দেবাশিস মৈত্র
(দ্বিতীয় ভাগ এখানে)
পল রোবসন # ৬
১৯৪৯ সালে নিউ জার্সিতে ছ’জন নিগ্রো যুবককে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সিভিল রাইটস কংগ্রেস নামে একটি বামপন্থী সংগঠন এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে, এবং প্রাথমিকভাবে জয়লাভও করে তারা। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, মামলার যাবতীয় শুনানি আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। অভিযুক্তদের হয়ে মামলার খরচ চালানোর জন্য সিভিল রাইটস কংগ্রেসের তখন বিপুল অর্থের প্রয়োজন। সেই উদ্দেশ্যেই নিউ ইয়র্কের শহরতলি অঞ্চল পীকস্কিলে পল রোবসনের অনুষ্ঠানের আয়োজন।
পীকস্কিল গ্রামের উত্তরে লেকল্যাণ্ড একর নামের একটি জায়গায় অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল ১৯৪৯-এর ২৭শে অগাস্ট। পীকস্কিলে এর আগেও রোবসন তিনবার নিরুপদ্রবে অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। কিন্তু এই বছর পরিস্থিতি ছিল অন্য রকম। ১৯৪৯-এর জুন মাসে প্যারিসে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন রোবসন। সেখানে তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার এক চূড়ান্ত বিকৃত রূপ সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গোটা অ্যামেরিকা জুড়ে। রোবসন নাকি বলেছেন, মার্কিন সরকারের সঙ্গে হিটলারের কোনও তফাৎ নেই। অতএব, আজ যদি রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বাধে, তাহলে নিগ্রোরা কখনওই তাদের অত্যাচারী শাসকদের পক্ষ নিয়ে সেই যুদ্ধে অংশ নেবে না। বলা বাহুল্য, রোবসন বলেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য কথা। কিন্তু কে আর তা খতিয়ে দেখছে? শ্বেতাঙ্গ সমাজের এক বড় অংশই গুজবে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে ‘দ্য ব্যালাড অফ অ্যামেরিকানস’-এর গায়ককে ঠেলে দিয়েছে দেশদ্রোহীর তালিকায়। দেশ জুড়ে তীব্র রোবসন-বিরোধী হাওয়া বইছে। উপরন্তু পীকস্কিল কনসার্টের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন রোবসনের পরিচিতা এক মহিলা, হেলেন রোসেন, যিনি ধর্মে ইহুদি। সুতরাং কু-ক্লুক্স-ক্ল্যান পীকস্কিলকেই তাদের আক্রমণের সেরা জায়গা হিসাবে বেছে নিল। সঙ্গে রইল তাদের সহযোগী আরও কয়েকটি ফ্যাশিস্ত সংগঠন, মূলত Hate group হিসাবেই যাদের পরিচয়।
২৭শে অগাস্ট দুপুর থেকে শ্রোতাদের ঢল নামতে থাকল লেকল্যাণ্ড একরে। অধিকাংশ শ্রোতাই এসেছেন নিউ ইয়র্ক থেকে। সেই ভিড়ের মধ্যে মিশে ছিল কয়েকশো সশস্ত্র সাদা চামড়ার গুণ্ডা। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে তারা স্বমূর্তি ধরল। তাদের তাণ্ডবে বেশ কিছু মানুষ আহত হল, অনেক গাড়ির কাচ ভাঙল, আর এক দল পুলিশ শান্তভাবে দাঁড়িয়ে দেখল এই সব। ভাগ্যক্রমে রোবসন অনুষ্ঠানস্থলে এসে উপস্থিত হওয়ার আগেই এই দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়েছিল, তাই বোধহয় তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেন। লিঞ্চিং-এর প্রতিবাদ করার অপরাধে পল রোবসনের কুশপুত্তলিকার গায়ে যথেচ্ছ পাথর ছুঁড়ে তাঁকে প্রতীকী অর্থে লিঞ্চ করেই গুণ্ডাদের ক্ষান্ত দিতে হল। কিন্তু ভেস্তে গেল ২৭শে অগাস্টের অনুষ্ঠান।
