মদ বেশ, যদি জল না মেশানো হয়

রাজর্ষি পি দাস

 

ভীষণ ভাবতে ভালো লাগে যে একটা লোক একটা বিশাল জলাশয়ের সামনে আমাকে পিঠ দেখিয়ে বসে আছে। প্রায় ১০০ মিটার দূর থেকে দেখছি। হালকা হাওয়াতে চুল উড়ছে, আকাশে কালো মেঘ আর লোকটার ডান হাতে হুইল-ছিপ বাঁ হাতে মদের গ্লাশ! গ্লাশের মদ কখনও শেষ হয় না আর ছিপে কোনওদিন মাছ ওঠে না! তবু মনে হয় আমার দেখা আমার ভাবনার প্রিয়তম চিত্ররূপ। এর চেয়ে নিশ্চিন্ত একটা জীবনের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা আমার নেই!

প্রায় ২৫-৩০ বছর হল এই দিবাস্বপ্নের!

অংশু পুরো মদটা গ্লাশে ঢেলে তৃপ্তি বারের সিগারেট খাওয়ার স্বাধীনতাকে রেলিশ করে একবুক ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তুমি কি কখনও জানতে চেয়েছ লোকটা কে?

উত্তরটা খুব সহজ, কিন্তু আমার এখন বলতে বা শুনতে ইচ্ছে করছে না! আমি জানি আমি না বললে অংশু এক্ষুণি বলে দেবে। তাই বললাম, জলাশয়টা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করছে না?

অংশু বলল, খুব সোজা। ওটা মদাশয়, পুরোটাই মদ তাই লোকটার গ্লাশে মদ শেষ হয় না, তাই কোনও মাছ ওঠে না! আর লোকটা পেছন ফেরে না কারণ তুমি চাও না— লোকটা তুমি না হয়ে অন্য কেউ হোক!

যা! লেখক ভাবার আগেই পাঠক এতটা জেনে ফেললে আর গল্প লেখা যায়! মানসকে যে কী বলি!

#

চল্লিশ বছর ধরে একটাই ওষুধ খাচ্ছি, নাম, মদ। প্রতিদিন রাতে খাওয়ার আগে ৫-৬ পাত্তর। আজ অব্দি কোনও কঠিন অসুখ হয়নি। হসপিটালে একদিনের জন্যও ভর্তি হতে হয়নি। আজ এই বর্ষার প্রথম দিনের বৃষ্টিতে আমার বয়স ৫১ বছর একমাস ৯ দিন। দিব্যো আছি, সাথে দৈনিক ২০-২৫টা করে বিষ (সিগারেট)।

হিসাব করে দেখলাম, আজ অব্দি আমি ৭০,১২০ পেগ মদ আর ২,৩৫,৫০০টা সিগারেট খেয়েছি (আজকের দিন বাদ দিয়ে)।

বিষ আর ওষুধের মিশ্রণে জীবন যৌবনকে ছাড়তেই চায় না! (সেই কুকুরের তিন ভাই-এর গল্পের মতো— বড় ভাইকে সারারাত আটকে ক্যালানোর গল্প)

আমি শুরু করেছিলাম একটা গুছিয়ে গল্প লিখব না বানিয়ে! নিজের জীবনের অর্জন আর বর্জন নিয়ে! একটা মহান হতে না পারার বিষাদে প্রতিটা শব্দ ডুবিয়ে— মহান না বিখ্যাত— এই বয়সে বিখ্যাত হবার চেয়ে মহান হবার কাতরতা বাড়ে। আসলে আমার মতো ব্যর্থ মানুষরাই শেষবেলায় মহান হতে চেয়ে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি লাভ করে। একা একা, (ব্যর্থ আমি একা থাকব এটা একটা— জানলা ছিল–র মতো সত্যি। তবে জানলাটা কোথায় ছিল বা কোথায় আছে সেটা বড় কথা নয়, আসলে একটা জানলা ছিল) কারও অনুমোদন ছাড়াই মহান হওয়া যায়!

