আহমেদ-খান হীরক
[ভূমিকা: রহনপুর আমার জন্মস্থান। সেখানেই বেড়ে ওঠা, বিকশিত হওয়া। এই রহনপুর থেকে এখন দূরে আছি। ফলে রহনপুর স্মৃতি হয়ে, মাঝে মাঝে পরাবাস্তব হয়ে আমাকে তাড়িত করে। এই তাড়নার সময় একধরনের বিভ্রম হয়, আমি ঠাওর করতে পারি না আমি কোথায় আছি… তখন রহনপুরেরর নানা টুকরো গল্প, নানা চরিত্র চোখের সামনে চলে আসে। এরা যে আসে এবং চলে যায়, এই চলে যাওয়ায় লাগাম লাগাতে এই লেখা। আর তার মধ্যে নিজেকে, নিজেরে মানুষ আর সম্পর্কগুলোকে নিজের কাছেই পরিচিত করে তোলা… পাঠক, আমার ভুবনে আপনাকে আমন্ত্রণ…]
স্টুডিও রূপছায়া ও ছবি তোলা
তখন ছবি তুলতে যাওয়া ছিলো এক উৎসবের বিষয়।
যেদিন ছবি তুলতে যাওয়া হবে সেদিন নদীতে দাপাদাপি কম। চোখ যেন লাল হয়ে না যায়। তারপর বেশ গুছিয়ে সাবান-টাবান মাখা। পা ছবিতে আসবে না বলে পা-কে কম গুরুত্ব দেয়া। চুলে খুব করে ফেনা ঘষা। সাবানেরই ফেনা– শ্যাম্পু তখনও নাগালের বাইরের জিনিস।
বিকেলে চুল পাট করে আঁচড়িয়ে, সবচেয়ে নতুন শার্টটা পরে, গলায় ভালো করে পাওডার ঘষে ছবি তুলতে যাওয়া হতো। পাসপোর্ট সাইজ সাদাকালো। ইস্কুলে লাগবে দুই কপি। দুই কপি এক্সট্রা, আর একটা নেগেটিভ। নেগেটিভটা খুব যত্ন করে রাখতে হতো। এ্যালবামে অন্য ছবির ভিতরে নেগেটিভগুলো সাধারণত চিপকাচিপকি হয়ে থাকতো।
ছবি তুলতে শৈশবের মথুরা ছিলো– স্টুডিও রূপছায়া।
ঝা চকচকে স্টুডিও। কাচের দরজা। ভিতরে একপাশে রিশেপশন, অন্যপাশে সোফা। সোফার পেছনে এ্যাকুইরিয়াম। এ্যাকুইরিয়ামে রঙিন মাছ। অবশ্য এ্যাকুইরিয়ামের আমদানি আরো পরে। কিন্তু অবস্থা এরকম ছিলো। ফলে স্টুডিওর ভিতরে ঢুকতে আমাদের বুকের রক্ত হিম হয়ে আসতো। এতো জেল্লা সহ্য করার মতো অবস্থা তখন ছিলো না।
আর রূপছায়ার কর্ণধার টুলু ভাই যেন নিজেই বিজ্ঞাপন। নায়কসুলভ চুল, ক্লিনশেভ, জিনস-ফুলহাতা চটকদার শার্ট– তাকে দেখলেই ঢাকাই ফিল্ম থেকে মন একলাফে মুম্বাই চলে যেতো। টুলু ভাই বলতেনও সুন্দর। আমরা ঢিবিঢিবি বুক নিয়ে যখন স্টুডিওর ভিতরে ঢুকতাম, প্রায়শ শুনতাম টুলু ভাই ভিতরে আছেন।
ভিতরে আছেন মানে ছবি তুলছেন। আমাদের তখন রিসেপশনের কাচের টেবিলে অন্যদের তুলে রাখা ছবি দেখে দেখে সময় কাটাতে হতো। আমরা বুঝতাম সৌভাগ্যবানদের ছবি এখানে স্থান পায়। আমাদের খুব ঈর্ষা হতো।
তারপর একসময় আমাদের ডাক আসতো।