কু-ক্লুক্স-ক্ল্যানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে রোবসন ঘোষণা করলেন, ৪ঠা সেপ্টেম্বর ওই পীকস্কিলেই তিনি অনুষ্ঠান করবেন। আগের দিনের তাণ্ডবের পর লেকল্যান্ড একর ইট-পাথর আর ভাঙা কাচের টুকরোয় ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। নিকটবর্তী অন্য একটি জায়গাকে তাই অনুষ্ঠানস্থল হিসাবে নির্বাচন করা হল।
অনেক শুভাকাঙ্খী রোবসনকে পরামর্শ দিলেন, আবার এত বড় একটা ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু রোবসন তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়।
৪ঠা সেপ্টেম্বর সকাল থেকে আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যরা, চামড়ার রঙ নির্বিশেষে, পীকস্কিলে এসে জমা হতে থাকল। দেখা যাক কু-ক্লুক্স-ক্ল্যানের কত ক্ষমতা! কানাঘুষোয় শোনা গিয়েছিল, অনুষ্ঠান মঞ্চেই নাকি রোবসনকে গুলি করে মারার চক্রান্ত করা হয়েছে। এক দল লোক তাই আশেপাশের জঙ্গলে অনুসন্ধান চালাতে শুরু করল, সম্ভাব্য স্নাইপারদের খোঁজে, আর সত্যিই বন্দুকধারী দুজন লোককে তারা পাকড়াও করেও ফেলল। ঢালাও পুলিশের ব্যবস্থা ছিল সেদিন। লোক দুটিকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হল। তখন তো কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে ফেডারেল পুলিশ সেদিন কু-ক্লুক্স-ক্ল্যানের পরিকল্পনার সক্রিয় সহযোগী, এবং তা খোদ ওয়াশিংটনের নির্দেশে।
স্নাইপারদের খোঁজ পাওয়ার পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। রোবসনের শুভানুধ্যায়ীরা শেষ চেষ্টা চালালেন তাঁকে নিবৃত্ত করার। রোবসনকে যে অনেক মানুষের প্রয়োজন; সামান্য একটা গানের প্রোগ্রামের চেয়ে ঢের বড় কাজ যে ভবিষ্যতে তাঁর করার আছে। রোবসন কিন্তু শান্ত এবং নির্বিকার। তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হল এই যে, আততায়ীর গুলির ভয়ে পিছিয়ে আসার কোনো প্রশ্ন নেই, তাতে প্রতিক্রিয়াশীলদের জমি ছেড়ে দেওয়াই হবে শুধু।
আমাদের মনে পড়ে যায় এই ঘটনার অনেক পরে অন্য প্রসঙ্গে করা উডি গাথরির এক বিখ্যাত উক্তি। উডি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকের ঢঙে বলেছিলেন, ‘হত্যা করার জন্য ওদের ছ’ঘরা বন্দুক দরকার হয়। আমাদের কাছে তো একটা কলমই যথেষ্ট!’
পীকস্কিলে সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন অন্যূন পঁচিশ হাজার শ্রোতা। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ এক বিশাল বৃত্তাকার মানবপ্রাচীর তৈরি করে সমগ্র অনুষ্ঠানস্থলটি ঘিরে ফেলল। সেই প্রাচীর না-ভেঙে গুণ্ডাদের আক্রমণ শানানোর কোনো উপায় নেই। আর মঞ্চটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল আরো কুড়ি-পঁচিশজন লোক। রোবসনকে লক্ষ্য করে যদি দূর থেকে গুলি ছোঁড়া হয়, সে-গুলি তারা বুক পেতে নেবে।
অনুষ্ঠান শুরু হল পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত দিয়ে-– বাখ, মোৎজার্ট, শোপ্যাঁ। তারপর মঞ্চে এলেন পরবর্তী যুগের দুই দিকপাল গায়ক, পিট সিগার ও উডি গাথরি, সঙ্গে তাঁদের বহুদিনের বন্ধু লী হেইস। অধুনালপ্ত ‘অ্যালমানাক সিঙ্গারস’ দলের এই তিন সদস্য একের পর এক লোকগান গেয়ে আসর মাতালেন।
সব শেষে মঞ্চে এলেন পল রোবসন। মুখে তাঁর সেই চিরপরিচিত চওড়া হাসি। প্রথমেই তিনি ধরলেন তাঁর বিখ্যাত নিগ্রো স্পিরিচুয়াল, গো ডাউন মোজেসঃ Go down Mozes//way down in Egypt’s land//Tell O’ Pharaoh//let my people go.