যেমন, রাস্তায় এক অসাধারণ সদ্য যুবতীর হৈ-হৈ বুক দেখে নিজের মধ্যে সাধকভাবকে জাগ্রত করা ও পরে অবচেতনে সেইরকম হৈ-হৈ বুক পর্নোতে খুঁজে যাওয়া বা সিঙ্ক-এর জলে ভাসমান আরশোলাকে হাতা দিয়ে তুলে পাশে রাখতে গিয়ে যদি দেখা যায় আরশোলা হাতা ছেড়ে হাত বেয়ে তরতর করে উঠে আসছে, সাথে সাথে আছাড় মারা আর র‍্যান্ডম লাথি মারতে মারতে আরশোলাটাকে মেরে ফেলা! এই দুটি ক্ষেত্রেই অর্জন এবং বর্জন আছে— দুটি ঘটনার প্রথম ভাগটা অর্জন আর দিত্বীয় ভাগটা বর্জন। নিজেকে মহান ভাবার জন্য আমি নিরন্তর প্রথম প্রতিক্রিয়াকে পুষে রাখব আর দ্বিতীয় প্রক্রিয়াকে বর্জন করে বিস্মৃতির গুদাম ভারি করব। এরকম ঘটনা সারাদিনে তিন-চারটে ঘটে এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অবচেতন মন এতটাই কী করি, কী করি-তে ভরে ওঠে যে কী করব ব্যাপারটাকে সাজাতে ঘনঘন সিগারেট খেতে হয়। তারপর রাত্রে বিস্মৃতির গোডাউন-এ ঢুকে টর্চ মেরে মেরে চেক করতে হয় কোন স্মৃতি এখনও বেঁচে আছে— যারা বেঁচে আছে তাদেরকে কবিতা-গদ্য-সিনেমা ইত্যাদির মধ্যে পাচার করে গুদাম খালি করো, তারপরেও যদি কেউ বেঁচে থাকে তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে মারো। তাই ডেইলি ওই ৪-৫ পেগ আর যেদিন পিটিয়ে মারাতে হয় সেদিন আট, দশ ইত্যাদি। ফলে প্রথমে বিষ তারপর ওষুধ, এই ডেইলি ডিসিপ্লিন আর ক্রমানুবর্তিতা কিন্তু প্রতিদিনকার মহান হতে চাওয়ার ঘটনাক্রমের বিপরীত! ফলে-শব্দটার-জায়গায়–যথারীতি-শব্দটা কল্পনা করুন!

যদি আপনি ফলে-র-জায়গায়-যথারীতি-শব্দটা দিয়ে বাক্য শুরু করেন তাহলে একটা জিজ্ঞাসা স্বাভাবিক— আমি তো ব্যর্থ মানুষের কথা বলছিলাম, কিন্তু আমার সিগারেট আর মদ খাওয়ার ব্যাপারটা ৩০ বছরের একটা গড় হিসাব। তাহলে আমি কি ২১ বছর বয়স থেকেই কি জানলা-ছিল-র দলে ভিড়ে গেছিলাম, নিজেকে ব্যর্থ ভাবা ঠিক করে ফেলেছিলাম? ঠিক ধরেছেন, সেটা আমি জানি না! আজকাল স্মৃতি কাজ করে না! ত্রিশ দিন আগের কথা মাথায় রাখতে পারি না আর ত্রিশ বছর! আর ঐ ইমেজ— হাতে ছিপ আর গ্লাশ সাথে পিঠ— সেটাও কী পুরনো! না! তবে, তখনও একটা ফ্রেম জ্যান্ত ছিল, আমি মাছ ধরছি পাতি কঞ্চি-ছিপে আর পাশে বসে চা-বাগানের সাহেবি কুকুরের মেয়ে জ্যাকি আমার পাশে বসে আছে HMV-ডগি-র মতো। এই জ্যাকি ছিল আমার ক্লাশ ফাইভ থেকে নিত্যসঙ্গী, আমি হাফ প্যাডেল থেকে ফুল প্যাডেল গেছি আর জ্যাকি আমার সাইকেলের পিছনে আগাগোড়া অরণ্যদেবের ডেভিল-এর মতো দৌড়ে গেছে। জ্যাকি আমার পিছনে দৌড়ত বলেই অলকদা বা আশিষদা বা কানাইদার সাইকেলকে তুফান ভাবতে পারতাম! আর জ্যাকির জন্যই আমি কোনওদিন ভুলতে পারি না কুকুরের তিন ভাইয়ের গল্প! কারণ জ্যাকির একটি ভাই ছিল, টমি নাম, যে মাত্র দেড় বছর বয়সে হারিয়ে গেছিল।