চারদিক থেকে চারটা তীব্র লাইট এসে পড়েছে বেঞ্চের যে-জায়গায় সেখানে বসতে হতো। টুলু ভাইয়ের ক্যামেরা স্ট্যানগানের মতো উদ্যত আমার দিকে। একবার শুধু বলতাম, পাসপোর্ট…
ঘাম হতো। টুলু ভাই টিস্যু দেখিয়ে দিতেন।
বুকে প্রচণ্ড জোরে কেউ যেন হাতুড়ি পেটাতো। মনে হতো হার্টফেল হয়ে যাবে। শরীর শক্ত করে বসে থাকতাম।
টুলু ভাই এগিয়ে এসে ঘাড়টা ঠিক করে দিতেন। কিন্তু ক্যামেরার কাছে ফিরে যেতে যেতেই আমার ঘাড় আবার স্থানচ্যুত হতো। মনে মনে নিজেকে খুব গালি দিতাম। কিন্তু শরীরের মাংসপেশীগুলো কখনোই ঢিলে হতো না।
টুলু ভাই বলতো, একটু হাসো…
হাসতে গিয়ে মনে হতো জীবন দিয়ে দিচ্ছি। কোনোমতেই হাসিটা নিয়মমতো খেলাতে পারছি না ঠোঁটে। ঠোঁটটা বরং অদ্ভুতভাবে ফুলে উঠছে।
টুলু ভাই আবার আসতেন। ঘাড় আবার ঠিক করে দিতেন। বলতেন, সহজ হও।
এখন এ অবস্থায় সহজ হই কী করে?
ফলে অ-সহজ মানুষ হয়েই ট্যারা চোখে তাকিয়ে থাকতাম ক্যামেরার দিকে।
‘রেডি…একটু হাসি’ বলেই টুলু ভাই শাটার টিপতেন। চোখ ঝলসে যেতো আলোয়। ছবি তোলার যুদ্ধ শেষ হতো। এবার শুরু হতো অন্যরকম যুদ্ধ। যুদ্ধটা অপেক্ষার। চারদিন পরে ছবি পাবো। কিন্তু ছবিটা কেমন হবে? গতবার যেমন বান্দর বান্দর লাগছিলো নিজেকে তেমনি কি লাগবে? ইত্যাদি নানারকম ভাবনায় চারটা দিন ঠিক করে ঘুম হতো না। পেট পর্যন্ত নেমে যেতো।
চতুর্থ দিন রশিদ দেখিয়ে ছবি নিয়ে আসতাম। প্রথমে একবার দেখে নেয়ার পর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। বোঝার চেষ্টা করতাম ছবিটা নিজেরই কিনা! কান দুটো আরো লম্বা দেখাচ্ছে কিনা! সদ্য গজানো লোম লোম গোঁফগুলো বাজে লাগছে কিনা!
তো একটা ছবি তোলা মানে সপ্তাহখানেকের বিশেষ পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে যাওয়া ছিলো। তবে এখন ছবি তোলা অনেক অনেক সহজ ব্যাপার। এই তো যে-বস্তুটায় লিখছি তাতেই একটা ক্যামেরা আছে। সামনে একটা মোবাইল অযতনে পড়ে আছে, তাতেও একটা ক্যামেরা বিদ্যমান। একটা ক্যামেরা ড্রয়ারবন্দি। চারদিকে ক্যামেরা আর ক্যামেরা। অথচ এত ক্যামেরার মথ্যেও আমি এখনও সাবলীল হতে পারি নি– এখনো ক্যামেরাকে আমার পিস্তল বা স্টেনগান বা মর্টার মনে হয়। আমার ঘাড়ের রগ শক্ত হয়ে যায়। ঠোঁটের মাংসপেশী স্বাভাবিকত্ব হারায়।
কানের কাছে কেউ যেন বলে, সহজ হও। সহজ হও…
আমি অ-সহজ মানুষ সহজ হই কী করে?