টানা এক ঘণ্টা ধরে গান গাইলেন রোবসন। অনুষ্ঠান শেষ করলেন প্রবাদপ্রতিম আরেকটি গান “Ol’ man river” দিয়ে।
অনুষ্ঠান আশাতীতভাবে সফল। সবাই খুশি। শ্রোতারা এবার বাড়ির পথে। কেউ ভাবতেও পারেনি, কী ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা ছকে রাখা হয়েছে তাদের শায়েস্তা করার জন্য। অনুষ্ঠানস্থল থেকে ফেরার প্রত্যেকটি রাস্তার ধারে, আনাচে-কানাচে, সশস্ত্র গুণ্ডারা লুকিয়ে ছিল। রাস্তার ধারে ধারে বিশ-পঁচিশ হাত অন্তর পাথরের স্তূপ জড়ো করে রেখেছিল তারা। একটি গাড়িও অক্ষত রইল না, কত মানুষ আহত হল, কত যে রক্ত ঝরল-– কোনও হিসাব রইল না তার। আর রাষ্ট্রের পুলিশবাহিনী সেদিনও শান্তভাবে দেখল সমস্ত কিছু।
বহু বছর পর এক হবু লোকসঙ্গীত গায়ক পিট সিগারের কাছে কবুল করেছিল, পীকস্কিলের ঘটনার দিন তার বাবাও ছিলেন সেখানে মোতায়েন পুলিশবাহিনীর মধ্যে। ছেলেটি বলেছিল, ‘পুলিশের লোকদের সঙ্গে গুণ্ডাদের যোগাযোগ রাখার জন্য সেদিন কত ওয়াকি-টকি মজুত করা ছিল ওখানে-– আপনাদের কোনও ধারণা নেই।’
২৭ অগাস্ট এবং ৪ঠা সেপ্টেম্বর পীকস্কিলের দাঙ্গার সাক্ষী ছিলেন আরও একজন। হাওয়ার্ড ফাস্ট। এই মানুষটির পরিচয় দিতে যাওয়ার মতো মূর্খতা আমি অবশ্যই দেখাব না। পল রোবসনের দীর্ঘদিনের বন্ধু হাওয়ার্ড ফাস্ট নিরিবিলিতে বসে তাঁর নতুন বই লেখার জন্য সাময়িকভাবে পীকস্কিলেই বসবাস করছিলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার কথা ছিল তাঁর। অথচ কার্যক্ষেত্রে কিন্তু তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিরোধবাহিনীর প্রধান।
সেই বছরেই পীকস্কিলের ঘটনা নিয়ে ফাস্ট লিখলেন তাঁর অতুলনীয় কলমে, ‘Peekskil – U.S.A.’
