জিনাত মহল
বিগত কিছু বছরের মতো এইবারও ৩রা মে অতর্কিতে শিক্ষামন্ত্রী সংবাদমাধ্যমের সামনে অতিরিক্ত গ্রীষ্মের ছুটির ঘোষণা করলেন। শিক্ষা দপ্তর ঘণ্টায় ঘণ্টায় ছুটির নির্দেশ পরিবর্তনের রেকর্ড গড়ে শেষ পর্যন্ত জানাল ৩রা মে থেকে ৩০শে জুন পর্যন্ত টানা ৫৯ দিন ফণী ঝড় ও গ্রীষ্মের দাবদাহে কারণে রাজ্যের সমস্ত সরকারি এবং সরকারপোষিত স্কুল ও মাদ্রাসা বন্ধ থাকবে।
ছুটির খবর সাধারণত আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। কিন্তু এই দীর্ঘ ৫৯ দিন ছুটিতে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা অভিভাবককুল কেউই সন্তুষ্ট নন। তারা বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ। এই অস্বাভাবিক ছুটির আসল কারণ কী তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠলেও শিক্ষা দপ্তর তার কোনও উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেয়নি।
ফণী ঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা পেয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে দুই তিন দিন ছুটি দেওয়া অবশ্যই যুক্তিগ্রাহ্য। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ফণী ঝড়ে আমাদের রাজ্যে বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়নি; ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ আছে, স্কুল বিল্ডিং অক্ষত আছে, ঝড়ের আশঙ্কা কেটে গিয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত স্কুল খোলার কোনও নির্দেশিকা শিক্ষাদপ্তরের তরফ থেকে আসেনি।
গ্রীষ্মপ্রধান আমাদের এই রাজ্যে, বিশেষত দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে গরমের দাপট যথেষ্ট লক্ষ করা যায়। ছুটির লিস্টে সেইমতো গ্রীষ্মের ছুটিও নির্ধারিত আছে। শিক্ষা দপ্তর যদি মনে করে গ্রীষ্মকালীন দাবদাহ থেকে ছাত্রছাত্রীদের বাঁচাতে নির্ধারিত ছুটির পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন, বা আবহাওয়া বুঝে ছুটির সময়সীমা পরিবর্তন করতে হতে পারে, তবে বছরের শুরুতে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে তা প্রকাশ করলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী দুই পক্ষেরই সুবিধা হয়। প্রতিবছর ছুটি নিয়ে তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে৷
তবে এই বছরে বিশেষত কোনও অবস্থাতেই ৩০শে জুন পর্যন্ত ছুটি সমর্থনযোগ্য নয়। তা অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক। আবহাওয়া দপ্তর অনুসারে আমাদের রাজ্যে ১লা জুন থেকে ১৫ই জুনের মধ্যে বর্ষা প্রবেশ করে। এই বছর বর্ষা ঢুকতে দেরি হবে এমন কোনও আগাম বার্তা আবহাওয়া দপ্তর দেয়নি। তবে কী ভিত্তিতে গরমের তীব্রতার অজুহাতে ৩০শে জুন পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হল? এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলতেই হয়, উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে গরমের তীব্রতা ততটা থাকে না। সে সমস্ত অঞ্চলে বর্ষার ছুটি দেওয়া হয়। শিক্ষাদপ্তরের খণ্ড চিন্তন এবং চাপিয়ে দেওয়া ছুটির বোঝা উত্তরবঙ্গের একটা বিরাট অংশের ছাত্রছাত্রীর পঠনপাঠনের উপযুক্ত মূল্যবান দিন অহেতুক নষ্ট করছে।
ভোটের বাজার গরম করতে রাজনৈতিক মহলে “মুসলিম তোষণ” তত্ত্ব উঠে আসছে। বলা হচ্ছে, এই ছুটি আসলে গরমের ছুটির আড়ালে রোজার ছুটি। অধিকাংশ মাদ্রাসাগুলিতে এবং মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের স্কুলগুলিতে পুজোর ছুটি টানা না দিয়ে রোজার শেষ দিকে প্রায় ১০ দিন ছুটি রাখার রেওয়াজ আছে। এছাড়া আলাদা করে রোজায় ছুটি রাখার দাবি কোনও দিন জানানো হয়নি। তবু তর্কের খাতিরে “মুসলিম তোষণ” তত্ত্ব যদি সত্যি হিসেবে ধরা হয়, শিক্ষাদপ্তর যদি মনে করে রোজার ছুটি দেওয়া প্রয়োজন, তবে স্পষ্টভাবে নির্দেশিকায় তা উল্লেখ করা উচিত। গরমের ছুটির আড়ালে রোজার ছুটি দেওয়ার উদ্যোগ কেন? রোজার ছুটি দেওয়া কি লুকিয়ে রাখার মত অপরাধ? তাছাড়াও, রোজা শেষ হচ্ছে ৫ই জুন, ৬ই জুন ঈদ, তাহলে ৩০শে জুন পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হয়েছে কেন?
