ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
গত এপ্রিল মাসের এগারো তারিখে লন্ডনের ইকুয়াদর দূতাবাস থেকে গ্রেফতার করা হল জুলিয়ান আস্যাঞ্জকে। ‘হুইসল ব্লোয়ার’ আস্যাঞ্জ আপাতত বিলেতের জেলে বন্দি।
ইকুয়াদরের লন্ডন রাজদূতাবাসে আস্যাঞ্জের বাস ২০১২ সাল থেকে, অ্যামেরিকায় তাঁর বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হবার পর। এই দীর্ঘ সাত বছর একাদিক্রমে শরণ পেয়ে এতদিন পর হঠাৎ এমন কী হল যার জন্য তাঁকে তুলে দেওয়া হল পুলিশের হাতে? এক কথায় বলতে গেলে— কারণ আস্যাঞ্জের ‘দুর্ব্যবহার’। এই দুর্ব্যবহারের কথা একটু বিশদে বললে ব্যাপারটা দাঁড়ায়— রাতবিরেতে দূতাবাসের মধ্যে স্কেটবোর্ডিং করে বেড়ানো, পরিচারকদের প্রতি দুর্ব্যবহার এবং নিজের মল দেওয়ালে দেওয়ালে ছেটানো! এইসব দেখেশুনে সেই দেশের প্রেসিডেন্ট লেনিন মোরেনো খুবই বিরক্ত হয়েছেন, এবং ‘এইসব তাঁদুড়েপনা কাঁহাতক সহ্য করা যায়’ বলে রীতিমত পুলিশ ডাকিয়ে আস্যাঞ্জকে তাঁদের হাতে সমর্পণ করে গরম জলে হাত ধুয়ে ফেলেছেন।
২০১২ সালে আস্যাঞ্জকে যখন আশ্রয় দেওয়া হয়, তখন ইকুয়াদরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাফায়েল কোররেয়া। কোররেয়া ছিলেন বামপন্থী নেতা এবং শাভেজের সমর্থক। দক্ষিণ অ্যামেরিকায় শাভেজ-রচিত ‘গোলাপি জোয়ার’-এর অন্যতম অংশীদার ছিলেন এই কোররেয়া।
২০১৭ সালের নির্বাচনে কোররেয়া প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে বেছে নেন নিজের দলের মোরেনোকে। কিন্তু নির্বাচনে জিতে প্রেসিডেন্ট হয়ে মোরেনো হয়ে যান অন্য মানুষ (ক্ষমতাও এক অনুঘটক)। এই লেনিন নিজের দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে গিয়ে কোররেয়া-প্রণীত অনেক আইন বদলে দেন যেগুলো কিনা ধনী প্রভাবশালীদের ঠিক সপক্ষে ছিল না। এর ফলে কোররেয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্রমাবনতি ঘটলেও বিশ্ব ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মোরেনোর সম্পর্ক ভালো হতে শুরু করে। পুরস্কারস্বরূপ ইকুয়াদর পেয়ে যায় আইএমএফের ঋণ। ২০১৭ সালে ইকুয়াদরের রাজধানী কিতোতে ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার চেয়ারম্যান পল ম্যানাফর্টের সঙ্গে মোরেনোর একটা মিটিং হয়। সেই মিটিং-এই ঠিক হয়ে যায় আস্যাঞ্জের ভবিষ্যৎ।
২০১২ আর ২০১৭-র কথাগুলো উল্লেখ করলাম প্রেক্ষিত বদলের প্রসঙ্গে। রসিক পাঠক বুঝবেন।
যাই হোক, আস্যাঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক।
২০১০ সালে, সুইডেনে, দু’জন মহিলা আস্যাঞ্জের নামে যৌন অপরাধের অভিযোগ আনেন। আস্যাঞ্জ তখন ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। এই অভিযোগ আস্যাঞ্জ অস্বীকার করলেও ইংল্যান্ডের ন্যায়ালয় তাঁকে সুইডেনে গিয়ে সেখানকার বিচারব্যবস্থার মোকাবিলা করতে আদেশ করেন। আস্যাঞ্জ ন্যায়ালয়ের কথা অগ্রাহ্য করে ইকুয়াদরের শরণাপন্ন হন, এবং সেই ২০১২ সাল থেকে এই সেদিন অবধি সেই দেশের দূতাবাসেই কালাতিপাত করেন। এখন আস্যাঞ্জের বিরুদ্ধে বিলেতে যে দুটো মামলা চলছে, তার একটা বৃটিশ ন্যায়ালয়ের প্রতি অবজ্ঞার মামলা, আরেকটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যর্পণের মামলা। যদিও মাইকেল মুর বা নাওমি উল্ফের মতন বিশিষ্ট মানুষেরা মনে করেন সুইডেনের মামলা দু’টো সাজানো, এবং আস্যাঞ্জকে তাতে ফাঁসানো হয়েছে।
এই সবের মধ্যে, বলাই বাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রত্যর্পণের বিষয়টাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।