পল রোবসন # ৭
একা পথ চলতে অভ্যস্ত ছিলেন না পল রোবসন। আরও অনেক মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই তাঁর জীবনের দীর্ঘ যাত্রা। রোবসন সম্পর্কিত এই লেখাতে তাই আরও কিছু মানুষের কথা উঠে আসা অবশ্যম্ভাবী। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন উডি গাথরি।
৪ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯, সকাল থেকে পল রোবসনকে যাঁরা ঘিরে রেখেছিলেন, উডিও ছিলেন তাঁদের একজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যাবতীয় সরকারি ইতিহাস থেকে পল রোবসনকে প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে, কিন্তু, কেন জানি না, উডিকে এখনও মোছা যায়নি।
উডি গাথরির নাম শুনলেই যে চেহারাটা চোখে ভেসে ওঠে তা হল, কৃশকায় একটি মানুষ, হাতে গিটার, গলায় ঝোলানো হারমনিকা, আর ঠোঁটের কোণে সিগারেট। তিনের দশকের ডিপ্রেশনের দিনগুলিতে উডি গোটা অ্যামেরিকা চষে বেড়িয়েছেন তাঁর গিটার আর হারমোনিকা নিয়ে। প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় কখনও হিচ-হাইক করে, কখনও বা মালগাড়ির কামরায় চড়ে, দূর-দূরান্তরে পাড়ি জমিয়েছেন। সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে উডি আদর্শ বলে মানতেন ফরাসী ইম্প্রেশনিস্টিক শিল্পীদের। ঠিক তাঁদেরই মতো উডি বিশ্বাস করতেন, যা কিছু তিনি চোখে দেখছেন, তা-ই নিয়েই গান লিখতে হবে তাঁকে। স্বল্পায়ু জীবনে প্রায় তিন হাজার গান লিখেছেন উডি, আর লিখে গেছেন একখানি মাত্র অনন্যসাধারণ গ্রন্থ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উডি তাঁর প্রত্যেকটি গিটারের গায়ে বড় বড় হরফে স্বহস্তে লিখে রাখতেন, ”This machine kills fascists.” তখন যেহেতু জার্মানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার পালা, রাষ্ট্রের কর্ণধাররা উডির এই ঘোষণা দেখে খুশিই হত।
গর্দভরা বুঝত না যে, মার্কিন ফ্যাশিস্তরাও উডির নিশানার বাইরে নয়।
ইতিহাসের সরণি ধরে একটু এগিয়ে যাওয়া যাক।
১৯৬০। উডি গাথরির দিন কাটছে নিউ ইয়র্কের গ্রেস্টোন পার্ক মানসিক হাসপাতালে। না, মানসিক রোগী নন তিনি। কিন্তু বংশানুক্রমে পাওয়া তাঁর যে অসুখ– Huntington’s disease-– তার সম্পর্কে তখন বিশেষ কিছুই জানা নেই ডাক্তারদের। তাই অ্যামেরিকার শ্রেষ্ঠ songwriter-এর (এই শব্দটির কোনও বাংলা প্রতিশব্দ নেই। গীতিকার আর songwriter সমার্থক নয়) ঠাঁই হয়েছে এই মানসিক হাসপাতালে।
ঠিক এই সময়ে সুদূর মিনেসোটায় বসে এক বখাটে ইহুদি তরুণ স্বপ্ন দেখছে গায়ক হওয়ার। দু’চারজন বন্ধুকে জুটিয়ে নিয়ে একটি রক-অ্যাণ্ড-রোলের দল গড়েছে সে। চেষ্টা করছে গান লেখার, গানে সুর দেওয়ার। একদিন কোনও বন্ধুর মারফৎ একখানি বই তার হাতে এল। বইটির নাম ‘Bound for glory,’ লেখক উডি গাথরি।
একটিমাত্র বই সেই তরুণের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ইলেকট্রিক গিটার ছেড়ে সে হাতে তুলে নিল অ্যাকস্টিক গিটার, রক-অ্যাণ্ড-রোলের চটুল জগতের বদলে বেছে নিল লোকগানের বাস্তবতাকে। গানের দলেরই বা কী প্রয়োজন? উডি তো বলেই দিয়েছেন, একজন মানুষ আর একটি গিটার, বড় জোর তার সাথে একটি হারমোনিকা-– সঙ্গীত সৃষ্টি করার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু তো দরকার নেই!
