সৌমিত্র দস্তিদার
গত ১৪ মে কলকাতায় অমিত শাহ-এর রোড শো, তৃণমূল ও বিজেপি কর্মীদের হাতাহাতি, এবং বিজেপি গুণ্ডাদের দ্বারা বিদ্যাসাগর মূর্তিভাঙাকে কেন্দ্র করে কলকাতায় যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, তার জেরে ভারতের নির্বাচন কমিশন বিশেষ ধারায় পরদিন রাত দশটার পর থেকে সমস্ত দলের নির্বাচনী প্রচার বন্ধ করে দেন। কত নম্বর ধারা, তা আইনসম্মত না বেআইনি তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলতে থাকুক। কিন্তু ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে একটা বিষয় পরিষ্কার যে এই ধরনের কাজ সংবিধান মেনে হয়তো হতে পারে, তবে নৈতিক দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে ফেডারেল কাঠামোর ওপর এক বিশ্রী আঘাত।
একটা রাজ্যে নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাসনসংক্রান্ত দায়িত্ব কমিশনের। সুতরাং যতই আইন শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে ৩২৪ ধারা জারি করা হোক তা মোটেই গণতন্ত্রের পক্ষে সুখকর দৃষ্টান্ত নয়। এ বিষয়ে অন্তত বামপন্থীদের রাজ্য সরকারের পাশে থাকা উচিত ছিল। তার কারণ বহুদিন ধরে, বস্তুত স্বাধীনতার পর থেকেই সারা দেশে বামপন্থীরাই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস নিয়ে আইনসভায়, বিভিন্ন ওপেন ফোরামে এবং রাস্তার আন্দোলনেও সবসময় সোচ্চার ছিলেন। অথচ আজ যখন একদা বাম দুর্গ পশ্চিমবঙ্গে এইরকম স্বৈরতান্ত্রিক নিদান জারি করে কেন্দ্রের অধীনস্থ (নির্বাচন কমিশন স্বাধীন এরকম সুশীল-মার্কা ধাপ্পায় আমি বিশ্বাস করি না) একটি সংস্থা তখন বামেদের শীতল নীরবতা একটু অবাক করে বৈকি। খেয়াল করুন আমি নিন্দা করেছি রাজ্যের সরকারের স্বাধীনতায় নির্বাচন কমিশনের অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের। আমি কিন্তু একবারের জন্যও এই সরকার কোন দলের তা নিয়ে একটি কথাও বলিনি। কারণ এখানে সে প্রশ্ন অবান্তর।
আজ তৃণমূল আছে। কাল অন্য কোনও দল থাকবে। কিন্তু আজ যারা ‘যা শত্রু পরে পরে’ মন নিয়ে নীরবতা পালন করছেন তারা নিশ্চিত সঙ্কীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসর থেকে সরে এসে আর এক ঐতিহাসিক ভুল করতে চলেছেন যা আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোয় যে আঘাত করা হল তার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। অন্তত আমাদের মতো আশৈশব বামমনস্কদের কাছে বামেদের এই নীরবতা মর্মান্তিক।
একতরফা এধরনের আদেশ দেবার কোনও নৈতিক অধিকার কি সত্যিই আদৌ নির্বাচন কমিশনের আছে? পাশাপাশি সচেতনভাবে কমিশন অন্য সব রাজ্যের কাছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তি ধুলোয় মিটিয়ে দিল। ৩২৪ ধারা প্রায় জরুরি অবস্থার কাছাকাছি এক কানুন। আমার রাজ্যে জরুরি অবস্থা-প্রতিম আইন জারি করে যাবতীয় সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে এই অপমানজনক আদেশ নিয়ে সমস্ত দলের প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। বোঝা যাচ্ছে এই নীরবতা আগামী দিনে যে কোনও সময় সর্বত্রই কেন্দ্রকে রাজ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়ার সাহস যোগাবে। আমার দেশ এমনিতেই অতিকেন্দ্রায়নের নামে স্বৈরতান্ত্রিক পথে হাঁটছে। এখনই আমরা দলমত নির্বিশেষে যদি এই প্রবণতার বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াই তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
ইতিহাসের কথা মনে যখন এলই তখন আর একটু পিছনে ফিরে যাই। জানি না সে ইতিহাস এখন কতটা প্রাসঙ্গিক হবে। তবু মনে করিয়ে দিই দেশভাগের চেনা ন্যারেটিভ যে দ্বিজাতিতত্ত্ব, আধুনিক গবেষণা ইদানিং বলছে তা আংশিক সত্য হতে পারে, তবে পুরো সত্যি নয়। লিগ ও কংগ্রেসের মধ্যে মূল দ্বন্দ্ব ছিল ভারত আগামী দিনে অর্থাৎ স্বাধীনতার পরে কোন রাষ্ট্রকাঠামো বেছে নেবে! যুক্তরাষ্ট্রীয় না অতিকেন্দ্রায়ন। মহম্মদ আলি জিন্না ছিলেন ফেডারেল ব্যবস্থার দিকে। আর নেহরু প্যাটেল ছিলেন অতিকেন্দ্রায়নের পক্ষে।
