স্টেশন মাস্টার
...মাস-পহেলায় তৃতীয় বৎসরের প্রথম যে মেল-ট্রেন যাত্রা করিবার কথা ছিল, তাহার সময়সূচি ঈষৎ পিছাইয়া করা হইয়াছে চৌঠা মে। এবং বলা বাহুল্য, দেশজোড়া সাধারণ নির্বাচনের আবহে তৃতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যার মূল বিষয়ভাবনার অভিমুখ নির্ণয় করিতে বসিয়া নির্বাচন ছাড়া আর কিছুই আমাদিগের বিবেচনায় আসে নাই। সে-কারণেই, গত সংখ্যার প্রতিধ্বনিস্বরূপ, এবারের রিজার্ভ্ড বগির নাম ‘আবার ভোটের লাইনে’। যেহেতু সাপ্তাহিক লোকাল ট্রেন বিভাগেও আমরা গত মাসাধিককাল ধরিয়া নির্বাচনেরই বিভিন্ন দিক লইয়া একাদিক্রমে আলোচনা করিয়া আসিতেছি, তাই এই সংখ্যার রিজার্ভ্ড বগিতে আমরা বাছিয়া লইয়াছি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সহিত জড়িত কিছু স্বল্পালোচিত বিষয় ও সংশ্লিষ্ট মানুষজনের কথা।...
জন্মদিনের সাড়ম্বর উদ্যাপন যখন বিশেষরূপ যাপনের দৃষ্টান্ত না-হইয়া কেবল উৎসবে পর্যবসিত হয়, তখন তাহা বালখিল্যতার নামান্তর। সেলেব্রিটি ও খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গের, এমনকী মেগা-প্রতিষ্ঠানেরও, জন্মদিন অবশ্য পৃথক বিষয় – আপনাপন ব্র্যান্ড-পরিচয় জনচিত্তে জাগরুক রাখিবার গুরুদায় ও তন্নিমিত্ত সূচনাবিন্দুটিকে জনমানসে সবিশেষ করিয়া তুলিয়া তাহাকে একটি ইভেন্টের রূপ দিতে তাঁহারা সদাতৎপর হয়েন, না-হইলে নয় বলিয়াই। তাঁহাদিগের ঈদৃশ তৎপরতার মর্ম বুঝা কঠিন নহে, যদিচ তাহাতে সেই ব্যক্তি বা সংস্থার প্রতি অনুকম্পাই হয়, শ্রদ্ধা ততদূর বাড়ে না। মানবসংসারে নবাগত শিশুটির জন্মদিন পালনের মধ্যে সেই ব্র্যান্ড-বিল্ডিংয়ের বীভৎস ধেড়েখোকামি নাই – সে উৎসবে পড়োশিবৃন্দকে ডাকিয়া আনিয়া জুটাইলেও তাহার মধ্যে যে আনন্দ ভাগ করিয়া লইবার প্রয়াস তাহা আপন সহজতার গৌরবেই ক্ষমাযোগ্য হইয়া উঠে। আর যদি বা সে উৎসবে পড়োশিগণ উপহারহস্তে উপস্থিত না-থাকেন, আয়োজনহীন গৃহকোণে মাতা যখন মৃদু শঙ্খধ্বনিটির পাশে মৃদুতর প্রদীপের আলোয় আপন সন্তানের মুখে স্বহস্তপ্রস্তুত পায়সান্ন তুলিয়া দেন, সে অনুষ্ঠান তাহার অন্তর্গত গৌরবের আলোকেই প্রোজ্জ্বল হইয়া উঠে – মৃদু দীপশিখাটিই তখন মশালের ন্যায় সন্তানের সম্মুখজীবনের পথরেখাটিকে আলোকিত করিতে থাকে। সে উৎসবের অনুচ্চকিত বিভাই তাহার গৌরব, তাহার নম্র অন্তর্মুখিনতাই তাহার সালংকার জয়টীকা।