সে তরুণ উডি গাথরির প্রত্যেকটি রেকর্ড কিনে এনে বার বার শুনতে থাকল। উডি এই অচেনা গায়ককে অদৃশ্য দ্রোণাচার্যের মতো ক্রমে গড়ে দিচ্ছেন তার ভবিষ্যৎ, নিজের চলার পথটি বোধহয় খুঁজে পেতে চলেছে সে। উডির গান শুনছে তরুণ, আর রপ্ত করে নিচ্ছে তাঁর বাচনভঙ্গী, তাঁর উচ্চারণ, এমনকী তাঁর গিটারের স্ট্রামিং-এর কায়দাটুকু পর্যন্ত। উডির গানের লিরিক নির্দ্বিধায় অনুসরণ করে নিজেও গান লেখার চেষ্টা করছে সে।
জানুয়ারি ১৯৬১। মিনেসোটা থেকে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা হল সেই তরুণ। উডি গাথরির সঙ্গে দেখা করতেই হবে তাকে। পথে উইসকনসিন এবং শিকাগো থেকে সে জুটিয়ে নিল আরও তিন বন্ধুকে। অতঃপর নিউ ইয়র্ক এবং গ্রেস্টোন পার্ক হাসপাতাল।
সেদিন অসুস্থ উডির সামনে বসে গিটার বাজিয়ে তাঁরই লেখা গানগুলি একের পর এক গেয়েছিল সেই তরুণ। দু’জনের চেহারার মধ্যেও কী অদ্ভুত মিল! দুজনেই কৃশকায়, প্রায় একই উচ্চতা দুজনের, মুখমণ্ডলের মধ্যেও রয়েছে সাদৃশ্য। আর তরুণের গান গাওয়ার স্টাইল তো হুবহু উডির স্টাইলেরই নকল। ঠিক যেন ছয়ের দশকের অসুস্থ, অকালবৃদ্ধ উডি গাথরির সামনে বসে তাঁকেই গান শোনাচ্ছে তিনের দশকের তরতাজা যুবক উডি।
সব শেষে সেই তরুণ উডিকে শোনাল তার নিজের লেখা একটি গান-– Song to Woody। উডির নীরব হাসি বুঝিয়ে দিল, গানটি তাঁর ভালো লেগেছে।
চার বন্ধু বিদায় নেওয়ার আগে উডি কাঁপা-কাঁপা হাতে একটি করে চিরকুট লিখে প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমাদের এই তরুণ গায়ক বাইরে এসে দেখল যে তার হাতের চিরকুটে উডি লিখেছেন, I ain’t dead yet।
১৯৬১। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই কুড়ি বছরের সেই যুবক পেশাদার গায়ক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল। অ্যামেরিকার আরও অনেক প্রথিতযশা গায়কের মতো তারও জীবন শুরু হল কাফে আর রেস্তোরাঁয় গান গেয়ে। গানের মাঝে সে গর্বের সঙ্গে শ্রোতাদের বলত, ‘I been travellin’ around the country, followin’ Woody Guthrie’s footsteps.’
১৯৬২। এই তরুণের প্রথম লং-প্লেয়িং রেকর্ড বেরোল। সে রেকর্ডে অনেকগুলি প্রচলিত লোকগানের সঙ্গে তার নিজের লেখা দুটি গানও রয়েছে। তার মধ্যে একটি হল Song to Woody। পিতৃদত্ত নাম রবার্ট জিমারম্যান ছেড়ে সে তখন নতুন নাম বেছে নিয়েছে। তার জীবনের প্রথম এই রেকর্ডটির আলাদা কোনও শিরোনাম ছিল না। গায়কের নামেই রেকর্ডের পরিচয়-– Bob Dylan।
১৯৬৩। একদিকে উডি তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন, অন্যদিকে বব ডিলানের জনপ্রিয়তা হু-হু করে বাড়ছে। একদিন নিউ ইয়র্কের টাউন হলে একক অনুষ্ঠানে অনেকগুলি গান গাইলেন ডিলান। অনুষ্ঠান শেষ করে উইংসের আড়ালে চলে গিয়েও আবার মঞ্চে ফিরে এলেন তিনি। বললেন, ‘একটা কবিতা পড়ে শোনাতে চাই। উডি গাথরির সম্পর্কে প্রকাশিতব্য একটি বইয়ের জন্য সম্পাদকরা আমায় বলেছিলেন, মাত্র পঁচিশটি শব্দের মধ্যে উডির সম্পর্কে আমার অনুভূতি যেন লিখে দিই। আমি পারিনি। আমি পাঁচ পাতা লিখেছি।’