#

বিয়েবাড়ির অনেকটা পিছনে, অন্ধকারে তিন ভাই বসে বিয়েবাড়ির খাবারের গন্ধে উতলা হয়ে উঠছিল। বড় ভাই বলল, তিনজন এক সাথে গেলে চোখে পড়ে যাব, মেজ কী করবি। মেজ বলল, ছোট যাক! ছোট অনুমোদন পেয়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেল। গন্ধে গন্ধে সোজা রান্নার জায়গায়। লোক আর লাঠি প্রস্তুত ছিল, দেখামাত্রই দু’চার ঘা— ছোট ব্যথায় কঁকিয়ে উঠতে গিয়েই মুখ চাপা দিল! ব্যথা বলে দিল এ জিনিস একা খাওয়ার নয়!

মুখ চেপে বিয়েবাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে ব্যথা হজম করে টিংটিং করে লেজ দোলাতে দোলাতে দু’ভাইয়ের কাছে গেল আর বলল, ওঃ যেতেই বসিয়ে দিল। মেজ আর কী করে! বড়-র আদেশের অপেক্ষা না করে বিয়েবাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মেজ পৌঁছতেই, আবার এসেছে আবার এসেছে হল্লার সমাপ্ত হল গরম জলের বরণ দিয়ে।

মেজ যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠতেই বড় ভাইয়ের কথা মনে পড়ল আর একটু দূরে গিয়ে চোখের জল চেপে জিভের জল দিয়ে চেটে চেটে স্মার্টলি দু’ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, যেতেই গরম গরম! এবার বড় ভাইয়ের পালা, বিয়েবাড়ি গিয়ে পৌঁছতেই, মালটাকে বেঁধে রাখত-র— সম্বর্ধনায় সারা রাত অঢেল এঁটো আর বাড়তি খাবারের মধ্যে দড়ি বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল। সকালে লাথি-ঝ্যাটা ইত্যাদি সহযোগে প্রাতঃরাশ সারার পর ছাড়া পেলে ছোট দু’ভাইকে গিয়ে বলল, ছাড়তেই চায় না!

লক্ষ করে দেখলে দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে একজন পাঠকও এসে বিরক্ত করেনি! কারণ আমি বুঝতেই দিইনি আমি কী বলতে চাইছি। একটা গল্প বলার নাম করে উপগল্পের সঙ্কেত রেখে তারপর অপ্রয়োজনীয় অনুভূতির কথা বলা শুরু করে আবার উপগল্পকে প্রায় মূলগল্পের আরামে নেওয়া অব্দি পাঠক অপেক্ষা না করে পালিয়ে গেছে।

হে পাঠক, যাকে প্রণাম করে কমলকুমার মজুমদার লিখতে বসতেন, বলুন না, এই তিন ভাইয়ের মধ্যে আমার জ্যাকির হারিয়ে যাওয়া ভাই টমি কোনটা? একটা ক্লু দিচ্ছি, টমি প্রচণ্ড হিংস্র ছিল। (আরেকটা ক্লু দিচ্ছি। আপনি, ঈশ্বর) লক্ষণীয়, কথাটা ব্র্যকেটের মধ্যে রাখলাম!