২০০৬ সালে আইসল্যান্ডের সানশাইন প্রেসের সাহায্যে উইকিলিকস সংস্থা তৈরি করেন অস্ট্রেলিয়ার ইন্টারনেট অ্যাক্টিভিস্ট আস্যাঞ্জ। মাত্র ষোল বছর বয়েস থেকে হ্যাকিং-এ সিদ্ধহস্ত আস্যাঞ্জ। ওই বছরের ডিসেম্বর মাস থেকেই বিভিন্ন গোপন খবর বিশ্ববাসীর সামনে তুলে এনে প্রভূত খ্যাতি ও বিরাগের অধিকারী হলেন তিনি। সেই ২০০৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আস্যাঞ্জের উইকিলিকসের দ্বারা ঘটানো বহু বিস্ফোরণের কয়েকটার উল্লেখ করা যাক।
২০০৭ সালের নভেম্বরে গুয়ান্তানামো প্রিজন ক্যাম্পের ইউএস আর্মি ম্যানুয়াল প্রকাশ করে দেন আস্যাঞ্জ। এই ম্যানুয়াল থেকে প্রমাণ হয়, ওই প্রিজন ক্যাম্পে কিছু বন্দিকে রেড ক্রসের আওতার বাইরে রাখা হত, আর নতুন বন্দিদের দু’সপ্তাহ আলাদা রেখে ভালো করে ক্যাম্পের ‘নিয়মকানুন’ শেখানো হত।
২০০৯ সালের নভেম্বরে উইকিলিকস বলে, কুখ্যাত ৯/১১-র দিনে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ছয় লক্ষ পেজার মেসেজ পেন্টাগন, এফবিআই, ফেমা আর নিউ ইয়র্ক পুলিশের মধ্যে চালাচালি করা হয়। এই রিলিজ প্রকাশ করে উইকিলিকস বলে— ৯/১১-র ঘটনার ক্রমপর্যায়ের এ এক দলিল।
উইকিলিকসের সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রিলিজ এল ২০১০-এর এপ্রিলে, যেখানে দেখা গেল— ভিডিও ফুটেজে— কিভাবে, ২০০৭ সালে, অ্যাপাশে হেলিকপ্টার থেকে চালানো গুলিতে মরলেন নয়জন সিভিলিয়ান, যার মধ্যে একজন রয়টার্সের ফটোগ্রাফার এবং একজন তাঁর গাড়ির চালক। এই রিলিজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল চেলসি ম্যানিং-এর নাম। সেই চেলসি ম্যানিং, যাঁর আসল নাম ব্র্যাডলি ম্যানিং, যাঁকে পরবর্তীতে আস্যাঞ্জের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই ভিডিও প্রকাশের জন্য গ্রেফতার করা হয়। সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ, চেলসি আস্যাঞ্জের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করায় তাঁর সাজা দীর্ঘায়িত হয়েছে।
২০১০-এর জুলাই আর অক্টোবর মাসে উইকিলিকস আফগানিস্তান-সংক্রান্ত ৯০,০০০ দলিল এবং ইরাক-সংক্রান্ত চার লক্ষ দলিল প্রকাশ করে। আফগানিস্তান ও ইরাক-সংক্রান্ত অর্থ, এই দুই দেশে অ্যামেরিকার যুদ্ধ-সংক্রান্ত। এই দলিলে ছিল সিভিলিয়ানদের মৃত্যুর কথা, ওসামা বিন-লাদেনের অন্বেষণের কথা আর ইরাকের যোদ্ধাদের ইরানি সাহায্যের কথা।
এরপর নভেম্বর ২০১০ থেকে সেপ্টেম্বর ২০১১-র মধ্যেকার সময়ে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের কেবল ফাঁস। এর নামই হয়ে গেল ‘কেবলগেট’। এই কেবলগুলো থেকে জানা গেল, কিভাবে অ্যামেরিকা গোপনে ড্রোন আক্রমণ চালিয়েছে ইয়েমেনে, কিভাবে সৌদি আরবের রাজপরিবার অ্যামেরিকাকে চাপ দিয়েছে ইরানকে আক্রমণের, আর কিভাবে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া হয়ে উঠেছে একটি মাফিয়া্রাষ্ট্র।
২০১৬ সালে ফাঁস করা ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির প্রায় কুড়ি হাজার ইমেল থেকে জানা গেল কিভাবে অ্যামেরিকার নির্বাচনে বার্নি স্যান্ডার্সকে পিছনে ফেলে এগোলেন হিলারি ক্লিন্টন। কিভাবে ডিএনসি-র ডোনা ব্রাজিল ক্যাম্পেনের ডিবেট প্রশ্ন আগেভাগে দিয়ে দিলেন হিলারিকে।
বলাই বাহুল্য, এইসব কাণ্ডকারখানার পর অ্যামেরিকার সরকার আস্যাঞ্জকে খুব একটা নেকনজরে রাখবেন না। ২০১০ সালে যে যুদ্ধের শুরু, তাতে প্রথম বিজয় পেল অ্যামেরিকা— এই দীর্ঘ নয় বছর পর। আপাতত বিলেতের কারাগারে বন্দি আস্যাঞ্জের কোন গতি হবে তা সময়ই বলবে। তবে এ-কথা নিশ্চিত, যে আস্যাঞ্জের গ্রেফতারির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মতন সাধারণ মানুষের শক্তি অনেকটাই খর্ব হয়ে গেল। অবশ্য আমাদের মতন দেশে, যেখানকার সংবাদমাধ্যমের ট্রেন্ড এখন কৃতাঞ্জলি হয়ে অরাজনৈতিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ, হুইসল ব্লোয়ারের গুরুত্ব কতটা, সেটাই এক মস্ত প্রশ্ন।