এত কথা মনে আসিল এই পহেলা মে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম তাহার দুই বৎসর অতিক্রম করিয়া তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করিল বলিয়া। জন্মদিনটি কীভাবে উদ্যাপন করা যায় তাহা লইয়া সম্পাদকমণ্ডলী যখন ভাবিতে বসিয়াছিলেন, তখন নানা প্রস্তাব আসিয়াছিল। আমরা কি গোটা বর্ষপূর্তি সংখ্যাটিকেই জন্মদিনের উদ্যাপনের স্মারক করিয়া তুলিব? আমরা কি জন্মদিনসূচক একটি পৃথক বিভাগ পরিকল্পনা করিব? আমরা কি জন্মদিনের থিমটিকেই এই সংখ্যার প্রধান আলোচ্য ও উপজীব্য করিয়া তুলিব? নাকি, এই মুহূর্তে চারিপার্শ্বের প্রধানতর বাস্তবতাগুলিই আমাদের আলোচনার সিংহভাগ দখল করিয়া থাকিবে? ভাবিতে ভাবিতে এক কাল্পনিক পিতার চিত্র মনে আসিল – কর্মক্ষেত্রের আর্থিক দুর্যোগে তাঁহার চাকুরিটি সদ্য গিয়াছে, কপর্দকহীন মানুষটি সংসারনির্বাহের অর্থসংস্থানে নাকানিচুবানি খাইতেছেন, এমতাবস্থায় গৃহে তাঁহার সন্তানটির জন্মদিন তিনি কীভাবে পালন করিতেন? বেলুন ও টুনিলাইটের দীপমালায় ঘর সাজাইতেন? পল্লীর সকল প্রতিবেশীকে নিমন্ত্রণ করিয়া কেটারারের সঙ্গে ভোজ্যতালিকা লইয়া পরামর্শ করিতে বসিতেন? সম্ভাব্য নতুন চাকুরির ইন্টারভিউ স্থগিত করিয়া সকাল হইতে উৎসবের আয়োজনে মাতিয়া উঠিতেন? নাকি, সে লজ্জাজনক আত্মপ্রতারণার পথে না-হাঁটিয়া বাস্তবকে স্বীকার করিয়া লইতেন? সারাদিন পথে-পথে চাকুরিসন্ধানের পর সায়ংকালে গৃহে ফিরিয়া সন্তানকে ক্রোড়ে করিয়া বাকি সন্ধ্যাটি যথাসম্ভব আনন্দে তাহার সঙ্গে কাটাইতেন? তাঁহার পক্ষে কোনটি বেশি শোভন হইত? কোনটি কম আত্মপ্রবঞ্চনাময়?
গোটা দেশ আজি যখন অভূতপূর্ব এক সামাজিক সঙ্কটের মধ্য দিয়া চলিয়াছে, সাধারণ নির্বাচনের মতো একটি রুটিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যখন বিবদমান রাজনৈতিক শিবিরগুলির মধ্যে পারস্পরিক কুৎসারটনার ক্লেদ ও আবিলতায় পূর্ণ অসূয়ার বিবমিষাময় মাসাধিককালীন উদ্যাপন, কর্মসংস্থান যখন ঘোর তলানিতে, একের পর এক বাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান যখন বন্ধের মুখে, দেশব্যাপী কৃষকদের আত্মহত্যা যখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা, তেলেঙ্গানায় ইন্টারমিডিয়েটের ফলপ্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে কুড়িটি ছাত্রের আত্মহত্যা যখন সংবাদের শিরোনামে, কুম্ভমেলায় বর্জ্যদূষণের কুপ্রভাবে ইলাহাবাদ যখন মর্মান্তিক মহামারীর মুখোমুখি, সর্বোচ্চ আদালত ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে শুরু করিয়া প্রধানমন্ত্রীর দফতর-সহ দেশের প্রধানতম প্রতিষ্ঠানগুলি যখন একের পর এক বিশ্বাসভঙ্গের অন্ধকারে নিমজ্জমান, প্রকৃত প্রস্তাবে তখন কি জন্মদিন পালনের সময়?