#

টমির হারিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা একটা বোরিং ব্যাপার, অন্তত যখন ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে, আকর্ষণীয় ব্যাপার হল ঘটনার রেশ। টমির হারিয়ে যাওয়ার পর তিনসুকিয়ার বড়পিসি অনেকদিন ধরে নিজের সাত সন্তানের মধ্যে একজনও বাড়ি ফিরতে দেরি করলে রাস্তায় কাকে খুঁজতে বেরোত এখনও জানি না! বড়পিসি টমি আর সন্তান— এর মধ্যে কাকে গ্রহণ করেছিলেন আর কাকে বর্জন করেছিলেন বলা মুশকিল। তবে শুক্লপক্ষে চাঁদ উঠলে এখনও টমির চাঁদের দিকে তাকিয়ে নেকড়ের মতো ওউউউ করে ওঠা মনে পড়ে… বড়পিসিকে মহান বলা হত কারণ উনি সাত সন্তান সহ, রেলের চাকরি থেকে উৎখাত হওয়া স্বামীকে নিয়ে কীভাবে সংসার চালাতেন…… আর অরণ্যদেব বারে ঢুকে বলে ডেভিল কুকুর নয় নেকড়ে, অথচ ওর জন্য দুধ চায়…… অংশু বলে উঠল, লোকটা কিন্তু হুইল নিয়ে বসে আছে। এভাবে চললে কিন্তু ছিপে মাছ গেঁথে যাবে। পুরো লেখাটাই ভোগে যাবে।

দেখলেন তো যেই মুহূর্তে আরেকটা গল্প তৈরি শুরু, ঈশ্বরসম পাঠক ঢুকে পড়ল! আমি চাই যে লোকটা মদের গ্লাশ আর ছিপ নিয়ে বসে থাকে তার সাথে এবার যেটা বর্জন করব সেটা ঘটুক! তাই লোকটাকে, কখন কী করবে বা হবে, ঠিক করব আমি, লেখক, আমার অনুমতি ছাড়া ওর ছিপে মাছ গেঁথে যাবে? এতটা! আমি ঈশ্বরকে অতটা জায়গা দিই না! ঈশ্বর বড়পিসির অর্জন এবং বর্জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ফোঁটা জলের মতো পলকা! কে আছে আর কে নেই এই বাছাই করে লেখক যদি চরিত্রকে আয়ু দিতে না পারে তাহলে শুভেচ্ছা রইল! লোকটা যদি আমিও হই, লেখক হিসাবে তো ঝালিয়ে নেওয়ার একটা ব্যাপার আছে। এই দুম করে সবজান্তা মন্তব্য– এইসব পোঁদপাকা পাঠক থেকে দূরে থাকতে হবে! সুতরাং অংশু বাদ! অংশু বসে থাকুক তৃপ্তি বারে!

#

মূল গল্পটা (যেটা ঘটাতে চাই) হল, আমি ওই লোকটাকে পেছন থেকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছি! একটা ঝরঝরে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল জোগাড় করেছি সাথে তিনটে বুলেট! এক শটে ঘাড়ের নিচে, মিস করলেও পিঠে তো লাগবেই। বুকের চেয়ে মানুষের পিঠ বেশি ভাল্‌নারেবল, অন্তত বিদ্ধ করার জন্য! পিঠে হানলে কোনও না কোনও ইম্পরটেন্ট অর্গানে লাগবেই, তাছাড়া এলিট মাস্‌লস আর মহান মেরুদণ্ড তো আছেই। যা করার ওই একটা শটেই করতে হবে, বেঁচে গেলে সেই তো আবার আমাকেই ছোটাছুটি করতে হবে। আর বোল্ট টেনে দুবার গুলি করার ইচ্ছে থাকবে কিনা সেটাও জানি না! অত বড় মাথার মতো নিখুঁত বুলস্‌ আই-য়ে কেন নয়? না এটা পাঠকের প্রশ্ন নয়, লেখকের! আরে, যার মুখ দেখতে চাই না তার মাথায় কী করে মারি— অনেকক্ষণ পর লেখক লেখকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরে তৃপ্ত!