মুচিরাজ কমলা
রহনপুরে, আমাদের কালে এক মুচি ছিলো।
মুচির নাম কমলা মুচি। আমরা তখন ছোট। স্যান্ডেল হাতে ধরে বাজারে নিয়ে গিয়ে সেলাই করাতে তখনো আমাদের প্রেস্টিজে লাগে না। ফলে বাড়ির সকলের ছেঁড়া জুতা-স্যান্ডেল আমাদের কাঁধে চাপে। আমরা পলিথিনযোগে হাতে স্যান্ডেল ঝুলিয়ে বাজার যেতাম। বাড়ি থেকে কড়া ইন্সট্রাকশন থাকতো, সেলাই করাতে হবে কমলার কাছে।
তবে, জ্ঞানের অভাবে, আমরা মুচিকে তখন চামার বলতাম। কেন বলতাম, কে জানে? তারা চামড়া জুতাস্যান্ডেলের মেরামতকারী বলে কি?
চামারেরা, জ্ঞানের মুচিরা, বাজারের একপাশ থেকে সারি সারি বসতো। কমলার নাম ছাড়া কারো নাম জানতাম না। জানার প্রয়োজনও ছিলো না। আমাদের জুতোস্যান্ডেলের উদ্দেশ্য, গন্তব্য, প্রতিগন্তব্য সবই ছিলো ওই কমলা।
কমলা নাম শুনে যারা ভ্রূ কুঁচকে ফেলছেন, তাদের জন্য বলি কমলা পুরুষ মানুষ; একটু বয়ষ্ক আর গরীব বলে তাকে ঠিক পুরুষ দেখাতো না, খুব ভালো করে না দেখলে মানুষও মনে হতো না মাঝে মাঝে।
একটা চটের বস্তা- যাকে আমরা ছালা বলতাম, তার ওপর বসে, একটা ভাঙা কাঠের বাক্স ও লোহার এক অদ্ভুত খণ্ড নিয়ে তার কারবার চলতো। জুতো স্যান্ডল সেলাই করে, আঙুলের ডগায় মোটা সুইয়ের আঘাত খেয়ে খেয়ে আঙুলের ডগাগুলো তার কেমন ফুলে ফুলে থাকতো। আর তার সাথে লেগে থাকতো কালো লাল রঙ। আঙুলগুলো থেকে রঙের গন্ধও আসতো। কুজো হয়ে সে দিনমান জুতোস্যান্ডেলে সেলাই বা রঙ করে যেতো।
আমরা যারা ছোট, যাদের হাতে বাড়ির জুতোস্যান্ডেলের ব্যাগ, তাদের জন্য কঠিন ছিলো কমলার লাইন পাওয়া। তার চটের ওপর জুতোস্যান্ডেলের সিরিয়াল লেগেই থাকতো। আমরা মিনমিন করে বলতাম, তিনটা স্যান্ডেল, কখন দিবেন?