গত বছর ক্লাস সাসপেন্ড থাকাকালীন, জনৈক সাংবাদিক মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চান দীর্ঘদিন ক্লাস সাসপেন্ড থাকলে ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে পড়বে? মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী উত্তর দেন— “ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে পড়বে।” মন্ত্রীর এহেন মন্তব্য প্রমাণ করে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ও গ্রামগঞ্জের নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা পিছিয়ে পড়া মানুষদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্পষ্ট নয়।
১) প্রাথমিক স্তরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই। সে ক্ষেত্রে তারা কীভাবে বাড়িতে পড়ে নেবে?
২) বিদ্যালয়ের চৌকাঠ ডিঙোনো প্রথম প্রজন্ম হিসেবে শিক্ষা গ্রহণ করছে, এমন বাড়ির শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য পুরোপুরি বিদ্যালয়ের ওপর নির্ভরশীল। বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। এমনকি প্রতিদিন পড়তে বসার অভ্যেস বাড়িতে তৈরি হয় না। স্কুল থেকে যে সমস্ত হোমওয়ার্ক দেওয়া হয় সেই কারণে দিনের শেষে তারা কিছুটা অন্তত পড়াশোনা করে।
৩) এছাড়াও পুষ্টির ব্যাপারে তারা অনেকেই মিড ডে মিলের ওপর নির্ভরশীল। জনমজুর, বিড়িশ্রমিক, গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন যে মায়েরা, তারা সন্তানদের সকালবেলা শুকনো মুড়ি বা পান্তা দিয়ে কাজে বেরিয়ে যেতে পারেন, কারণ স্কুলে তাদের জন্যে গরম ভাতের ব্যবস্থা আছে। শুধুমাত্র গরম ভাতের টানে সরকারি স্কুলে পড়তে আসে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। দুই মাসের জন্যে তাদের দুপুরে পেট ভরে খাবারের নিশ্চয়তার ব্যাঘাত ঘটল।
৪) খবরে প্রকাশিত, দুই মাস ছুটি ঘোষণা হওয়ায় মুর্শিদাবাদ জেলার জনমজুর পরিবারের ছেলেরা রাজমিস্ত্রির কাজে ভিনরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। একইভাবে মেয়েরা স্কুল না গিয়ে ঘরে বসে থাকলে তাদের ঘরের কাজ শিখিয়ে পাত্রস্থ করার ব্যবস্থা করা হতে পারে। শুনতে অবাক লাগলেও গ্রামের অনেক পরিবারেই কিন্তু স্কুলে পাঠরত মেয়ের বিয়ে দেওয়ার অজুহাত খোঁজা হয়।
৫) স্কুল খোলার দুই সপ্তাহের মধ্যে শুরু হবে দ্বিতীয় পার্বিক পরীক্ষা, সেক্ষেত্রে স্কুলে সিলেবাস শেষ হবে না, পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা আরও পিছিয়ে পড়বে, ফলে পরীক্ষা দিতে ভয় পাবে। কার্যক্ষেত্রে স্কুল খুললে দেখা যাবে ড্রপ আউটের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গিয়েছে। আগ্রহী ও সচেতন শিক্ষার্থীরা পড়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে টিউশ্যন নির্ভর হয়ে পড়বে, পরবর্তীতে স্কুলের ক্লাসের প্রতি আগ্রহ হারাবে, স্কুলকে শুধুমাত্র পরীক্ষা গ্রহণ ও সার্টিফিকেট প্রদানকারী সংস্থা রূপে বিবেচনা করবে।
এই ছুটিতে সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা শিক্ষক-কুলের, ঘরে বসেই দুই মাসের মাইনে পাবেন৷ কিন্তু তাঁরাও এই ছুটিতে বিরক্ত ও আশঙ্কিত। এমনিতেই বিগত কিছু বছর থেকে শিক্ষক নিয়োগ ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে না। তার উপর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ওপর পড়ানো ছাড়াও আরও নানাবিধ স্কুলসংক্রান্ত ও স্কুলের বাইরের কাজের দায়িত্ব চাপানো হয়েছে— আদমশুমারি (প্রাইমারি শিক্ষকদের জন্য), ভোট, বিভিন্ন সময় রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারকে ছাত্র-ছাত্রী সংক্রান্ত গাদা গাদা তথ্য নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জোগাড় করে পাঠানো— এসবই তাঁদের করতে হয়।