তবে প্র্যাক্টিসের জন্য একটা বুলেট খরচা করব। আর যেহেতু জানি না, দু’বার গুলি করতে ইচ্ছে হবে কিনা তাই একটা বুলেট থাকুক স্ট্যান্ড-বাই হয়ে।

হালকা শুনতে পেলাম, কেউ একজন বলে উঠল, পেছন থেকে মারাটা একটু— কাপুরু কাপুরু– হয়ে গেল না কমরেড!

এই হল মুশকিল, ওনাদের মতো করে দু’চার লাইন ভাবলে কি ভাবলে না পাঠক আসা শুরু করে দিল। আর দুরাচার দেখুন, কমেন্ট করতেই থাকবে! আমি এদেরকে নিয়ে ভাবব না ঠিক করলাম! আর ওমনি মনে পড়ে গেল, সিনেমায় আর স্কেচে দেখা বেশ কয়েকটা যুদ্ধবন্দিকে গুলি করে মারার দৃশ্য— সবাই হাত তুলে হাঁটুর উপর বসে বা একটা নিয়তির মতো দেওয়ালের দিকে দাঁড়িয়ে! পিঠ (গ্যইয়ার দ্য থার্ড মে বাদে) বিজয়ীর দিকে! ফলে একটা চিন্তা আঁকড়ে ধরল! আমাকে। মানুষ শত্রুকে মারে মুখোমুখি অবস্থায় অথচ হেরে যাওয়া মানুষকে নাকি শুধু সৈন্যকে, মারা হয় পেছন থেকে। গ্যইয়া বলে আবার— মানুষকে নাকি– কেন? শত্রুসৈন্যকে অসম্মান করার জন্য? সৈন্যদের সবচেয়ে গ্লানির মৃত্যু পিঠে গুলি খাওয়া।

না, ওই ছবির সব মানুষ সিভিলিয়ান মানে স্পেনের সাধারণ মানুষ ছিলেন! নেপো-বোনা জাস্ট ক্ষেপে গেছিলেন! আর গ্যইয়া নেপোদার থেকেও বেশি ক্ষেপে গেছিলেন সেটা ঠিকড়ে আসা চোখ দেখলেই বোঝা যায়। ঐ চোখ— দ্য থার্ড মে-র ফ্রেমে অন্য কিছুকে দেখতে দেবে না।

নেপো মুছে গেছে চোখ থেকে গেছে।

কিন্তু যার গ্লাশে কোনওদিন মদ ফুরোয় না তাকে কী বলব! সে তো আমার হাতে বন্দি নয়! সবচেয়ে বড় কথা সে পরাজিত নয়! সে শত্রু হলে তো আমার জন্য বিপজ্জনক। কারা জানতে চায় না যাদেরকে মারছি সে আমার শত্রুসৈন্য না সাধারণ মানুষ-– নিঃসন্দেহে টেরোরিস্ট!

#

আমি, ঢপের সৈনিক জীবনে, খুব সম্ভবতঃ ৫০০ খানেক গুলি চালিয়েছি। সবই চাঁদমারিতে। থ্রি-নট-থ্রি, কারবাইন, এস-এল-আর, রিভলভার ইত্যাদি মিলিয়ে! তার মধ্যে টার্গেটে লেগেছে খান ১০০। তার মানে ১০০ জনকে হত্যা করার বিভ্রম। কিন্তু সব শত্রুই বুক চিতিয়ে টানটান। ১৮০ ডিগ্রি লাইনে সরে যায়, চলে আসে, নিরন্তর।

তাই হয়তো চাঁদমারিতে একটা লোহার প্লেটের গায়ে শত্রুর ছবির আউটলাইন আঁকা থাকে গোদা হাতে! তবে, ঐ মুখোমুখি হত্যা, পেছন থেকে নয়!