‘কী হৈছে?’ বলে কমলা স্যান্ডেলগুলো নির্মমভাবে পরখ করতো, তারপর আবার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে একপাশে রেখে দিয়ে বলতো, বিকালে।
আমরা তখন একটু সংকটে পড়ে যেতাম। যে বাড়ি গিয়ে বিকালের কথা বললে ভর্ৎসনা শোনার সম্ভাবনা থাকে, ফলে আমরা একটু গাইগুই করতাম। কমলা আমাদের দিকে তাকিয়ে, একটা বিড়ি জ্বালিয়ে, হাতের কাজটা শেষ করে, আমাদের পলিথিন টেনে নিতো। এরমধ্যে সূক্ষ্ম দুর্নীতি থাকতো। এই দুর্নীতি আমাদের ভালো লাগতো। আমরা, বলা যায় শৈশব থেকেই, দুর্নীতিপ্রবণ ছিলাম।
মেরামতের পর তিনটা স্যান্ডেলে হয়তো তিনটাকা বিল আসতো। আমরা খুব চেষ্টা করতাম সেটাকে দুটাকায় নিয়ে আসার। কারণ একটাকা বাঁচাতে পারলে তাতে কাঠিবরফ বা নারকেল বরফ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চাটনি হতে পারে। বা কটকটি। কিন্তু কমলা ছিলো বেরহমদিল। সে পইপই করে তিনটাকা গুনে গুনে নিতো। আমরা কিছুটা হাসিমুখে, কিছুটা ব্যাজার মনে, স্যান্ডেলগুলো নিয়ে ফিরতাম বাড়িতে। বাড়ি তখন আরো একবার স্যান্ডেল পরীক্ষা করতে বসতো। ভালোমতো দেখে, সাধারণত, কমলার প্রশংসাই করতো।
তো, কমলা চামার, বা মুচি, ছিলো প্রশংসনীয়।
হাতের কাজে সে ছিলো পটু।
ফলে বাজারের মধ্যে তার বসাটা ছিলো, অন্য মুচিদের তুলনায়, রাজকীয়। আমরা তাকে রাজা জ্ঞানই করতাম।
এর পনের বছর পরের ঘটনা বলি।
না, কমলা মুচি তখনো বেঁচে আছে। রহনপুর গেছি। স্যান্ডেলের একটা ফিতা দাঁত বের করে দিলো। মানুষের হাসি সহ্য করা যায়, স্যান্ডেলের হাসি যায় না। স্যান্ডেলটার হাসি বন্ধ করতে ছুটলাম বাজারে। ছোটাটা হলো দেখার মতো, মনে হয় খানিকটা উটের মতো, খানিকটা লেংচিয়ে লেংচিয়ে।
বাজারে গিয়ে দেখলাম মুচিদের কারবার ছোট হয়ে এসেছে।
কেন ছোট হয়ে এসেছে? মানুষের পায়ের সংখ্যা, জুতোস্যান্ডেলের সংখ্যা কি কমে এসেছে?
নাকি, পেশা হিশেবে মুচিত্বকে আর গ্রহণ করছে না পরের জেনারেশন?
যাই হোক, চার পাঁচজন মুচির ভেতর একটু খোঁজ লাগালাম কমলার। কমলা আছে, বাজারের এক কোণায় জবুথবু হয়ে সে আছে। আরো আরো বয়স বেড়েছে। এখন তাকে পুরুষ বা মানুষ দূরের থাক, মুচিও লাগে না।
গেলাম তার কাছে, স্যান্ডেলটা এগিয়ে দিলাম। কেমন আছে জিগ্যেস করলাম।
উত্তরে কী বললো কিছুই স্পষ্ট হলো না।
দেখলাম, তার হাত কাঁপছে। স্যান্ডেলের কোথায় সমস্যা খুঁজে পাচ্ছে না। আমি ঝুঁকে দেখিয়ে দিলাম স্যান্ডেলের হাসিটা। কমলা আমার দিকে চোখ তুলে, যেন সূর্যকে দেখছে এমনভাবে কপাল-ভ্রূ কুঁচকে দেখলো, দেখে অবশ্যই চিনতে পারলো না। তার ঠোঁটের দুইকোণে শাদা ঘা। রঙলাগা হাত থেকে বোধহয় গন্ধটাও আসছে না।
কমলা স্যান্ডেল সেলাইয়ের প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু সেই তৎপরতা আর কই? সেই চটপটে ভাব?