অনেক ভাবিয়া সম্পাদকমণ্ডলী মনস্থ করিলেন, জন্মদিন থাকুক, কিন্তু এককোণায় – কখনওই কাগজের সর্বস্ব জুড়িয়া নহে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারেই গত পহেলা মে আমরা একটি বিশেষ সংখ্যা পাঠকের হস্তে তুলিয়া দিয়াছি, যাহার বিষয়, ‘দুই’। লিখিয়াছেন শতাব্দী দাশ ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য। আর, মাস-পহেলায় তৃতীয় বৎসরের প্রথম যে মেল-ট্রেন যাত্রা করিবার কথা ছিল, তাহার সময়সূচি ঈষৎ পিছাইয়া করা হইয়াছে চৌঠা মে। এবং বলা বাহুল্য, দেশজোড়া সাধারণ নির্বাচনের আবহে তৃতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যার মূল বিষয়ভাবনার অভিমুখ নির্ণয় করিতে বসিয়া নির্বাচন ছাড়া আর কিছুই আমাদিগের বিবেচনায় আসে নাই। সে-কারণেই, গত সংখ্যার প্রতিধ্বনিস্বরূপ, এবারের রিজার্ভ্ড বগির নাম ‘আবার ভোটের লাইনে’। যেহেতু সাপ্তাহিক লোকাল ট্রেন বিভাগেও আমরা গত মাসাধিককাল ধরিয়া নির্বাচনেরই বিভিন্ন দিক লইয়া একাদিক্রমে আলোচনা করিয়া আসিতেছি, তাই এই সংখ্যার রিজার্ভ্ড বগিতে আমরা বাছিয়া লইয়াছি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সহিত জড়িত কিছু স্বল্পালোচিত বিষয় ও সংশ্লিষ্ট মানুষজনের কথা। ভোটপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী অথচ সংবাদ-শিরোনামের অন্তরালে থাকা সেইসব বিষয় লইয়া একেবারে ভিন্নস্বাদের নিবন্ধগুলি লিখিয়াছেন প্রতিভা সরকার, কাজল সেনগুপ্ত, অনিমিখ পাত্র ও বুবাই বাগ। নির্বাচন কমিশনের শুভেচ্ছাদূত জীজা ঘোষের সাক্ষাৎকার লইয়াছেন সৌমিত দেব। আপফ্রন্ট মিডিয়ার তরফে সাংবাদিক করণ থাপারের লওয়া রোমিলা থাপারের একটি সাক্ষাৎকারও আমরা এই সুযোগে পুনঃপ্রকাশ করিয়াছি। সাক্ষাৎকারটির অনুলিখন করিয়াছেন ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য।
সম্প্রতি আমাদের ছাড়িয়া গিয়াছেন বিশ্রুত পল্লীগীতিশিল্পী অমর পাল। এ-সংখ্যায় তাঁহাকে স্মরণ করিয়াছেন সমকালীন সঙ্গীতের আর এক বিশিষ্ট পুরুষ, শুভেন্দু মাইতি। এতদ্ব্যাতীত এই সংখ্যায় যথারীতি রহিয়াছে প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, অণুগল্প-সহ অন্যান্য সকল নিয়মিত বিভাগ।
পরিশেষে জানাই, বাল্যকাল হইতে শিখিয়া আসা ‘একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র…’ পদ্যকণিকাটি আমাদিগের পত্রিকার পক্ষেও সবিশেষ সুপ্রযুক্ত হইয়াছে। প্রথম বর্ষে চাঁদের কপালে চাঁদ টি’ (বেড টি নহে) দিয়া যাইবার পর, দ্বিতীয় বর্ষে বিবিধ বিষয়ে আমরা পক্ষবিস্তার করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলাম। বর্ষণদিনের মরণোন্মুখ পিপীলিকার সঙ্গে তুলনা করিয়া নিন্দকেরা বলিয়াছিলেন ইহাদের পাখা গজাইয়াছে; কিন্তু আমরা জানিতাম, তাহা প্রকৃতপক্ষে পাখা মেলিবারই প্রয়াস। বিভিন্ন বিষয়কে আলোচনার আওতায় আনিয়া, একাধিক নূতন নিয়মিত বিভাগের প্রবর্তনা করিয়া, আমরা আসলে পাখনা মেলিতেছিলাম – পরিণত হইতেছিলাম। দুইয়ে পক্ষবিস্তারের পর এইবার তিনে নেত্র – আপনাদিগের শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদে, আশা করিব, আমাদিগের জ্ঞাননেত্র উন্মীলিত হইবে – চক্ষু ফুটিবে।
কলমের খাপ বন্ধ করিবার মুহূর্তে দেখিতেছি ঘূর্ণিঝড়ের রুদ্রনৃত্য – প্রতিবেশী ওডিশায় তাণ্ডব চালাইয়া সে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের দিকে আসিতেছে। দুর্যোগের সময়ে সকলে হাতে হাত ধরিয়া পরস্পরের সঙ্গে থাকুন, ধ্বংসের স্মৃতি পশ্চাতে রাখিয়া, আসুন, একযোগে পুনর্নির্মাণের কাজে লাগি।
মানুষের পাশে থাকুন।
শুভেচ্ছাসহ, ইতি।