১৯৪ লাইনের সেই দীর্ঘ কবিতা-– Last thoughts on Woody Guthrie-– ওই একবারই জনসমক্ষে আবৃত্তি করেছিলেন বব ডিলান। এর পর গত ৫৪ বছরে আর কোনওদিন তাঁকে এই কবিতা আবৃত্তি করতে দেখা যায়নি।
Last thoughts on Woody Guthrie একটি ব্যালাডধর্মী কবিতা, যেখানে কবি সরাসরি কথা বলছেন তাঁর পাঠক অথবা শ্রোতার সঙ্গে। সেই পাঠক বৃদ্ধ হতে পারে, অথবা তরুণ; বুদ্ধিমান হতে পারে অথবা নির্বোধ; তারই উদ্দেশে বলা এক সুদীর্ঘ মনোলগের মধ্য দিয়ে ডিলান ক্রমশ নিংড়ে বার করে আনছেন তার এবং তারই মতো আরও বহু মানুষের হতাশা আর দোলাচলের কথা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা, নাগরিক জীবনের উদ্দেশ্যহীনতার কথা….. আর পরিশেষে বলছেন জীবনে পরম শান্তি খুঁজে পেতে সে যদি চায় তো দুটি পথ খোলা রয়েছে তার সামনে।
কী পথ?
কবিতার শেষ কয়েকটি পংক্তিতে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আছে:
“ইচ্ছা হলে তুমি যেতে পারো তোমার পছন্দসই কোনও গির্জায়
অথবা যেতে পারো ব্রুকলিন স্টেট হাসপাতালে
তোমার পছন্দসই গির্জায় তুমি ঈশ্বরকে খুঁজে পাবে
আর ব্রুকলিন স্টেট হাসপাতালে খুঁজে পাবে উডি গাথরিকে
কিন্তু আমার নিজের ধারণা-–
ঠিক হতে পারে তা, হতে পারে ভুলও-–
সূর্যাস্তের মুহূর্তটিতে একবার যদি
গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়নের সামনে গিয়ে দাঁড়াও,
তবে দু’জনকেই একসাথে খুঁজে পাবে তুমি।”
বছর কয়েক আগে এ-বি-পি আনন্দ চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানে মুখোমুখি বসেছিলেন এ যুগের দুই দিকপাল বাঙালি গায়ক, এবং দুই ঘোষিত ডিলানভক্ত, কবীর সুমন ও অঞ্জন দত্ত। আলোচনার বিষয় ছিল, বব ডিলানের সম্ভাব্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি (সে বছর ডিলান শেষ পর্যন্ত অবশ্য নোবেল পাননি)। সেই দীর্ঘ আলোচনায় একবারের জন্যও উডি গাথরির নাম উচ্চারিত হয়নি।
অথচ দুই আলোচকই তো নাকি গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন স্বচক্ষে দেখে এসেছেন!
পঞ্চান্ন বছরের স্বল্পায়ু জীবনের প্রায় পনেরো বছর একাধিক হাসপাতালে কাটিয়ে ১৯৬৭ সালের ৩রা অক্টোবর চলে গেলেন উডি গাথরি।
পল রোবসন তখনও জীবিত, কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে।
(চতুর্থ ভাগ এখানে)
অসামান্য লেখা! আরো চলুক|
তবে রক এন্ড রোলের চটুল জগত ছেড়ে ফোক গানের বাস্তবতা, ব্যাপারটা সাধারনীকরণ হলো অপ্রত্যাশিত ভাবে| রক এ প্রতিবাদ সঙ্গীত কম হয়নি , ফোক মানেই প্রতিবাদী বাস্তব টাও নয়|
বাকি লেখাটা টান টান
চার নম্বর এসে গেছে। তলাতেই লিংক রয়েছে। ক্লিক করে পড়ে ফেলুন… 🙂