আমার বিশ্বাস, হিংস্রতার এহেন নিষ্ঠায় আত্মরক্ষার নামে বুকে মানে বুলস্‌ আই-তে বিদ্ধ করার মধ্যে যা পুঁতে দেওয়া যায় সেটা থাকে। একটা খুন করার ছাড়পত্র। পিঠে মারলে অবচেতনে একটা লোহার প্লেট হয়েই থেকে যাওয়ার সুযোগ থাকে। তাই বুকে, তাই একটা মুখের মতো একটা অঞ্চল থাকে, তাতে চোখ থাকে কিনা মনে করতে পারছি না! যুদ্ধের সময় সেটা দেশ বা ভাষা বা ধর্মের নামে হয় কিন্তু খুন করার ব্যাক্তিগত আরামের শুরু ওই চাঁদমারি থেকেই! তাই পৃথিবীতে সব টেরোরিস্টকে আর্মি ট্রেনিং নিতে হয়! এবং আমার সাথে একই বছরে আরও সাড়ে তিন হাজার আন্ডার ২০ ছেলে (মাত্র একটা ট্রেনিং সেন্টারে) খুনের ব্যাক্তিগত আরামের স্বাদ পেয়েছিল সেই ৩৪ বছর আগে যা প্রায় হস্তমৈথুনের গভীর আনন্দের মতো নশ্বর! নশ্বর, তাই যে কোনও আর্মি ইউনিট রাতারাতি টেরোরিস্ট হয়ে উঠতে পারে।

এ ক্ষেত্রে আমি কুকুরের তিন ভাই-এর মতো বা অন্য কোনও উপগল্প মনে করতে পারছি না যেটা ব্র্যাকেটের ভিতর রাখা যায় তারপর আবার পরে খুলে বলতে হয়! দুঃখিত!

#

তো, একটা বুলেট খরচা করে হাত সেট করার জন্য প্রথমে আমি একটা মানুষের আউটলাইন এঁকে ফেললাম! আমার সাইজের। তবে এটা টানটান হয়ে দাঁড়ানোর আঁক নয়। ওর মতো একটা মানুষের বসে থাকা অবস্থায় পেছন থেকে যেরকম লাগে দেখতে সেরকম। তারপর মার্কার দিয়ে ঘাড়, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, মেরুদণ্ড আর কিডনির জন্য মার্কিং করলাম! তারপর চলে গেলাম বন্ধুর গাড়ি চালিয়ে ধাপার মাঠ!

ধাপা শব্দটার জন্ম কি ধাপ্পা থেকে? একটা প বাদ দিয়ে যাবতীয় জঞ্জালকে (বড় যারমধ্যে খালি পেটে বসেছিল) কি আশ্বাস দেওয়া যায় যে তোদেরও একটা গতি হবে। একটা শহরের ইতিহাস বা বর্তমান শুধু ব্যবহারযোগ্য আইটেম নিয়ে নয়, তার চেয়ে অনেকটা বেশি শহরের বর্জন দিয়ে। অর্থাৎ যেটাকে ধামাচাপা দিয়ে মহান হওয়া যায়!

ইদানীং অবশ্য রিসাইকেল মেশিন বসেছে, বর্জনকে আবার অর্জনের কোটায় ফেলে দাও! মহান তকমা ধরে রাখার জন্য নতুন শহুরে টেকনোলজি, যেটা যাবতীয় অতীতের দর্শনকে একটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়! যাকে বাদ দিলাম সে আবার দৈনন্দিন হয়ে ফিরে আসলে কীভাবে নেব? যদি কল্পনা করি, আমি আর আমার হৈহৈ-মার্কা যুবতীকে নিয়ে একটা পাবলিকের হাগা-মোতার দোতলায় বসে ধাপার মাঠের অর্জন দিয়ে তৈরি বায়ো-মাগে কফি খাচ্ছি আর হাসতে হাসতে অনেকগুলো কফি মাগ হয়ে উঠছি!

দেবদারু ফিসফিস করে উঠল, লোকটা কিন্তু বসে আছে।

ঠিক আছে, আর বলতে হবে না– আমি এবার সত্যিই বিরক্ত!