মোটা সুইটা স্যান্ডেলের অন্য জায়গায় ঢুকিয়ে দিলো সে। ‘গেল গেল’ বলে উঠল মন। ভাবলাম, স্যান্ডেলটাই বোধহয় এবার গেলোই! কমলা এখানে ওখানে সুঁইটার ফোঁড় দিয়ে, একেবারে কোনোমতে সেলাই শেষ করলো। সেলাইয়ের পরেও দেখলাম স্যান্ডেল হাসছে। বৃদ্ধ বয়সের সাথে আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না কমলা– একদার মুচিরাজা। তার চোখ, তার হাত, তার হৃদয় কিছুই আর তার সঙ্গে সঙ্গতে বসছে না।
স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে টাকা দিয়ে যখন ফিরছি, আমার প্রদত্ত টাকা হাতে নিয়ে নেড়ে, শূন্যদৃষ্টিতে কমলা বলে, বাবু, আর পাঁচটা টাকা দিবেন?
মুচিরাজ কমলা এখন কেমন আছে কে জানে! আমার স্যান্ডেল ছিঁড়লে তার কাছে আর যাওয়া হয় না। রহনপুর অনেক দূর। কমলা, তুমি ভালো থেকো।
আনন্দ-বেদনার তীর্থকেন্দ্র : মুক্তাশা সিনেমাহল
সিনেমা হলের নাম ‘মুক্তাশা’।
নামের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি। শৈশবের বড় পর্দা, রূপালি পর্দা, স্বপ্নের পর্দা বলতে যা বোঝায় তা ওই মুক্তাশাহল।
বাঙালি মধ্যবিত্ত তখন দলে দলে, সপরিবারে, সিনেমা দেখতে যেতো। সিনেমা ছিলো মাসিক খোরাক। কারো কারো সাপ্তাহিক– তাদের তখন ঈর্ষা করতাম।
বড় পর্দায় আমার প্রথম সিনেমা দেখা ওই মুক্তাশা সিনেমা হলে। আমরা তখন সিনেমা বলতাম না– বলতাম, বই। অমুক বই এসেছে, তমুক বই এসেছে ইত্যাদি।
প্রথম কী সিনেমা দেখেছিলাম তার নাম কী করে কই? কারণ, তখন তো আমি গ্যান্দাপোলা। আম্মার কোলে চেপেই গিয়েছিলাম নিশ্চয়। মহিলাদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে অন্যান্য বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে চিৎকার করতে করতে সময় পার হয়েছিল, এমন ধারণা করি।
এখন যে-বইয়ের কথা মনে পড়ে তা হলো ‘বিরোধ’।
আম্মা আব্বার সাথে গিয়েছি। মুক্তাশা সিনেমা হলের এ-ক্লাশের নাম নিরালা। আমরা নিরালায় বসেছি। হাতে একঠোঙা বাদাম। বয়স কোলে চেপে থাকার মতো হলেও বসেছি একটা চেয়ারে। ফলে, ছোট্ট দিলেও ভাব চলে আসছে। বাদাম কখন খাবো বুঝতে পারছি না– সিনেমা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো না আগেই শুরু করে দিবো সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা। দেখলাম সবাই উঠে দাঁড়াচ্ছে। আমি আম্মার দিকে তাকালাম। আম্মাও উঠে দাঁড়াচ্ছেন। ফলে আমিও উঠে দাঁড়ালাম।