এসব কাজে অনেকক্ষেত্রে একান্ত বাধ্য হয়ে ক্লাস সাসপেন্ড রাখতে হয়। এছাড়াও মিড ডে মিল, বই, খাতা, ব্যাগ, সাইকেল, স্কুল-ড্রেস, জুতো, প্রভৃতি শিক্ষা সহায়ক ও শিক্ষায় উৎসাহ-দানকারী জিনিসের হিসাব রাখা, বাচ্চাদের আয়রন ট্যাবলেট, কৃমির ট্যাবলেট খাওয়ানো, শৌচাগার গণনা, স্কলারশিপ ও গ্র্যান্টসংক্রান্ত নানান ফর্ম ফিলাপ প্রভৃতিও আছে। তার উপর অস্বাভাবিকভাবে দুই মাস ছুটি থাকলে সিলেবাস শেষ করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। ছুটি পূর্ব-নির্ধারিত ক্যালেন্ডার অনুয়ায়ী হলে শিক্ষকরা সেইমতো সিলেবাস ভাগ, লেসন প্ল্যান, পরীক্ষার রুটিন, বাচ্চাদের ছুটির কাজের পরিকল্পনা করে রাখতে পারেন। কিন্তু ছুটি অতর্কিতে হওয়ার ফলে সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে যায়; নিরবিচ্ছিন্ন শিখন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
শিক্ষক সমাজের একাংশের মত, সমাজের চোখে শিক্ষকদের হেয় প্রতিপন্ন করতে চক্রান্ত করে শিক্ষকদের দুইমাস ঘরে বসিয়ে বেতন দেওয়া হবে। গত পঞ্চায়েতে ভোটে, ভোটকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রতিবাদে এবং লোকসভা ভোটে একশ শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবিতে রাজ্যব্যাপী শিক্ষক-কুল সরকারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে আন্দোলন করেছে। তাই শিক্ষকদের সমাজের কাছে অপ্রয়োজনীয় প্রতিপন্ন করতে প্রতিহিংসাবশত এই জনবিরোধী ছুটি দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষক মহলের আর এক অংশের অভিমত অস্বাভাবিক দীর্ঘ ছুটি শিক্ষাব্যবস্থাকে বেসরকারিকরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ ধাপ। সরকার শিক্ষার মত অ-লাভজনক প্রকল্পে আর বিনিয়োগ করতে চায়ছে না। এমনিতেই রাজ্যের সরকারি প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। সচেতন অভিভাবকরা তার সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষার জন্যে বেসরকারি স্কুল বেছে নিচ্ছেন। শহরাঞ্চলে মাধ্যমিক শিক্ষার হালও একই। শিক্ষার্থীর অভাবে কলকাতার প্রায় ৭৫টি স্কুল বন্ধ হওয়ার মুখে। যদিও মফঃস্বল অঞ্চলে কিন্তু এখনও একটা বিরাট অংশের সচেতন অভিভাবক সরকার পোষিত স্কুলের উপর আস্থা রাখেন। কিন্তু অস্বাভাবিক দীর্ঘ ছুটিতে বিরক্ত হয়ে তাঁরা সন্তানদের আর সরকারপোষিত স্কুলে পাঠাতে চাইবেন না। মফঃস্বল অঞ্চলেও ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠবে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অভিভাবকরা সন্তানদের সেখানেই পাঠাবেন। অদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে যখন জনসাধারণই সরকারি বিদ্যালয় তুলে দেওয়ার দাবি জানাবেন।
রাজ্যের কয়েকটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ, এবিপিটিএ, এসটিইএ এই ছাত্রবিরোধী ও হঠকারী ছুটির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে জেলায় জেলায় শিক্ষা দপ্তরের মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও ডেপুটেশন দেওয়ার মত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সংগঠনগুলির কেন্দ্রীয় কমিটির তরফ থেকেও বিকাশ ভবনে ছুটি প্রত্যাহারের দাবিতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি স্কুলে অভিভাবক ও শিক্ষক সংগঠিত হয়ে সরকারি নিৰ্দেশ অমান্য করে স্কুল খোলা রেখেছেন। কিন্তু শিক্ষাদপ্তরের তরফ থেকে এখনও পর্যন্ত ছুটির আদেশ প্রত্যাহার হবে কিনা সে বিষয়ে কোনও সদর্থক উত্তর পাওয়া যায়নি।