে দিলে জমিদারদের হাতেও আর কিছুই থাকবে না। চাষিদের বশ করার এটাই সবথেকে ভালো সময়। এখনই এদের বোঝাতে হবে যে জমিদাররাই এদের পাশে থাকবে। এদের বোঝাতে হবে যে জমিদাররা ছাড়া তাদের গতি নেই। নীলকরদের সঙ্গে জানপ্রাণ লড়ে এ কথা প্রমাণ করে দিতে হবে। এখনও তার বাবা বুলবুলির লড়াই, বাঈনাচ, মেয়েমানুষ এসব নিয়ে পড়ে।
কালীনাথের ভাবনায় ছেদ পড়ল। কারণ চার্লি দুই পেয়াদার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে শম্ভুর বউকে। চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে এনেছে সামনে।
শম্ভুর বউয়ের চোখে অপরিসীম আতঙ্ক কালীনাথকে বুঝিয়ে দিল কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে চলেছে।
সে প্রাণপণে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল।
আর তার চেষ্টা, তার বেপরোয়া ভাব যত বাড়তে লাগল, তত ছড়ির মোক্ষম ঘাগুলো তার শরীরের নানান অংশকে ক্ষতবিক্ষত করল। আর তত একটা বিশ্রী হাসির শব্দের মাত্রা বাড়তে লাগল। হাসিটা দেবীলালের।
আর চার্লি চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে শম্ভুর বউকে নিয়ে গেল পাশের ঘরে। তার আগে শম্ভুর বউয়ের মুখের বাঁধন টেনে খুলে ফেলল চার্লি।
কালীনাথকে চরম আক্রোশে, চরম হিংসায় আঘাত করতে করতে উল্লাসে তুমুল চিৎকার করছিল প্যাটন। আর দেবীলাল হো হো করে হাসতে হাসতে বলছিল, “জমিদারের গুমর, হোঃ, জমিদার!”
এই বিশাল শব্দকোলাহলের সঙ্গে এবার যুক্ত হল শম্ভুর বউয়ের আর্তচিৎকার। যেন জ্যান্ত নরকে আছে, এমন মনে হল কালীনাথের।
চার্লি তাকে বলল, “টুমি যাথে শুনিতে পাও শম্ভুর বউ কতটা চিথখার খরিতেছে তার জন্য ওর মুখ থেকে হ্যান্ডকারচিফটা খুলে নিলাম!”
এই বলে রুমালটা ছুঁড়ে মারল চার্লি কালীনাথের দিকে। এবং দরজাটা বন্ধ করল।
কালীনাথ অসহ্য যন্ত্রণায় হাহাকার করতে লাগল। সে কল্পনাও করতে পারল না শম্ভুর বউয়ের ওপর কী অত্যাচার হয়েছে। শম্ভুর বউয়ের চিৎকার, আজন্ম শোষিত শ্রেণির চিৎকার, আজন্ম শোষিত লিঙ্গের চিৎকার, যার আসল নামটা পর্যন্ত কেউ উচ্চারণ করে না তার চিৎকার মিশে গেল শোষক কালীনাথের হাহাকারের সঙ্গে। আরেক শোষকের তুমুল অট্টহাসি আর উল্লাসের শীৎকারের সঙ্গে। মঙ্গলগঞ্জের নীলকুঠি থেকে ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়ের সেই আবহসঙ্গীত প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সারা গ্রামে।
পাঁচীর একটা নাম আছে। কেউ জানে না। বোবা বলে তাকে ওই নামে কেউ ডাকেও না। কিন্তু মোহন আর পাঁচী দুজনেই বোবা হওয়াতে দুজনেই সমাজের এক ব্যবহার পেয়েছে, দুজনেই বুঝেছে লড়াই করে বাঁচতে হবে। তাই ওদের দুজনের নামগুলো ঠিক মাথায় বসে গেছে, যে সংস্কার থেকে বাঙালি মহিলারা স্বামীদের নাম মুখে আনত না সে সংস্কার ঘুচে গেছে তাদের।
পাঁচীকে মারধর করা হয়নি। রাজাবাবুর কড়া নিষেধ। তাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে খানিক। পুরোপুরি সফল না হলেও খানিক ঝিমুনি এসেছে তার। তার অবোধ্য চিৎকার তার কণ্ঠস্বর চিরে দিয়েছে। তার যাবতীয় প্রতিরোধের ক্ষমতা লোপ পেয়ে গেছে।
রাজাবাবুর আদেশ অনুযায়ী তাকে সাজানো হচ্ছে নববধূর বেশে।
সেই সাজঘরে দরজা ঠেলে ঢুকল রাধামোহন।
ঘরে উপস্থিত চাকর বেয়ারাদের উদ্দেশ্যে বলল, “ঘরে অতিথি এসেছে! আমার আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত এই মাগীকে ঘর থেকে বের করবি না!”
তারা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
ক্রমশ