ঝিরঝিরে পর্দায় পতপতে পতাকা উড়ছে। আমি পতাকা দেখছি আর দেখছি মাথার ওপর দিয়ে রঙিন একটা ফোকাস চলে যাচ্ছে পর্দায়। আমার সমস্ত বিস্ময় ওই ফোকাসের ওপর। ফোকাসটা আসছে একটা চারকোণা ফুটো দিয়ে। আমার ইচ্ছা ওই ফুটোয় উঁকি দেয়ার। কিন্তু ইচ্ছাটা কাজে বদলাতে যাওয়ার আগেই আওয়াজ, পর্দায় লেখা, বইয়ের কলাকুশলীদের নাম। আমি পড়তে পারি তখন– ফলে পড়লাম শাবানা। বোম্বে থেকে আগত রাজেস খান্না। আর এখন মনে পড়ছে মাস্টার তাপুর না। মাস্টার তাপুর নাম মনে পড়ার কারণ– মাস্টার তাপু ঠোঁট উল্টে কাঁদতে কাঁদতে যে গান গেয়েছিল সে-গান অনেকদিন আমার ভেতর ছিল। আমি বিরাট পর্দায় বিরাট বিরাট মুখ দেখে বাদামের কথা ভুলে গেলাম।
কিছুক্ষণ যেতেই আমার পেশাব পেলো, আমি পেশাবের কথাও ভুলে যেতে চাইলাম। বইয়ে এত দুঃখ, এত আনন্দ, এত মজা আমার কিছুই মনে থাকলো না। অথবা, সিনেমার ভেতরের যে আনন্দ দুঃখ বেদনা তার কিছুই আমি বুঝছিলাম না– আমার হয়তো ভালো লাগছিল বড় বড় রঙিন রঙিন মানুষগুলো। এ ভালোলাগা থেকে গেল আজীবন।
তারপর বড় হয়েছি আর মুক্তাশা সিনেমা হলের সাথে আমাদের সম্পর্কটা গভীর ও লম্বা হয়েছে। হলটা আমাদের বাড়ি থেকে দূরে নয়। তবু, সিনেমা হলে যাওয়াটা ছিল অনেকটা উৎসবের মতো। প্রথমে পরিবারের সাথে, পরে বন্ধুবান্ধবের সাথে, আরো পরে একা একা হলের ভেতর ঢুকেছি বই দেখার জন্য।
মনে পড়ছে, হুমায়ুন ফরিদীকে বড় পর্দায় প্রথম দেখেছি ওই মুক্তাশা সিনেমা হলেই। সিনেমার নাম ত্যাগ। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। বি-ক্লাশে বসেছি। লম্বা লম্বা টানা বেঞ্চ। চারদিক থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে কটু। তারমধ্যে আমি আর আমার ভাই বেশ আয়েশ করে জমিয়ে তাকিয়ে আছি পর্দার দিকে। হাতে বাদাম নেই।
সিনেমা শুরু হলো। প্রথম দৃশ্যেই দেখলাম নায়ক গেল মরে। অত্যন্ত চিন্তার কথা। হুমায়ুন ফরিদী লাল রঙের একটা আলখেল্লা পরা। সমুদ্রের তীরে আলখেল্লা পরা হুমায়ুন ফরিদী পুরো আলখেল্লা তুলে, লম্বা ছুরি বের করে, ইলিয়াস কাঞ্চনের পেটে আমূল গেঁথে দিলো। বলল, লাগছে লাগছে জায়গা মতো লাগছে!
হাহাকার জাগানিয়া অবস্থা!
নায়ক মরে গেলে আর থাকে কী সিনেমার! ফরিদী এতো নিষ্ঠুর? এতো পাষাণ?
কিন্তু একটু পরেই দেখলাম আরেকটা ইলিয়াস কাঞ্চন। পুলিশ। হাততালি পড়ে গেলো সিনেমাহলে। শিস বাজালো অনেকে। আমাদের বুকে যেন বল ফিরে এলো। এবার রে ফরিদী?
আরেকটা সিনেমার কথা মনে পড়ছে এখন। নাম বনের রাজা টারজান। নায়ক ড্যানি সিডাক। সুপার হিরোঅলা সিনেমা হলে ড্যানি যেন বাঁধা নায়ক। কোনো এক ঈদে এলো এই সিনেমা। গেলাম ঈদের দিন এই সিনেমা দেখতে। নতুন জামা, নতুন প্যান্ট, পান খাবো কিনা ভাবছি! মনে অত্যন্ত উৎসাহ। পোস্টারে দেখেছি সিনেমার নায়িকা পাতার জামাকাপড় পরে আছে– এ সিনেমা না দেখলে জীবন বৃথা। বাঘ-ভালুক-হরিণ-হাতি-বানর কী নেই এই সিনেমায়?