এখন প্যাটেল ভক্তরা যে গোটা সিস্টেমকেই অতিকেন্দ্রায়নের চাপে ভাঙতে চাইছে এটা বুঝতে কোনও বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। মোদি মমতা বাইনারিতে আপাতত যাচ্ছি না। মমতার প্রধানমন্ত্রীকে অসংসদীয় ভাষায় সম্বোধন করা (শালা) নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্বাভাবিক। কোনও সন্দেহ নেই এবারের নির্বাচন রাজনীতির যাবতীয় শিষ্টাচার ভদ্রতা সৌজন্য লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। মোদি মমতার রাজনৈতিক অভিসন্ধিও এক। দেশের গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থা এখনও যেটুকু যা অবশিষ্ট তা ভেঙে দেওয়া। মুনমুন সেন, নুসরৎ, মিমি, দেবকে প্রার্থী করার পিছনে সংসদীয় সিস্টেমকেই খেলো, হাল্কা, গুরুত্বহীন করে তোলার স্পষ্ট বার্তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তবু এরা কেউ মোদির সঙ্গে তুলনায় আসে না। কারণ একজনও দাগী অপরাধী নন, যা বিজেপির মধ্যে আমরা প্রচুর দেখতে পাব। মমতা অরাজনীতির রাজনীতি এ রাজ্যে আমদানি করেছেন। কিন্তু মোদি সাধ্বী প্রজ্ঞার মতো হিন্দু সন্ত্রাসী একজনকে প্রার্থী করে নিজের ঘোষিত হিন্দুরাষ্ট্রের পতাকা প্রকাশ্যে ওড়াতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন।
আপাত তুচ্ছ অথচ গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যেক স্লোগানকে আলাদা আলাদা করে বিশ্লেষণ করার পরে বামপন্থীরা রণকৌশল ঠিক করলে বোধহয় ভালো করতেন। রণকৌশল আর রণনীতি যে এক নয় তা বামেদের চেয়ে আর ভালো কারা বোঝে। কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস নিয়ে নিজেদের পুরনো শ্লোগান সর্বভারতীয় স্তরে ফিরিয়ে আনার সোনার সুযোগ হেলায় নষ্ট করল বামেরা। অথচ নির্বাচন কমিশন যে পক্ষপাতদুষ্ট তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতেই পারে না। অমিত শাহ রোড শো যেভাবে দাঙ্গার পরিসর নির্মাণ করেছিল তা কী করে কমিশনের চোখ এড়িয়ে গেল তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। প্রশ্ন থাকবে গান্ধীনগরে নিজের ভোট দিতে যাওয়ার দিন, মোদি যেভাবে আচরণবিধির তোয়াক্কা না করে বুথে যাওয়ার পথটুকুকে বিজেপির পক্ষে একটি মিনি রোড শো-য় রূপান্তরিত করেছিলেন, তা কমিশনের কাছে আপত্তিকর মনে হল না কেন? মমতার ভাষা নিয়ে কথা হচ্ছে। বিশেষ করে শালা শব্দটি নিয়ে। আমি নিশ্চিত এটা যদি কোনও পুরুষ বলতেন তাহলে এত জলঘোলা হত না। পাশাপাশি মোদি অমিত শাহ আসামের বিস্তীর্ণ এলাকায় যে ভাষায় দিনের পর দিন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করেছেন, যেভাবে প্রতিবেশী বাংলাদেশকে প্রমাণ ছাড়াই অপরাধের কাঠগড়ায় তুলেছেন তা সত্যিকারের নিরপেক্ষ কমিশন কাছে ছাড় পেত না।
এই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ হওয়ার ক্ষমতা নেই। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে একটি হালকা রসিকতা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তা হল— নির্বাচন কমিশন একটি আভ্যন্তরীণ ও উচ্চস্তরীয় মিটিং-এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা বিজেপি সরকারে সরাসরি যোগ দেবে না, বরং বাইরে থেকে সমর্থন করবে। রসিকতাটি বলাবাহুল্য রসিকতাই। কিন্তু এ কথা সত্য যে এই কমিশনের অনেকেরই নিজের নিজের স্বার্থে কেন্দ্রের কাছে টিকি-বাঁধা হয়ে আছে। কমিশনের একজন সদস্যের ভাই কাতারে ভারতের রাষ্ট্রদূত, যার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ আছে। এরকম আরও আছে, যাঁদের টিঁকে থাকার চাবিকাঠি নরেন্দ্র মোদির হাতে। এই অবস্থায় তাঁরা সৎ নির্ভীক নিরপেক্ষ হবেন এ ভাবনাটাই শিশুসুলভ। এ রাজ্যের এক সামান্য নাগরিক হয়ে পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করতে বাধ্য হচ্ছি।