টার্গেট দাঁড় করিয়ে ১০০ মিটার (ফিতে নিয়ে গেছিলাম) দূর থেকে উবু হয়ে বসে, বাঁ চোখ বন্ধ করে টেনে দিলাম ট্রিগার। প্রথমে ঠাস্‌ তারপর হাওয়ায় একটা সুঁইইই শব্দ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আবার এক পাঠকের জিজ্ঞাসা-– আপনি কিছুক্ষণ আগেই বলেছিলেন যে ঝরঝরে রাইফেল, আর আপনি ট্রিগার টিপলেন আর গুলি বেরিয়ে গেল? একটু তাড়াহুড়ো করে ফেললেন না তো!

আমি ক্ষেপে চীৎকার করে-– আপনি থামবেন– বলে উঠতেই গুলি গিয়ে লাগল লোকটার পোঁদে! অথচ দেখো লোকটা ঘুরে দেখতে চাইছে! লোকটা আমাকে কী ভাবল! হায় হায় এতদিনের সম্পর্ক!

না না মুখ দেখব না–! প্রাণপণে উল্টোদিকে পালানো শুরু করলাম! মনে হল পিছনে জ্যাকি আছে।

পালাতে পালাতে মনে পড়ল আরে ওটা তো আঁকা মাল ছিল, জ্যান্ত হয়ে গেল কী করে। থামলাম! থামতেই মনে হল, ওর হাতে এখন অস্ত্র আছে, হু হু করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে, মুখ দেখা যাবে না তাই বুঝতে পারছি না ও কে– আমাকে পিছন থেকে মারবে কিনা বা আমি ঘুড়ে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় গুলি করব কিনা জানি না সুতরাং পালাতে পালাতে তৃপ্তি বারে ঢুকে দেখলাম সোমনাথ বসে আছে। আমাকে দেখেই বলল, থানকুনি পাতা পেয়ে গেছি, কাল থেকে সকালে কাঁচা হলুদ দিয়ে খাব! তুমিও খাও! আরও ভালো লিখতে পারবে!

অংশু পেছন থেকে এসে বলল, আর গুলি না করে তুমি লোকটার আহত পোঁদের কাছে একটু থানকুনি পাতা আর কাঁচাহলুদ রেখে এসো!

কোথা থেকে শ্যামল বলে উঠল, টেরোরিস্ট বললে নিজেকে, আর হাতে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ছ্যা!

দেবদারু বলল, ফিসফিস— লোকটা বসে থাক না! শুধু তুমি ওর সামনে চলে যাও!

নীল এই প্রথম, জ্যাকি কোথায়?

মানস, এই হল গল্পের অবস্থা, লেখক ভাবার সাথে সাথে পাঠক জেনে ফেলছে, শুধু তাই নয়, পরের ভাবনায় ঢোকার আগেই পাঠক নিজের প্রশ্ন নিয়ে প্রস্তুত। আশ্চর্য! পাঠক এতটা জেনে ফেলে কী করে? আমরা কি পাঠককে মাথার ভিতর পুষে বেড়াই। যাতে একা বোধ না করি! লেখক যখন লেখে সে কি পাঠককে ঘাড়ে নিয়ে চরিত্র, প্লট, ঘটনা আর ভাষাকে খুঁজে বেড়ায়? অন্ততঃ দ্বিতীয় লেখা থেকে, যেখানে তার প্রথম লেখার পাঠক ছিল সে নিজেই! একজন লেখকের একটা লেখার জন্য কিছু নিজেকে ছাড়াও কাল্পনিক পাঠকের দরকার পড়ে কত দিন অব্দি— লোকটা কিন্তু পেছন ফিরে তাকায়নি, বা আমাকে মারার জন্য তাড়া করেনি। লোকটা শুধু বাঁ দিকে বডিওয়েট দেওয়ার জায়গায় ডানদিকে দিল!

#

দু’দিন পর, রাত বারোটা নাগাদ এক পাঠকের প্রতিক্রিয়া— বালের লেখা, ইংরেজি হলে তাও কিছুটা দাঁড়াত… চুরি করা খাঁচা তো!

 

 

 

(ছবি: ইন্টারনেট)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...