তবে মুক্তাশা হলের সামনে গিয়ে মনটা দমে গেলো। লোকে লোকারণ্য। শুধু মানুষের কালো কালো মাথা। ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে যেমন লোক হয় তেমন অবস্থা। আর ঠেলাঠেলি, গুতোগুতি, মারামারি পর্যন্ত! টিকেট নেই। না, এমনকি ব্ল্যাকেও নেই। যাহ, তাহলে কি বনের রাজা টারজানকে দেখা হবে না? বেলুনের মতো চুপসে গেলাম। এতো লোকের মধ্যে যেন এই পৃথিবীর আমার কেউ নেই। একটা টিকেট দেয়ার মতো কেউ নেই। হায়, কেউ নেই।
তখনই, বলা যায় আসমানী সহায়তায়, এসে হাজির হলেন এলাকার বড় ভাই। বড় ভাই প্রভাবশালী এবং আমাকে ভালো(!) ছেলে হিশেবে জানেন; ফলে, জিগ্যেস করলেন আমি সিনেমা দেখতে যাবো কিনা!
আমি অনন্যোপায় হয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম। বড় ভাই বুক চিতিয়ে লোকের মধ্যে ঢুকে গেলেন তারপর বীরের বেশে টিকেট নিয়ে এলেন। এ টিকেটের উৎস কী তা আমার আজও জানা হয় নি। বড় ভাইও সিনেমা দেখবেন। তার সিট আমার সিট পাশাপাশি। বসলাম। জাতীয় পতাকা দেখানো শেষ হলো। আমি ঠারে ঠারে ফুটো দিয়ে বেরোনো ফোকাসের দিকে তাকাই। শৈশবের সেই বিস্ময় আজো শেষ হয়নি আমার!
সিনেমা শুরু হলো। নায়ক এলো নায়িকা এলো। দুজনের পোশাকই স্বল্প- লতাপাতা দিয়ে তৈরি। আমার কান গরম হয়ে গেলো। বড় ভাইয়ের দিকে তাকাতে পারি না। সিনেমাহল অন্ধকার, কিন্তু পর্দার আলোয় বড় ভাইকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বড় ভাই কিছুক্ষণ পরপর অস্বস্থি নিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। বুঝলাম, তাঁর কানও গরম হয়ে যাচ্ছে।
বিরতিতে বড় ভাই পেশাব করার জন্য সেই যে বের হলেন আর ফিরলেন না। আমি সিনেমা শেষ করে, নিজে একটা বানর পোষার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
তো মুক্তাশা সিনেমা হল ছিলো আমাদের নতুন নতুন ছবি বই দেখার স্থান। কত না আনন্দ এই সিনেমা হল আমাদের দিয়ে এসেছে। বাংলাদের শত শত সিনেমা হলের মতো এই সিনেমা হলও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে এখন কমিউনিটি সেন্টার হয়েছে। জমকালো কমিউনিটি সেন্টার। মানুষজন মুখরিত।
এই যে মানুষজন মুখরিত বললাম কারণ মুক্তাশা সিনেমা হলের শেষটা ভালো ছিলো। মানুষের ঘরে ঘরে টিভি ভিসিআর সিডিপ্লেয়ার পৌঁছে যাওয়ায় মানুষ হলবিমুখ হয়ে যায়। কিন্তু এটাই কি একমাত্র কারণ সিনেমা থেকে বিচ্ছেদের? মনে হয় না। যতো না দর্শকের দায় তারচেয়ে অনেক বেশি দায় মনে হয় ফিল্ম মেকারদের।
এ নিয়ে বিস্তর তর্ক হতে পারে– কিন্তু সে তর্ক করেই বা আর কী লাভ হচ্ছে? শৈশবের আনন্দ বেদনার তীর্থকেন্দ্র মুক্তাশা সিনেমা হলকে তো আর কেউ ফিরিয়ে দিতে পারছে না!
মুক্তাশা সিনেমা হলের নামটা ভাঙলে হয় মুক্ত+আশা। আমরা এখন কেউই মুক্ত নই বোধকরি, আর কেউই আশান্বিত নই।
দ্বিতীয় পর্ব এখানে